সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ শেষ পর্ব 

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ শেষ পর্ব 
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

বিয়ে বাড়ি। সরল-সুন্দর সাজসজ্জায় মাখোমাখোর সাথে এ এক স্বপ্নের মতো জায়গা।
অতিরিক্ত আড়ম্বরপূর্ণ!
চারদিকে হৈচৈ, রঙচঙে ফুলে সজ্জিত,ঝলমলে আলোয় আলোকিত প্রায় প্রতিটি কোনা। বিলাসবহুল খাবারের সুগন্ধে বাতায়ন মেতেছে।
গ্রাউন্ডফ্লোরের একটা বড়ো কর্ণার বরাদ্দ তার জন্যে। মামুন শাহ নিজের সবটুকু চেষ্টা ঢেলে এমন বিরাট আয়োজন করেছেন। বাড়ির একদম সামনে
আয়োজনের সর্বাধিক দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যের এক অনন্য সমাহার হলো বাড়ির হাতিকায় গেট।
যেখানে মাত্রই এসে চারখানা বড়ো গাড়ি ভিড়েছে। অমনি হিড়িক পড়ল আশেপাশে,

‘’ বর এসেছে,বর এসেছে।”
উদ্বোলিত স্লোগান দ্বিকবিদিক মাড়িয়ে পুষ্পিতার কান ছুঁয়ে দেয়। বউ সাজে রূপসীর বুকখানা ধ্বক করে ওঠে । নড়েচড়ে বসে একটু!
মুখায়বের আইঢাই ছাপ দেখেই, ফিক করে হেসে ফেলল নূহা। ভ্রু উঁচিয়ে টেনে টেনে বলল,
“ কী, কেমন ফিল হচ্ছে? বুক ধকধক করছে? ঘাম হচ্ছে? লজ্জা লাগছে?”
ঘরে আরো বেশ ক’জন ছিলেন। নূহার রসিকতায় হাসলেন তারাও। পুষ্পিতা লজ্জা পেলো। ঠোঁট টিপে
ছোটো কণ্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ ওনাকে কেমন লাগছে,কে জানে!”
নূহা জবাব দিলো না। ফটাফট পুষ্পিতার কিছু ছবি তুলে নাহিদকে সেন্ড করল হোয়াটসঅ্যাপে। নিচে লিখল,
“ আমি নিজে না সাজলেও,কত সুন্দর সাজাতে পারি দেখেছ? পুষ্পিতাকে একদম রানীর মতো লাগছে না?”
পরের ম্যাসেজটায় লিখল,
“ অ্যাই, এসব ছবি কিন্তু তীব্র ভাইয়াকে দেখাবে না। বিয়ের আগে নো দেখাদেখি। মনে থাকে যেন।”
নাহিদ তখন অফলাইনে। ম্যাসেজ সিন হয়নি। নূহা নিজের মতো গড়গড় করে লিখে আবার ফোনটা জায়গায় রেখে দিলো।

প্রবেশদ্বারের সামনে একটা মোটামুটি জটলা বেধেছে। সবার সামনের জিপ থেকে পুলিশের লোক নামলেন। পরের ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটার আশপাশ থেকে ভিড় কমাতে হাঁক ছুড়লেন কয়েকবার।
জায়গা পাতলা হলে, নাগড়া জুতো সমেত মাটিতে পা রাখল তীব্র।
ধবধবে সাদা শেরওয়ানির কারুকাজ, হীরের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে আলোতে। পাগড়ীর উঁচু অংশে বসেছে লম্বালম্বি চাঁদের দাগ।
রাহাত ছুটে গিয়েই তার হাত আকড়ে ধরল।

খোরশেদ, পুষ্পিতার মামা, মামুন সহ বেশ কজন পুরুষ বরপক্ষকে সাদরে নিয়ে গেলেন ভেতরে। জামশেদ পা মেলাতে মেলাতে অদূরে দেখলেন কিছু পল। মিডিয়াকে কোনোভাবেই এখানে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। চারদিকে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। ভদ্রলোকের চোখমুখ খেয়াল করল হাফিজ। আগ বাড়িয়ে বলল,
“ আপনি চিন্তা করবেন না, স্যার! আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।”
তুষ্ট হাসলেন তিনি। হাফিজকে আগে যে কেন এসিস্ট্যান্ট হিসেবে পেলেন না! কাজের প্রতি এত ডেডিকেটেড ছেলেটা! সেখানে আবুল! একটা বোকার মতো চাল চালতে গিয়ে নিজের কপালটাই পোড়াল।
এখন মরার আগ অবধি গুপ্ত ঘরে আটকে থাক ।
এত গিজগিজে মানুষ দেখে একটু অস্বস্তি হচ্ছে তীব্রর! সবাই কেমন ড্যাবড্যাব করে দেখছে। কী অদ্ভুত! এরা কি আগে কাউকে বিয়ে করতে দেখেনি?

বাড়িতে হলেও,আয়োজন সেন্টারের থেকে কম কিছু নয়।
মুখোমুখি বিশাল বড়ো স্টেজ। পুরোটা একেবারে তকতকে সাদা থিমে বানানো। শুভ্রতায় মোড়ানো সেখানকার পর্দা থেকে সোফাসেট অবধি। সামনেই
অতিথিদের বসার জায়গা। এপাশটায় খাবারদাবারের হল্লাহল্লি। নতুন জামাকাপড়ে মোড়া নিমন্ত্রিতরা,অনুষ্ঠানের
চাকচিক্য আরো বহুগুণ বাড়িয়েছে।
তীব্র লম্বা লম্বা পা ফেলে স্টেজে এসে বসল। দুপাশে চারজন ছায়াসঙ্গী তার। নাহিদ কিন্তু আজ কনেপক্ষ নয়। একেবারে বরযাত্রীর মতো দাপট নিয়ে বন্ধুর সাথে সাথে এসেছে সে।
রাহাত তো পণ করেছে দুলাভাইয়ের হাতই ছাড়বে না। ওকে পাশে নিয়েই সোফায় বসল তীব্র। ফরসা ছেলেটা মুহুর্তে মিশে গেল শ্বেত রঙের সাথে।
রাহাত জিজ্ঞেস করল,

“ ভাইয়া জুস নিয়ে আসব?”
“ যাও।”
পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা ছুটল অমনি।
তীব্র দুহাতের তালু ঘষতে ঘষতে দেখল চারিপাশ। নিচ তলার কোনো এক ঘরেই রয়েছে পুষ্পিতা। সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামার ধকল না দিতেই এই সিদ্ধান্ত। মেয়েটাকে খুঁজতে গিয়েও তীব্রর বুকের সরব গতি বেড়ে গেল ফের। প্রকাণ্ড হলো ওই ঢিপঢিপের রেশ। অনুভূতির তরঙ্গচ্ছ্বাসের কী মাত্রাধিক আলোড়ন এসব।
কিছু সময় পর স্টেজে সালমা বেগম এলেন। সাথে খোরশেদও আছেন। তবে তাদের ছাপিয়েও তীব্রর চোখ পড়ল ওপাশের এক বৃদ্ধায়। মিথিলার দাদি লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে। আগের থেকে বুড়িয়ে যাওয়ায় একা একা চলাফেরা মুশকিল।
সালমা মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত বোলালেন। এই ছোঁয়ায় কোনো সংকোচ, কোনো দ্বিধা নেই আজ। হাসি হাসি মুখ করে বললেন,

“ তোমার মতো বড়ো মনের মানুষ আমি খুব কম দেখেছি তীব্র। দোয়া করি,আল্লাহ তোমাকে ভীষণ সুখে রাখুক!”
সে ফটাফট বলল,
“ সুখটা যেন আপনার মেয়ের সাথে হয়।”
উত্তর শুনে বুক ভরে গেল প্রৌঢ়ার। চোখ দুটো ছলছল করল আনন্দের তোড়ে৷ পরপর আংটির বাক্স নিয়ে বললেন,
“ নিন আম্মা, পরিয়ে দিন।”
আমেনার ভীতসন্ত্রস্ত চোখ নড়েচড়ে ওঠে।
“ আমি? আমি ক্যা? তোমরাই পরাও।”
খোরশেদ বললেন,
“ আহহা,তুমি গুরুজন তুমি পরাও না।”
আমেনার ভালো লাগছে না। তীব্র আজকে চুপটি করে ভদ্র বর সেজে রইলেও,সেদিনের কথা তার স্পষ্ট মনে আছে। কেমন ধমকে বলেছিল ,
“ এই বুড়ি চুপ।”
বৃদ্ধা দোনামনা করে আংটি ধরলেন। তীব্র নিজেই হাত বাড়ায়। স্বর্ণের আংটিটা নিমিষে গলে যায় তার লম্বা-খসখসে অনামিকাতে।
খোরশেদ বললেন,

“ তা, আমাদের ওপর আর কোনো রাগ নেই তো তোমার?”
তীব্র হেসে ফেলল। দুপাশে মাথা নাড়লেও, চাউনীতে দুষ্টুমি।
কয়েক বছর আগের কথা।
খোরশেদকে পেটাতে ও কিছু লোক ভাড়া করেছিল। বলেছিল, বাকি সব রেখে ডান হাত ভাঙতে। কাটায় কাটায় হুকুম তামিল করেছিল ওরা। ছ’মাসেরও বেশি সময় লেগেছে, খোরশেদের হাত ভালো হতে। সৌভাগ্য যে লোকটা ওসব জানে না। জানলে আজ হেসে হেসে এভাবে প্রশ্ন করতে পারতো!
জামশেদ সিকদারের বসার জায়গাটা এই নিয়ে আরেকবার ঝেড়ে দিলেন মামুন।
খুব গদগদ হয়ে বললেন,

“ বসুন, স্যার বসুন।”
“ ঠিক আছি আমি। আপনি ব্যস্ত হবেন না।”
“ তা বললে তো হয় না, স্যার। আপনি কত বড়ো মাপের মানুষ। আমার কপাল ভালো যে আপনার পায়ের ধুলো পড়েছে আমার চৌকাঠে। আপনার বসার জন্য কিন্তু এই জায়গাটা আমি আলাদা ভাবে বানিয়ে দিতে বলেছিলাম,স্যার। আপনি বসলে একটু শান্তি পেতাম মনে।”
জামশেদ ওপর ওপর গম্ভীর রইলেও,মনে মনে হাসলেন।
এক চোট দম ফেলে বসলেন চেয়ারে। হাফিজ পেছনেই দাঁড়িয়ে। বেচারার এক দণ্ড শান্তি নেই। একের পর এক কল আসছে ফোনে।

রিংটোনের শব্দে জামশেদের মাথা ধরে গেল। বিরক্ত হয়ে বললেন,
“ আহহা,সাইলেন্ট করতে পারছো না?”
এমনিতেই চারপাশে এত আওয়াজ! তার মধ্যে আবার তোমার ফোন।”
ছেলেটা মুখ গোঁজ করে জানাল,
“ কী করব স্যার বলুন! একেক মিডিয়া থেকে একেকবার ফোন করছে। মনে হয় বিয়ের ব্যাপারটা লিক করেছে কেউ।”

“ করবেই তো। এরকম একটা সরব এলাকায় খোলামেলা বিয়ে হলে কি ঢেকে রাখা যায় কখনো?
কিন্তু করারই বা কী আছে? তীব্র বারণ করেছে, শোনোনি?
আর ব্যাপারটা সত্যি, বউমার কথা মিডিয়া জানলে একেবারে রঙতামাশা শুরু করে দেবে। এসব ও চায় না। আমিও চাই না।
ঘরের ব্যাপার ঘরে থাকুক। বউ মা কষ্ট পেতে পারে। সেজন্যেই তো নিজেদের আত্মীয় ছাড়া বাড়তি কাউকে ডাকিনি।”
“ সে আমি বুঝেছি,স্যার। কিন্তু এখন এদের কী বলব?”
“ কিচ্ছু বলতে হবে না। ফোনটা সুইচড অফ করে যাও, তোমার ম্যাডামকে ডেকে আনো।”
“ জি।”
মাথা নুইয়ে চলে গেল হাফিজ। জামশেদ একটু হাত ছড়িয়ে আরাম করে বসলেন। কাঁধের দুপাশে দুজন দেহরক্ষী কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে। এর মাঝেই শরবত পাঠালেন খোরশেদ। গ্লাস হাতে দিয়ে সার্ভিস বয় ফিরে গেল আবার। চুমুক দিতে দিতে স্টেজে বসা ছেলের পানে দেখলেন জামশেদ। আজ সকালেই তীব্র শেভ করেছে। এতদিন বটগাছের ঝুড়ির মত লম্বা লম্বা চুল-দাঁড়িগুলো এখন ছোটো ছোটো, টিপটপ সাজানো।

তারওপর প্রথম বরের বেশ ছেলের। কী চমৎকার লাগছে না?
ভদ্রলোক তৃপ্ত চোখে হাসলেন ওকে দেখে।
আজকে মন্ত্রানলায়ে একটা বড়ো কাজ ছিল তার। সেটা বাতিল করে বিয়ের ডেট ফিক্সড করেছেন। তীব্র খুব জোরাজোরি করছিল এই দিনেই বিয়ের ডেট ফেলতে।
কেন কে জানে! কত যে তাড়াহুড়ো হলো তাতে!
ভাবনার মাঝেই আবার ফিরে এলেন মামুন। দুহাত জড়ো করে বললেন,
“ কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো, স্যার? সব ঠিকঠাক আছে? আমি কি আপনাদের মনের মতো আয়োজন করতে পেরেছি?”
জামশেদ হেসে বললেন,

“ জি। অনেক বেশিই করেছেন। এতটাও দরকার ছিল না। তবে খরচা যা হচ্ছে, মনে করে সব কিছুর একটা লিস্ট দেবেন আমাকে।”
মামুন জ্বিভ কেটে বললেন,
“ ছি! ছি! কী যে বলেন,স্যার! আমিতো যা করছি মন থেকেই। স্বেচ্ছায় বিয়ের সব দায়িত্ব নিয়েছি। বিট্টু ভাইয়ের জন্যে কিছু করতে পেরেও ভীষণ ভালো লাগছে।”
“ আপনি যতটুকু করেছেন যথেষ্ট। বাকিটা আমাকে করতে দিন। আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে, কিছু দায়িত্ব তো আমারো আছে।”
মামুন কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। ওদিক থেকে কেউ একটা ডাকায় বিদায় নিলেন ত্রস্ত। লুৎফা হাজির হলেন কিছু সময় পর।

“ ডাকছিলেন?”
ফিরে চাইলেন ভদ্রলোক।
“ হু? হ্যাঁ। কোথায় ছিলে?”
“ বউমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কী যে সুন্দর লাগছে জানেন! পুরো ঘর জ্বলছে রূপে। বলতেই হয়,আমাদের ছেলের কিন্তু পছন্দ আছে! ”
“ সেতো আছেই। এতটুকু মেয়ে! অথচ সেদিন বিয়ের সময় কত দামি একটা কথা বলেছিল শোনোনি? আমিতো কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়েছিলাম। দাঁড়িয়ে আছো কেন? বোসো।”
লুৎফা বসলেন। প্রসংশার ঝুড়ি মেলে বললেন,
“ মেয়ের খালা-খালুও অমায়িক মানুষ। এত মার্জিত ব্যবহার। সব মিলিয়ে ভালোই হয়েছে।”
জামশেদ শুধালেন,

“ তোমার খারাপ লাগেনি?”
“ খারাপ! কেন?”
“ এই যে মেয়ের একটা পা…”
পথিমধ্যেই থামালেন তিনি।
“ মেয়েটার জন্যে লেগেছে। তবে যদি জানতে চান,একমাত্র ছেলের বউ করতে খারাপ লাগছে কী না? তাহলে বলব, না। একটুও না। আমার কাছে আমার ছেলের ভালো থাকা সবার আগে। ওর কদিন আগের অবস্থা আপনার মনে নেই?
কিন্তু আজকে ওকে দেখেছেন? মুখের হাসিটা দেখেছেন? যে কোনো মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে দামি কিচ্ছু নেই। ওরা ওরা ভালো থাকলে আমার খারাপ লাগবেই বা কেন বলুন তো! তাছাড়া মেয়েটা মাশআল্লাহ এত মিষ্টি! এত বিনয়ী! গলার স্বর তো শোনাই যায় না কাছে না গেলে। বউমা আমার একেবারে মনের মতো।”
পরপরই স্বামীর দিকে ফিরলেন। সতর্ক গলায় শুধালেন,

“ আমার থেকে শুনতে চাইলেন যে,আপনার বুঝি এ নিয়ে খারাপ লেগেছিল?”
ভদ্রলোক ফোস করে শ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসলেন।
“ দেখো, মিথ্যে বলব না। একটু তো খারাপ লেগেছিলই। কিন্তু ঐ যে বললে সন্তান সবার আগে? আর তার থেকেও বড়ো কথা, আমার খারাপ লাগলেও বা কী? তোমার ছেলে আমাকে পাত্তা দেয়? কী বদনসিব আমার! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েও ঘরের ছেলের থেকে দু আনার দাম পাচ্ছি না। ”
লুৎফার হাসি পেলো। হাসলেনও ঠোঁট টিপে। তিনি বললেন,
“ ও হ্যাঁ, ভালো কথা! শুনলাম তোমার ছেলে ব্যাংক থেকে লোন তুলেছে। ”
“ হ্যাঁ। কালই বলল আমাকে। আসলে মামুন লোকটা তো আমাদের নিজের কেউ নন। এত বড়ো আয়োজন করছেন,একটু কেমন লাগছে না? ও চাইছে বিয়ের ব্যাপার-স্যাপার মিটে গেলে একেবারে কড়ায়-গণ্ডায় সব হিসেব করে শোধ করে দেবে।”

“ কত বছর লাগিয়ে দেবে শুনি? মাত্র কাজে জয়েন করল। যদিও গাজীপুরের থেকে ঢাকার ভার্সিটিতে বেতন ভালো। কিন্তু তাও! তারওপর আবার একটা ফ্ল্যাটের টাকা পাই আমি,সেটা নিয়ে তো আমাকে দিনে দশবার রিমাইণ্ডার দিচ্ছে। উঠতে-বসতে বলছে,
“ আপনি চিন্তা করবেন না,আপনার ফ্ল্যাটের টাকা আমি শোধ করে দেব।” যেন ওর টাকা না পেলে আমার কপালে ভাত জুটবে না।
মানে আমার জন্য জন্মাল,আর আমাকেই আত্মসম্মান দেখাচ্ছে? অথচ, সারাজীবন যে লোক পিটিয়ে, জবরদস্তি চাঁদা তুলে গুণ্ডামি করে বেড়াল তার বেলা? তার বেলা এসব সম্মান কোথায় ছিল?”

“ এভাবে বলবেন না। ছেলেটা কি আর আগের মতো আছে বলুন তো! কত বদলে গেছে এখন! খারাপ অতীত নিয়ে কাউকে খোঁচা দিতে নেই। আল্লাহ নারাজ হন।”
জামশেদ চোখ সরিয়ে আরেকবার তীব্রকে দেখলেন। পরপরই কণ্ঠ নামিয়ে বললেন,
“ শোনো, আমার একটা পরিকল্পনা আছে। ভাবছি ব্যাংকের টাকাটা আমি চুপিচুপি শোধ করে দেব। তীব্র মাসে মাসে যা পাঠাবে ওখানে? সেটা বরং ওর নামেই জমা হয়ে থাকল। পরে কোনো একটা অফারের ছুঁতো দেখিয়ে ওকে ফেরত দেওয়াবো নাহয়! সেদিন তো বলল,পুষ্পিতাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাবে। সে তো অনেক টাকার ব্যাপার!
এই টাকা তখন কাজে লাগবে। আমার থেকে যখন নেবেই না,তাহলে এভাবেই সাহায্য করি। তুমি কিন্তু আবার গিয়ে বলে দিও না।”
লুৎফা চুপ করে রইলেন। চোখে এক প্রস্থ জলের মাঝে ঠোঁট দুটো চকচক করছে হাসিতে। লোকটা এখন ছেলের জন্যে কত ভাবেন! কত চিন্তা তার!
জামশেদ অতশত বুঝলেন না। নিজের মতো বললেন,

“ এই যে বোরখা পরে আছো, গরম লাগছে না?”
“ অভ্যেস হয়ে গেছে। কত বছর ধরেই তো পরি।”
“ তাও। এসিটা বাড়াতে বলি।”
করলেনও তাই। কাউকে একটা হাঁক ছুড়লেন তাপমাত্রা নামাতে। তারপর বললেন,
“ খাওয়া দাওয়ার সময় কোথাও যেও না। ছেলেমেয়ে দুজনকে নিয়ে সবাই একসাথে বসব।”
লুৎফা নিরুত্তর। একইরকম চেয়ে রইলেন তখনও। জামশেদ অপ্রস্তুত হয়ে বললেন,
“ ইদানীং এমন হাঁ করে তাকাও কেন? হয়েছেটা কী?”
মনের কথাই বলে ফেললেন তিনি।

” তাকাব না? বদলে যাওয়া মানুষটাকে দেখেই তো এত অবাক হচ্ছি। ভাগ্যিস পুষ্পিতা আপনার ছেলের জীবনে এসেছিল। নাহলে শেষ বয়সে এসেও আপনাকে এভাবে কখনো পেতাম আমি?”
জামশেদ কপাল কুঁচকেও, হেসে ফেললেন।
স্ত্রীর হাতটা ধরে বললেন,
“ বদল নয় লুৎফা। সত্যিটা হলো,
তীব্র তো বিয়ের পর ওর বউ নিয়ে থাকবে। তাই আমি ভাবলাম,আমিও বরং এখন থেকে আমার বউ নিয়ে থাকি। আর শেষ বয়স বলে কিছু হয় না। তোমার শুরুটা আমি আনন্দের করতে পারিনি,কিন্তু বাকি জীবনটাতো করতেই পারি। তাই না?”
পুষ্পিতাকে পার্লার থেকে সাজানো হয়নি। সালমা বেগম ওসব একদম পছন্দ করেন না। তার মেয়ের রূপ এমনিই পড়ন্ত বিকেলের মতো সুন্দর। ওসব রঙচঙের কী দরকার? তবে ভারি বেনারসি পরাতে বেশ শ্রম দিয়েছেন ডলি বেগম। এক সময় তিনিও নিজের পার্লার সামলাতেন। মামুনের সাথে বিয়ের পর আর করা হয়নি। তবে হাতটা টুকিটাকি পাকা এখনও।

বিয়ে উপলক্ষে দু মিনিট দাঁড়াবার ফুরসত পাচ্ছেন না তিনি। ওদিকে খাওয়া দাওয়া শুরু হয়ে গেছে। এ নিয়ে আরেকবার ডাক পড়লে, ডলি ঘর ছাড়লেন দ্রুত।
ওপাশ হতে তখনই ঢুকল মিথিলা। হাতে এক থালা বিরিয়ানি। চপল পায়ে এসেই পুষ্পিতার সামনে বসল সে।
খুব চিন্তা নিয়ে বলল,
“ তুই সকাল থেকে কিচ্ছু খেলি না। একটু পর বিয়ে পড়াবে। সবার সামনে খেতে পারবি তখন? এখন দুটো খেয়ে নে তো।”
“ কিন্তু আমার তো খিদে নেই,আপু।”
মিথিলা চোখ পাঁকায়,
“ হাঁ কর তাড়াতাড়ি।”

পুষ্পিতা অনিচ্ছায় হাঁ করল। এত সাজগোজের তোপে মুখ খুলতেও কষ্ট। ঠোঁটের লিপস্টিকের চটচটে ভাবটাও শুকায়নি ভালো করে। তারওপর নাকে পরানো নথটায় কী ভার!
নূহা ওদের কাছেই বসে । ও আড়চোখে মিথিলাকে দেখল কিছু পল। অন্তঃসত্ত্বা সে! পাঁচ মাসের পেট বোঝা যায়। আগের হ্যাংলা শরীরটা এখন নেই। গালগুলো বেশ ফুলেছে। কী সুন্দর করে পরেছে শাড়িটা!
আঁচলখানা আবার গিন্নীদের মতো কোমর ঘুরিয়ে প্যাঁচানো।
ও মুচকি হাসল। সবার জীবনের মোড় কী আশ্চর্য রকম ঘুরে গেছে! কেউ কারো জন্য কোথাও পিছিয়ে নেই।
মিথিলা আচমকা তাকাল ওর দিকে। এমন চেয়ে থাকতে দেখে বলল,

“ খাবে নূহা? তুমিও তো মনে হয় তেমন কিছু খাওনি।”
প্রচণ্ড অবাক হলো নূহা। সেই নাহিদের সাথে ঝামেলার পর,মিথিলার সাথে ওর আজকে এমন মুখোমুখি দেখা। মাঝে হাসপাতালেও দেখা হয়েছিল,কিন্তু তখন পুষ্পিতার চিন্তায় কোনোদিকে খেয়াল ছিল না। মেয়েটা উত্তর দিতে থতমত খেল। নার্ভাসনেসে হাসল একটু।
“ না মানে আপু…”
“ আরে কীসের আপু? নাও নাও হাঁ করো।”
নূহা হাসল। পেটে খিদে নেই। কিন্তু ভীষণ ভালো লাগায় হাঁ করল তাও। খেতে খেতে বলল,
“ দুলাভাইয়ের সাথে আমাদের আলাপ করাবে না?”
“ এলোই একটু আগে। এত ব্যস্ত না! এসেই বাবার সাথে ছোটাছুটিতে নেমেছে। একটু ফ্রি হোক,নিশ্চয়ই আলাপ করাব।”

“ শুনলাম তোমাদের লাভ ম্যারেজ! আগে কে প্রপোজ করেছিল?”
মিথিলার ভাতে মাখা হাতটা থামল। চাইল চোখ তুলে। মৃদূ হেসে বলল,
“ ওই করেছিল। তবে প্রেমের প্রস্তাব নয়,সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল আমাকে। আমাদের কম্পিউটার ক্লাসে আলাপ ।
এত ভালো না মানুষটা! বড্ড সরল জানো। একটা সত্যি কথা বলব, নূহা? ওর সরলতা দেখেই হয়ত প্রস্তাবে আমি রাজি হয়েছিলাম। ওর হাবভাবে কারো সাথে ভীষণ মিল পেয়েছিলাম তো,তাই। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো, আমি কার কথা বলছি?”
নূহা একা নয়,পুষ্পিতা নিজেও বুঝেছে। কিন্তু মেয়েটা বরাবরের মতো,আজকেও এ নিয়ে টু শব্দ করল না।
নূহা বলল,

“ আসলে সরল মানুষগুলো এমনই হয়, আপু। ভালোবাসার জাল ফেলে খুব চমৎকার দক্ষতায় প্যাঁচিয়ে নেয় এরা।
এই যে আমি, আপনি সবাই কেমন চোখের পলকে ফেঁসে গেলাম! তবে আমাদের থেকেও বড়ো উদাহরণ হলো তীব্র ভাইয়া। পুষ্পিতাকে ভালোবেসে, কিভাবে বাড্ডার মাস্তান থেকে লেকচারার বনে গিয়েছিল, মনে নেই?”
মিথিলা বলল,
“ আর বোলো না! আমি ওনাকে যা ভয় পেতাম! ভয় কিন্তু এখনো কাটেনি। শ্বশুর বাড়ির সবার সঙ্গে মা তার নতুন জামাইয়ের গল্প করেছে। এরপর থেকেই সবাই এত পাকড়াও করছে আমাকে ওনার সাথে আলাপ করাতে। আমিতো ভয়েও ধারেকাছে যাচ্ছি না!
আবার সেদিন বান্দরবান থেকে পুষ্পিতাকে ওভাবে তুলে এনে বিয়ে করে ফেলায়? ফারজানা আন্টি, শাহেদ ভাই সবাই একটুর জন্যে বিস্ময়ে অজ্ঞান হয়ে যায়নি। সত্যি রে পুষ্পিতা, চার আঙুল কপালে তোর আট আঙুলই সৌভাগ্য।”

পুষ্পিতা মুচকি হেসে বলল,
“ সেজন্যেই তো তোমার কাছে আমার অনেক ঋণ, আপু।”
ও কপাল গোছাল। বুঝতে না পেরে বলল,
“ আমার কাছে? কেন?”
“ বা রে! ঐদিন যদি তুমি আমাকে বাড়ির পেছনে না পাঠাতে,ওনাকে আমি পেতাম কখনো?”
মিথিলা শব্দ করে হেসে উঠল। নূহাও হাসল তাল মিলিয়ে। কিন্তু পুষ্পিতার কাছে এটা সূর্যের মতো সত্যি কথা।
যা কোনোদিন মিথ্যে হবার নয়। সত্যিই তো, যদি ও মিথিলার বিয়ের দিন বাড়ির পেছনে গিয়ে না দাঁড়াত, যদি ভুল করে মিরাজরা ওকে তুলে নিয়ে না যেত, এই মানুষটাকে ও পেতো কী করে?
নিঃস্ব-রিক্ত পুষ্পিতা ইহজীবনে এমন পূর্ণ হোতো পারতো কখনো!

স্টেজ জুড়ে নিরন্তর আড্ডা চলছে। নাহিদ, আরমান মিরাজ মুশফিক, প্রত্যেকে দুষ্টুমিতে মেতে।
হঠাৎ,নাহিদ খেয়াল করল তীব্র মোড়াচ্ছে। এক পল স্থির নেই চোখ দুটো। স্বস্তিতে যেন শ্বাসও ফেলতে পারছে না।
বিষয়টা হয়ত বুঝল সে। বিয়ে করার অভিজ্ঞতা আছে কী না!
ওইপাশ থেকে উঠে এসে বসলো কাছে। প্রস্তাব ছুড়ল ফিসফিস করে,
“ পুষ্পিতাকে দেখবি?”
তীব্র সতর্ক চোখে চাইল,
“ কীভাবে?”
নাহিদ দ্রুত হাতে ফোন বের করল। হোয়াটসঅ্যাপ খুলতেই দেখা মিলল পুষ্পিতার। লাল টুকটুকে বেনারসিতে জ্বলজ্যান্ত পুতুল সেজেছে সে।
ও বলল,

“ নূহা তোকে দেখাতে মানা করেছিল। তাও দেখালাম। বন্ধু বলে এটুকু মায়া করছি নে!”
তীব্র নিলো না। নাহিদের হাতে থাকা অবস্থায় একবার দেখল কোনোরকম। তারপর ঠেলে দিয়ে বলল,
“ সরা, দেখব না।”
নাহিদ যেন আকাশ থেকে পড়ল। এই প্রতিক্রিয়া আশা করেনি সে। তীব্র, পুষ্পিতা অন্তঃপ্রাণ। পাগল এক কথায়। ও তো ভেবেছিল দেখামাত্র ড্যাবড্যাব করে থাকবে।
কত সুন্দর লাগছে পুষ্পিতা কে! তাহলে এমন করল কেন?
আচমকা তীব্র উঠে দাঁড়াল।
নাহিদ শুধায়,
“ কই যাস?”
মাথা থেকে পাগড়ীটা খুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিলো সে। বলল ব্যস্ত গলায়,
“ আসছি।”
ঘরের ভেতর হতে এক ঝাঁক তরুণীর খিলখিলে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। কত কথা! কত গল্প তাদের!
তক্ষুনি খোলা দরজার কাঠে আঙুলের উল্টোপাশ তুলে টোকা দিলো কেউ একজন। হাসি থামল,এক যোগে ফিরে চাইল সবাই।

তীব্রকে দেখেই পুষ্পিতার কলিজা ছলাৎ করে উঠল। বুকের একটা সুনিশ্চিত কম্পন হারাল সুদূরে। ভেতরটায় সুর জাগানো অনুভূতি ঠেসে তৎপর চোখ সরাল সে।
তীব্রকে এখানে কেউ আশা করেনি। নূহা অবাক হয়ে বলল,
“ ভাইয়া, আপনি?
কিছু বলবেন?”
তীব্রর চোখ পুষ্পিতার দিকে। ঠোঁটে এক ফোঁটাও হাসি নেই। ভীষণ থমথমে গলায় জানাল,
“ পুষ্পিতার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
তীব্র সিরিয়াস কিছু না হলে নাম ধরে ডাকে না। পুষ্পিতা ত্বরিত ফিরল,ঘাবড়ে গেল। নূহার দশাও তাই। আজকের মতো আনন্দঘন দিনের সঙ্গে, তীব্রর মুখের কোনো মিল নেই। এক পল বন্ধু আর মিথিলার সাথে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল,

“ কিছু কি হয়েছে?”
তীব্রর উত্তর তৈরি,
“ অনেক কিছু হয়েছে। যেটা আমি শুধু ওকেই বলতে চাচ্ছি। তোমরা বাইরে যাও।”
“ কিন্তু…”
“ এত কথার তো দরকার নেই। যাও।”
তীব্রর তপ্ত চোখমুখ দেখে ভয় পেলো মেয়েটা। দুরুদুরু বুক নিয়ে পুষ্পিতাকে দেখল আবার। কী হলো কে জানে! এত কসরতের পর দুজন এক হয়েছে,ফের ঝামেলা হয়নি তো?
নূহা আর কথা বাড়াল না। বাড়িয়ে লাভও নেই। তীব্র জবাব দেবে না নিশ্চিত। ভেতরে
যে কজন ছিল,সবাইকে নিয়ে বের হলো চুপচাপ। পুষ্পিতার অবস্থা শোচনীয়। মুখটা ফ্যাকাশে।
শঙ্কায় হাবুডুবু খেয়ে বলল,
“ কী হয়েছে? আমি কি কিছু করেছি? আপনি কি আমার ওপর রেগে আছেন?”

তীব্র কোনো জবাবও দিলো না। দরজার ছিটকিনি টানল ব্যস্ত হাতে। গম্ভীর মুখে ঘুরে,এগিয়ে এলো কাছে। পুষ্পিতার গলা শুকিয়ে কাঠ। ও নির্ঘাত কিছু একটা করেছে। তীব্র কষ্ট পেয়েছে বোধ হয়। গতকাল ঘুমের মধ্যে মানুষটা কল করেছিল,ও ধরতে পারেনি। সে নিয়েই কী! নাকি সকালে বলেছিল সেজেগুজে সবার আগে ওকে ছবি পাঠাতে। ওর তো ফোন হাতের কাছে নেই বলে পাঠাতে পারেনি। কী নিয়ে রাগ করল মানুষটা? মেয়েটা আতঙ্কে
জবুথবু যখন,
তীব্র ঠিক সামনে এসে বসল। ঘনঘন ঢোক গিলতে থাকা পুতুল বউয়ের দিকে বাক্য ছুড়ল আচমকা,
“ একটা চুমু খাই তোমাকে?”
পুষ্পিতা ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। তিরতির করা ঠোঁটযুগল হাঁ হলো দুই প্রান্তে এসে।
হতভম্ব আওড়াল,

“ এ্যা?”
তীব্রর কণ্ঠ ছটফটে,
“ প্লিজ!”
“ আপনি এইজন্যে এসেছেন? তাহলে অমন…”
তার সংকোচহীন উত্তর,
“ এসব তো ওদের তাড়াতাড়ি বের করতে করেছি। দুটো দিন এই বিয়ের চক্করে তোমার ধারেকাছে আমাকে ঠিকঠাক আসতে দেয়নি। কিন্তু ছবি দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। একটা চুমু খাব,অল্প একটু!
আজকেরটাতে ঠোঁট কাটবে না। প্রমিস!”
পুষ্পিতার বিস্ময় তখনো কাটেনি।
“ আপনি কি পাগল? আর কিছুক্ষণ পরেই তো বিয়ে।”
“ এত কথা বোলো না ভীতু মেয়ে! যত কথা বলবে অত দেরি।”
পুষ্পিতা কিছু বলতেই পারল না। কালচে ওষ্ঠপুট কেমন তেড়ে এসেই বসে গেল ঠোঁটে।
ঠিক দু মিনিট!

তীব্র সরে এলো। পুষ্পিতার নথ খুলে ঝুলছে গালে। সেটা তুলে আবার আটকে দিলো ও। হতবাক চেয়ে থাকা মেয়েটার নাকে টোকা দিয়ে বলল,
“ থ্যাংক ইউ! বাট স্ট্রবেরি ওয়াজ ফার বেটার দ্যান ইট।”
পরপরই স্বর নামিয়ে বলল,
“ ব্যাপার না। রাতে পুষিয়ে নেবো।”
পুষ্পিতা হতচেতন! ভড়কানো ভাব কাটেনি ঠিক করে। দোর খুলে চলে যাওয়া শরীরটার দিকে স্তম্ভিত চেয়ে রইল সে।
তুরন্ত হুড়মুড়িয়ে ঘরে এলো নূহা। সাথে মিথিলাও আছে।
অস্থির চিত্তে বলল,

“ কী হয়েছে রে? ভাইয়া কী বললেন?”
পুষ্পিতা মাথা নোয়াল। লজ্জার বানে রুদ্ধ স্বর। শুধু এপাশ ওপাশ ঘাড় নেড়ে বোঝাল,
“ কিছু না।”
“ কিছু না? তাহলে এলেন কেন?”
পুষ্পিতা বসে বসে হাঁসফাঁস করল নীরবে। উত্তর তার কাছে নেই।
বেশি বেগ পোহাতে হয়নি,তাকে নিস্তার দিতে আয়েশা চৌকাঠে এলেন। ঘোষণা করলেন তাড়াহুড়ো করে,
“ কাজী সাহেব আসছেন।”
পুষ্পিতা অশান্ত মন জোর করে শান্ত করতে চাইল। এখনও হাত-পা কাঁপছে। কত বছর পর তীব্রর এত প্রগাঢ় স্পর্শ পেলো আজ! এই কাঁপুনি সামলাতে গিয়ে না শেষ হয় ও!
সেই একই কাজী ঢুকলেন ঘরে। আজ চেহারায় ভয় নেই। হেলেদুলে,বুক চিতিয়ে এসে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
“ আজও কি কাবিন সব থেকে কম নেবে? না কি আজকেও বরের নাম লিখে দেব?” সবাই হেসে ফেলল। সালমা বললেন,
“ যেখানে আত্মার বন্ধন এত গাঢ়! যে সম্পর্কে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার রহমত আছে,সেখানে কাবিন একটা হলেই হোলো। আপনি কমই লিখুন। এ নিয়ে আমাদের কোনো চাওয়া নেই।”
“ বেশ বেশ।”
দ্বিতীয় বার বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। আজকের বিয়ে শুধুই আনুষ্ঠানিকতা, সমাজকে জানানো,আর মেয়ের অভিভাবক থাকার হেতুতে।

হৃদয় দিয়ে যারা বহু আগেই কাছাকাছি, তাদের নতুন করে আবার কাছে আনার কী আছে!
সময় কাটল। খাওয়া-দাওয়ার বিস্তর পাঠ চোকানো শেষে,এবার বর-বউকে সমসঙ্গে বসানোর পালা।
পেছনে এক ঝাঁক মানুষ সমেত, তীব্র পা ফেলল ঘরে।
এসে বসল, ঠিক পুষ্পিতার ডান পাশটায়। তুখোড় সুগন্ধির প্রখর ঘ্রাণে, মেয়েটা ত্রস্ত বেনারসি চেপে ধরল মুঠোতে। সেদিন বিয়েতেও তার অনুভূতি ছিল। নতুন শিহরণ ছিল রন্ধ্রের ভাঁজে। কিন্তু ওসবের মাত্রা এত প্রগাঢ় হয়নি তো!
তক্ষুনি, কোত্থেকে একটা বড়ো আয়না নিয়ে হাজির হলো নূহা। বর-বউয়ের সামনে ধরতেই, মাথা দুটো কেউ একজন পাতলা কাপড়ে ঢেকে দিলো ওদের। পুষ্পিতা পাশ ফিরল তখন। তীব্র আগেই চেয়ে। চোখাচোখি হলো,দুম করে চোখ টিপল সে। পুষ্পিতার বুক ছলকায়,লজ্জা পায় । দৃষ্টি ফিরিয়ে আরশিতে নিয়ে আসে সহসা।
নূহা জিজ্ঞেস করল,

“ বলুন তো ভাইয়া,আয়নায় কাকে দেখতে পাচ্ছেন?”
ওপাশ থেকে নাহিদ বলল,
“ আগে বিট্টু কেন বলবে? লেডিস ফার্স্ট! আগে আমরা আমাদের ভাবির মুখে শুনব। বলুন ভাবি,আপনি কাকে দেখতে পাচ্ছেন?”
পুষ্পিতা এমনিই লজ্জায় কাবু। এত মানুষ এখানে! যদিও গুরুজন কেউ নেই। কিন্তু তাও…
মেয়েটা ঠোঁট টিপে রাখল। নূহা তাগিদ দেয়,
“ কী রে বল! আমাদের মতো ভাইয়াও কিন্তু অপেক্ষা করছে।”
পুষ্পিতা চোখের কোনা তুলে দেখতে চাইল তাকে। বিধিবাম! চোরা নজর পৌঁছালোই না।
মাথা নামিয়ে মিহি কণ্ঠ ছোটাল,

“ আমার দেখা সব চেয়ে সুদর্শন পুরুষকে।”
অমনি ঘরময় হাত তালি পড়ল। পেছনে বসে মিরাজরা টেনে টেনে বলল,
“ ওয় হোয়! সুদর্শন পুরুউউউউষ!”
রাহাত অধৈর্য। বলল ছটফটে গলায়,
“ এবার, এবার বিট্টু ভাইয়া বলবে!”
মিথিলা চোখ পাঁকিয়ে বলল,
“ অ্যাই! তুই এখানে কী করছিস? বলেছি না এখানে ছোটোদের আসতে নেই?”
ও ঠোঁট উলটে বলল,

“ আমি কী আর ছোটো আছি? আমি তো এখন তোমার থেকেও লম্বা।”
সৌরভ তাল মেলাল সাথে।
“ ঠিক কথা । শালাবাবু এখন কলেজে উঠবে। আর তুমি তাকে বাচ্চা বানিয়ে দিচ্ছো মিথিলা? এইত দুদিন,তারপর সেও তো বউ নিয়ে বসবে স্টেজে। সিনিয়রদের দেখে দেখে শিখে রাখতে হবে না?”
রাহাতের যুক্তি পছন্দ হলো। উদ্বেজনায় হাইফাইভ করল দুলাভাইয়ের সাথে। মিথিলা মুখ বাঁকায়।
নূহা একবার নাহিদকে দেখল,একবার ওকে। একটা সময় এরা দুজন দুজনকে ভালোবাসতো। অথচ আজ,ভাগ্যের চালে কে কোথায় গিয়ে পড়েছে!
নাহিদ বড্ড স্বাভাবিক। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, মিথিলাকে চেনেই না। এখন অবধি একবার তাকাতেও দেখেনি।
ও ছোট্ট করে শ্বাস ঝাড়ল। পরপর ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,

“ ভাইয়া এবার আপনার পালা। বলুন,আয়নায় কাকে দেখতে পাচ্ছেন!”
পুষ্পিতার মতো তীব্রর এত সময় লাগেনি। সে ঝট করে বলে দিলো,
“ আমার বউকে। পৃথিবীর হাজার-কোটি মানুষের মধ্যে, যার ওপর শুধু আমার একার অধিকার।”
পুষ্পিতার বুক জুড়াল। শ্বেত কপোলে কুণ্ঠার ধারা। হাত তালির শব্দ এবারে চড়াও হলো বেড়ে। তীব্রর উত্তরে বন্ধুদের উচ্ছ্বাসও বাড়ল আরেকটু ।
মুশফিক তো বলেই ফেলল,
“ আমিও বিয়ে করব। বউকে দেখে এভাবে বলব। কেউ আমাকে বিয়ে দাও, প্লিজ!”
ঘরময় এক চোট হাসাহাসির মাঝে আচমকা ছুটে এলেন সালমা। হইহই করে জানালেন,
“ পুষ্পিতা, ফারজানা এসেছে।”

মেয়েটা উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ কোথায়?”
এর মাঝেই ঢুকলেন ফারজানা। একা নন,শাহেদও এসেছে। ত্রস্ত পায়ে এগিয়েই পুষ্পিতাকে জড়িয়ে ধরলেন রমণী। বুকের সাথে বসে থাকা পুষ্পিতাকে শক্ত করে চেপে রেখে চুমু খেলেন মাথায় । মুখটা তুলে বললেন,
“ কেমন আছো এখন?”
“ ভালো। আসতে এত দেরি করলেন কেন?”
“ পথে গাড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি তো ভাবলাম এসে বিয়েই পাব না। যাক,দেখে শান্তি লাগল যে অনুষ্ঠান এখনো হচ্ছে।”
তারপর তীব্রর দিকে চাইলেন তিনি। কপাল কুঁচকে বললেন,

“ তুমিই বুঝি সেই গুণ্ডা বর,যে আমার বাড়ির উঠোন থেকে আমাদের মেয়েকে তুলে এনেছ?”
তীব্র মৃদূ হেসে সালাম দিলো। ভদ্রমহিলা খুশি হয়ে বললেন,
“ ওয়ালাইকুমুস সালাম। এতদিন ছবি দেখেছি,আজ সামনে থেকে দেখলাম। মাশআল্লাহ, একেবারে রাজপুত্র!”
পুষ্পিতার নজর পড়ল ফারজানার পেছনে। বিশাল ফুলের বুকেই হাতে দাঁড়িয়ে শাহেদ। চোখেমুখে প্রকট দ্বিধাদ্বন্দ্ব!
মেয়েটা স্ফুর্ত কণ্ঠে শুধাল,
“ কেমন আছেন, স্যার? ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন।”

শাহেদ একটু অবাক হয়। গলা ঝেড়ে, হেঁটে আসার মাঝে পুষ্পিতার ঠোঁট ভরতি হাসিটা মন দিয়ে দেখে। দু বছরে কখনো ওকে এমন হাসতে দেখেনি তো। হু-হা ছাড়া জবাব না দেয়া মেয়েটা কী প্রফুল্ল আজ!
দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েটাকে দেখছে শাহেদ।
ভালোবাসায় সত্যিই এত জোর? যার বিরহে মানুষ শোকে নিঃশেষ হয়,তাকে পেলেই আবার হাসতে পারে?
ও এসে বুকেইটা পুষ্পিতার হাতে দিয়ে বলল,
“ কংগ্রাচুলেশনস!”
পুষ্পিতার হাসির অন্ত নেই। ওভাবেই বলল,
“ ধন্যবাদ।”
তারপর তীব্রর দিকে হাতটা বাড়াল সে।
“ আমি শাহেদ আহমেদ। বান্দরবান **** স্কুলের শিক্ষক।”
হেসে সেই হাত ধরল তীব্র।
কিন্তু শাহেদকে তার একটুও ভালো লাগেনি। পুষ্পিতার দিকে এমন করে তাকাচ্ছিল কেন? তার বউয়ের দিকে শুধু সে তাকাবে। আর কেউ না!

সাদা হাফ হাতা শার্টের ওপর কালো রঙের লম্বা দাগ টানা। পরনের পাজামাটাও একই নকশায় তৈরি। স্বল্প মেকি অন্ধকার মাখা ছোট্ট একটা ঘর!
ভেতরের এক কোনায় বসে থাকা
কালো বর্ণের ছেলেটা হাঁটুতে মুখ গুঁজে রইল। খাবার সময় হয়েছে এদিকে। মাঝে একবার ডেকে গেলেন হাবিলদার। রুক্ষ ভাষায় বললেন,
“ খাবার দিচ্ছে,উঠছিস না কেন?”
হাতের লাঠিটা দিয়ে লোহার শিকে দু চারটে বাড়ি দিয়ে মনোযোগ চাইলেও,বিশেষ লাভ হয়নি। ঠায় বসে থাকা ছেলেটা নড়ল না এক চুল।
শেষে মেজাজ খারাপ করে চলে গেলেন ভদ্রলোক। কিছু সময় কাটল তারপর। আচমকা আরেকটি প্রশস্ত, চওড়া দেহের দেখা মিলল সেথায় । গারদের এপাশ থেকে ডাকল,

“ শাফিন!”
খুব চেনা কণ্ঠ! ত্রস্ত মাথা তুলল শাফিন। তীব্রকে দেখে চমকাল,হকচকাল তার নিভন্ত চোখ। ত্বরিত উঠে এলো ছেলেটা।
খুশিতে হড়বড় করে বলল,
“ বিট্টু তুই এসেছিস? আমি জানতাম,জানতাম তুই আসবি। আমাকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছিস তাই না?
আমি না এখানে আর থাকতে পারছি না। দ্যাখ না,কতগুলো মিথ্যে মামলায় আমাকে দশ বছরের জেল দিয়ে দিয়েছে।
আমি কিছু করিনি বিট্টু। আমাকে নিয়ে যা ভাই,প্লিজ নিয়ে যা।”
তীব্র নিশ্চুপ,নিরুত্তর। শাফিনের চোখের তলায় কালি জমেছে। বেশভূষা ঠিক নেই। বোঝাই যাচ্ছে এখানে কতটা দুঃসহ দশায় সে।
হঠাৎ ওর নজর পড়ল তীব্রর পোশাক-আশাকে। সেবার দেখে আসা অগোছালো,অবিন্যস্ত বন্ধুটাতো নেই। পরিপাটি মুখস্রী, গায়ে চাপানো শেরওয়ানী দেখে অবাক হলো শাফিন।
কৌতূহলে একশা হয়ে বলল,

“ তোর কি বিয়ে, বিট্টু?!
উত্তর এলো সহসা,
“ হ্যাঁ।”
শাফিন থমকাল তাতে। পুষ্পিতাকে ছেড়ে তীব্র এগিয়ে গেছে? দু বছরেও যা হলো না,দু সপ্তাহে হলো কী করে?
তীব্র নিজেই বলল,
“ কার সাথে জানিস?”
শাফিনের চোখে প্রশ্ন। অল্প আওয়াজে শুধাল,
“ কার?”
“ পুষ্পিতা।”
ওর চোখ বেরিয়ে আসে। কণ্ঠ শৃঙ্গে তুলে বলে,
“ কী?”
তীব্র বুকে হাত গুঁজে দাঁড়াল। মুখায়বে আত্মগরিমা জ্বলজ্বল করছে । তেমনই সুদৃঢ় তার কণ্ঠস্বর,

“ তুই আমাদের আলাদা করতে চেয়েছিলি না? অথচ দ্যাখ, কিচ্ছু হলো না।
আসলে এটাই ভালোবাসা। এখানে খাদ না থাকলে, আল্লাহ ছাড়া আলাদা করার ক্ষমতা কারোর নেই,শাফিন। আমার পুষ্পিতাকে আমি ঠিক খুঁজে নিয়েছি।”
শাফিন উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ কিন্তু আমি তো তার জন্যে অনুতপ্ত। আমি ক্ষমাও চেয়েছি তোর পা ধরে। তুই তো বলেছিলি আমাকে মাফ করে দিয়েছিস।
এখন তাহলে আমাকে নিয়ে যা না,বিট্টু। তুই একবার আঙ্কেলকে বললে…”
তীব্র হুট করেই মুখ শক্ত করল। জ্বলন্ত আগুন ঠিকড়ে দিলো দৃষ্টিতে ,

“ না।
মাফ তোকে আমি আমার জন্যে করেছিলাম। ভেবেছিলাম তোর এই ছেলেমানুষি চক্রান্তটায় শুধু আমি ভুগছি। কিন্তু তোর জন্যে আমার ভীতু মেয়ের যা ক্ষতি হয়েছে শাফিন, তার সব আমি এবার কড়ায়-গণ্ডায় উসুল করে নেব।”
শাফিন বুঝতে না পেরে বলল,
“ কী করেছি আমি? পুষ্পি…”
পথিমধ্যেই ঠোঁটে আঙুল চাপল ও। নেত্রমণিতে উষ্ণতার ঝড় তুলে বলল,
“ শশশশ। তোর অপবিত্র মুখে আমার স্ত্রীর নাম নিবি না। ”
“ বিট্টু!”
তীব্রর দুপাশের চিবুক মটমট করল ঠোঁট নাড়াতে গিয়ে। ভীষণ ক্রোধে চৌচির হয়ে বলল,
“ তোর একটা অন্যায়ে আমার জীবনের দুটো বছর নষ্ট হয়ে গেছিল। তাও আমি তোকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম, শাফিন। কিন্তু, তুই আমার ভীতু মেয়ের সাথে যা করেছিস! তোর জন্যে ও যতটা যন্ত্রনা পেয়েছে, যা হারিয়েছে, শুকরিয়া কর তোর আর আমার মাঝে এই লোহার শিকগুলো আছে। নাহলে আজ, আজ তুই এক্ষুনি আমার হাতে খুন হতি। ফর শিয়র!”
একটু থেমে বলল,

“ আমি নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব,তুই যাতে কোনোদিন থানা থেকে বের হতে না পারিস। এটা আমার নিজের কাছে নিজেকে করা প্রতিজ্ঞা।”
“ ভাই এভাবে বলিস না। আমি,আমি… “
তীব্র কথা শেষ করতে দিলো না।
হুঙ্কার ছুড়ল দরাজ স্বরে,
“ তোর প্রত্যেকটা দিন কাটবে অনুশোচনায় শাফিন। প্রতিটা মুহুর্ত তুই হাহাকারে ভুগবি। মাদক সেবন,বিক্রি,ইভটিজিং আরো অনেকগুলো মামলা খেয়েছিস শুনলাম!
এবার তোর ওপর আমি এটেম্প টু মার্ডার কেসও করব। রাজসাক্ষী হব নিজে। এক কথায় বলতে পারিস,এখান থেকে তোর বের হওয়ার কোনো সুযোগই আমি রাখব না। যদি ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়েও যাস,সেটা তোর জন্যে আরো বড়ো দূর্ভাগ্যের হয়ে দাঁড়াবে।

তোর শাস্তি,তিল তিল করা কষ্টই হবে বিয়ের দিন আমার স্ত্রীকে দেয়া আমার উপহার। তীব্র রেজা তালুকদার কখনো প্রেম আর প্রতিশোধ ফেলে রাখে না।”
কথা শেষ করে, ঘুরে হাঁটা ধরল সে। শাফিনের চোখে অন্ধকার নেমে আসে। এতদিন অন্তত আশায় ছিল তীব্র জানলে ঠিক একটা ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এখন তো তাও শেষ।
উদ্ভ্রান্তের ন্যায় পিছু ডাকল সে,
“ বিট্টূ যাস না। আমাকে ফেলে যাস না, বিট্টু। আমার ভুল হয়ে গেছে! মস্ত বড়ো ভুল করে ফেলেছি আমি।”
তীব্র শুনল হয়ত। কিন্তু দর্পের গতি থামেনি। অনুতাপে হাহুতাশ করে শিকের গায়ে মাথা ঠুকল শাফিন। চোখের ব্যকুল বর্ষায় ভিজে গেল বুক । কিন্তু আজকের এই কান্নার কোনো সুরাহা নেই। কেউ নেই তার অপরাধের পাশে। এজন্যেই হয়ত বলে,
“ ভাবিয়া করিও কাজ,করিয়া ভাবিও না।”

নতুন করে বিয়ে পড়ানোর পরপরই বাতাসে খবর ছুটে বেড়াল, তীব্রকে পাওয়া যাচ্ছে না। অমন বেশভূষাতেই কোথাও একটা উধাও হয়ে গেছে। বন্ধুরা ফোন করল। বাবা করলেন। পুষ্পিতা ফোন করল,ম্যাসেজ পাঠাল। কিছুতেই কোনো লাভ হয়নি!
পাক্কা দেড় ঘন্টা পর তাকে দেখেই যেন প্রান ফিরল জামশেদের। চৌকাঠেই ছুটে গেলেন তিনি।
“ কোথায় গিয়েছিলে?”
“ থানায়।”
জামশেদ থমকালেন।
“ শাফিনের সাথে দেখা করতে?”
“ হ্যাঁ।”
ভদ্রলোকের চেহারায় চিন্তা দেখা গেল। ফিচেল গলায় শুধালেন,
“ কেন জানতে পারি?”
উনি ভেবেছিলেন,বন্ধুর বেলায় তীব্র ফের উদারতা দেখাবে। হয়ত বলবে, ওকে ছাড়িয়ে দেয়ার কথা।
অথচ সে বলল,

“ ও যেন কোনোদিন থানা থেকে ছাড়া না পায়,সেটা এনশিয়র করতে।”
তারপর দীর্ঘ পায়ে চলে গেল সামনে। জামশেদ অবাক হলেন। পরপরই ভীষণ স্বস্তিতে বুকটা লুটোপুটি খেল। ক্রুর হেসে ভাবলেন,
“ এত মারাত্মক মারাত্মক কেসে ফাঁসানো হয়েছে, জামিন নাকচ হতে বাধ্য। তুমি চিন্তা করো না মাই সন,যে তোমাকে ভুগিয়েছে? দূর্ভোগ এখন তার পোহানোর পালা।”

বিয়ে বাড়ি এখন মোটামুটি শান্ত। আজকের রাত সবাই এখানেই থাকবে। একেবারে কাল বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবে তীব্র। তাই ওদের প্রথম রাতের আয়োজন করা হয়েছে সেখানে,যেখানে ভাড়া থাকতেন সালমারা। সুন্দর ঘরটা ফুলেল বসন্ত ঢেলে দিয়ে লোক দিয়ে সাজিয়েছেন মামুন। ডলি নিজে করেছেন তদারকি। সকলের আশ্চর্য বদল দেখে সালমা,নূহা দুজনেই প্রসন্ন খুব। ওইদিন পুষ্পিতাকে করা অপমানগুলো এখনো সবার পরিষ্কার মনে আছে। সেদিন যে মেয়েকে এক ঘর লোকের সামনে চরিত্রহীন বলেছিলেন ডলি,আজ তার বিয়ের সমস্ত কাজ তিনি নিজ হাতে করছেন।

নূহা এমন দৃশ্য দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি। ফটাফট ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলল কিছু।
অন্যদিকে মিরাজরা ঘোঁট পাকাতে ব্যস্ত। বিস্তর পরিকল্পনা করেছে সবাই মিলে। তীব্র বাসর ঘরে ঢোকার আগেই তারা পাকড়াও করবে। দরকার পড়লে টাকা আদায়ের লক্ষে মিছিল নিয়ে দাঁড়াবে।
গুণে গুণে কড়কড়ে নোট পকেট হতে না খসাতে পারলে, বাসর-টাসর বাদ।
মুশফিক বলল,
“ কত চাইলে ভালো হয় বলতো?”
আরমান বলল,
“ আরে,চাইব যত খুশি। বউয়ের কাছে যাওয়ার জন্যে বিট্টু জানও দিয়ে দেবে।”
মিরাজ কেমন খ্যাক করে বলল,
“ ওর জান নিয়ে কোলে বসিয়ে রাখব?
কত টাকা চাইলে ঠিকঠাক হবে ভাব।”
নাহিদ মাথা চুলকে বলল,

“ আমি বলছিলাম কী,এসব না করলে হয় না? বেচারা প্রথম বার বিয়ে করল,রাত প্রায় একটা বাজে। এখন আবার এসব! আমার টায়ার্ড লাগছে।”
“ এই তুই চুপ কর। গোরুটা আর ভালো হলো না। খুব বুঝি আমরা,টায়ার্ড না কী! বল যে মেশিনে চাপ পড়েছে। ঘরে যাওয়া জরুরি।”
ছেলেটা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“ আবার! তুই… ”
কথার মাঝেই তীব্র এসে দাঁড়াল।
ওকে দেখে শশব্যস্ত থামল সবাই।
“ কোথায় গিয়েছিলি বিট্টু? সবাই কত ফোন করলাম!”
“ কাজ ছিল একটা। তোরা এখানে কী করছিস?”
আরমান বলল,
“ আমরা তো ওই এই ওই গল্প করছিলাম।”
তীব্র এসে
মুশফিকের কাঁধে হাত রাখল। পিঠ চাপড়ে বলল,

“ বিয়েতে দেখলাম তোরা অনেক খেটেছিস। তাই তোদের সবার জন্যে আমি একটা স্পেইশাল ট্রীটের ব্যবস্থা করেছি।”
বলেই দারুণ করে হাসল সে। আরমান বুঝে গেল। হইহই করে বলল,
“ হবে নাকি দু পেগ?”
কাঁধ উঁচায় সে,
“ অফকোর্স। কেন হবে না?”
বাকিরা উচ্ছ্বাসে ফেঁটে পড়লেও, নাহিদ নীরস আওড়াল,
“ ওসব তো আমি খাই না।”
“ বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে একটু খেলে কিছু হবে না। চল,ঘরে যাওয়ার আগে দু দান তাসও খেলে আসি।”
মিরাজের কণ্ঠে অবিশ্বাস,

“ সত্যি বলছিস?”
তীব মাথা নাড়তেই, হইচই বাঁধিয়ে দাঁড়াল সকলে।
বিট্টু, পুষ্পিতাকে ঘরে বসিয়ে রেখে ওদের সময় দিচ্ছে এ যেন ভাবাই যায় না। বন্ধুদের এত ভালোবাসে ছেলেটা?
ভাবতেই ওদের চোখ আবেগে ছলছল করে উঠল। মুশফিক তো গদগদ হয়ে বলল,
“ তুই কত ভালোরে, বিট্টু!”
তীব্র স্বভাবসুলভ বলল,
“ আই নো। এখন সামনে হাঁট।”
ওরা হেলেদুলে আগে আগে হাঁটে। তীব্র একটা ঘরের সামনে এলো। দরজা ঠেলতেই মেঝের ওপর তাস সাজানো দেখে, সবার চোখ চকচক করে ওঠে। পাশেই কাচের দুটো বড়ো বোতল রাখা।
শুধু নাহিদ আনন্দ পেলো না। এরা সবাই ব্যাচেলর। কিন্তু ওর‍ তো একটা বউ আছে। এসব মদ-টদ খেয়ে যদি টাল হয়ে যায়! নূহা তো রণচণ্ডী হয়ে গর্দান ছেদ করে ফেলবে।
কিন্তু তীব্রর মুখের ওপরেও ছেলেটা মানা করতে পারছে না। ততক্ষণে মিরাজ,আরমান,মুশফিক ভেতরে ঢুকে গেছে। নাহিদ দুশ্চিন্তায় আস্তেধীরে এগোনোর মাঝেই,তীব্র পেছন থেকে জোরসে এক ধাক্কা মারল ওকে। অপ্রস্তুতিতে সোজা গিয়ে আরমানের গায়ে হুমড়ি খেল ছেলেটা।
বিকট চোখে ফিরতেই,

খট করে দোর আটকে দিলো তীব্র।
ওরা চমকায়। ভড়কে থাকে কিয়ৎক্ষণ।
তারপর ধড়ফড় করে দরজায় ঝুঁকে আসে।
“ কী রে! এই বিট্টু, দরজা আটকালি কেন?”
ওপাশ থেকে জবাব এলো,
“ তোদের কাউকে এক ফোঁটাও বিশ্বাস করি না আমি। এত সাধের বাসর নিয়ে তো কোনো রিস্ক নেয়া যাবে না। থাক এখানে। ভাগ্য ভালো হলে, কেউ এসে খুলে দিতেও পারে।”
তীব্র চলে গেল। তার পায়ের শব্দ কমতেই মুখ কালো হলো সবার।
আরমান মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“ যাহ! এটা কী হলো?”
মিরজা বলল,
“ আমি আরো ওর ভালোমানুষি দেখে সেন্টি খেয়ে উল্টে যাচ্ছিলাম! ধুর।”
মুশফিক একটু নিরুদ্বেগ।
বলল,

“ তবে এমনি এমনি কিন্তু আটকায়নি। আড্ডা দেয়ার সব সরঞ্জাম রেখে গেছে। ও বাসর ঘরে লুকোচুরি খেলুক,
আমরা তাস খেলি। কী আর করার,সিঙ্গেল স্যাড লাইফ।”
বাকিদেরও একই মত। মুশফিকের দেখাদেখি নিজেরাও এসে বসল। নাহিদ তখনই একইরকম দাঁড়িয়ে। আরমান বলল,
“ কীরে ব্যাটা, আয়।”
“ আমি না মানে..”
“ আবার মানে মানে করছে। ও বুঝেছি! সে তো এখন বিবাহিত। দরজা আটকে গেছে বলে বউয়ের জন্যে ছটফটানি শুরু হয়েছে তাই না?”
মুশফিক বলল,
“ হবে না? সবে এক রাত একসাথে ঘুমাল বেচারা। একদিন বিরিয়ানি খেয়ে বাকি দিন কি সাদাভাত ভালো লাগে?”
নাহিস চ সূচক শব্দ করে বলল,
“ কিসব অশ্লীল কথা বলছিস বলতো! ”
মিরাজ দুষ্টু হেসে বলল,
“ তা ভাই নাহিদ,বিয়ে তো করলে। এখন মেশিন ঠিকঠাক কাজ করছে তো?”
নাহিদ খটমটিয়ে বলল,

“ আবার শুরু করেছিস? গতবার তোর এই মেশিনের চক্করে নূহা আমাকে শুধু চর মারতে বাকি রেখেছিল ।”
“ আমি কি তোকে বলেছিলাম ওকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে? তোর মাথায় ঘিলু নেই তাতে আমার কী দোষ?”
নাহিদ অতীষ্ঠ শ্বাস ফেলল। আরমান গ্লাস বের করেছে। বোতল খুলে লালচে তরল ঢালতেই মুশফিক আটখানা হয়ে বলল,
“ আহহা হা, কতদিন পর খাব। বিট্টু,দোয়া করি ভাই শত পূত্রের জনক হ তুই।”
নাহিদ উলটো ঘুরে দরজায় ধাক্কা দিলো। যদি কেউ শুনতে পায়! মিরাজ বিরক্ত হয়ে বলল,
“ শব্দ করছিস কেন?”
“ কেন করছি মানে? তোরা এসব ছাইপাস খেতে হলে খা,আমি ভাই বের হব।”
তিনজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। সমস্বরে টেনে টেনে বলল,
“ ওওওও,বের হবে?”
আচমকা আরমান এসে জাপ্টে ধরায় নাহিদ হকচকাল খুব। ছেলেটা ওর হাত নিয়ে পিঠের সাথে ধরেছে। মিরাজ-মুশফিককে বোতল নিয়ে ছুটে আসত দেখেই, যা বোঝার বুঝে ফেলল নাহিদ। চোখ রাঙিয়ে বলল,
“ না, একদম না। বারন করছি আমি।”
তার নিষেধ কেউ শুনলই না। গাল চেপে ধরে ঠোঁটের ভেতর মদের বোতল ঢুকিয়ে দিলো মুশফিক।
মিরাজ বলল,

“ বউকে চুমু খেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বোতলকেও চুমু খাওয়া যায়। নে নে ট্রাই কর।”
সব কটা জোর করে অনেকটা মদ খাওয়াল ওকে। নাহিদ এসব আগে খায়নি। গলা অবধি যেতেই মুখ কুঁচকে বলল,
“ এ্যা কী বিশ্রী!”
অর্ধেক বোতল শেষ। এবার ক্ষান্ত দিলো ওরা। নাহিদের তখন রফাদফা দশা। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“ সব ঝাপ্সা দেখছি কেন?”
তক্ষুনি তার মুঠোফোন বাজে। আরমান পকেট থেকে টেনে তুলল সেটা। রিসিভ করে বলল,
“ হ্যালো,হ্যাঁ ভাবি! আমরা এই কোনার রুমটায়। তীব্র আটকে রেখে গেছে। একটু এসে খুলে দিন না!”
নূহা এলো মিনিট কয়েকে। দরজা খুলে বলল,
“ ভাইয়া আটকে রেখেছে কেন?”
মিরাজ নাক সিটকে বলল,
“ কঞ্জুস যে। টাকা পয়সা দেবে না, তাই। যাই এখন ধরি গিয়ে।”
“ কিন্তু ভাইয়া তো মাত্র রুমে ঢুকেছে।”
“ এই যা! তাহলে এখন?”
নূহার নজর পড়ল নাহিদের ওপর। ঘনঘন চোখমুখ ডলছে ছেলেটা।
শক্ত পা টলছে এদিক-ওদিক। বুঝতে না পেরে বলল,

“ ও এমন করছে কেন?”
পরপরই মেঝেতে রাখা মদের বোতল দেখল সে। চোখ বড়ো করে বলল,
“ ও কি ড্রিংক করেছে?”
মিরাজ অবোধ গলায় বলল ,
“ জি। আমরা এত মানা করলাম, শুনলোই না। বললাম আপনি এসব পছন্দ করেন না, তাও খেলো।”
নুহা দাঁত কপাটি পিষে নাহিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অমনি এক দলা উৎক গন্ধ ছুটে এলো নাকে।
ও খ্যাক করে বলল,
“ মদ খেয়েছ কেন?”
নাহিদ হাসল। শাড়ি পরা নূহাকে আগাগোড়া দেখে বলল,
“ কী সুন্দর লাগছে তোমাকে! আসো একটা চুমু…”
পথিমধ্যেই ঠাস করে একটা চর মারল নূহা। কটমটিয়ে বলল,
“ আজ এসো ঘরে।”
বেরিয়ে যেতেই হুহা করে হেসে উঠল সবাই৷
নাহিদ ঠোঁট উলটে বলল,

“ যাহ,রাগ করেছে? চুমু খেতে চাইলে রাগ করল কেন?”
তারপর বন্ধুদের দিক চেয়ে বলল,
“ আমি যাচ্ছি গাইস। রাগ ভাঙাই। যদি, যদি রাগের আগুনে ভস্ম হয়ে যাই, আর না ফিরে আসি? আমাকে তোমরা প্লিজ মনে রেখ। ম্যায় চালতি হু,মুঝে প্লিজ দুয়াও মে ইয়াদ রাখ না।”
নাহিদ টালমাটাল পায়ে প্রস্থান নিতেই,ওরা স্বশব্দে হাসল একেকজন। ভদ্র ছেলেটাকে নাকানিচুাবানী খাওয়াতে পারার এ এক মহা আনন্দ।

দরজায় আচমকা খট করে শব্দ হতেই, মেরুদণ্ড সোজা করে বসল পুষ্পিতা। উদগ্রীব চোখজোড়া সোজাসুজি বর্তাল সেথায়। তীব্র ঢুকল। ঝকমকে আলোতে শুভ্র চেহারায় কী আশ্চর্য সৌন্দর্য তার! তবে সেই সৌন্দর্য ছাপিয়ে গেল
পুষ্পিতার অস্থির চিত্ত।
হড়বড়িয়ে মুখ খুলল তরুণী,
“ আপনি এসেছেন? কোথায় গিয়েছিলেন? আমার এত চিন্তা হচ্ছিল! ফোন ধরছিলেন না কেন?”
তীব্র দরজা আটকায়। এগিয়ে আসে মসমসে শব্দে।
“ চিন্তা কীসের? তোমায় ছেড়ে আমি কোথায় যাব?”
“ তাও। একবার ফোন তো ধরবেন।”
মৃদূ হাসল সে। কথা নেই,বার্তা নেই,
আচমকা শেরওয়ানিটা টান দিয়ে খুলে,ছুড়ে মারল দূরে।
পুষ্পিতা চমকে গেল। এক চোট শীতল-দমকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিলো হাড়। শিরদাঁড়া বেয়ে নামা কলকলে ধারাটুকুন স্পষ্ট টের পেলো সে।
স্বামীর ফরসা,নগ্ন বুক হতে চট করে চোখ নামিয়ে ফেলল।
নার্ভাসনেসে গলা ভিজিয়ে কপালের ঘাম মুছল পুষ্পিতা। তীব্রর কণ্ঠ ধীর,

“ গরম লাগছে?”
মেয়েটা তাকালো না। মেঝেতে
এলোমেলো পাতা ফেলে বলল,
“ না মানে একটু ফ্রেশ হোতাম। খুল,খুলতাম শাড়িটা।”
তীব্র তক্ষুনি বসল এসে। একদম মুখের সামনে,চোখ বরাবর। পুষ্পিতার শীর্ণ বুক ধ্বক করে ওঠে। তীব্র ঠান্ডা হাতটা ধরতেই,কম্পিত
চোখ তুলে চাইল সে।
কিন্তু এসবের সামান্য চিহ্নও ওই পুরুষের মাঝে নেই। সে সাবলীল,স্বাভাবিক।
পুষ্পিতার কুণ্ঠাকে শতধাপ বাড়িয়ে দিতে বলল,
“ শাড়ি তোমাকে খুলতে হবে না। সে জন্যে আমি আছি।”
পুষ্পিতার প্রান গলায় চলে এলো। তীব্র গাল ছুঁতেই, ফ্যাসফ্যাসে হলো জোরালো দম। দূর্বল পিঠ ঠেকল খাটের সঙ্গে। তীব্র এগোয়। এগোয় তার সুঠাম দেহ। নিঃশ্বাসের ঘনিষ্ঠ হতে হতে বলে,

“ সেই প্রথম দিন থেকে তোমাকে একটু ছোঁয়ার জন্যে,একটু কাছে পাওয়ার জন্যে আমার ভেতরটায় যে কী সাংঘাতিক ঝড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল,পুষ্পিতা!”
তারপর ঘড়ির দিকে চাইল সে। কথার মাঝে বাধ নেই,সংকোচ নেই। বলল অনর্গল,
“ দুটো বাজে। সাড়ে চারটায় ভোর হবে। আড়াই ঘন্টা কি তোমাকে ভালোবাসতে যথেষ্ট?”
পুষ্পিতার কণ্ঠরোধ। কোনো কথাই ফুটছে না। লিপস্টিকে ঢাকা ঠোঁটদুটোর ভূমিকম্প দেখে, তীব্রর মাথায় নেশা চড়ে বসল।
আরেকটু এগোতে চাইলে,
খেয়াল পড়ল মেয়েটার রক্তশূন্য মুখের ওপর। ছোট্ট শরীরও কেমন থরথর করে কাঁপছে।
ভ্রু নাঁচায় সে,

“ ভয় পাচ্ছো?”
পুষ্পিতা উত্তর দিতে ব্যর্থ! অনুভূতির তাণ্ডবে তার সব কিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
সম্মুখের পুরুষালি ওষ্ঠপুট ঠিক ঠোঁট অবধি আসে। থেমে যায়। সরু নাক তৈরি হয় আজগুবি সংষর্ষের।
তীব্র কানের কাছে এলো। উষ্ণ হাওয়ার ঝটকা দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ ভয় পেও না!
আই উইল বি জেন্টেল!”

ফজরের আযান শুরু হয়েছে। বাতাবরণে একটু একটু আলো ফোটার সংকেত।
অন্ধকারে ডুবন্ত ঘরে পুষ্পিতার ছোট্টো একটু গোঙানীতে তৎপর তীব্র বেড সুইচ টিপল।
দৃষ্টিতে তার মায়ার পাহাড়।
মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ কষ্ট হচ্ছে?”
পুষ্পিতা মাথা নাড়ল। বোঝাল,হ্যাঁ। ত্রস্ত উঠে বসল তীব্র। বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বলল,
“ আমি ওষুধের ব্যবস্থা করছি।”
ফ্লোরে লুটিয়ে থাকা শেরওয়ানিটায় সে হাত দিতে যায়। পূর্বেই কব্জি টেনে ধরল মেয়েটা। খুব আস্তে বলল,
“ এখন যেতে হবে না। আমি ঠিক আছি।”
“ কিন্তু…”
পুষ্পিতা বসল আস্তেধীরে। অনাবৃত দেহ এক টুকরো চাদরের আড়ালে। মাথা নুইয়ে বলল,

“ এখন গেলে সবাই কী ভাববে?”
তীব্রর কণ্ঠ নির্বাধ।
“ যা ভাবার ভাববে,আই ডোন্ট কেয়ার।”
“ লাগবে না বলছি তো।”
“ তাহলে?”
“ শুধু একটু ওয়াশরুমে যাব।”
তীব্র এগিয়ে আসে।
“ আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
ও বলল,
“ ক্রাচ আছে তো। আমি পারব।”
তীব্র শুনল না। ক্ষুদ্র শরীরটা চটপট তুলে নিলো দুহাতে।
ঠান্ডা পানির ঝটকা চামড়ায় পড়তেই,পুষ্পিতার গা জ্বলে যায়। রিনরিনে গলার নিনাদ শুনে তীব্রর বুক মুচড়ে উঠল। মুখবিবরে বিশদ বিষণ্ণতা নিয়ে বলল,
“ সরি!”
পুষ্পিতা চিবুক নামিয়ে হেসে ফেলল।
একটু কপাল কুঁচকে বলল ,
“ এই বুঝি আপনার জেন্টল হওয়ার নমুনা?”

তীব্র কিছু বলল না। পুষ্পিতার শোচনীয় দশায় সে স্বাভাবিক হতে পারনি। চুপচাপ গোসল করিয়ে ফের খাটে এনে বসাল ওকে। ভেজা চুল মুছিয়ে দেয়ার ফাঁকে, তোয়ালে জড়ানো কোমরটা দুহাতে প্যাঁচিয়ে ধরল পুষ্পিতা। গায়ে মাথা ঠেসে, ফুঁপিয়ে উঠল হঠাৎ। কান্নার শব্দে হাত থেমে গেল তীব্রর।
ধড়ফড় করে মুখ তুলে,পাশে বসল সে।
উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,

“ কী হয়েছে? খারাপ লাগছে? ব্যথা বা…”
পুষ্পিতা নাক টেনে মাথা নাড়ল দুপাশে। পরপরই ঝাঁপ দিলো চওড়া বুকের ভেতর। দুহাতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে বলল,
“ আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি! খুব ভালোবাসি আপনাকে।”
তীব্র হাসল।
“ আমি জানি।”
পুষ্পিতা ভেজা চোখে বলল,
“ উহু,আপনি কিচ্ছু জানেন না।
সব মেয়েরা স্বপ্ন দেখে,তার জীবনে একদিন রাজপূত্র আসবে। ঘোড়ায় চড়ে, খুড়ের ঠকঠক শব্দটা এসে ভিড়বে তার আঙিনায়।
খসখসে হাতটা পেতে বলবে,
‘ এসো মেয়ে,তোমাকে সুখের রাজ্যে নিয়ে যাই।’

সেই মধুর স্বরেই মুদে আসবে মেয়েটি। নির্ভাবনায় হাত ধরবে তার। কিন্তু আমি কখনও এরকম কিছু ভাবিনি। কোনো রাজপূত্র নিয়ে স্বপ্ন দেখার সাহস আমার ছিল না। আমার মতো চালচুলোহীন মেয়েকে কে বিয়ে করবে?
কিন্তু যেদিন আপনাকে অনুভব করতে শুরু করি? সেদিন বুঝেছিলাম,আমি না চাইতেও, রাজপূত্র ঘোড়া নয় জিপ সমেত এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে।
মিষ্টির বদলে নিরেট স্বরে বলেছে,
“ ভীতু মেয়ে, গাড়িতে ওঠো।’’
আর শেষ বেলায় আমি যখন নাকচ করলাম তার সুখের রাজ্যে যেতে? সেতো রেগেমেগে
মাথায় বন্দুক ধরে বোঝাল,
“ ভালোবাসলে আমি যেতে বাধ্য!”
তারপর ভয়ে ভয়ে সেই হাত ধরলাম আমি। সুখের পবনে উড়ে বেড়ানো শিখলাম। হাওয়ার স্নিগ্ধতায় উপলব্ধি করলাম, দিনশেষে এই কর্কশ রাজকুমারটাকেই আমার চাই। তীব্র নামের মানুষটাকে আরো তীব্রভাবে চাই।”
পুষ্পিতা হুহু করে কেঁদে উঠল।
নাক টেনে টেনে বলল,

“ আপনি আমায় কেন এত ভালোবাসতে গেলেন বলুন তো!”
তীব্রর জবাব এলো সময় নিয়ে। ধীর-স্থির বলল,
“ জানি না। কবে এত ভালোবেসে ফেলেছি,তাও জানি না। শুধু জানি এটাই
প্রেম,এটাই ভালোবাসা। এই ভালোবাসার কাছেই তো এক জীবনে সকল মানুষ হেরে যায়। তোমাকে প্রথম দেখেই হয়ত আমার প্রেম নিয়ে অনীহ তরীটা মুগ্ধতার অর্ণবে ডুবে গেছিল,ভীতু মেয়ে। ধাঁধায়,দোটানায় নিজেকে এলোমেলো মনে হয়েছিল সেই প্রথম বার।”
তারপর কালচে ঠোঁট বাড়িয়ে কপালে চুমু খেল সে। অমসৃন অঞ্জলিপুটে পুষ্পিতার সুকোমল আনন রেখে বলল,
“ কবিদের মতো চোখের প্রশংসা আমাকে দিয়ে হবে না। শুধু বলতে পারি, এই চোখে আছে এমন কিছু, যা শেষ করে দিয়েছে আমার সব।”
একটু থামল সে। বুক ভরে দম টেনে বলল,

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৯

“ টিমটিমে এক আলোর মাঝে, ভীতসন্ত্রস্ত শুভ্র সুন্দর মুখ।
এক পলকের একটু দেখায়,কাঁপল আমার বুক।”
আরো কিছু বলতে নিলে বাধ সাধল পুষ্পিতা। ঠোঁটের ত্বকে নরম আঙুল চেপে বলল,
“ তারপর মন দেয়া-নেয়া,
অশনীর সুরে বুক ঢিপঢিপ।
পুষ্পিতার ভুবন দোলানো অন্ধকারে,
আপনিই সেই সন্ধ্যাপ্রদীপ!”

সমাপ্ত