সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১৯
সাইয়্যারা খান
হৃষ্টপুষ্ট এক পুরুষ দেহ লেপ্টে বিছানায়। মুখটা গুজে রাখা নরম এক বালিশে। পুরুষটার মুখের একপাশ ঢেকে থাকলেও আরেক প্রান্ত দৃশ্যমান। চোখের নিচে কালো দাগটা যেন এক স্পষ্ট প্রমাণ তার নির্ঘুম রাতের। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে বাইরে থেকে কেউ। সারারাত না ঘুমানো মস্তিষ্ক তখন তোয়াক্কা করে না কারো ডাকের। দরজাটা খট করে খুলে আপনাআপনি। ভেতরে আসে তাসরিফ। সূর্য এখন মাথার উপরে। তামজিদ কাল রাত থেকে বাড়ী ফিরে নি৷ আজ সকালে এসেছে। সারাটা দিন রাত এক করে সে খুঁজে যাচ্ছে দুপুরকে। তাসরিফ এই একমাস ধরে ভাইকে হাজার বার বুঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ। এই ব্যার্থতা বর্ণনাতীত। ইাশারায় কাজের মেয়েটাকে খাবার টেবিলে রাখতে বলতেই সে রেখে যায়। তাসরিফ গিয়ে তামজিদের পাশে বসে। খোলা পিঠে কিসের এক আঘাতের চিহ্ন, দেখেই বুকটা ধ্বক করে উঠে ওর। ড্রয়ার খুলে একটিসেপটিক লাগিয়ে ডাকে,
— ভাই, ভাই? উঠো।
তামজিদ নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ওর ঔষধ বাকি। ইদানীং ডাক্তার ঘুমের ঔষধ দিচ্ছে। হুটহাট রাস্তা হারিয়ে ফেলে থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে ও। গত একমাসে চারবার ঘটেছে এই কাহিনি। এলাকায় হলে এক কথা কিন্তু তামজিদ কাউকে না বলে কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম গিয়েছে। এই খবর পেয়েছে তাসরিফ কিন্তু আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে নি ভাইকে। ডাক্তার ওর অবস্থা দেখে ব্রেইন স্টকের সম্ভাবনা প্রকাশ করলেও তামজিদ বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না৷ ও নিজের মতো চলছে। এলোমেলো।
তাসরিফ গায়ে হাত বুলিয়ে ডাকলো ভাইকে। এবার একটু আধটু চোখ খুলে তামজিদ। তাসরিফ’কে দেখেই হাসে। বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— ঘুমাস নি?
— দুপুর এখন ভাই…..
কথাটা বলতেই ঝট করে উঠে বসে ও৷ চোখে দেখা যায় এক অদৃশ্য উন্মাদনা। তামজিদ’কে কিছু বলতে না দিয়েই তাসরিফ বলে উঠলো,
— বেলা হয়েছে অনেক। খাবে। উঠো। মুখ ধুয়ে এসো তো ভাই। আজ সায়রা নাস্তা বানিয়েছে।
তামজিদ কিছু একটা মনে করে উঠে যায়৷ মুখ মুছতে মুছতে ফিরে আসে। খেতে বসে বলে,
— তুই ভালো আছিস তো তাসরিফ?
ভাইয়ের প্রশ্নে সামান্য থতমত খেলো ও৷ ভালো থাকা আসলে কাকে বলে? যদি ভালোবাসার মানুষকে কাছে নিয়ে থাকা ভালো থাকা হয় তাহলে তাসরিফ ভালো আছে। যদি প্রতিরাতে ভালোবাসার মানুষের বুকে মাথা রেখে ঘুমানো ভালো থাকা হয় তাহলেও তাসরিফ ভালো আছে। কিন্তু যদি প্রিয় মানুষটা নিজেকে খোলসে পুরে নেয়, যদি মানুষটা এক নিরেট পাথরে রূপান্তরিত হয়ে যায়, যদি তার মাঝে এক আকাশসম অভিমান জমে থাকে তাহলে কি ভালো থাকা যায়?
সায়রা’কে ও নিজের কাছে আটকে রেখেছে। শিকলটা দেখা যায় না যদিও কিন্তু সে তালাবন্ধ তাসরিফে’র হাতে। কথাটা ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো ও৷
বললো,
— ভালো আছি ভাই।
— সায়রা একটা ভালো মেয়ে।
— জানি।
— জানিস না। ও কিন্তু চাইলেই ফেলে চলে যেতো বল কিন্তু দেখ গেলো না। আচ্ছা, ও কি জানে দুপুর কোথায় আছে?
স্বাভাবিক। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই করলো প্রশ্নটা। তাসরিফ ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো। মাথা নেড়ে বললো,
— একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ জানে না বললো।
— আর জিজ্ঞেস করিস না। আমি খুঁজে নিব।
— হুম৷
— বাবা’র সাথে ঐ সাইডের ব্যাবসাটা দেখিস কিছুদিন। দুপুর আসুক এরপর আমিই সামলে নিব।
তাসরিফ মাথা নাড়ে। ওদের অস্ত্রের ব্যাবসা আছে কিন্তু সেগুলো সম্পূর্ণ বৈধ। এই দিকটা তামজিদ নিজে সামলায়। মালোশিয়া থাকাকালীনও ওখান থেকে এখানে সমলাতো। তাসরিফ শুধু মাঝেমধ্যে যেতো। নিজের কোটি টাকার ব্যবসা যে তামজিদ এভাবে হেলাফেলা করবে তা ভাবতে পারে নি তাসরিফ। ভাইকে খায়িয়ে ঔষধের মধ্যে ঘুমের ঔষধটা লুকিয়ে খাওয়ালো তাসরিফ। কিছুক্ষণ কথা বলে বের হতেই তামজিদ হাসলো। তাকে কি ভাবে সবাই? ঘুমের ঔষধ খাওয়াবে আর ও জানবে না।
আস্তে ধীরে উঠে বারান্দায় দাঁড়ায় তামজিদ। সুদূর আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে। ঘন ঘন মেঘ দেখে একা একা অভিযোগ তুলে,
— তোমাকে আমার কাছে আনতে হবে দুপুর। তুমি যেখানেই আছো খারাপ আছো৷ আমার মন বলে তুমি খারাপ আছো। আমি বাদে কেউ তোমাকে ভালো রাখতে পারবে না।
দুপুর অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে চারপাশ। ওর চোখের দেখা ভুল হোক। দুপুর খুব করে চায় ভুল হোক সবটা। ড্রয়িং রুম থেকে আবার বরাবর সেই বন্ধ দরজায় তাকায়। একটু আগে সে ঐ রুমে গিয়েছিলো। নিজের জীবনে সে ঘৃণা বলতে দুপুর দুটো জিনিসকে করে। এক অস্ত্র, দুই পুলিশ। ঘৃণিত দুটো জিনিস একসাথে দেখে দুপুর হতভম্ব হয়ে গেলো। নিজের কাছে আজ মনে হচ্ছে জীবনটা তার জন্য না। অন্তত এই পৃথিবী তার জন্য না। হাত পা আরেকটু গুটিয়ে নিলো দুপুর। বাড়ী ফিরে তখন শাহ ভাতের পানি ঝাড়াচ্ছে। দুপুর কাঁদতে ভুলে গেলো। ওর কান্না কেন পাচ্ছে না?
ঘৃণিত দুটো জিনিস সে একসাথে পেলো তাও কি না নিজের অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকা মানুষটার মাঝে। নিয়তি এত কেন নিষ্ঠুর হবে? দুপুরকে আর কত পরীক্ষা দিতে হবে? আর কত দুপুর এভাবে জ্বলে জ্বলে ম র বে? যাকে নিজের দুনিয়া বানালো সেই মানুষটার মাঝেই যখন কলঙ্ক পেলো তখন গতি কি ই বা থাকলো দুপুরের?
নিজের মাথায় কারো হাত টের পেলেও দুপুর হাঁটু থেকে মাথা তুলে না। ও জানে সামনের মানুষটা কে। এই মূহুর্তে শুধু নিজের ফুপি বাদে কারো কথা মাথায় আসে না দুপুরের। তার মন চাইছে ছুটে যেতে তার কাছে। ফুপিকে জানাতে কত বড় প্রতারণা হয়েছে দুপুরের সাথে।
— উঠো ফ্রেশ হয়ে এসো দুপুর।
দুপুর নড়ে না। শাহ ওর পাশে বসে। গা ঘেঁষে। দুপুর নিরুত্তাপ। শাহ ওর পিঠে নিজের হাতটা রেখে বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— দিন গড়াচ্ছে সোনা। চলে এসো।
দুপুর তখনও অবশ্য নড়ে না। শাহ ওকে সেখান থেকে কোলে তুলে। পা বাড়ায় গোসলের উদ্দেশ্যে। পানির প্রতিটি বিন্দু আজ যেন বলে কয়ে যাচ্ছে দুপুরকে। মাথাটা ঝিম মে’রে আছে। শাহ ওকে কখন বের করলো, কখন খাওয়ালো দুপুর কিছুই টের পেলো না। এই যে এখন দুপুরকে জড়িয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে শুয়ে আছে দুপুর তো তাও অনুভব করতে পারছে না৷ যেই শাহ’র বুকে এতটা দিন দুপুর সুখ খুঁজলো সেই শাহ থেকে পাওয়া সবচাইতে বড় ধোঁকায় দুপুর সিটিয়ে আছে। কথা বলার ভাষা ওর জানা নেই যেন।
আজ সকালে শাহ যাওয়ার পর দুপুর কৌতুহল বশত ঐ ঘরটা খুলে। খোলা সহজ ছিলো না অবশ্য। আজ তারাহুরোয় শাহ চাবিটা টেবিলে রেখে চলে গেলো। দুপুর সারাদিন কাজ করলেও চাবিটাকে মাথা থেকে সরাতে পারলো না। অগত্যা রুম খুলে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে সাধাসিধা একটা রুম৷ খাট, আলমারি আর পড়ার টেবিল। বিসিএস সহ নানান বই। দুপুর কৌতুহলী হয়ে হাতায় কিছুক্ষণ। খাটে বসে কিছুক্ষণ বই ঘাটে অতঃপর গিয়ে আলমারি খুলে। ভাজে ভাজে অনেক পোশাক রাখা। দুপুর দেখে মাঝ বরাবর একটা ড্রয়ার৷ টান দিতেই খুললো। দুপুর হতবাক হয়ে তাকিয়েই রইলো। সেখানে রাখা পুলিশের ইউনিফর্ম সহ গান। দুপুর তখনও তেমন কিছু ভাবলো না কিন্তু হাতে এলো নানান সময়ে ট্রেনিং থেকে শুরু করে নানান ছবি। সবগুলোয় শাহ আছে।
বিভিন্ন মেডেল সহ শাহ’র ছবি। দুপুর সেগুলো দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা, কতটা সময় দুপুর জানে না। শাহ এসে কলিং বেল দিলেও দুপুরের কানে তা ঢুকে নি। নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে খুলেই শাহ ঢুকেছে। বরাবর রুমটা খোলা দেখে দুই মিনিট দাঁড়িয়ে যায় ও অতঃপর ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ফেলে পা বাড়ায় সেই রুমে। তার ভাবনায় যা ছিলো তাই ঘটেছে। দুপুর সব দেখেছে। এই জিনিস গুলো শাহ বেশিদিন লুকাতে পারতো না যদিও তবুও ও চায় নি এভাবে জানুক দুপুর। শাহ সেখান থেকে ওকে ধরে বের করে ড্রয়িং রুমে বসায়। ঐ ঘরটায় সব গুছিয়ে পুণরায় লক করে তবে এবার তালা ঝুলায় না। যা জানার দুপুর জেনেছে। শাহ ওর কাছে হাঁটু গেড়ে বসে কিছু বলে, দুপুর শুনে না। চুপচাপই থাকে।
দুপুর চোখ বুজে আছে। শাহ বুঝলো ঘুমিয়েছে। ফোনটা হাতে নিয়ে কল করলো মিরাজ সাহেব’কে। ওপাশ থেকে যা শোনা গেলো তার জন্য শাহজেব প্রস্তুত ছিলো না। ফোনের ওপাশে কাঁদছে সন্ধ্যা। ফোনটা ইফাত হাতে নিলো। শুধু বললো,
সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১৮
— দুপু’কে নিয়ে আসবেন একটু?
শাহজেব হতভম্ব ভাব নিয়েই উত্তর করে ছোট করে,
— হু।