সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৯
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
নূহা শাড়ি পরেছে। লাল রঙের পাতলা জামদানি শাড়ি। সোনালী সুতার ফাঁক গলে মেয়েটার মসৃন পেট দেখা যায়।
নূহার আরক্ত কপোল লজ্জায় একশেষ এ নিয়ে। শাড়িটা আজকে নাহিদ এনে দিয়েছে। নূহা এমনিতে শাড়ি পরে না। পছন্দও না। পরলেই, পায়ে বেঁধে উলটে পরার ভয় থাকে। অথচ সেই নাহিদের সব ধ্যান-জ্ঞান শাড়িতেই আটকে।
ওদের বিয়ের আজ দুদিন। কথা ছিল শুধু কাবিন হয়ে থাকবে,তারপর বর-বউ যে যার মতো। অথচ দুদিনেই সব ঘটনা উলটে গেল কেমন! যেমন পালটে গেছে দুই পরিবারের সিদ্ধান্ত। বর-বউ এমন পাশাপাশি বাসায় আলাদা রাখতে তারা সকলেই নারাজ।
সেজন্যে আজ প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে এক ঘরে রাখা হচ্ছে ওদের।
নূহারা গতকালই নতুন বাসায় উঠেছে। পুষ্পিতার ফ্ল্যাটে তালা ঝুলছে আপাতত। সময় সুযোগ বুঝে চাবি মালিকের কাছে হস্তান্তর করা বাকি।
তবে এবারের বাসা পাল্টাতে বিশেষ ভোগান্তি হয়নি। একই বিল্ডিংয়ের পাঁচতলা খালি থাকায় তত্র শিফট হয়েছে ওরা। নাহিদ চার তলায় থাকে। এখন কেবল দুজনের ওই এক তলার দুরুত্বটাও এক বিছানায় ঘুচে যাওয়ার অপেক্ষা!
নাহিদের বাবা-মা এসেছেন। সাথে বড়ো ভাই,ভাবি সবাই আছে। নূহা এখান থেকেই গল্প-আড্ডার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। আজ মাও ভীষণ ব্যস্ত ! নতুন জামাই,নতুন কুটুম বাড়ি নিয়ে তার আহ্লাদের কোনো কমতি নেই। শাড়িটা নূহা একা একাই পরল। সাজলও মন ভরে।
কিন্তু যার জন্যে এত কিছু, সে কোথায়?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কে একটা ফোন করল তখন,আর অমনি ব্যস্ত ভাব করে বেরিয়ে গেছে। বলেও যায়নি কিছু।
এদিকে যে উত্তেজনায় নূহার বুকটাও দুরুদুরু করছে। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে ওরা এক ঘরে শোবে। এক খাটে,এত কাছাকাছি।
মেয়েটা যতবার সেসব ভাবতে যায়,ছোট্টো প্রান এসে গলায় ঝুলে থাকে। নূহা আয়নায় দেখল নিজেকে। ঘুরেফিরে চোখ আটকাল সেই পেটের ওপর।
কী করবে এখন?
এমন পেট বের করে ও নাহিদের সামনে দাঁড়াবে কী করে?
মেয়েটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগল। একটা কোনো বুদ্ধি আসছে না মাথায়। মাকেও তো ভেঙেচুরে বলতে পারবে না কিছু । ইস,আজ যদি পুষ্পিতাটা থাকতো এখানে!
ঠিক একটা বুদ্ধি দিতে পারতো! এসব সাংসারিক বিষয়ে তো ওর পাণ্ডিত্যের শেষ নেই।
নূহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পুষ্পিতার কথা ভাবলে এটুকু ছাড়া আর ভালো কিছু আসে না। ফের আয়নায় চোখ দিতেই,খট করে শব্দ হলো দরজায়। ত্রস্ত
পিছু ফিরল সে।
নাহিদ ঢুকেছে। গতিবেগ অধীর,অশান্ত।
দরজার সিটকিনি তুলতেই চোখ কপালে তুলল নূহা। তড়িঘড়ি করে পাতলা আঁচলটা টেনে প্যাঁচাল গায়ে। কণ্ঠ চেপে বলল,
“ দরজা আটকালে কেন? সবাই দেখলে কী ভাববে?”
নাহিদ ঠান্ডা চোখে চাইল। নূহার লজ্জার সাথে তার হাবভাবের এক বিস্তর তফাত। নরম ছেলেটা মুখ খুলল বেশ থমথমে গলায়,
“ বিট্টু, পুষ্পিতাকে খুঁজে পেয়েছে নূহা।”
নূহার নিভু চোখ চমকায়। বিস্ময়ে থমকায় এক চোট। মুখ ফুটে অস্পষ্ট বেরিয়ে আসে,
“ কী?”
নাহিদের পরের প্রশ্ন ছুটে এলো সহসা,
“ পুষ্পিতার ব্যাপারে তুমি সব জানতে,তাই না?”
নূহা এই প্রশ্ন আশা করেনি। প্রসঙ্গটাও না। তীব্র, পুষ্পিতাকে খুঁজে পাবে এও যে ধারণার বাইরে। এতক্ষণের লালচে কপোল তার তমসার তোড়ে খুঁজে পাওয়া গেল না। বক্ষঃস্থলে হাতুড়ির দ্রিমদ্রিম শব্দ নিয়ে বলল,
“ জানতাম মানে?”
নাহিদের অভিব্যক্তি শক্ত। তেমনই শক্ত তার কণ্ঠের গতি,
“ পুষ্পিতার সাথে তোমার সত্যিই যোগাযোগ আছে? না কি নেই?”
নূহা চটজলদি উত্তর দিতে পারল না। পুরন্ত ঠোঁট দুটো তিরতির করে উঠল।
ঝট করে মাথা নোয়াল মেয়েটা। মেঝেতে চেয়ে বলল,
“ ননেই। ককতবারই তো বললাম। বারবার এক কথা জানতে চাও ককেন?”
নাহিদ চড়া কণ্ঠে বলল,
“ উত্তরটা আমার দিকে তাকিয়ে দাও।”
নূহা ঢোক গিলল। চোখ তোলার সাহস তার নেই। অধৈর্য নাহিদ দুপা গিয়েই হাতটা চেপে ধরল ওর।
নূহা তাকাল। চোখ গিয়ে পড়ল ঠিক স্বামীর নয়নতারায়। নাহিদ বলল,
“ এবার বলো,নূহা। পুষ্পিতা কোথায় ছিল তুমি জানতে না?”
নির্মল মানুষের চোখ দেখে মিথ্যে উগড়ে দেয়ার সাহস নূহার নেই। নাহিদের দৃঢ়তায় সবটা ভেঙে গেল আরো। থেমে থেমে বলল,
“ জানজানতাম।”
তুরন্ত,হাতটা ছেড়ে দিলো নাহিদ। প্রকোপে এক পা পিছিয়ে গেল তরুণী। সে হতবাক আওড়াল,
“ সব জানতে? তাও লুকিয়ে রেখেছিলে নূহা? পুষ্পিতা কোথায় আছে,ওর সাথে কী হয়েছে সেসব জানা সত্ত্বেও এভাবে মিথ্যে বলে গিয়েছ তুমি?
এত পাথর তুমি,নূহা! এতটা?
আর আমার বন্ধুটা? আমার বন্ধুটা যখন তোমার চোখের সামনে কাতরাল,কাঁদল,হাহাকার করল তোমার মন গলেনি? কী করে পারলে বলো? এত স্বার্থপর হতে কী করে পারলে নূহা? এই নূহাকে তো আমি ভালোবাসিনি। এই নূহাকে তো আমি চিনি না। তুমি কি সত্যিই আমার নূহা?”
নাহিদের কথা,চোখেমুখের ওই অবিশ্বাস সব মিলিয়ে নূহার পায়ের জমিন থরথর করে উঠল। অসহায়ত্বের যাতাকলে ঝাপসা হলো সব কিছু।
আচমকা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মেয়েটা! শীর্ণ দেহ ভেঙে ধপ করে বসে পড়ল নিচে।
“ বিশ্বাস করো, বিশ্বাস করো নাহিদ আমি এমন করতে চাইনি। একদম চাইনি। বাধ্য হয়েছি আমি। পুষ্পিতার কান্না,ওর কথা, ওর অনুরোধে বাধ্য হয়েছিলাম সত্যিটা লুকাতে।
কিন্তু, যতবার তীব্র ভাইয়াকে দেখেছি না? ততবার ইচ্ছে করত ছুটে গিয়ে ওনাকে সবটা বলে দেই। জানিয়ে দেই যে পুষ্পিতার বিয়ে হয়নি। ও ভালো নেই আপনাকে ছাড়া।
তোমরা যখন ওকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলতে? অভিশাপ দিতে?
সেসব আমার গায়ে কাঁটার মতো ফুটত নাহিদ। সব জেনেশুনেও দাঁত চেপে সহ্য করে যেতাম। কিন্তু, তাও আমি কিচ্ছু করতে পারিনি! কিচ্ছু না।”
নাহিদ চুপ করে থাকল কিছু পল। নূহার কান্না বাড়ছে। মেয়েটাকে এমন বৃষ্টির ন্যায় কাঁদতে ও কখনো দেখেনি। তার নূহা তো শক্ত মেয়ে! যে অন্যের কান্না থামাতে জানে। অন্যকে শক্ত হয়ে দাঁড় করাতে জানে।
নাহিদ শ্বাস ফেলল। দুবাহু ধরে তুলল ওকে। এনে বিছানায় বসিয়ে বলল,
“ কেঁদো না প্লিজ!’’
নূহার কান্নাকাটি থামল না। শব্দটা কমলেও চোখের জলে একইরকম সুনামি। স্বামীর প্রশ্রয়ে হেচকির তোড়টা বাড়ল আরো।
কেঁদে কেঁদে বলল,
“ সেদিন, সেদিন তোমরা যখন তীব্র ভাইয়ার সাথে ঢাকায় চলে গেলে?
তখন পুষ্পিতা টঙ্গীর একটা হাসপাতালে ছিল। সালমা আন্টির সাথে আমরা সবাই গেলাম। মেয়েটার অবস্থা তখন খুব খারাপ! সারা গায়ে রক্ত! ফরসা মুখটা পুরো ঢেকে গেছে তাতে। জানতে পারি,জিপ উলটে যাওয়ায় পুষ্পিতা ভেতরে চাপা পরে যায়। আর তাতেই এই দশা। ওখানে ভালো কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তার ছিলেন না। সেজন্যে ওকে নিয়ে আমরা মূল শহরে চলে আসি।
আমি তোমাকে কয়েকবার ফোনও করেছিলাম,তুমি ধরোনি। সবাই তীব্র ভাইয়াকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলে।
অলরেডি দুটো দিন ছুটি কাটানোয়,আম্মুও থাকতে পারলেন না। আমাকে রেখে ফিরে আসেন এখানে। শুধু আমি,আর সালমা আন্টি হাসপাতালে ছিলাম। খোরশেদ আঙ্কেলও এসেছিলেন। সেসময় তো ওনার হাত ভাঙা ছিল। তাও মানুষটা একা একা হাসপাতালের সব ছোটাছুটি করলেন । পুষ্পিতার রক্তাক্ত মুখ দেখে রাহাত ভয়ে এত কাঁপছিল, খোরশেদ আঙ্কেল মিথিলাকে দিয়ে ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। তারপর অপারেশন শুরু হলো। মাঝপথে হঠাৎ ডাক্তার এসে জানালেন,ওর একটা পা…”
বলতে বলতে হুহু করে কেঁদে উঠল নূহা। নাহিদ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সময় দেয় ওকে সামলে ওঠার। জিজ্ঞেস করে সাগ্রহে,
“ তারপর?”
নূহা নাক টানল। বলল,
“ তারপর, পুষ্পিতার জ্ঞান ফিরল একদিন বাদে। জানো,ও যখন দেখল ওর একটা পা নেই? ওর সেই সময়ের কান্না,চিৎকার গুলো এখনো আমার কানে স্পষ্ট বাজে নাহিদ।”
একটু থেমে বলল,
“ পুষ্পিতা সিদ্ধান্ত নিলো,এই পঙ্গুত্ব নিয়ে ও তীব্র ভাইয়ার বোঝা বাড়াবে না। আসলে,ছোটো বেলা থেকে খোরশেদ আঙ্কেলের মুখে বোঝা, বোঝা শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছিল তো,তাই হয়ত ব্যাপারটা নিয়ে মনের মধ্যে অনেক বেশি দাগ পড়ে গেছে।
ঢাকায় থাকলে তো ভাইয়া খুঁজে পেতেন,তাই ও ঠিক করল শহরই ছেড়ে দেবে।
সালমা আন্টির একদম স্কুল জীবনের এক বান্ধুবি ছিলেন ফারজানা ইসলাম। উনি বান্দরবানে থাকেন। পুষ্পিতাকে হাসপাতাল থেকে সরাসরি সেখানে পাঠানোর সমস্ত ব্যবস্থা খোরশেদ আঙ্কেল নিজে করে দিলেন।
পুষ্পিতা জানতো,আমি তীব্র ভাইয়াকে পছন্দ করি। উনি প্রেসার দিলে হয়ত মুখ ফস্কে সব বলে দেব। তাই বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে হাত-পা বেঁধে রাখল আমার।
কিন্তু ভাইয়া যে ওকে সুস্থ হয়ে খুঁজতেন,এটা তো জানা কথা। হয়ত মুখে কিছু বানিয়ে বললে, মেনেও নিতেন না।
তাই, পুষ্পিতা যাওয়ার আগে আমাকে ঐ চিঠিটা লিখে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছবিটা নকল ছিল। ওটা মিথিলা আপুর বিয়ের ছবি। সেখানে শুধু পুষ্পিতার মুখ বসানো। এইসব ও করিয়েছিল, শুধুমাত্র যাতে
ভাইয়া ভুল বোঝেন। ওকে ঘৃনা করে,ওর ওপর রাগ থেকে হলেও নতুন করে জীবনটা গুছিয়ে নেন।”
নাহিদ বলল,
“ বিট্টু যখন অসুস্থ ছিল,পুষ্পিতা খোঁজ নেয়নি?”
মেয়েটা জবাব দিলো উদ্বেগ নিয়ে ,
“ হ্যাঁ, নিয়েছিল তো। আমাকে প্রতিদিন,প্রতি বেলা ফোন করতো। মরিয়া হয়ে বলতো,একটু তোমার থেকে খবর এনে দিতে।
তখন তো ভাইয়া সিঙ্গাপুর ছিলেন,তোমরাও ভালো করে কিছু জানতে না। তারপর যখন ভাইয়া সুস্থ হয়ে এখানে এলেন? সেই খবরটা শোনার সাথে সাথে পুষ্পিতা ওর সিম পালটে ফেলল। এমনকি সালমা আন্টিও তাই করলেন।”
“ তাহলে আমাদের বিয়েতে এলেন কী করে?”
নূহা চোখ মুছল। ফোস করে শ্বাস ফেলে বলল,
“ রাহাতের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিলাম। হয়ত আল্লাহ চাইছিলেন এমন হোক। হঠাৎ একদিন ফেসবুকে ওর একাউন্ট আমার সামনে আসে। আমিই ওকে ম্যাসেজ পাঠাই। যাতে সালমা আন্টি বিয়েতে আসেন,সেজন্যে ফ্ল্যাট ছেড়ে দেয়ার কথাও বলি। সালমা আন্টি সত্যিই এলেন। তবে এর মাঝে একটা কথা আছে, পুষ্পিতার সাথে আমার যোগাযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। হতো মাঝেমধ্যে। ভিন্ন ভিন্ন বুথ থেকে হুটহাট কল করতো ও! আমি কেমন আছি,মা কেমন আছে! ব্যস, তারপর লাইন ডিসকানেক্ট। ভাইয়ার কথা বলত না,হয়ত ভেবেছিল শুনলে দূর্বল হয়ে পড়বে।
পুষ্পিতা কখনো ওর ঠিকানা বলেনি। জানতাম ও বান্দরবান থাকে,কিন্তু অত বড়ো শহরের কোথায় খুঁজব আমি? আমার মতো একজন নগণ্য মানুষের পক্ষে কাউকে অজ্ঞাত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে খুঁজে নেয়া কি আদৌ সম্ভব? কাউকে যে কিছু বলব,সাহায্য চাইব এ ব্যাপারে তাও পারতাম না। কাকে বলব? তোমাকে বা মাকে? তাহলে যে পুষ্পিতাকে দেয়া কথার খেলাপ করা হবে। ঐ মুহুর্তটায় আমার নিজেকে এত অসহায় লাগত নাহিদ!
আমি
হয়ত সত্যিটা জানতাম,কিন্তু আমার কী করার ছিল বলো? তুমি যেমন তোমার বন্ধুকে ভালোবাসো? আমি আমার বন্ধুকে আরো বেশি ভালোবাসি।
আমরা সেই ছোট বেলা থেকে একসাথে বড়ো হয়েছি। আমি পুষ্পিতার সব সুখ-দুঃখের সাথী ছিলাম,নাহিদ। সেই মেয়েটা যদি কেঁদে কেঁদে আমার হাত ধরে কিছু চায়, আমি ফেলতে পারব? তুমি হলে পারতে?”
নূহা আরেকবার কান্নায় ভেঙে পড়ল।
নাহিদ নিরুত্তর। যুতসই জবাব তার কাছে নেই। শুধু নূহার চ্যাটচ্যাটে গাল মুছিয়ে ঠোঁট বাড়িয়ে চুমু আঁকল কপালে। মাথাটা বুকে নিয়ে বলল,
“ ওরা এক হয়ে গেছে, নূহা! ওদের সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেছে। ওদের মাঝে আর কোনো দুরুত্ব নেই।”
শশব্যস্ত মাথা তুলল সে। স্তম্ভিত আওড়াল,
“ সত্যি?
কিন্তু, ভাইয়া ওকে কী করে খুঁজে পেলো?”
“ সালমা আন্টির ফোন থেকে পুষ্পিতার ফোন নম্বর নিয়েছিল। সেটার লোকেশন ট্র্যাক করিয়ে!”
মেয়েটা চোখ কপালে তুলে বলল,
“ হ্যাঁ?”
মাথা নাড়ল নাহিদ। নূহা
মুক্ত শ্বাস নিলো । চোখের ভাঁজে এক ফালি আশা নিয়ে বলল,
“ পুষ্পিতার সব কষ্ট, সব দুঃখ তাহলে শেষ হচ্ছে?”
বড়ো লিভিংরুমটা জুড়ে পায়চারি করছেন জামশেদ। দুই হাত পিঠে বেঁধে এদিক ওদিক হাঁটছেন। মুখবিবর চিন্তায় ডুবেছে। লুৎফা ঠিক পাশের সোফায় বসে। দুশ্চিন্তায় একশা তিনিও।
তকতকে কাচের সেন্টার টেবিলে কতগুলো মেয়ের ছবি রাখা। এগুলো লুৎফা গতকাল প্রিন্ট করিয়ে এনেছিলেন তীব্রকে দেখাতে। সব এই শহরের নামিদামি লোকের সুন্দরী মেয়ে। যার মধ্য থেকে দুজনকে ওনার ভীষণ ভালো লেগেছে! দুজনেরই যেন আগুন ঝরা রূপ!
সত্যি বলতে লুৎফা প্রথম দফায় ঘাবড়ে ছিলেন কিছু। তীব্র যদি রাগারাগি করে? কিন্তু গত পরশু থেকে ছেলেটা আচমকা চুপ হয় যাওয়ায় একটু বল এসেছে বুকে। যদি একবার মেয়ে দুটোকে
দেখাতে পারেন,ছেলেটার কাউকে তো ভালো লাগবেই। তখন মন বদলাবে। ওই স্বার্থপর মেয়েটার কথা ভুলে যাবে নিশ্চয়ই?
কিন্তু কোথায় তীব্র? রাত পেরিয়ে প্রায় ভোর হতে চলল,অথচ কোনো খোঁজ নেই। এ নিয়ে
চিন্তায় লুৎফার মাথা ফেটে যাচ্ছে। তীব্রর বন্ধুরাও কেউ কিচ্ছু জানে না। নাহিদের বিয়ে থেকে ফেরার পরপরই, তাড়াহুড়ো করে কোথায় চলে গেল?
জামশেদ কয়েক জায়গায় ফোন করেছেন। তীব্র বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে গেছে।
কিন্তু সেটার গন্তব্য বাস স্ট্যান্ড অবধি। এরপর বাসে উঠে কোথায় গেল?
ভদ্রলোক এত ভার আর নিতে পারলেন না। এমনিতেই কদিন ধরে প্রেসারের অবস্থা যাচ্ছে-তাই। আবার কাহিল লাগছে শরীরটা। আগে হলে এত চিন্তা হোতো না। এখন যা অবস্থা ছেলেটার!
সদরের দোর হাঁ করে খোলা ছিল। জামশেদ বসতে এসেও থামলেন, দুমদাম পায়ের শব্দ পেয়ে। ঘাড় ফিরিয়ে চাইলেন ভদ্রলোক। তত্র পা দুটো থমকাল চমকের তোড়ে ।
তীব্র ঢুকেছে। একেবারে হাওয়ার মতো জোরালো তার বেগ। বিস্ময় বেড়ে প্রকাণ্ড হলো ছেলের দুহাতে একটা মেয়ে দেখে। সহসা তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন লূৎফা। দুজন বয়ষ্ক মানুষের প্রকট চাউনীতে পুষ্পিতার চিবুক তখন গলায়। চোখমুখ খিচে রাখার মাঝে তীব্র সোজা এনে তাকে মায়ের পাশে বসাল।
জামশেদ হতবাক,হতচেতন। পুষ্পিতাকে একবার দেখেছিলেন তিনি। না,সামনাসামনি নয়। আবুলের ফোনে, কোনো একটা ছবিতে। অতীতের সাথে বর্তমানের পুষ্পিতাকে মেলানোর প্রয়াস করলেন তিনি।
মুখের আদলটাই মিলল শুধু। সেদিনের মত উজ্জ্বল গড়ন নেই। রোগা-সোগা শীর্ণ একটা মেয়ে!
তবে লুৎফা দেখলেন প্রথমবার। প্রৌঢ়া চিনতে পারেননি প্রথমে। তীব্র হুট করে কোন মেয়েকে এভাবে কোলে নিয়ে ঢুকল, সেই বিস্ময়ে এখনো হতবুদ্ধি তিনি।
আনত পুষ্পিতার আগাগোড়া দেখলেন আশ্চর্য বনে।
কৌতূহলে নিঃশেষ হয়ে শুধোলেন,
“ ও কে?”
তীব্র সোজা হয়ে দাঁড়াল। হাবভাবে ব্যস্ততা। ছুড়ে দিলো উত্তর,
“ ও আমার পুষ্পিতা!”
লুৎফা ছলকে উঠলেন বিস্ময়ে। ঠোঁট দুটো হাঁ করে ফের চাইলেন। পুষ্পিতার মাথা তখন গলার খাঁজে। কোলের ওপর রাখা হাত দুটো কচলে যাচ্ছে সমানে।
কোথায় তাকাবে,কী করবে সবেতে আমূল দ্বিধাদ্বন্দ্ব।
জামশেদ স্তব্ধ হয়ে বললেন,
“ ওকে, ওকে কোথায় পেলে তুমি?”
“ এখন এসব কথা থাক। মা,তুমি যাও, এক্ষুনি গিয়ে দোকান থেকে একটা ভালো বেনারসি আর বিয়েতে যা যা দরকার সব কিনে নিয়ে এসো। আমি মিরাজদের বলেছি, ওরা কাজী নিয়ে আসছে। এই বেশি বোঝাটাকে আমি আজকেই বিয়ে করব।”
পুষ্পিতা চমকে বলল,
“ আজই? আমি মানে…”
“ চুপ!”
মেয়েটা চুপসে গেল ধমকে। ঠোঁট টিপে মাথা নোয়াল ফের।
লুৎফা কিছুই বুঝতে পারছেন না। বলেই ফেললেন,
“ ওর তো বিয়ে হয়ে গে..”
“ হয়নি। সব নাটক। তোমাকে যা বললাম করো।”
জামশেদ ইশারায় স্ত্রীকে শান্ত হতে বোঝালেন। বললেন গলা ঝেড়ে,
“ বিয়ে করবে ভালো কথা। কিন্তু, এত তাড়াহুড়ো কেন?”
“ তাড়াহুড়ো তো এমনি এমনি করছি না।”
বলেই, পুষ্পিতার দিক চাইল তীব্র। কটমটে কণ্ঠে অসন্তোষ নিয়ে বলল,
“ সব কিছুর জন্যে ও দ্বায়ী। বিয়ে না করেও দু বছর ধরে মেলোড্রামা চালিয়ে গিয়েছে। ওর নাটকের জন্যেই তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে। এতদিন বান্দরবন লুকিয়েছিল,ছেড়ে দিলে আবার কোন বনে গিয়ে লুকোবে কে জানে!”
জামশেদ কণ্ঠ শৃঙ্গে তুলে বললেন,
“ তুমি কি ওকে সেখান থেকে আনলে?”
মাথায় হাত দিলেন লুৎফাও। ছেলেটা বান্দরবান চলে গেছিল?
“ কীসে এলি এত পথ? গাড়ি তো শুনলাম বাস স্ট্যান্ড রেখে গেছিস।”
“ মাইক্রো ভাড়া করে। তোমরা এত প্রশ্ন কেন কোরছো বুঝতে পারছি না!’’
“ তো কী করব? এই শুনলাম ওর বিয়ে হয়ে গেছে। এখন বলছো হয়নি। আর বিয়ে নাহলে ও এতদিন লুকিয়েছিল কেন?”
পুষ্পিতা মুখ খুলল। মিহি কণ্ঠে বলল,
“ আসলে আমার একটা পা…”
তীব্র আবার ধমক দিলো।
“ তোমাকে চুপ করতে বলেছি না?”
লুৎফার সব হযবরল লেগে গেছে। পুষ্পিতা বিয়ে করেনি,অথচ বিয়ের নাটক করছিল! কেন? ওর কি তীব্রকে পছন্দ নয়?
ভদ্রমহিলা সরল,নম্র মনের। পুষ্পিতার প্রতীমার মতো,স্নিগ্ধ-বিষণ্ণ মুখখানা সেই মায়া কয়েকগুণ বাড়াল। মাথায় হাত রাখলেন ওর। মোলায়েম কণ্ঠে বললেন,
“ তোমার বুঝি আমার ছেলেটাকে পছন্দ নয়?”
পুষ্পিতা চোখ তুলে চাইল। একটা স্বচ্ছ জলের পুকুর সেথায়। বলল বোজা স্বরে,
“ ছি! ছি! নার মত মানুষকে অপছন্দ করার যোগ্যতা আমার আছে?”
লুৎফার হঠাৎ নজর পড়ল মেঝেতে। পুষ্পিতার ঝুলন্ত স্কার্ট হতে বাম পা বেরিয়ে আছে। লুৎফা আরো ভালো করে তাকালেন। পাশের জায়গাটা ফাঁকা! সিলিং ফ্যানের তোপে স্পষ্ট হাওয়ার গতিপথ । ভদ্রমহিলার মুখখানা অমনি বিবর্ণ হয়ে গেল। ত্রস্ত দেখলেন স্বামীর পানে। জামশেদের নজরও এদিকেই আটকে। দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন৷ দৃষ্টিতেই যেন সব উত্তর, সব সমাধান।
বাবা মায়ের এই চাউনী হয়ত বুঝে নিলো তীব্র। ছোট্টো শ্বাস ফেলে বলল,
“ এক্সিডেন্টে আমি যেমন কোমায় চলে গিয়েছিলাম? পুষ্পিতারও দেহের সামান্য একটা অংশ চলে গেছে। ও ভেবেছিল এসব জেনে আমি ওকে ছেড়ে দেবো। তাই আগ বাড়িয়ে, বেশি বুঝে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল নিজেকে। কিন্তু ও বোঝেইনি,তীব্র রেজা তালুকদারের ভালোবাসা এত সস্তা নয়। আই থিংক তোমাদের সব কনফিউশান দূর হয়েছে এবার?”
দুজনের কেউই জবাব দিলেন না। লুৎফা ফ্যালফ্যাল করে পুষ্পিতাকেই দেখছেন।
মেয়েটা পাংশুটে আদলে নামিয়ে রাখল নজর। এক ফোঁটা জলের কণা ছিটকে পড়ল হাতে। লুৎফা অমনি ওর মাথাটা বুকে চেপে ধরলেন। অনুশোচনায় অন্তঃপট জ্বলেপুড়ে গেল। না জেনেবুঝে মেয়েটাকে এতকাল উনি অভিশাপ দিয়েছিলেন? একটু আগেও স্বার্থপর বলেছিলেন? ছি! ছি!
ভদ্রমহিলা ভেজা চোখ মুছলেন। আচমকা কেমন তাড়াহুড়ো বাঁধিয়ে বললেন,
“ আমি এক্ষুনি তৈরি হয়ে আসছি। আমার বিয়ের সব গয়না তো এখনও একইরকম আছে । ওকে বরং সেসব দিয়ে সাজাব। তবে বেনারসীটা কিনতে হবে বুঝলেন! বিট্টু, তুই একটু অপেক্ষা কর বাবা,আমি আসছি!”
যেতে নিলে আটকালেন জামশেদ। বললেন,
“ কষ্ট করে মার্কেট যেতে হবে না। আমি ফোন করছি,কোন ব্রান্ডের নেবে? বাড়িতে পাঠিয়ে দিক।”
“ সেতো আরো ভালো। তাহলে যাই, একটু খাবার নিয়ে আসি। সকাল থেকে তো কিছু খাওনি মনে হয়। তাই না?”
উত্তর নিতে, পুষ্পিতার চিবুক ধরলেন তিনি। মেয়েটা হাঁ করে রইল। চোখেমুখে হাজারো দ্বিধা,হাজারো দ্বন্দ্ব।
ওনারা তো দেখলেন,বুঝলেন ওর পা নেই। এরপরেও বিয়েতে রাজি? এত আনন্দ এ নিয়ে!
লুৎফা জবাবের আশায় রইলেন না। চপল চিত্তে রান্নাঘরে ছুটলেন। জামশেদ কল দিলেন কোনো এক নম্বরে। কথা বলার সুবিধায় খোলা জায়গায় দাঁড়ালেন এসে। তীব্র সদরের দিকটা একবার দেখল। তারপর কাছে এলো পুষ্পিতার। এক হাঁটু মুড়ে বসল ওর সামনে। কোমল হাতদুটো মুঠোয় ধরে বলল,
“ চিন্তা হচ্ছে?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল দুপাশে। বলল,
“ ভয় করছে।”
“ কীসের ভয়?”
পুষ্পিতা ভেজা চোখে বলল,
“ এটা ঠিক হচ্ছে না,স্যার। আপনি আবেগের বশে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন । আমি পঙ্গ…”
তীব্র চট করে একটা আঙুল ওর ঠোঁটে চেপে ধরল।
“ শশশ!
আমাকে ভালোবাসো?”
পুষ্পিতার কাতর চাউনী থমকায়। নেমে আসে এক পৃথিবী ব্যকুলতা।
ও ভ্রু উঁচাল,
“ কী? ভালোবাসো?”
“ বাসি।”
তীব্রর কণ্ঠে দৃঢ়তা,
“ ব্যস!
ভালোবাসার ওপর আর কোনো কথা নেই! কোনো যুক্তি নেই। কোনো তর্ক নেই। সেখানে একটা পা কী জিনিস?”
একটু থামল সে। বলল,
“ আমি তোমাকে চাই,তোমার মনটাকে চাই। একটা গোটা পুষ্পিতাকে চাই। আর সেই চাওয়ার মধ্য পৃথিবীর কোনো কিছুর কোনো জায়গা নেই, ভীতু মেয়ে!
তীব্রর দুটো হাত আছে,একটা বুক আছে। তোমাকে আগলে রাখতে ওরা কি যথেষ্ট নয়? তোমার সমস্ত অপূর্ণতা আমার, ভীতু মেয়ে। আমার সবটা দিয়ে তোমাকে আমি পূর্ণতায় রাঙিয়ে দেব!”
পুষ্পিতা হুহু করে কেঁদে উঠল। কিন্তু হাসল তীব্র। সিক্ত চোখ মুছিয়ে বলল,
“ পৃথিবী ছাড়ার আগ অবধি,তোমাকে আমি এতটা ভালোবাসব ভীতু মেয়ে,
যতটা ভালোবাসা এর আগে কেউ কক্ষনো কাউকে কোনোদিন বাসেনি। প্রেমিক হিসেবে নয়, স্বামী হিসেবে তোমাকে দেয়া এটা আমার প্রথম ওয়াদা!”
ওদের কথার মাঝেই জামশেদ ফিরে এলেন। তুষ্ট চিত্তে বললেন,
“ হা*** ব্যান্ডের ম্যানেজারের সাথে কথা বললাম।
বেনারসির সবথেকে নামি ব্রান্ড!
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওনারা শাড়ি সহ ওনাদের স্টাফ পাঠাবেন। পুষ্পিতা, তোমার যা যা পছন্দ হয়,সব নিও।”
তীব্র বলল,
“ মানা করে দিন! এসবের কোনো দরকার নেই।”
তিনি কপাল কুঁচকে বললেন,
“ মানা করব?
কেন?”
তীব্র উঠে দাঁড়াল। জবাব দিলো ভণিতাহীন,
“ পুষ্পিতা বিয়ে করবে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো,একটা সাদামাটা বেনারসী পরে। আর সেটা আমি কিনব। আমি যতটুকু এফোর্ট করতে পারব,পুষ্পিতা তাই ব্যবহার করবে,ড্যাড।”
“ কিন্তু তোমার বাবা আমি। আমি দিলে কী সমস্যা?”
“ সমস্যা আছে । আমি ওকে মন্ত্রীর ছেলে হিসেবে ভালোবাসিনি। বেসেছি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে। যে একটা ভার্সিটির সামান্য লেকচারার ছিল।
তাই আমার স্ত্রী আমার টাকায় চলবে। শ্বশুর মন্ত্রী হওয়ার কোনো এডভান্টেজ নিয়ে নয়!”
“ কিন্তু তুমি এখন কী করে খরচ করবে? তোমার তো …”
“ অসুবিধে নেই। যা আছে,তাই দিয়ে হবে।”
তারপর পুষ্পিতার দিকে চাইল সে। সোজাসুজি বলল,
“ তোমার শ্বশুরের মতো হয়ত অঢেল টাকা আমার হবে না। একজন লেকচারার হিসেবে হয়ত অল্প বেতন পাব। এ দিয়ে চলতে পারবে, পুষ্পিতা?”
মেয়েটা জবাব দিলো সাথে সাথে,
“ পারব। আপনি পাশে থাকলে আমি সব পারব।”
দুজনের দৃঢ়তায় অবাক হলেন জামশেদ। তীব্রর তৃপ্ত হাসিটা সেই বিস্ময় বাড়াল। কতদিন পর আবার হাসছে ছেলেটা!
পুষ্পিতা কড়কড়ে লাল রঙের বেনারসি পরেছে। সাথে গা ভরতি গয়নায়। ভারে মেয়েটার নড়চড়ও রুদ্ধ।
জ্বর-টর সেই কখন পালিয়েছে! লুৎফা নিজ হাতে ওকে সাজালেন।
সব শেষে গাল ধরে বললেন,
“ কী সুন্দর লাগছে! আমার ছেলেটা কিন্তু এমনি এমনি এত পাগল হয়নি।”
পুষ্পিতা লজ্জা পেলো।
মাথা নামাতেই,দোরের কাঠে টোকা দিলো কেউ একজন। লুৎফা তাকালেন। তীব্র বলল,
“ হয়নি?”
প্রৌঢ়া বিরক্ত হয়ে বললেন,
” দেখলে,একটু মন ভরে সাজাব তাও দিচ্ছে না। এত অধৈর্য তুই? উফ! হয়েছে,নিয়ে যা।”
লুৎফা বাকি জিনিস গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে গেলেন । তীব্র ভেতরে এলো। বসে থাকা পুষ্পিতার দিকে তাকিয়ে হাসল মিটিমিটি। পুরোনো সেই হাসিতে কুণ্ঠায় কুপোকাত তরুণী।
তীব্র সময় নিলো না। ফের কোলে তুলতেই ও বলল,
“ শুধু শুধু এত কষ্ট করছেন। দুটো ক্রাচ এনে দিলেই হোতো!”
“ আমার হাত দুটোই তোমার ক্রাচ!
আর এখন কষ্ট আমি করছি,বিয়ের পর তো তুমি করবে।”
পুষ্পিতা বোকা চোখে চাইল। তীব্র ঠোঁট কামড়ে হাসে। চোখেমুখে দুষ্টুমি।
“ সামলাতে পারবে আমায়? সেভেনটি ফাইভ কেজি কিন্তু।”
পুষ্পিতা মুখ হাঁ করে ফেলল। ছটফটিয়ে বলল,
“ ছি, নির্লজ্জ! নামান আমাকে, নামান।”
তীব্র কথা শুনল না। সরু নাক কোলে থাকা পুষ্পিতার নাকে ঘষে বলল,
“ আর কিছুক্ষণ! এরপর তুমি আমার ভীতু মেয়ে! তোমার সবটা আমার। আস্ত তুমিটা আমার।”
মিরাজ,মুশফিক,আরমান,নাহিদ,নূহা সবাই একসাথে কাজী নিয়ে এসেছে। আশ্চর্যের বিষয়, আরো একটা সুক্ষ্ণ পরিচিত মুখ আছে সঙ্গে। তবে সেদিকে কারো খেয়াল পড়ার আগেই,নূহার একটা চিৎকার টেনে নিলো মনোযোগ।
মেয়েটা “ পুষ্পিতায়ায়ায়া” বলে ছুটে গেল কাছে। পুষ্পিতা তখন সেজেগুজে পুতুল হয়ে বসে। দৌড়ে এসেই ওকে জড়িয়ে ধরল নূহা। কেঁদে কেঁদে, কণ্ঠে নিপাত অভিমান ঝরিয়ে বলল,
“ তুই কী করে পারলি আমার সাথে এতদিন কথা না বলে থাকতে? কষ্ট হয়নি তোর? একবারও আমার কথা মনে পড়েনি?”
পুষ্পিতা বন্ধুর মুখটা তুলল। তার চোখেও জল। বলল খুব আস্তে,
“ তুই আর উনিই তো আমার সব। তোদের ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারি কখনো?”
তীব্র হাট্টাগোট্টা বন্ধুদের দেখল কিছু পল। সবকটা সেজেগুজে এসেছে। ও ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ কাজী কোথায়?”
ত্রস্ত পেছন থেকে হাত তুললেন ভদ্রলোক। মিনমিন করে জানালেন,
“ এই যে বাবা,আমি এখানে।”
তীব্রর চোখ ছোটো হয়ে গেল।
এ তো সেই কাজী। নাহিদের সাথে মিথিলার বিয়ে পড়াতে তুলে এনেছিল যাকে।
“ এটাকে কোথায় পেলি?”
মুশফিক খুব আনন্দ নিয়ে বলল,
“ তুলে এনেছি।”
“ আজকেও?”
মিরাজ বলল,
“ তো কী করব?
তুই হুট করে কাজী যোগাড় করতে বললি! তাও এত তাড়াহুড়ো করে। আমরা তো চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। তখনই এ ব্যাটা সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। ভাবলাম, কষ্ট করে খুঁজব কেন? তাই তিনজন মিলে বগলদাবা করে সাথে নিয়ে এসছি।”
কাজী ভয়ে ভয়ে বললেন,
“ বাবারা, আমি আজকেও কাউকে কিছু বলব না। তাহলে, নিশ্চয়ই আজও আপনারা আমাকে জবাই না করে সহি সালামতে বাড়ি পৌঁছে দেবেন?”
জামশেদ কৌতূহলে শুধালেন,
“ আজকেও কিছু বলবেন না মানে? ওরা কি আপনাকে আগেও তুলে এনেছিল না কি?”
ভদ্রলোক কথা বলার আগে, ঠোঁট ফাঁকা হয়ে গেল।
দুই ভ্রু তুলে বললেন,
“ আপনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জামশেদ তালুকদার না?”
জামশেদের অভিব্যক্তি নিভে গেল অমনি। এই রে, লোকটা যদি এখন বাইরে গিয়ে মিডিয়াকে সব বলে দেয়? মন্ত্রীর ছেলে কাজী তুলে এনে বিয়ে করছে,এমন নিউজ তো দেশে রমরমিয়ে চলবে।
তীব্র বলল,
“ এত কথার দরকার নেই। বিয়ে পড়াতে এসেছেন বিয়ে পড়ান। বসুন!”
“ কিন্তু… “
“ বোস ব্যাটা!”
মিরাজ একটা ধাক্কা মারল। অপ্রস্তুতি হুড়মুড়িয়ে এসেই সোফায় বসে পড়লেন ভদ্রলোক।
চশমাটা খুলতে খুলতেও ঝুলে রইল নাকে। তারপর ঠিকঠাক হয়ে বসলেন তিনি। খাতাপত্র মেলে ব্যস্ত হলেন লিখতে।
তীব্রর পরনে সোনালী পাঞ্জাবি।
মাথায় একটা টুপি মিসিং। আরমান এদিক -ওদিক চাইল। তীব্রর চেহারায় ভালো বর বর ফিল সে পাচ্ছে না। বড়ো চুল-দাড়িতে সেই ছ্যাকাখোর মাস্তান মনে হচ্ছে। বন্ধুর এই চেহারা সে মেনে নিতে পারল না। চোখ পড়ল কোনায় দাঁড়ানো মামুনের দিকে। ভদ্রলোক সব সময় টুপি পরেন মাথায়।
ও গিয়েই সেটা ছো মেরে নিলো। মামুন চমকাল। চাইল হতভম্ব চোখে। কিন্তু,সাফাই দেয়া তো দূর কোনো কিছুর ধার ধারল না আরমান।
চোখের চোটপাট দেখিয়ে ফিরে এলো আবার। চুপচাপ গিয়ে তীব্রর মাথায় পরিয়ে দিলো টুপিটা।
তীব্রর অবশ্য এসবে মন নেই। ও চেয়ে আছে কাজীর খাতার দিকে। আচমকা খ্যাক করে বলল,
“ এটা কি পিপড়ে হাঁটছে? তাড়াতাড়ি লিখুন।”
“ জি জি,লিখছি।”
জামশেদ দোনামনা করে বললেন,
“ বলছিলাম কী তীব্র,আরেকবার ভেবে দ্যাখো। এখানে তো পুষ্পিতার অভিভাবক
থাকাও জরুরি! এর থেকে আজ ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে হোতো না? এরপর
আমরা দুই পরিবার আরামসে বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে, ধুমধামে বিয়ে দেবো নাহয়!”
তীব্র বলল,
“ না। এদের একটাকেও আমার বিশ্বাস নেই! বিয়ে এক্ষুনি হবে। তারপর যেখানে যাওয়ার আমি নিয়ে যাব। এটাকে এক মুহুর্তও কাছ ছাড়া করা যাবে না।”
জামশেদ পরাস্ত চোখে স্ত্রীর দিক চাইলেন। কিন্তু ঠোঁট চেপে হাসছেন লুৎফা।
পুষ্পিতা বসে রইল কাচুমাচু মুখে। কাজী বললেন,
“ কাবিন কত লিখব,বাবা?”
জামশেদ বললেন,
“ ত্রিশ-চল্লিশ লা..
পুষ্পিতা বাধ সাধল কথায়। মিহি কণ্ঠে বলল,
“ না। এসবের প্রয়োজন নেই!”
তীব্র বিরক্ত হয়। কপাল গোছায় মেজাজ খিচড়ে। ভাবল,পুষ্পিতা বিয়েতে আবার বেঁকে বসবে। এবার যদি সত্যিই এমন করে,তাহলে দ্বিতীয় চরটা খুব তাড়াতাড়ি খাবে।
বাকিরা বিস্মিত হয়ে একে-অপরকে দেখল। কাজী বললেন,
“ কিন্তু এটা তো নিয়ম। কিছু না কিছু অর্থ বাঁধতেই হবে।”
“ তাহলে, ১০১ টাকা লিখুন।”
নূহা কাঁধে হাত রাখল।
“ কেন রে? কোনো সমস্যা?”
সবার চোখে প্রশ্ন। পুষ্পিতা সরাসরি তীব্রর দিকে চাইল। অন্যসময়ের স্বল্পতে লজ্জায় মূর্ছা যাওয়া তরুণী সকলের সামনে স্পষ্ট জানাল,
“ আমার দেনমোহরের অর্থ চাই না। দেনমোহর হিসেবে আমি আপনাকে চাই। যদি কখনো বিচ্ছেদের প্রশ্নও আসে? ক্ষতিপূরণ হিসেবে যেন আপনাকেই পাই!”
( এই লাইনগুলো প্রণয় সিজন ২-এ ব্যবহার করেছিলাম ২০২০ সালে। গল্পটা পেজ থেকে ডিলিট করায়,আবার এখানে দিলাম)
বিস্ময় ভুলে হেসে ফেলল সবাই। লুৎফা মুগ্ধতার তোপে যেন আকাশ ভেঙে পড়লেন।
রাগে গোটানো কপালটা তীব্রর টানটান হলো সহসা। নিম্নোষ্ঠ দাঁতে পিষে হাসতেই,মাথা নামিয়ে মুচকি হাসল পুষ্পিতাও। কাজী মুগ্ধ হয়ে বললেন,
“ আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! প্রথম কোনো কনের মুখে এমন কথা শুনলাম।”
অমনি সব ভয়ডর ভুলে, মহাআনন্দে বিয়ে পড়ালেন তিনি।
সবার ভেতর পুষ্পিতার হাতটা সদর্পে ধরে রাখল তীব্র।
যেন, ছাড়লেই পালাবে।
সময় শেষে বিয়ে সম্পন্ন হয়। সকলের চকচকে হাসি,আর আলহামদুলিল্লাহ ধ্বণিতে মুখোরিত বাড়িঘর।
তীব্রর হঠাৎ নজর পড়ল মামুনের দিকে। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ এই নমুনাটা এখানে কেন?”
সবগুলো চাউনী নিক্ষেপ হতেই ভদ্রলোক গুটিয়ে গেলেন আরো। জড়োসড়ো হয়ে বললেন,
“ ইয়ে মানে..”
উত্তর দিলো মিরাজ,
“ কাজী সাহেবকে আনার সময় দেখে ফেলেছিল। তাই এটাকেও নিয়ে এসেছি। যদি সমস্যা করে!”
মামুন শিশুর মতো ঠোঁট উলটে বললেন,
“ কিন্তু আমি তো বাজারে যাচ্ছিলাম।”
তীব্র রেগে রেগে বলল,
“ ব্যাংকের অফিসার হয়েছিস, আর গুণ্ডামো গেল না? যা, এটাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা কর।”
মামুন সাহস পেলেন একটু! এক পা এগিয়ে এসে বললেন,
“ বলছিলাম যে,আমি একটা কথা বলতে পারি?”
মুশফিক বলল,
“ এতক্ষণ কি তাহলে কবিতা বলেছিস?”
“ না মানে..”
জামশেদ হাত তুলে ওকে থামালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“ আপনার পরিচয়?”
নূহা বলল,
“ উনি পুষ্পিতাদের আগের বাসার বাডিওয়ালা আঙ্কেল।”
আরমান আগ বাড়িয়ে বলল,
“ ওই,যে বাড়ির দারোয়ানকে আমরা ন্যাড়া করে মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছিলাম না? সে বাড়ির মালিক আঙ্কেল।”
সাথে গর্বের হাসি হাসল ছেলেটা। জামশেদ চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন,
“ লজ্জাও করে না এসব বলতে? আবার দাত দেখাচ্ছে!”
আরমানের হাসি দপ করে নিভে গেল।
দাঁড়াল চোর চোর মুখ করে।
মামুন বললেন,
“ ইয়ে মানে, আমাকে যদি অনুমতি দিতেন তাহলে একটা প্রস্তাব রাখতাম।”
জামশেদ বললেন,
“ জি বলুন,কী বলবেন?”
“ না মানে আসলে বিট্টু ভাই, বলছিলাম যে আপনার বিয়ের অনুষ্ঠানটা যদি আমার বাড়িতে করতেন!’’
মুশফিক কথা টেনে নিলো,
“ কেন? ওর বাড়ি নেই? তোর বাড়িতে করতে যাবে কোন দুঃখে?”
জামশেদ বললেন,
“ আহা,তোমরা চুপ করবে? ওনাকে বলতে দাও। আর বাবার বয়সি লোককে তুই-তোকারি করা এটা কোন ধরণের বেয়াদবি! সে সরি টু হিম!”
মুশফিক সরি বলতে তাকাল। কিন্তু মামুনের মনে হলো দৃষ্টি দিয়ে জান কবজ করছে সে। ত্রাসে লাফিয়ে উঠে বললেন,
“ না না লাগবে না। আমি কিছু মনে করিনি!”
“ তাহলে বলুন,কী বলার আছে?”
“ আসলে স্যার,ইয়ে বিট্টু ভাই,আপনি তো সেদিন আমাদের শাস্তি দিতে কিছু কাজ ঠিক করে দিয়েছিলেন। পুষ্পিতাকে খুঁজে না পাওয়ায় যার কিছুই হয়নি। সত্যি বলতে,
মেয়েটাকে সেদিন আমরা কম কথা শোনাইনি। না জেনে বুঝে, ডলিও যা তা বলেছিল। সেসবের প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোগ যদি দিতেন! মানে, এখন আমার বাড়ির ওই ফ্লোর পুরো খালি। গ্রাউন্ডফ্লোরেও বিশাল জায়গা আছে। হ্যাঁ, আপনাদের এই বাড়ির কাছে সামান্য। তবে আমি অনেক আশা নিয়ে প্রস্তাবটা রাখতে চাচ্ছিলাম। যদি আপনার মর্জি হয়,আপনার আর পুষ্পিতার বিয়ের অনুষ্ঠান আমার বাড়িতে করলে আমি, ডলি দায়িত্ব নিয়ে সমস্ত কাজ করে দেব।”
অনুনয়ের তোড় বাড়াতে হাতজোড় করলেন মামুন। চোখেমুখে পরিষ্কার অনুশোচনা।
তীব্র পুষ্পিতার দিক তাকাল।
জানতে চাইল সে কী চায়!
মেয়েটা বাধ্যের ন্যায় বলল,
“ আপনি যা বলবেন।”
ও মাথা নাড়ে। মামুনকে উত্তর দেয়,
“ ঠিক আছে!”
ভদ্রলোক খুশিতে আপ্লুত! হইহই করে বললেন,
“ আমি তাহলে যাই,ব্যবস্থা করি গিয়ে।” বলতে বলতে চপল পায়ে ঘর ছাড়লেন তিনি।
এতদিনের নিস্তব্ধ বাড়িটা মুহুর্তেই আনন্দে মাখোমাখো আজ। বন্ধুদের উল্লাস,তীব্রর প্রাপ্তি সব মিলিয়ে উৎসবে হইচৈ লেগে গেছে। লুৎফা অল্প সময়েই আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন করে ফেললেন। খাবার বাড়তে আরো দুজন লেগে গেল তাই। সবাই এক সাথে টেবিলে বসল। নূহা বসতে বসতে অদূরের পুষ্পিতাকে দেখল কিছু পল। ওর তো ক্রাচ নেই এখানে। খেতে আসবে কী করে? ভাবল,
“ আমি বরং খাবারটা নিয়ে যাই। দুজন একসাথে ওখানে বসে খাব।”
নূহা নিজের থালায় হাত দিলো কেবল,তক্ষুনি চোখ পড়ল তীব্রর দিকে। মানুষটা
প্লেটে ভাত-মাংস নিয়ে পুষ্পিতার কাছে যাচ্ছে।
মেয়েটা মুচকি হাসল। বুক ভরে শ্বাস টেনে বসল কেদারায়।
তীব্র একটা চেয়ার নিয়ে পুষ্পিতার মুখোমুখি বসেছে।
তরকারিতে ভাত মেখে সামনে ধরতেই, গাল দুটো লজ্জায় ছেঁয়ে গেল তার। চোখের কোণা তুলে চাইল সবার দিকে।
ও বলল,
“ স্বামীর হাতে খাচ্ছেন,ম্যাডাম। এত লজ্জার কী আছে?”
“ না মানে…
পুষ্পিতার কথা বেশিদূর গেল না। তীব্র চোখ রাঙিয়ে হুকুম দেয়,
“ হাঁ করুন।”
মেয়েটা মুখ খুলল। তবে প্রশ্ন করল পরপরই
“ আপনি খাবেন না?”
“ একসাথে খাব। একবার তুমি খাবে,একবার আমি।”
নিবিড় এই দৃশ্যখানা টেবিলে বসে বসেই দেখলেন জামশেদ। চোখের হোচট, পরিষ্কার চাউনীতে। তীব্র কি সত্যিই তার ছেলে?
হ্যাঁ, শরীরে তো ওনার রক্তই বইছে । জেদ,সাহস সব ওনার সেই যুবক বয়সের মতো। কিন্তু বউয়ের প্রতি তো জামশেদের এত গদগদ ভাব কখনোই ছিল না। আজ অবধি লুৎফাকে খাইয়ে দিয়েছেন কখনো?
একটা মেয়ের শোকে তার ছেলে প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল! আচ্ছা, লুৎফা পাশে না শুলে জামশেদেরও কি কখনো ঘুম খারাপ হবে? উনি দূরে গেলে,ওনারও কি এমন দশা হবে?
ভদ্রলোক মনঃদ্বিধা নিয়ে স্ত্রীকে দেখলেন এক পল। সবাইকে পরিবেশন করায় ব্যস্ত রমণী। জামশেদের হাত-গলা নিশপিশ করে উঠল। পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় দমিয়ে রেখে গাট হয়ে বসে রইলেন তাও।
ভাতে হাত চালালেন খুব ধীরে। আস্তে আস্তে সবার খাওয়া শেষ হলো।
মিরাজরা হাত ধুয়ে, গিয়ে বসল সেই লিভিং রুমের সোফায়।
লুৎফা লক্ষ্য করলেন জামশেদকে। ভাতে আঙুল চালাতে চালাতে গভীর চিন্তায় ডুবেছেন তিনি।
জিজ্ঞেস করলেন,
“ আপনার কিছু লাগবে?”
ভদ্রলোক নড়ে ওঠেন।
“ হুঁ? না।”
তারপর গলা খাঁকারি দিলেন। রয়েসয়ে বললেন,
“ আমার পাশে এসে বোসো তো।”
লুৎফা একটু ভয় পেলেন।
জামশেদ তো এভাবে কখনো বলে না। গুরুতর মুখভঙ্গিতে বসলেন এসে। সহসা তাকে চমকে দিয়ে মুখের সামনে ভাত ধরলেন তিনি।
লুৎফার বিস্ময়ে মাথা চক্কর কাটে। চোখ থেকে মণিদুটো ঠিকড়ে আসতে চায়।
জামশেদের মাঝে লুতুপুতু ভাব কখনোই ছিল না। রাজনীতি,ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত লোকের এসবের জন্যে ফুরসত কই?
সময় করে যে একটা ছেলের জন্ম দিয়েছেন এই ঢেড়।
দৃঢ়ীভূতে ওষ্ঠ ফাঁকা করে চেয়ে রইলেন লুৎফা। সেই খোলা মুখে ভাত ঠুসে দিলেন জামশেদ।
“ এভাবে দেখছো কেন? অস্বস্তি হচ্ছে!”
লুৎফা হেসে ফেললেন এবার।
“ ছেলেকে দেখে বুঝি প্রেম জেগে উঠল?”
জামশেদ ধরা পড়ার ভাবটা চটজলদি লুকোতে পারলেন না।
হয়ত চাইলেনও না আজ। মনের কথাই বলে দিলেন,
“ না, আসলে হঠাৎ মনে হলো সমাজের চোখে আমি এত সভ্য মানুষ হয়েও তোমাকে কোনোদিন কোনো যত্ন করিনি। তোমার কোনো খেয়াল রাখিনি। খেয়েছ কী না! শরীর খারাপ কী না! কিচ্ছু না। দুটো ভাত আর একটা পরিপাটি বিছানা, ব্যস! এর বাইরেও যে একটা স্বামীর কিছু দায়িত্ব থাকে কেন যেন হুট করেই মনে এলো সেটা।
এই যে দ্যাখো, যাকে সারাজীবন অসভ্য- অভদ্র বলে গালাগাল দিয়ে এলাম,সেই ছেলের মাঝে কতটা নিঁখুত ভালোবাসা আছে। ভালোবাসার মানুষটার প্রতি কত যত্ন তার!
আসলে কী বলোতো লুৎফা,ভালোবাসতে সভ্যতার দরকার হয় না। ভালোবাসতে দরকার মন। আমার হয়ত সেটা ছিল না। স্ত্রী যে ভালোবাসার জিনিস,আমরা অনেকেই ভুলে যাই। তাই ভাবছি, এই বয়সে এসে যদি তোমার ছেলের থেকে এই ভালো গুণটা শিখে নেই,কেমন হবে?”
সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৮
লুৎফার চোখে জল ছুটে এলো। আলগোছে মুছতে অন্যদিকে ফিরলেন। যেখানে তীব্র পুষ্পিতাকে খাইয়ে দিচ্ছে, চোখ পড়ল সেথায়। শুধু কী তাই? খাওয়া শেষে মেয়ের এঁটো মুখ টিস্যুতে মুছিয়ে দিলো সে। পানি খাওয়াল গ্লাস তুলে। লুৎফার চোখ ধরল মুগ্ধতায়। বুক ভরল শান্তিতে।
মনে হলো,
সত্যিই ভালোবাসতে সভ্যতার দরকার হয় না। ভালোবাসতে মন চাই! যেটা তীব্রর আছে। সবার থেকে অনেক বেশিই আছে!