সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১৭

সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১৭
সাইয়্যারা খান

একা বাড়ীতে সায়রা বসা নিজের কামরায়। একা ঘরে বসে থাকার মেয়ে সায়রা না অথচ পৃথিবীটা আজ-কাল তার নিকট সংকীর্ণ ঠেকছে। মনমানুষিকতা বিগড়ে যা তা অবস্থা। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিতেই দেখলো অপরূপ প্রকৃতির অগাধ সৌন্দর্য। মেঘ জমাট বেঁধে আছে। বর্ষণ হবে হবে ভাব৷ এদিকে সায়রা’র মনের মেঘ গুলো শুধু জমাট ই বাঁধে। সেই কত বছর ধরে জমাট বেঁধে যাচ্ছে অথচ বর্ষণ হলো না এই অব্দি। কখনো এই চোখ দুটি কাঁদে না।

হাজার কষ্টেও সায়রা কিভাবে জানি বেঁচে থাকে। মন বলে, এমন সায়রা হাজার হাজার। চোখের সামনেই আছে অথচ দেখা যায় না। বাইরে থেকে সায়রা’রা হয় খুব কঠিন, শক্ত, মাথা উঁচু করে সবাইকে ডিঙিয়ে জীবন যুদ্ধ করা নারী অথচ প্রতিটি সায়রা নিজে জানে তারা কতটা ভঙ্গুর, নমনীয় এবং ক্লান্ত। লড়াই করতে করতে একসময় হাতটাও যেন বলে, ‘এবার রেয়াই দাও, আমরা ক্লান্ত আর লড়াই করতে পারব না’। সায়রা তবুও অ’স্ত্র ধরে রাখে। লড়াই করার চেষ্টা করে। বিয়ের বয়স সীমা সমাজ ধরে বেঁধে দিয়েছে। গণ্ডীর বাইরে পা ফেলা বড়ই দায়। সেই সমাজে সায়রা মাথা উঁচু করে এতটা বছর বেঁচে ছিলো। মাহমুদ নামক ব্যক্তির নাম মন থেকে মুছলেও মস্তিষ্কে তো ছিলো। কখনো এই সমাজ বা কেউ তাকে বলার সাহস করে নি সায়রা’র চরিত্রে সমস্যা আছে। বিন্দু মাত্র কথা তোলার সাহস তারা পায় নি৷ কেউ একটা বললে তার মুখে দশ কথার তুল্য চড় সায়রা নিজ মুখে দিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই সমাজে বাঁচার এক অলিখিত নিয়ম, ‘দশজন যেই শব্দে কথা বলবে নিজের স্বর তাদের দশগুণ উঁচুতে তুলে কথা বলবে, তাহলেই তুমি টিকে থাকবে’। সায়রা এই নিয়ম মেনেই চলেছে। অথচ তাসরিফটা তার জীবনের সুতাটা টেনে ধরে মোড় ঘুরিয়ে ফেললো। সায়রা’র মতো মানুষটা সাধারণ কিছু মহিলা তাকে নিয়ে বলা কথায় জীবন থেকে মায়া হারিয়ে ফেললো।
সিলিং এর দিকে নজর যেতেই সায়রা’র মুখটা বিমূর্ত হয়। সেই রাতেই রুমের ফ্যান তাসরিফ খুলেছে। আর লাগায় নি। সায়রা’র মন বলে, এই ঘরে ফ্যান লাগাবে না আর তাসরিফ। সে ভয় পেয়েছে। ওর চোখে ভয় জিনিসটা দেখেছে সায়রা। সাতাইশ বছরের পুরুষ অথচ সায়রা’র মনে হয় ছোট ছেলে এই তাসরিফ। মন, দেহ কোনোটারই টান সে তাসরিফ থেকে পায় না অথচ তাসরিফ কাছে টানছে সেই প্রথম রাত থেকে। সায়রা বাঁধা দেয় না। এক তরফা ভালোবাসা কঠিন জিনিস। তিনটা বছর পিছু নিয়েছে, কিছুটা পাওনা তো তার অবশ্যই আছে।

আনমনা হয়ে সায়রা উঠে দাঁড়ালো। পরণের শাড়ীটা কিছুটা কুঁচকে আছে। এগিয়ে এসে দাঁড়ালো জানালার কাছে। আকাশে তখন মেঘ ক্রমশই বাড়ছে। ঘ্রাণ আসছে মাটির। একটা কাজের মেয়ে এসে ডেকে গেলো একবার খেতে। সায়রা উত্তর করে নি৷ তার ভালোলাগে না এসব। বেঁচে থাকা প্রতিটি মূহুর্ত হলো এক একটা রত্ন৷ জীবন উপভোগ করা উচিত। গুমরে কত মানুষ ম’রে অথচ তাদের উচিত জীবনকে মায়া করা। একটা মাত্র জীবন একে হেলায়-ফেলায় কাটালে চলবে? এত সুন্দর জীবনটার প্রতিই মায়া যখন হারিয়ে যায় তখন মানুষ হয় জীবন্ত লা’শ। নিজেকে সায়রা সেভাবেই দেখে। মুখটাও আজ-কাল ফ্যাকাশে দেখায়। মনে মনে সায়রা ভাবে, তার রোগ হয়েছে। ম র ণ রোগ। এই রোগ হওয়ার প্রথম উপসর্গ হলো মুখ ফ্যাকাসে হওয়া।

দরজার নবটা খুব ধীরে শব্দহীন খোলার চেষ্টা করে তাসরিফ তবুও সে ব্যর্থ। একটু শব্দ হলোই। ভেবেছিলো সায়রা’কে ঘুমন্ত পাবে কিন্তু ও জেগে। ক্লান্ত পা দুটো টেনে এগিয়ে গেলো ও৷ হাসপাতালে তামজিদে’র অবস্থা ভালো না৷ ঘুমের ইনজেকশন দিয়েই রেখেছে। অবস্থা বেগতিক। এই পর্যন্ত দুইবার জেগেছে। দুইবারই ‘দুপুর’ নামটা উচ্চারণ করেছে। ‘ভালোবাসা’ শব্দটার আসলে ব্যাখা হয় না। যারা দেয় তারা দেয় নিজ অভিজ্ঞতা থেকে। এই শব্দের বিশ্লেষণ হবে সবার ভিন্ন ভাবে। এই যে অপেক্ষা, এটা যেমন ভালোবাসা, ঠিক তেমনই অধৈর্য হওয়াও ভালোবাসা। কাউকে জানপ্রাণ উজাড় করে চাওয়া যেমন ভালোবাসা, ঠিক তেমনই ভালোবাসা হলো কাউকে নিজের করে পেতে কাউকে খু ন করা। ন্যায় অন্যায় ভালোবাসা বুঝে না৷ ভালোবাসা শুধু দুটো শব্দ চিনে, ‘প্রেমিক-প্রেমিকা’। তারা কাছাকাছি তো পূর্ণতা। তারা বিচ্ছিন্ন তো ধ্বংস।

আস্তে ধীরে এগিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাসরিফ। সায়রা ঠাই দাঁড়িয়ে। অনুভূতিহীন এক জড় পদার্থ যেন। আলিঙ্গন ধীরে ধীরে গভীর হলো। কাঁধটাকে উন্মুক্ত করার চেষ্টা করলো তাসরিফ। লাভ অবশ্য হলো না। ওভাবেই মাথা দিয়ে রাখলো ও। সারাটা দিনের ক্লান্তি মুছার জন্য এহেন কিছু মূহুর্তে যথেষ্ট। পেটটা দুই হাতে জড়িয়ে রেখে অস্পষ্ট কণ্ঠে গুঙিয়ে উঠলো। মৃদু জড়ানো গলায় বললো,
— খুব ক্লান্ত লাগছে য়রা।
— ঘুমাও গিয়ে।
— হুম।
ছাড়ে না তাসরিফ। শক্ত করে পেছন থেকে তখনও জড়িয়ে রাখে। সায়রা বাইরে তাকিয়ে রইলো। তাসরিফ ছাড়লো মিনিট দশ পর। নিজের দিকে ঘুরালো সায়রা’কে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
— আমার সব এলোমেলো হয়ে গেলো সায়রা৷ কি থেকে কি হলো। ভাবীর বিয়ে কখন দিলেন আপনারা সায়রা?
— আরেকজনের বউকে ভাবী ডাকছো?
তাসরিফ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বলে,
— তাকে কখনো নাম ধরে ডাকিনি।
— বয়সে তোমার থেকে খুব ছোট। চাইলেই ডাকতে পারো।
তাসরিফ কথা ঘুরিয়ে বললো,
— তোমার ভাই এখন ঠিক আছেন।
— ম রে গেলে ভালো হতো।
— এসব বলতে নেই য়রা।
— আচ্ছা, তোমাদের পি স্ত ল গুলো লাইসেন্স করা?
— হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কেন জিজ্ঞেস করছেন?
— আগে বলো, যে কেউ ব্যবহার করতে পারবে?
— না য়রা। কি ভাবছেন আপনি?

তাসরিফ উদ্ধিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলো। সায়রা এক গাল বাকিয়ে হাসে। তা দেখে তাসরিফে’র বুকে ভয় জাগলো৷ ও ব্যস্ত হয়ে সায়রা’র হাত টানলো। সোজা রুমের ভেতরে নিয়ে খাটে বসালো। নিজে বসলো হাঁটু ভেঙে ওর পায়ের কাছে। সায়রা’র কোলের কাছে হাত দুটো নিয়ে বললো,
— আপনি কি করতে চাইছেন য়রা? এসব কেন ভাবছেন? আপনার ভাই ঠিক আছে এখন৷ মাত্র দেখে এসেছি। আপনি যাবেন? আমি নিয়ে চলি? এ..এখন যাবেন য়রা? উঠুন।
বলেই কুঁচকানো শাড়ীটা নিজের হাতে ঠিক করতে লাগলো তাসরিফ। সায়রা তাকিয়ে দেখছে ওকে। দেখতে দেখতে বললো,
— তিনটা বুলেট লাগবে আমার। একটা পি স্ত ল ম্যানেজ করে দিতে পারবে?
তাসরিফে’র বুকটা এবার ধরাস করে উঠে। তিনটা বুলেট দিয়ে কি করবে কি মেয়ে? একটা শুকনো ঢোক গিলে তাসরিফ বলে উঠলো,

— এসব মাথা থেকে বের করুন য়রা৷ এসব কথা বলবেন না।
— ভাই, ভাবী আর মা। শুধু এই তিনজনকে কাউকে দিয়ে মা র তে হবে। ওদের জন্য জীবনটা কষ্টের হয়ে যাচ্ছে। আমার ভাই যে কি এক পাপ করলো দুপুরটাকে পয়দা করে। ইশ! আফসোস হয় বুঝলে তাসরিফ। ছোট থেকেই চোখে লাগার মতো সুন্দর ছিলো। আচ্ছা, তুমি কি জানো ছোট বেলায় ওর সাথে কি হয়েছিলো? সেই ঘটনা তো তোমাকে বলা হয় নি। শুনবে নাকি?
তাসরিফ দেখলো অদ্ভুত ভাবে হাত নেড়ে কথা বলছে সায়রা। এভাবে হাত নেড়ে কথা বলার অভ্যাস ওর নেই। সায়রা মনোযোগ টানার জন্য তাসরিফে’র মুখটা নিজের দিকে করলো। বললো,

— তখন ওর সাত বছর বুঝেছো। আমাদের বাসায় আমার বাবার বন্ধু এসেছিলো। বন্ধুর সাথে ছিলো তার ছেলে। আমার ভাইয়ের বয়সেরই। দুপুর তখন ধীরে ধীরে ফুটছিলো। সদ্য সাতে পা দেয়া ছোট্ট একটা বাচ্চা। ও আমার বাচ্চা। আমি এটাই বলি সবাইকে। যখন থেকে ও হলো তখন থেকে। ওর মা থেকে বেশি আমাকে ভালোবাসতো বুঝলে। এখনও বাসে। সেই ছেলে দুপুরকে খেলার ছলে কাছে টেনে হাতের ক্ষুধা মিটাতে চাইছিলো। তুমি জানো, দুপুর ওসব না বুঝলেও সন্ধ্যা কিন্তু বুঝতো। মায়ের কোলে কোলে বড় হওয়া মেয়ে। মা সবই বুঝাতো কিন্তু আমার দুপুর? ওকে কে বুঝাবে? আমি তখন ছিলাম না৷ বাসায় এসে দেখি আমার ছোট্ট দুপুর খাটে ঘুমাচ্ছে। চোখ মুখ লাল। এত সুন্দর চামড়ায় লাল লাল দাগ৷ ফুলে ফুলে উঠেছে শরীরে। ফ্রকটা খুলেও দেখলাম। দরজা আটকে ঘুম থেকে তুলে সবটা শুনেছি৷ আমি অপারগ কিছুই করতে পারি নি৷ দুপুর যখন ব্যথা পেয়ে কাঁদছিলো তখনই সন্ধ্যা দৌড়ে ভয়ে নিজের মায়ের কাছে গেলো কিন্তু কিছুই বলে নি। দোষ কাকে দিব আমি? সন্ধ্যাও ছোট কিন্তু বুঝতো।

দুপুর যখন ছুটে গেলো মায়ের কাছে তখন নাকি ভাবী দুটো চড় দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো। এসব জানাজানি হলে মুখ থাকবে না৷ শশুড়ের বন্ধুর ছেলের নামে এসব কথা মানায়? দুপুরের বাবার বয়সী লোকটা। ছোট্ট দুপুরটার সেই কি জ্বর রাতে। আমি সারারাত জেগে মাথায় পানি দিলাম। ভাই জেনেছিলো পরদিন। ভাবীর সাথে তুমুল ঝগড়াও বেঁধেছিলো।
তাসরিফ চুপ করে আছে। সায়রা আচমকাই উত্তেজিত হলো। তাসরিফে’র হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
— ছোট থেকেই ওর সৌন্দর্য ওর কাল হয়েছিলো তাসরিফ৷ তোমার ভাই তাতে কলঙ্ক যোগ করেছে। তুমি… তুমি যখন ফোন নিয়ে যেতে ওর মুখটা র’ক্তশূণ্য হয়ে যেতো। তোমরা কেন এমন করতে? এই বয়সে আমার মা নিজের ত্রিশ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে দেখলো তাও কি না তুমি পি স্ত ল দেখিয়ে বিয়ে করেছো? আমার ভাই, ভাবী তারা আতঙ্কেই ম রে যাবে। একেবারে মে রে ফেলো। আমি বলছি কোন কেস করব না৷ ওদের মে রে ফেলো। মে রে ফেলো!
তাসরিফ উঠে দাঁড়ালো। সায়রা ছটফট করছে। শক্ত করে নিজের বুকে চেপে ধরে তাসরিফ থামাতে চাইছে। বারবার বলছে,

— সব ঠিক আছে য়রা, তুমি শান্ত হও। প্লিজ এমন করো না। য়রা, প্লিজ….
বুকের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সায়রা৷ অতীত বলতে বলতে গিয়ে ক্লান্ত সে। নেতিয়ে যাওয়া শরীরটা তাসরিফ বুকে চেপে চুপ করে বসে রইলো। সায়রা’র এহেন রূপ সে দেখতে পারছে না৷ কি হচ্ছে সায়রা’র? ও তো এমন মেয়ে না। তাসরিফ জানে সায়রা’কে সঠিক ভাবে বিয়ে সে করে নি কিন্তু কি করবে ও? তিনটা বছর তো কম না। বয়সের বাহানায় সায়রা তাকে দেখেও দেখে না। তাসরিফ কি করেছে? শুধু সুযোগ বুঝে নিজের ভালোবাসা লুফে নিয়েছে।

সারা বাড়ী একা একা টইটই করছে দুপুর। নিজের মতো করে ভাত, মাছ, ডাল রেঁধেছ। ঘর বাড়ী ঝাড়ু দিয়ে মুছেছে। বন্ধ ঘরটার কাছে এসে কৌতূহল হলো কিছুটা কিন্তু শাহ না করায় সেই দিকে ততটা যাচ্ছে না অথচ কোথায় গিয়ে ভেতর ভেতর একটা চাপা আগ্রহ সেই বন্ধ ঘরটাকে ঘিরে। দুপুর গিয়ে ভেজা কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিলো। শোনা গেলো ফোন বাজছে। দৌড়ে আসে দুপুর। শাহ দিয়েছে নিশ্চিত! দেখা গেলো শাহ না দিলেও দিয়েছে তিব্বি। দুপুর বিছানায় বসে ফোন তুলে। অপর পাশ থেকে তিব্বি উদাস গলায় বলে উঠলো,
— আমাকে রেখে ভাইয়ের কাছে কেন গিয়েছো ভাবী?
— তুমি চলে এসো আন্টিকে নিয়ে।
— পরীক্ষা চলছে না? মাকে বললে পিটাবে আমাকে। আর এখন ওখানে এলে তোমার বর আমাকে দুটো ডান্ডার বারি দিয়ে ঠান্ডা করে দিবে।

— ইশ! কি যে বলো না তুমি? তোমার ভাই এত শান্ত অথচ তুমি তার বদনাম করছো?
— শান্ত না ভাবী সুনামি বুঝেছো। দেখেনি আমাকে সেদিন কিভাবে ধমকালো?
— আরে বাবা, ওটা তো আদরের শাসন।
— নিজের বরের হয়ে সাফাই গাইছো ভাবী? তোমাকে আপন মনে করি আমি।
— আপনই তো আমি।
— আচ্ছা, শুনো তুমি মনোযোগ দিয়ে। ভাইকে আঁচল দিবে না মুখ মুছতে। কোন কাজও করে দিবে না৷ বলবে এতদিন যেভাবে ছিলো ওভাবে যাতে থাকে।
— আচ্ছা।
— এত সহজে মেনে গেলে?
— সকালেই তো মুখ মুছে গেলো। তার কাজও সব করা শেষ আজকের মতো তাই আর চিন্তা নেই।
— কলটা আগে দেয়া উচিত ছিলো তাহলে।
— মিস করে গেলে।
পাশ থেকে মা তিব্বিকে এবার নিয়ে তিনবার পিঠে চড় লাগালো। শেষটা জোরে হওয়াতে তিব্বি মুচড়ে উঠলো। বললো,

— ভাবী, তোমার শাশুড়ী কথা বলবে।
মা কল ধরতেই বললেন,
— কেমন আছিস মা?
— আলহামদুলিল্লাহ। ভালো। আপনাদের খুব মিস করছি।
— আহারে আমার মেয়েটা একা হাতে সব করছে। শোন কিচ্ছু করবি না। শাহজেবকে বলে বুয়ার ব্যাবস্থা করছি আমি।
— না না। উনি আমাকে বলেছিলো কিন্তু আমিই না করেছি৷ দু’জনের কাজ আমি একাই পারব।
— তবুও….
— আচ্ছা প্রয়োজন হলে আমি বলব। আন্টি, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
— হ্যাঁ হ্যাঁ বল আম্মু।
— উনি কি কি পছন্দ করেন খেতে?
— শাহজেব? তোর উনিকে শুধু ভর্তা দিবি নানান পদের। বাঙালী খাবারই বেশি পছন্দ করে ও।
দুপুর মাথা নাড়ে। আজ সে বাকিটা সময় ভর্তা বানাবে। কাজে লেগে পড়লো দুপুর। কোমড়ে আঁচল গুজে আলু থেকে শুরু করে ডিম ভর্তা করলো। ঘরে আরো কিছু থাকলে দুপুর তারও ভর্তা করতো। তার শাহ’র পছন্দ বলে কথা।
গোসল সেরে দুপুর ফোন তুললো হাতে। বাসায় ফোন দেয়া দরকার। মনের ভেতর কেমন একটা লাগে মাঝেমধ্যেই। আতঙ্কে থাকতে থাকতে এখন আতঙ্কই লাগে সবসময়। এখানে ভয় নেই কোন দুপুর জানে। এই ঠিকানা কেউ জানে না৷
ফোন কেউ রিসিভ করে না৷ দুপুরের চিন্তা আরো বাড়ছে। চার বারের সময় মিরাজ সাহেবই ফোন ধরলেন। দুপুর শ্বাস আটকে ডাকলো,

— বাবা?
— মা।
— কণ্ঠ ভারী লাগে কেন?
— ঠান্ডা লাগছে সামান্য।
— আশ্চর্য! এই গরমে ঠান্ডা লাগলো কিভাবে?
— ঘামে ভিজে এই অবস্থা। আম্মু, বাবার কথা শোন।
— বলো শুনছি। বাবা?
— হ্যাঁ।
— আমার খুব চিন্তা হচ্ছে?
— কেন মা?
— জানি না কিন্তু বুকে কেমন জানি লাগছে।
— নতুন জায়গা যে তাই এমন লাগছে মা। বাবা কি বলি শুন, তুমি আপাতত কোন ভাবেই এখানে এসো না। আমি তোমার মা আর দাদুকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাব ভাবছি।
— দুলাভাই এর কাছে?
— না মা। ওখানে কোথাও বাসা ভাড়া নিব।
— বাবা?
— বলো।
— ওনারা কি এসেছিলো?
মিরাজ সাহেবের কণ্ঠ চেপে চেপে আসছেন৷ চোখটা বুজতে বুজতে বললেন,

সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১৬

— উহু। ওরা টেরই পায় নি মা। টের পেলেই বা কি? আমার দুপুরকে এখন আর পাবে না। আমি ম রে গেলেও শান্তি পাব এখন।
— এসব কথা বলবে না বাবা৷ আমার খারাপ লাগে।
— বলব না।
— ফুপিকে রেখে যাবে?
— ওরা তো দিবে না।
— তাসরিফ ভাই ফুপিকে ভয় পায়।
— তোমার ফুপি খুব স্ট্রং বুঝেছো।
— হু।
— রাখি তাহলে মা?
— আচ্ছা।
ফোনটা রেখেই স্ত্রীর পানে তাকালেন মিরাজ সাহেব। এখান থেকে সোজা চট্টগ্রামের পথ ধরবেন তারা। মেয়েটা এখন ভালো থাকবে। চিন্তা নেই আর।

সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১৮