সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১৬

সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১৬
সাইয়্যারা খান

হাসপাতালের বিছানায় কৃত্রিম অক্সিজেনের সাহায্যে শ্বাস টানছে তামজিদ। বাইরে গুনগুনিয়ে কাঁদছেন মা৷ চেয়ারম্যান সাহেব চিন্তিত মুখে ডাক্তারের সাথে কথা বলে মাত্র ফিরলেন। ছেলের অবস্থা খারাপ। খবর সুখকর না বরং একটু শোচনীয়। ডাক্তার কড়াকড়ি ভাবে বলেছেন তামজিদকে মানষিক চাপ থেকে বিরত থাকতে কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? দুপুর কাকে বিয়ে করলো, কবে করলো, কিভাবে করলো? প্রশ্ন গুলো মাথায় ঘুরছে। চোখে চোখে তো রাখা হয়েছিলো। মিরাজ সাহেবকে সহ দেখে রাখতেন যাতে মেয়ের বিষয়ে কারো সাথে কিছু বলতে না পারেন। এত খোঁজ, এত খবর মিথ্যা হলো।
শান্ত ভাবে ঘুমন্ত ছেলেকে দেখে চেয়ারম্যান সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। ছেলেটার হার্ট অ্যাটাক শুনে তার বুকেই চাপ দিচ্ছিলো। এখন তো তাও নাহয় ঘুমে আছে, চিন্তা তো তখনকার জন্য যখন এই ঘুম ভাঙবে। কিভাবে সামলাবেন তামজিদকে?

ওকে সামলাতে পারে একমাত্র তাসরিফ। ছোট ভাইকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে সে কিন্তু আজ তাসরিফ নেই। হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে ডাক্তারের হাতে দিয়েই চলে গিয়েছে। কানে খবর এসেছে মিরাজ সাহেবকে নাকি শ্যুট করেছে তামজিদ। লাইন্সেস করা পি স্ত ল তাই বলে রেগে এই কাজ করলো ছেলে? তাসরিফের রাগটাও এবার কঠিন, বাবা হিসেবে এতটুকু তিনি বুঝেন৷ সায়রা’কে খুব ভালোবাসে সে। বউ এর অসম্মান মানবে না তাসরিফ।
ভোরের আলো ফুটছে সবে। চারপাশে কলকাকলীতে মুখরিত। এখনও চোখ খুলে নি তামজিদ। ডাক্তার এসে দেখে গেলেন। তার ভাষ্য মতে জ্ঞান ফিরবে শিঘ্রই। ঘন্টা খানিক পরই চোখ মেলে তামজিদ। প্রথম প্রায় দশ মিনিট অবুঝের মতো এদিক ওদিক ভ্রান্ত দৃষ্টিতে চাইলো। নিজেকে বুঝার চেষ্টা করলো। মা ছেলেকে দেখে কেঁদে ফেললেন৷ চেয়ারম্যান সাহেব ডাক্তার ডাকলেন। ডাক্তার চেকআপ করছেন তখন। হঠাৎ তামজিদ জোড়ালো কণ্ঠে বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— দুপুর এসেছে?
উপস্থিত সকলেই চমকালো এহেন প্রশ্নে। চেয়ারম্যান সাহেবের কপালে ঘাম। ছেলে বলতে কি এটা? এখন যদি দুপুরকে চায় তাহলে কোথা থেকে আনবে? তামজিদ আবারও জিজ্ঞেস করলো,
— দুপুর আসে নি আমাকে দেখতে?
কেউ উত্তর দিতে পারলো না৷ তামজিদ একে একে সবাইকে দেখছে। মা, বাবা, ডাক্তার, সাদা কাপড়ে দু’জন নার্স। চোখটা দরজা সহ মাথার উপর সাদা দেয়াল সবই দেখলো। দেখলো না শুধু দুপুরকে। চোখের খায়েশ তার মিটছে না। পলক ঝাপটায় তামজিদ। হাতে তখনও ধীর গতিতে স্যালাইন চলছে। উঠে বসতে চাইতেই বাঁধা দিলো ডাক্তার। তামজিদ শুধু গরম চোখে তাকালো। ডাক্তার ছাড়লেন না। পূর্ব পরিচিত তামজিদে’র। জোর খাটিয়ে বললেন,

— শুয়ে থাক তামজিদ।
— সর।
— কোথায় যাবি তুই?
— দুপুরের কাছে।
চেয়ারম্যান সাহেব এগিয়ে এসে ছেলের হাত ধরলেন৷ বুঝানোর ভঙ্গিতে বললেন,
— দুপুর তো নেই বাবা। তুমি শান্ত হও। চাপ নিও না এখন।
তেঁতে উঠে তামজিদ। নেই মানে? কেন নেই? তারা কেন দেখে রাখলো না? রেগে হাতের ক্যানোলা টেনে খুললো ও। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাচের পানির জগটা ছুঁড়ে মা রলো ফ্লোরে। দুই পা পেছালো৷ সকলে। রাগে অদ্ভুত ভাবে গুঙিয়ে কাঁদছে তামজিদ। মা এগিয়ে এলেন৷ তামজিদে’র হাতটা ধরবেন তার আগেই হুংকার দিয়ে উঠে ও। চিৎকার করে বলে,

— দেখে রাখো নি কেন? কেন দেখে রাখলে না? কোথায় খুঁজব ওকে আমি?
নিজের কোমড়ের দিকে হাতড়ে পি স্ত ল খুঁজলো। না পেতেই রাগী স্বরে জিজ্ঞেস করে,
— পি স্তল কোথায় বাবা?
— তামজিদ বাবা কথা শোন৷ এখন এমন করো না।
তামজিদ হন্তদন্ত হয়ে পি স্তল খুঁজে। রাগে গজরাতে গজরাতে বলে,
— মিরাজকে খু ন করব আমি৷ ওকে খু ন করে দিব৷ দুপুর ওর বাবার লা শ দেখতে তো আসবেই। ওখান থেকেই লুকিয়ে ফেলব ওকে। ওকে আসতে হবে বাবা৷ দুপুরকে আসতে হবে। ও জানে তো আমি ওকে কতটা চাই।
চেয়ারম্যান সাহেব ছেলের হাতটা ধরলেন শক্ত করে। বুঝানোর মতো বললেন,
— মিরাজ সাহেবকে তুমি দুটো গু লি করেছো তামজিদ।
— ম রার মতো করি নি৷ ওর বুক ঝাজড়া করব আমি। কত সাহস! আমার দুপুরকে বিয়ে দেয়….

“দুপুরকে বিয়ে” কথাটা বলতে গিয়ে কণ্ঠনালী অদ্ভুত ভাবে কাঁপলো তার। বুকের ভেতর চিনচিন করে ব্যথা হচ্ছে। সেই ব্যথা বলে কয়ে ধীরে ধীরে বাড়ছে। বেড থেকে হুরমুর করে নামতে গিয়ে মুখ থুবড়ে নিচে পড়লো তামজিদ। দৌড়ে সবাই ধরতে ধরতে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো ও। বুকে হাত চেপে কাঁদছে সে। ভালোবাসা হারানোর কান্না। কাছে পেয়ে হারিয়ে ফেলার কান্না। এক অদ্ভুত ব্যথা যা চোখে দেখা যায় না অথচ ম র ণ যন্ত্রণা দিয়ে যায় অন্তঃপটে। ছেলের কান্নায় চেয়ারম্যান সাহেব অসহায় হলেন৷ ডাক্তার ওকে থামাতে চাইলেও পারছেন না। উন্মাদ হয়ে উঠে তামজিদ। ওয়ার্ড বয়রা ধরতে আসলেই হাতের কাছের জিনিস ছুঁড়ে দিচ্ছে। ওকে সামলানো কঠিন। কারো কথা না শোনা তামজিদ’কে এখন সামলানো একটু বেশিই কঠিন।

তখনই ত্রস্ত পায়ে কেবিনে আসে কেউ। দুই হাঁটু গেড়ে বসে জড়িয়ে ধরে তামজিদকে। ছোট ভাইয়ের বুকে মুখ গুজে কাঁদে তামজিদ। তাসরিফ চোখের ইশারায় ডাক্তারকে ঘুমের ইনজেকশন দিতে বলে। তামজিদ ছোট ভাইয়ের বুকে তখন অদ্ভুত সেই ভঙ্গিতে কাঁদছে। মুখে তার শত অভিযোগ দুপুরকে ঘিরে।
— অ্যই তাসরিফ, তুই জানিস না ওকে আমি কতটা ভালোবাসি? দুপুর তো জানে৷ ও আমাকে ছাড়লো কিভাবে? ভুলে গেলো কিভাবে? ও কার কাছে থাকে ভাই? কার কাছে থাকে?
আবার কাঁদে তামজিদ। বুকে হাত চেপে রাখে। অভিযোগ তুলে পুণরায়,
— তুই জানিস না আমার দুপুরটা বোকা? ও তো যাকে তাকে বিশ্বাস করে বসে থাকে। ওকে বিয়ে দিলো কিভাবে? ভালো-মন্দই তো বুঝে না ও। আমার দুপুর… আমার দুপুর… অ্যই তাসরিফ আমাকে দুপুর এনে দে। দুপুর চাই আমার তাসরিফ… ওকে এনে দে না। দে নারে ভাই। আমার বুকটা কেমন জানি করছে তাসরিফ। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। দুপুর এনে দে আমাকে। দু…পু…র এ..নে দে।
তাসরিফে’র বুকেই ঢলে পড়লো ও। পাঁজা কোলে তুলে বেডে রাখতেই ডাক্তারটা রুম শিফট করলেন কারণ ততক্ষণে তামজিদে’র অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে। শ্বাস টান উঠেছে। উত্তেজিত হওয়াতে বুকের চাপ বেড়েছে। মেঝেতে বসে পরলেন মা। র ক্ত শূন্য মুখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন স্বামীকে,
— আমার তামজিদ বাঁচবে তো?

মুখে পানির ছিটেফোঁটা পড়তেই চোখ মেলে তাকালো দুপুর। খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে শাহ। দুপুর কপাল কুঁচকে জোড়ানো গলায় বলে,
— ঘুমাব শাহ।
— সংসার করবেন না দুপুর?
— হুউ।
— তাহলে উঠুন।
— ঘুম হয় নি তো।
শাহ থামলো না৷ এগিয়ে এসে ভেজা চুল গুলো ঝাড়লো ওর মুখের উপর। বালিশে মুখ গুজে দিতেই দুপুরের উন্মুক্ত কাঁধে নিজের ঠান্ডা হাত রাখে শাহজেব। লাফিয়ে উঠে দুপুর। চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে তাকিয়ে বলে উঠে,

— কি চাই?
— নাস্তা সাথে হালকা পাতলা একটা রোম্যান্টিক কিস্সি। সে-ই সাথে একটু জড়িয়ে ধরে বিদায় আর আমার ফেরার অপেক্ষা করা একটা বউ।
দুপুরের মনটা ভীষণ খারাপ হলো। নিজে জোরজবরদস্তি এখানে এলো। মুখের বুলি ছিলো সংসার করবে অথচ প্রথম দিন ই কি না নাস্তা বানাতে পারলো না। ওর উদাস মুখ দেখে শাহ ঝুকলো। কপালে ঠান্ডা একটা ছোঁয়া দিয়ে বললো,
— মন খারাপ করে লাভ নেই পাখি। আ’ম ওয়েটিং।
দুপুর বিছানা ছাড়লো৷ শাহ ওর হাত টেনে নিজের কাছে নিলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
— মন খারাপ করে লাভ নেই৷ গাড়ি এক ঘন্টা পর আসতে বলেছি।
দুপুরের মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। দৌড়ে বাথরুমে ঢুকতেই পেছন থেকে শোনা গেলো,
— কাল থেকে একা গোসল করতে পারব না দুপুর। বউ চাই আমার।
দুপুর মনে মনে মুখটা লাজুক করে বললো,

— কালো চাঁদের সখ কত।
একা হাতে শাহ’র জন্য রুটি আর ডিম করলো দুপুর। চা বানিয়ে টেবিলে দিতেই শাহ বললো,
— বসো আমার সাথে।
— আপনি আগে…
— বসতে বলেছি।
দুপুর বসা মাত্রই রুটি ছিড়ে ওর মুখে দিলো শাহ। দুপুর নরম চোখে তাকিয়ে রইলো। শাহ তখন চোখ টিপে। টিটকারি দিয়ে বলে,

সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১৫

— দুপুরেও দুপুর চাই আমার দুপুর। দুপুর চন্ডী ফুটাতে আমার বেশ লাগে।
দুপুর উঠে দাঁড়ালো। গটগট করে চলে গেলো রুমে। শাহ এদিকে হাসছে। খেতে খেতেই বলছে,
— গাড়ি আসছে দুপুর। আমার জুতা দাও।

সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১৭