সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৮

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৮
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

পুরূ চন্দ্রের আভায় আলোকিত রাত।
মাথার ওপর এক ঝাঁক তারাদের ঠান্ডা, প্রাণহীন দৃষ্টি এসে মিশে গেছে মাটিতে। বাঁশের লম্বা লম্বা পাতা ছুঁয়ে পাখা মেলেছে শীতকাল। জ্যোৎস্নার মোলায়েম আলোয় বড্ড মলিনতা।
নিগুঢ় অন্ধকারে মাখা রজনীর কোথাও কোনো কোলাহল নেই। ঘুমন্তপুরীর ন্যায় নিস্তব্ধ নীলাচল। চারপাশের তিনটে ঘরে কড়া লাইট নিভে গেছে অনেকটা সময়।
উঠোনের এক কোনে একটা বড়ো পিলার দাঁড়িয়ে আছে। ওর মোটা দেহে শখানেক বৈদ্যুতিক তার প্যাঁচানো। তার একটাতে ঝুলছে বড়োসড়ো হলদে বাল্ব । অনেকগুলো উইপোকা ঝাঁক বেঁধে ঘুরছে সেথায়।
বাতাবরণের কোল ঘেঁষে যখন সবকিছু নিশ্চুপ পড়ে রইল?

সিমেন্টের উঠোনে স্টিলের ক্রাচের ঠকঠক শব্দ পরিষ্কার ভেসে চলল বাতাসে। দুহাতের দুটো ক্রাচের গায়ে ভর দিয়ে দিয়ে হাঁটছে পুষ্পিতা। লম্বা স্কার্টের নিচ হতে বাম পা-টা দেখা গেলেও,ডান পা নিরুদ্দেশ ।
পুষ্পিতা একটু থমকায়,ফের হাঁটে। ঘামে জবজবে সারা মুখ। অসুস্থতার সঙ্গে,
শরীরী ক্লান্তিটাও রগে ছুটে বেড়ালে ঘরের দিকে রওনা করল তারপর।
এক চালার ঘরের সামনে তিনটে চ্যাপ্টা সিঁড়ি বাঁধানো।
পুষ্পিতা ভেতরে না ঢুকে সেখানে এসে থামল। ক্রাচ দুটো এক পাশে নামিয়ে রেখে বসল ধীরে। শীর্ণ বুকের ফ্যাসফ্যাসে শ্বাসটা কমাতে হাত উলটে ঘাম মুছল কপালের।
অদূরের কোথাও পেঁচার ডাক নিরন্তর বইছে। পাহাড়ের সাথে চারপাশের তমসায় কিছুটা ভুতুড়ে পরিবেশ। পুষ্পিতার তো মনে ভয় নেই। বিষণ্ণ নয়ন তুলে সুবিশাল আকাশ দেখছে সে।
কানের কাছে বাজছে কর্কশ সেসব কথা,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ আমার গায়ের চামড়া ছিলে নিলেও এতটা যন্ত্রনা পেতাম না,যতটা তোর ছলনায় পেলাম।”
পুষ্পিতা ঢোক গিলল। উবে দিতে চাইল বুকে জমা সমস্ত পীড়াদের। কিন্তু চাইলেই কী তা হয়?
পিলারের গায়ে
দূর্বলের ন্যায় পিঠ এলিয়ে দিলো সে। চোখ বুজতেই তরতর করে নোনাজলে ভিজে গেল গাল।
সুনসান নিশিতে ছুটে বেড়াল তার বোজা গলার সুর,
❝ আমি আবার ক্লান্ত পথচারী।
এই কাঁটার মুঁকুট লাগে ভারী।
গেছে জীবন দুদিকে দুজনারই।
মেনে নিলেও কি মেনে নিতে পারি?
ছুঁতে গিয়েও যেন হাতের নাগালে না পাই।
এভাবে হেরে যাই,যেই ঘুরে তাকাই।
কেমন যেন আলাদা আলাদা সব।
আলগা থেকে তাই,খসে পড়েছি প্রায়। কেমন যেন আলাদা আলাদা সব।❞
( মুহুর্তটা ভালো করে অনুভব করতে গানটা একবার ইউটিউবে গিয়ে শুনে নেবেন। )

পুষ্পিতা চোখ মেলল। তপ্ত জল মুছে নিলো হাত তুলে। পাঁজর ছিঁড়ে নেওয়া টান পড়ল সেই পরের কথায়,
“ লজ্জা করে না তোর? দিনের পর দিন আমার বুকে মাথা রেখে,
মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের কথা বলে, এখন অন্য পুরুষের সাথে সংসার করছিস!
মনের মধ্যে এত প্রবঞ্চনা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে?
তোর মতো মেয়ের কাছ থেকে এসবই আশা করা যায়। চ্যালেঞ্জ করলাম,
আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তোর থেকে হাজার গুণ সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করব আমি। আর তা যদি নাহয়, আমার নামও তীব্র রেজা তালুকদার না!”
পুষ্পিতা নীরস নয়নে স্বীয় বাম পা-টা দেখে নেয়। এরপর চোখ সরায় ডান পায়ের ওপর। হাঁটু থেকে যার কিচ্ছু নেই। স্কার্টের ফাঁকা ঐ অংশটুকু বড়ো নিশ্চিন্তে ধুলোয় লুটিয়ে আছে।
আঙুল নেই,পায়ের পাতা নেই। পুষ্পিতার গলার ভাঁজে কান্নার তুবড়ি ছিটকে এলো। দুহাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠল হঠাৎ।

একটা দূর্ঘটনা সব কিছু আজ কোথায় ভাসিয়ে নিয়েছে। সেই এক্সিডেন্ট! সেই এক্সিডেন্ট পুষ্পিতার জীবন থেকে শুধু তীব্রকে নিয়ে যায়নি।
সারাজীবনের মতো ওকে পঙ্গু করে,ওর সুস্থভাবে হাঁটার ক্ষমতা নিয়ে গেছে।
সাথে নিয়েছে তার সমস্ত স্বপ্ন। তীব্রর বউ হওয়ার ইচ্ছেদের। গলা টিপে মেরে ফেলেছে তার জীবনের ঐ ক্ষনস্থায়ী সুখপাখিকে।
সেই বিভৎস অতীত আরেকবার মেয়েটার চোখের পর্দায় ভেসে উঠল।
পুষ্পিতার যখন জ্ঞান ফিরল,

সারা গায়ে ব্যথা। শরীরের অর্ধেকটা প্রায় সফেদ ব্যান্ডেজের আড়ালে। শূন্য কেবিনটাকে ঝাপ্সা চোখে কিছু পল দেখল সে। পায়ের কাছে কেমন চিনচিনে ভাব। মনে হচ্ছে হাঁটু থেকে পুরোটা অবশ। কিছু যেন পাথরের মতো ভারি। পুষ্পিতা উঠে বসল কোনওমতে।
ব্যথাটা ঠিক কোন পায়ে? ও কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে প্রথমে বাম পা ছুঁলো। এরপর আঙুলগুলো যখন ডান পায়ে এলো,সেখানে কিছু নেই। পুষ্পিতা উদ্বীগ্ন হয়ে পড়ে।
উদ্ভ্রান্তের মতো আরো ভালো করে হাতায়। খেই হারিয়ে যখন ওপর থেকে চাদরটা সরাল,হাঁটুতে প্যাঁচানো বিশালাকার ব্যান্ডেজ দেখেই বুঝে ফেলল যা বোঝার। পুষ্পিতার শ্বাস থমকে গেল।

“ মাআআআ ”
বলে আর্তচিৎকারে ভারি হলো সারাঘর। পুরোনো সেই দৃশ্য মনে করে
পুষ্পিতার কান্না বেড়ে যায়। হুহু শব্দটা হাউমাউয়ে রূপ নেয় ক্রমে।
ফোঁপানোর তোড়টা খুব কষ্টে আটকে বলল,
“ আপনি কখনো বুঝতেও পারবেন না তীব্র,
আপনাকে পাওয়ার কতটা তীব্র ইচ্ছে নিয়েই,আপনার থেকে দূরে সরে এলাম।”
হঠাৎ কাঁধের ওপর একটা নরম হাত পড়ল। মাথা তুলে চাইল মেয়েটা।
টলটলে চোখে পাশে বসলেন সালমা। অমনি বুকের মধ্যে ঝাঁপ দিলো ও ।
কেঁদে কেঁদে বলল,

“ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মণি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!”
সালমা ওকে শক্ত করে চেপে রাখলেন বুকে। কাঁদছেন তিনিও। পিঠে,মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ শক্ত হ মা। শক্ত হ।
তীব্রর কথা মনে পড়ছে, তাই না?”
পুষ্পিতা সরে এলো। চোখ মুছে বলল,
“ না।”
“ মিথ্যে বলছিস কেন? আমি সব বুঝি।”
“ মিথ্যে বলছি না মণি। একটুও মিথ্যে বলছি না।”
কিন্তু কথার সাথে যে চোখমুখ মেলেনি। পুষ্পিতার হরিণী নয়ন নৈকট্যের পথে মিশেছে। চাউনীতেই তারা মনের কথা বলল,

“ যে সব সময় আমার সাথেই থাকে, তাকে আলাদা করে মনে পড়বে কেন? উনি তো রোজ আমার কাছে আসেন। আমায় ছুঁয়ে যান। কখনও সন্ধ্যা হাওয়ার সুদর্শন, দুপুরের চকচকে রোদ। কখনও রাতের জ্যোৎস্না হয়ে। আর যেদিন চাঁদ না থাকে? সেদিনও আসেন। অন্ধকারের মাঝে উড়ে বেড়ানো হিমেল হাওয়ার মতো। যার সাথে আমার নিঃশ্বাসের লেনদেন হয়,তাকে আমি ভুলতে পারি মণি?”
মেয়েটার মুখ দেখেই সালমার বুক পুড়ে গেল। অনুতাপে হাহাকার করে বললেন,
“ আমার জন্যে আজ ও তোকে এত খারাপ খারাপ কথা শুনিয়ে গেল। সব কিছুর জন্যে আমি দ্বায়ী। সব আমার জন্যে হয়েছে।”
ক্রন্দিত প্রৌঢ়ার হাতদুটো মুঠোয় ধরল পুষ্পিতা। কণ্ঠে উৎদ্বেগ

“ এমন করে কেন বোলছো? এখানে তোমার কী দোষ? এসব তো তোমরা আমার কথায় করেছিলে মণি! তোমরা তো মিথ্যে বলতে চাওনি। আমিইতো জোর করেছিলাম তোমাদের।”
পুষ্পিতা ফের ডান পা-টা দেখল। হাত দিয়ে উরুতে দুটো আঘাত করে বলল,
“ আমি যে এই পঙ্গু জীবনটা নিয়ে ওনার ওপর বোঝা হতে চাইনি।”
নাক টেনে চোখের পানি সামলাল পুষ্পিতা। ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে বলল,
“ সেজন্যেই তো তোমাদের বলেছিলাম,ওনাকে জানাতে
আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
চিঠি আর ছবি দেখার পর আমাকে ঠিকই ঘৃনা করতেন উনি। তখন নতুন করে জীবন সাজাতে ওনার আর কোনো পিছুটানই থাকতো না।”

“ কিন্তু তা কী ও পেরেছে? ওর চোখমুখের অবস্থা দেখিসনি? যে ছেলে একদিন তোর জন্যে মাস্তান থেকে ভালো হয়ে গিয়েছিল,সে তোকে এত সহজে ভুলে যাবে,এমনটা কখনো হয়! দেখলি তো, ঠিক তোকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসেছে! তীব্র ভালো নেই পুষ্পিতা! ওর অবস্থা দেখে আমি বুঝতে পেরেছি ও তোকে ছাড়া সত্যিই ভালো নেই। তুইও তো ভালো নেই। আর আমি কী করছি? সব জেনে শুনেও দুটো মানুষের কষ্ট শুধু বসে বসে দেখছি। ছিহ,
ছি!ছি!”

“ তুমি কাঁদছো কেন মণি? আমার তো ভাগ্যটাই এমন। কপালে কোনো সুখ বেশিদিন থাকে না। যা একটু বাঁচার আশা দেখেছিলাম, তাও চলে গেল। অবশ্য,
এটা আমি অনেক আগে থেকেই মেনে নিয়েছি মণি। এবার তুমিও মেনে নাও তো।”
পুষ্পিতা বড়ো করে শ্বাস নিলো। ফের বলল,
“ তবে কী জানো?
উনি এখানে এসে একদিকে ভালোই হয়েছে। এখন আমাকে আরো বেশি বেশি করে ঘৃণা করতে পারবেন। উনি ভেবেছেন ওই নিসঙ্গ ঘরটা আমার সংসার।
শাহেদ স্যার আমার বর।

তুমি শোনোনি উনি কী বলে গেলেন? সাতদিনের মাথায় এক সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করবেন। আমি জানি, ওনার মতো মানুষ নিশ্চিত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেয়েটাকেই বউ হিসেবে পাবে। তাই না মণি? যে ঠিক এই ঠকবাজ পুষ্পিতার কথা ভুলিয়ে দেবে ওনাকে। উনি খুব সুখী হবেন,মণি। দেখো তুমি,খুব সুখী হবেন।”
সালমা বেগমের কান্নার তোড় বাড়ল। কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললেন,
“ তুই কী দিয়ে তৈরি রে, মা? যাকে এত ভালোবাসিস তার পাশে অন্য কাউকে ভাবতে তোর কষ্ট হচ্ছে না?
তুই নিজে কি এখনো ওকে ভুলতে পেরেছিস! বালিশের তলায় তীব্রর ছবি নিয়ে ঘুমাস। দিনরাত এক করে কাঁদিস। আমি এখানে থাকি না বলে কি কিছু বুঝি না? কিছু জানি না?

এই যে ঠিক করে খাস না,ঘুমাস না। কারো সাথে হাসিমুখে দুটো কথা বলিস না! কার শোকে? কার দুঃখে? তীব্রকে ছাড়া তুই বাঁচতে পারবি পুষ্পিতা? এমন মরার মত বেঁচে থাকাকে কী আদৌ বেঁচে থাকা বলে?”
কান্না আর বিরহের দলায় পুষ্পিতার কণ্ঠনালী রোধ। ভীষণ টেনেহিঁচড়ে হাসল তাও। বলল,
“ তুমি এভাবে কেন ভাবছো বলো তো? উনি ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকব।
তাছাড়া ,
পেতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। জীবনের কিছু কিছু জিনিস বহুদূর থেকে সুন্দর হয়! তীব্রও না হয় তেমনই থাকুক!’ ঠিক ঐ আকাশের তারার মতো। যাদের আমি রোজ মন ভরে দেখব,কিন্তু চাইলেও ছুঁতে পারব না।”
সালমা আঁচলে মুখ চেপে ধরলেন। চোখের জলে তার চটচটে চেহারা স্যাতস্যাতে প্রায়। এই মেয়েটার কপালে আল্লাহ কি একটুখানি সুখও লিখে রাখেননি? ছোট থেকে অনাদর,অবহেলা, খাবার খোঁটা,থাকার খোঁটা শুনে শুনে বড়ো হলো। একটা ভালো-দামি জামা,একটু আলদা ভালো কিচ্ছু দিতে পারেননি তিনি। প্রচণ্ড শীতেও বিছানা রেখে মাটিতে শুতে হয়েছে।

সেই মেয়ে তীব্রকে নিয়ে একটু ভালো থাকার স্বপ্ন দেখল যখন,সৃষ্টিকর্তা এমন করলেন কেন?
কী চান উনি? সালমা আকাশপথে চাইলেন। দৃষ্টিদ্বয়ে হাজার প্রশ্ন,হাজার অভিযোগ।
তারপর সব কিছু শান্ত। হুতুমের ডাকাডাকি কখন থেমে গেছে। ওরাও বুঝি পুষ্পিতার অন্তরের সুপ্ত আর্তনাদ শুনতে পেলো! ঘুমন্ত মানুষগুলোর ভারি শ্বাসঃপ্রস্বাস ছাড়া, নৈসর্গে আর ভিন্ন আওয়াজ নেই।
দুই রমণীর খোলা আসমান মাথায় নিয়ে অশ্রুজল বিসর্জনের মুহুর্তে, ছুটে এলো এক জোড়া মসমসে জুতোর শব্দ।
দেয়ালের আড়াল হতে যা সদর্পে হেঁটে এসে দাঁড়াল এপাশে।
উঠোনের মোহময় আলোয় লম্বাটে কালো ছায়ামূর্তিটা এসে থামল,ঠিক পুষ্পিতার পায়ের কাছে।
ভেজা চোখদুটো সেথায় পড়তেই,তড়িৎ চোখ ওঠালেন সালমা।
কান্না থামল সহসা। ঠোঁটফুঁড়ে বেরিয়ে এলো,

“ তুমি!”
পুষ্পিতা মাথা তুলল কৌতূহলে। এক পল সালমাকে দেখে সামনে চাইতেই,চমকে উঠল পিলে। সুঠামদেহী, চেনা সেই পুরুষ একদম মুখোমুখি তার। এইতো, মাত্র হাত কয়েক দূরে। পুষ্পিতার বিস্ফোরিত চোখ বেরিয়ে আসে। দুপুরের মতোই শরীর জমে যায়।
কিয়ৎক্ষণ স্তম্ভিত চেয়ে থেকে,কম্পিত হাত বাড়িয়ে ক্রাচ দুটো ধরল সে। টালমাটাল দেহে, দুহাতের ভর রেখে উঠে দাঁড়াল কোনোরকম।
তীব্র এগিয়ে এলো। এক পা,দু পা। দুরুত্ব যত কমে, হৃদপিণ্ডের বিকলভাব তত বৃহৎ হয় পুষ্পিতার। বক্ষপিঞ্জরের ফাঁকে ফাঁকে দম ফেলার ফুরসত আটকে যায়।
পিঠের হাড়ে কলকলে হিম ধারার মাঝে,তীব্র খুব কাছে এসে দাঁড়াল। তপ্ত শ্বাস বাড়ি খেল পুষ্পিতার কপালের শক্ত শৈলের ওপর।

সালমা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। হতবাক তিনিও। তীব্র যে দুপুরে ওনার সামনে থেকেই বেরিয়ে গেল। এখন আবার কী করে এলো তাহলে?
তীব্রর চাউনীতে শিথিলতা নেই। চিবুকে শক্ত পাহাড়। পুষ্পিতা যখন নিস্তব্ধতার দোলাচলে হাঁ করে চেয়ে, আচমকা ঠাস করে একটা চর মারল সে।
সালমা ভড়কে গেলেন। হাত দিয়ে মুখ চেপে পিছিয়ে গেলেন এক পা।
পুষ্পিতা হকচকালেও, রা নেই। উলটে আনত মাথায় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। যেন বহুদিনের গুমোট মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নামল কেবল। ত্রস্ত তার দুই বাহু চেপে ধরল তীব্র।
ক্ষুদ্র শরীরটা ঝাঁকিয়ে বলল,

“ নিজের মনে হলো আর দূরে চলে গেলি? একবারও আমার কথা ভাবলি না? আমার জীবন নিয়ে খেলার সাহস তোকে কে দিয়েছে?”
থামল সে। জোরালো দম টেনে বলল,
“ দুপুরে আমি যখন নিজের দেয়া আংটি তোর আঙুলে দেখেছিলাম, যখন একবারও আমাকে দেখে তুই দাঁড়ালি না তখনই আমার খটকা লেগেছিল। আর সেটাকে যাচাই করতেই আমি রয়ে গেছিলাম এখানে। তুই এভাবে আমায় ঠকালি পুষ্পিতা? এইভাবে ঠকালি!
শেষ দিকে কণ্ঠস্বর ধরে এলো ওর।
পুষ্পিতা আস্তে করে হাত দুটো সরিয়ে দেয়। পেছন ঘুরে বলে,
“ আপনি আবার কেন এলেন স্যার? একজন পঙ্গু মানুষের কাছে কেন এলেন?”
ত্রস্ত ওকে টেনে নিজের দিকে ফেরাল তীব্র।
“ ওই এক্সিডেন্টে যদি আমার এই অবস্থা হোতো,তাহলে তুই কী করতি?
এভাবেই আমাকে ফেলে চলে আসতি?”

সহসা ওর মুখ চেপে ধরল পুষ্পিতা । চোখে জলের বন্যা নিয়ে বলল,
“ এমন কথা বলবেন না। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত যে আপনার কিছু হয়নি!”
তীব্র ওই কোমল হাত ঠোঁট হতে নামিয়ে আনল। শক্ত বাঁধনে ধরে রাখল মুঠোয়। নিরেট স্বর নরম করে বলল,
“ তাহলে তুমি কী করে ভাবলে ভীতু মেয়ে,এই সামান্য কারণে আমি তোমাকে ছেড়ে যাব?”
সালমার চোখ জলে ভরে যায়। বিমূঢ়তার ফাঁক গলে উঁকি দেয় অনেকখানি আশা। মনে হলো,পুষ্পিতার কপালের সমস্ত দূর্ভোগ মিটে যাব আজ।
যাক, শুধু একবার মেয়েটা সুখের দোরে পা রাখুক। তাহলে আর কিচ্ছু চাইবেন না সালমা। নিজের জন্যেও না।
প্রৌঢ়া চোখ মুছলেন। দাঁড়ালেন না আর। সময়টা ওদের লিখে দিতে দ্রুত ঢুকে গেলেন ঘরে।
এত বছর পর আবার সেই পুরোনো ডাক! পুষ্পিতার খরায় ভরা অন্তঃপটে ঝড় তুলে দেয়। আনন্দে বা ক্লেশে, মেয়েটা ফের ফুঁপিয়ে উঠল।

তার হাতে ধরা ক্রাচদুটোকে তীব্রর অসহ্য লাগে। ঝট করে টেনে নিয়ে ছুড়ে ফেলল দূরে। পুষ্পিতা এক পায়ের টাল রাখতে পারে না। ঢলে পড়তে নিলেই,তীব্র আগলে নিলো দুহাতে । পাখির ডানার ন্যায় ক্ষুদ্র শরীরটা শক্ত করে চেপে ধরল বুকে। জমাট কণ্ঠ বুজে গেল কথা বলতে গিয়ে,
“ আ’ম সরি! আ’ম সরি ভীতু মেয়ে! না জেনে তোমাকে কী না কী বলেছি। আ’ম সরি!’’
তারপর একটু সময় কাটে।
তীব্র মুক্ত শ্বাস টানল। পুষ্পিতা মাথা রাখতেই এতকাল খাঁ খাঁ করা বুকটায় কী অপার শান্তি নেমেছে।
কথার পিঠে পুষ্পিতার উত্তর এলো না। মনের আঁশ মিটিয়ে মেয়েটা হাউমাউ করে কাঁদছে। তীব্রর পিঠের শার্ট খামচে ধরে, গলা ভেজাচ্ছে জলে।
তীব্রর বিলাতি নয়ন টলমলে। বুক থেকে পুষ্পিতার মুখ তুলে, চোখ মুছে দিলো। বলল,

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৭

“ এত বছর ধরে নিজেও কষ্ট পেয়েছো, আমাকেও কষ্ট দিয়েছ!”
অনেক ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিয়েছ আমার। এই শেষ।”
তারপর চট করে ওকে কোলে তুলল সে।
প্রতাপি স্বরে দৃঢ়তা নিয়ে বলল,
“ তুমি আমার এই অন্ধকার জীবনের আলো, ভীতু মেয়ে! আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ তুমি। তোমাকে আমি শেষ নিঃশ্বাস অবধি ছাড়ব না। তুমি ছাড়া পেতে চাইলেও না!”

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৯