স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৪

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৪
সানজিদা আক্তার মুন্নী

অন্ধকার নিভৃত কক্ষে মিটিমিটি আলোর ঈষৎ আভায় দেয়ালে পিঠ ঠেস দিয়ে বসে আছে নাজহা, এক অচল প্রতিমার মতো। দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত, একদম নিশ্চল হয়ে। আর তা হবেই না কেন? আজ যে প্রাণহীনতা তাকে গ্রাস করেছে। তৌসির আজ ওকে শারীরিকভাবে আঘাত করেনি, শুধু সজোরে ছিটকে ফেলে দিয়ে চপেটাঘাতের জন্য ভর্ৎসনা করেছে তবে আঘাত করেনি। কিন্তু চপেটাঘাতের চেয়েও বহুগুণে তীক্ষ্ণ ছিল তৌসিরের বলা বাক্য-কষাঘাত। ওর মুখ হতে নিসৃত তিক্ত গালিবর্ষণ, মাংসের আঘাতের চেয়েও দ্বিগুণ রেখাঙ্কন এঁকে দিয়েছে নাজহার অন্তর্জগতে।তৌসিরের অশালীন তিরস্কারে মনটা একতো বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন, তার ওপর এই দারুণ ভাবনা আপন অস্তিত্বের ধরণী কীভাবে এই স্বেচ্ছাচারী কিটের সঙ্গে সারাজীবন যাপন করবে? এ কি আদৌ নাজহার পক্ষে সম্ভব?

এই অসম্ভব প্রশ্নটির কোনো উত্তর নাজহা খুঁজে পায় না, আর না পায় এই অমিলন সমীকরণের কোনো গূঢ় মিলনসূত্র।ঠিক এমন অসহায় মুহূর্তে তৌসির ঘরে প্রবেশ করে। রুমের মাঝ বরাবর এসে দাঁড়িয়ে ও। অকস্মাৎ চারপাশে এক পলক চোখ বুলায়। নাজহার দেয়ালের সাথে এমন বিধ্বস্ত ও নিশ্চল ভঙ্গিমায় বসে থাকাটা তৌসিরের দৃষ্টিকে আটকায়। আটকাতেই তার বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘ, ভারি শ্বাস”এই মেয়েটিকে নিয়ে সে কী করবে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তৌসির মনে মনে অহর্নিশ চেষ্টা করে নাজহার মনমতো হতে, তাকে প্রীত রাখারও চেষ্টা করে তথচা নাজহা বরাবরই তৌসিরের প্রতিবর্তী কাজ করে। কীসের প্রয়োজন নাজহার তৌসিরের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির? কেনই বা সে এসব করবে? পরিণীতা তো পরিণীতার মতোই থাকবে, প্রতিটি বিষয়ে এমন হস্তক্ষেপ কেন? সম্ভবত এই কারণেই স্ত্রীকে অতিশয় প্রশ্রয় দিতে নেই।
তৌসির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরে ধীরে দু’কদম এগিয়ে আসে। নাজহা তৌসিরের উপস্থিতি টের পায়, তথাচি টের পেয়েও কোনো সাড়া দেয় না, সেই পূর্বের ন্যায় নিস্পৃহ হয়ে বসে থাকে, দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ রেখে। এ দেখে নাজহার সামনে এক হাঁটু গেঁড়ে বসে তৌসির। নাজহার দিকে কিছু সময় নির্বাক চেয়ে রয়। নাজহা তৌসিরকে নিজের সামনে বসে থাকতে দেখেও তৎক্ষণাৎ ওর দিকে নজরপাত করে না। তৌসির নাজহার এই মৌনতা দেখে নিজেও কিছু মুহূর্ত নীরবতা যাপন করে। অতঃপর, নাজহার শীতল হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলে,

” চলো ঘুমাইতাম।
নাজহা নিরুত্তর, সেই আগের ন্যায় স্তব্ধতার মূর্তি হয়ে বসে থাকে। তার ভেতরের আগ্নেয়গিরি এখনও শান্ত হয়নি। তৌসির এটা দেখে হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধে অন্য হাত রাখে, তৌসরিরে স্বরে অক্লান্ত চেষ্টা পরিস্থিতি শান্ত করার এক ব্যর্থ প্রয়াস “চলো, ঘুমাই আমরা।”
​এই অসহ্য স্বাভাবিকতা নাজহার অন্তরের ক্রোধাগ্নিকে মুহূর্তে আক্রোশে পরিণত করে। ও দাঁতে দাঁত চেপে তৌসিরের দিকে তাকায়, চোখে এখন তিক্ত ঘৃণা। সমস্ত গুমোট ভেঙে এক ঝাঁঝালো চিৎকার করে
​”তো ঘুমোচ্ছেন কেন? আমি কি ধরে রেখেছি! যান!”

​তৌসির নাজহার এই ঝাপটা ক্রোধে সামান্যও বিচলিত হয় না। বরং ও ঠোঁটে এক ব্যঙ্গাত্মক হাসি টেনে ধরে। এক দীর্ঘ, ক্লান্ত শ্বাস ফেলে বলে “তেজ দেখাচ্ছো আমায়, তালুকদারের মাইয়া?”
​নাজহা ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে জবাব দেয় “হ্যাঁ, দেখাচ্ছি তো! আপনার কোনো সমস্যা?”​
তৌসির আর কোনো তর্ক বাড়াবার উপায়ান্তর না দেখে, মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয় আর এক ঝটকা টান দিয়ে নাজহাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং পরক্ষণেই শক্ত হাতে কোলে ওকে তুলে নেয়। আর বলে​”এত রাগ কইরো না, তালুকদারের মাইয়া। রাগ, অহংকার ভবিষ্যতের জন্য খুব খারাপ।”
​নাজহা কোল থেকে নামার জন্য বন্যের মতো হাত-পা ছুঁড়তে থাকে। ওর মুখ দিয়ে ক্ষোভের বিষ ঝরে পড়ে “নেশাখোর! গাঁজাখোর! বাটপার! ছাড়ুন আমায়!”

​কিন্তু তৌসির ওকে ছাড়ে না। তার ধরা শক্ত বাঁধন নাজহার সমস্ত প্রতিবাদকে ব্যর্থ করে দেয়। ওকে জোর করে বিছানায় বসাতে বসাতে তৌসির ঠাট্টার সুরে বলে “এমন ব্যাঙের মতো লাইফছ না লো ডাকাইতনি। কোমর-টোমর ভাইঙ্গা নিয়া আমার বিপদি বানাবি ।”
​বিছানায় বসিয়ে তৌসির নাজহার দিকে ঝোঁকে। নাজহার চোখ এখনও প্রতিরোধের আগুন নিয়ে জ্বলছে, কিন্তু ওর শরীর অবসন্ন। সে বোঝে, এই মানুষটির শারীরিক বলের কাছে ওর সমস্ত আবেগিক শক্তি আজ পরাস্ত।
{ একটু সাহিত্যিকের মতো লিখতে চাইলাম আরকি! তথাপি আমি ব্যার্থ 🫢}

কিছুক্ষণ পর…
নাজহার রাগ কমেনি, একটুও কমেনি। বিছানার দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে চুপচাপ গুটিসুটি মেরে বসে আছে, মুখে রাগের আগুন নিয়ে। ক্রোধে রগে রগে জট লেগে যাচ্ছে। তৌসির ওর সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে। তবে শান্তিতে ও বসে নেই। শান্তি শব্দটা তৌসিরের সাথে জীবনেও যায়নি আর যাবেও না। এই তো তৌসির বসে আছে তো আছেই, সাথে নাজহার পায়ের আঙুলগুলোতে নিজের হাতের বৃদ্ধা আঙুল কখনো বুলাচ্ছে, আবার কখনো আঙুলগুলো আলতো টেনে ধরছে আর ফিসফিস করছে, “আর কখনো তোমার লগে চিল্লামু না, সত্যি কইতাছি। আও, এবার ঘুমাই।”

নাজহা রাগে ফোঁস করে ওঠে, “না, চিল্লাবেন না কেন? আরও বেশি করে চিল্লান। আমি তো বান্দি, আমায় এনেছেন তো বান্দি। আমার সাথেই তো চিল্লাবেন।”
এটা শুনে তৌসির থতমত খেয়ে যায়। এই মাইয়া তো বহুত বজ্জাত! নিজের মুখে নিজেকে ‘কামের বেডি’ বানাইয়া নিতাছে! তৌসির মুখ তুলে ওর পানে নিরলস চাহনি নিয়ে বলে, “তুমি বউ, বউয়ের মতো থাকবা। তুমি ক্যান আমার লগে গাদ্দারি করবা আর আমার রাগ উঠাবা?”
নাজহা তৌসিরের কথায় চিৎকার করে উচ্চারণ করে, “আমি যা করেছি ভালো করেছি। গাঁজা বিক্রি করেন! ড্রাগস বিক্রি করেন! লজ্জা নেই? দেশের ছোট ছোট কিশোরগুলোকে এসবে জড়িয়ে মারেন! নির্লজ্জ! ওদের কতটুকু ক্ষতি হয় বোঝেন? টাকা আয় করার নেশায় মনুষ্যত্ব খুইয়ে নিয়েছেন? জানেন আপনারা জানেন? যেখান অন্য দেশের তরুণ প্রজন্মের হাতে মানুষ দেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ তুলে দিচ্ছে, সেখানে আমাদের এই দেশে আপনাদের মতো রক্তচোষারা তাদেরই ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিচ্ছেন এই মাদকদ্রব্যের দ্বারা।”

তৌসির নাজহার কথায় বিরক্ত হয় খানিকটা চোরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রয় আর হেসে বলে, “এত দেশপ্রেম না মারাইয়া চুপচাপ ঘুমাও। দেশের মাইনষের ভবিষ্যতের চিন্তা না কইরা আমার বংশ বিস্তার করার চিন্তা করো।”
নাজহার খুব রাগ হয়, বড্ড বেশিই রাগ হয়। দুই হাত দিয়ে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে আর দাঁত চেপে জবাব দেয়, “আমি করব না আপনার ঘর।”
তৌসিরের রগও এবার ত্যাড়া হয়ে যায়। এতক্ষণ নরম ছিল, তথাচ আর রইতে পারে না শান্ত। এবার তাই শক্ত গলায় বলে, “তাইলে তোর বাপরে ফোন দিয়া কই যে আফনার ডাকাইতনি আমার ঘর করত না। নিজের ঝিজ নিজের কাছে নিয়া যান।”

“হ্যাঁ, বলুন! এক্ষুনি বলুন! থাকবো না আপনার সাথে!”আমি আব্বাদের সব বলে দিব, সব বলে দিব!”
ওর কথায় তৌসির তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “ও সিনাল, তোর বলা লাগতো না। তোর বাপ-চাচা এসবে আমার থেকেও এক কাঠি ওপরে, তাই এত ফোঁসফোঁস করিস না।”
“আমার বাপ-চাচা খারাপ হলেও আপনার মতো খবিস না। আপনার নামে আমি মামলা দিব, নারী নির্যাতনের মামলা দিব।”
“তুই আমারে যে প্যারা দেস লো ভেত্তমিজনি, তাইলে তো আমারও তোর নামে পুরুষ নির্যাতনের মামলা দায়ের করা উচিত!”
“আমি পুলিশকে আপনার কুকর্মের কথা বলে দিব, সব বলব।”
“আমিও তোর বাপ-চাচার বিরুদ্ধে যত প্রমাণ আছে, সব মিডিয়ায় দিয়া দিমু। হইবো?”

নাজহা তৌসিরের সাথে কথায় পেরে ওঠে না। ও এক কথা বললে তৌসির একশো কথা বলে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে নাজহা তর্ক বন্ধ করে উঠে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। থাকবে না এই লোকের সামনে। তথাপি এতেও সে ব্যর্থ। কারণ তৌসির ওকে যেতে দেয় না। তৌসির ওকে এক টানে নিজের বুকে চেপে ধরে বালিশে মাথা রাখে। আর সাথে নাজহার কাঁধে, ঘাড়ে, গলায়, গালে, নাকে, কপালে, চুলে ইচ্ছে মতো এলোপাতাড়ি নিজের ঠোঁটের নিগূঢ় ছোঁয়া এঁটে নিতে নিতে বলে, “তোমার এই মামলার দায় আমার দেওয়া চুমুতে পুষিয়ে যাবে, কৈতরি।”
তৌসিরের এই পাগলামি মোটেও সহ্য হয় না নাজহার। তৌসিরের দাড়ির আঘাতে দম নাকের কাছে চলে এসেছে। নাজহা চিৎকার করে ওঠে, “আপনার দাড়ি গিয়ে যদি আপনি না ফেলেন, তাহলে দেখবেন কী করি! খবিস গাঁজা বিক্রেতা গরু কোথাকার।”

এই যে তৌসির এমন এলোপাতাড়ি চুমু এঁটে যাচ্ছে নাজহাকে। এতে রাগ হচ্ছে না নাজহার কারণ ও বাস্তবতা মেনে নিয়েছে এই লোকই ওর সমস্ত কিছু। নিজের সবকিছুই এই নিকৃষ্ট সত্তার অধিকারী তৌসিরের। এটাই চিরসত্য আর এটাই বাস্তব। তাই নাজহাও মেনে নিচ্ছে এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা, এই নির্মম সত্যকে। মেনে না নিলেও মানাতে হবে।নাজহাকে ইচ্ছে মতো চুমু খেয়ে তৌসির ওকে নিজের বুকের মাঝ বরাবর টেনে ধরে বলে, “রাগ কমলো?”
নাজহা নিশ্চুপ, কোনো উত্তর দেয় না। চুপচাপ তৌসিরের বুকে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকে। তৌসির আবারো শোধরায়, “কী হইলো? কথা কও না ক্যান?”
“ইচ্ছে নেই আপনার সাথে কথা বলার!”
তৌসির নাজহার পিঠে ও বাহুতে আলতো হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গলার সুর নরম করে বলে ওঠে, “গাদ্দারি না করলেই কি নয়? আমি তোমার জামাই, তুমি আমার লগে ক্যান এসব করো?”
নাজহা এ কথায় তৌসিরের বুক থেকে মাথা তুলে তার মুখ পানে নিশ্চুপ চেয়ে থেকে শান্ত গলায় বলে, “আচ্ছা, এগুলো না করলে না হয় না? ভালো কিছু করা যায় না? আমি চাই না আপনি এসবে যুক্ত থাকুন। আমি চাই আপনি একজন ভালো মানুষ হোন।”

তৌসির নাজহার কথায় তব্দা খেয়ে মনে মনে ভাবে, “বাহ! হঠাৎ আমার ইচ্ছাধারী নাগিন এত সুন্দর রূপ নিলো কী মতলবে?” তবে মুখে এটা বলে না। যদি মুখে বলে, তাহলে ছোবল খাওয়ার সম্ভবনা একশো পার্সেন্ট আছে। তাই জীবনের ঝুঁকি না দিয়ে ম্লান গলায় বলে, “দেখি, দু-এক বছর যাক। টাকা-পয়সা আরও কিছু মেরে নিই। বাচ্চা দু-একটা হইলে যেন আয়েশে জীবন কাটাইতে পারে, তার ব্যবস্থা করি। তারপর ছাইড়া দিমু’নে।”
তৌসিরের কথায় ঠান্ডা মেজাজ আবারও তিক্ত হতে থাকে নাজহার। বিরক্ত হয়ে বলে, “আপনার এই চিন্তা মনে যদি থাকে, তাহলে ভালোভাবে মনে সেঁটে নিন আপনার বাচ্চার মা হবো না আমি।”
নাজহার কথায় তৌসির ওকে নিজের বুকে আবার জড়িয়ে নিতে নিতে বলে, “তুই তো ব্যাটি নিজেই বাচ্চা। আর কী আমার বাচ্চার মা হবি! আগে নিজে বড় হ, পরে ডায়লগ দিস।”
নাজহা তৌসিরের বুক থেকে পিছলে গিয়ে তার বাহুতে মাথা রাখে। আগের ধস্তাধস্তির কারণে নাজহার হাতের চুড়ির সাথে ঘষা খেয়ে হাতের চামড়া খানিকটা ছিলে যায়। নাজহা নিজের হাত তৌসিরকে দেখিয়ে বলে, “দেখুন, আপনার জন্য আমার হাত কেটে গেছে।”

তৌসির তীক্ষ্ণ চোখে তার হাতের দিকে কিছু সময় চেয়ে থাকে। তারপর হাতটা টেনে নিয়ে যেখানে ছিলেছে, সেখানে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলে, “কইমা যাইব।”
নাজহা ঝাড়ি মেরে নিজের হাত সরিয়ে হাতের চুড়িটা খুলে নিয়ে তৌসিরের বুকের উপর রাখে আর বলে, “এটা বালিশের নিচে রাখুন। এদিকে রাখলে বিছানা ঝাড়ার সাথে পড়ে যাবে আর আপনার বিবিজান কা কা করবে।”
তৌসির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুড়িটা বালিশের নিচে রাখতে রাখতে বলে, “তোমরা মেয়েরা এমন ক্যান? এক সেকেন্ডও বনে না কারও লগে কারও।”
“বনার হলে তো বনবে। আপনার বিবিজান একজন বদ মহিলা।”
“মুখ সামলিয়ে কথা কও! আমার বিবিজানকে এভাবে বলবা না।”
নাজহা তৌসিরের এই দরদ দেখে বিষাক্ত গলায় বলে, “এত যখন দরদ উনার প্রতি, আমায় বিয়ে করলেন কেন? উনাকেই করে ফেলতেন।”

“উফ! এত কথা কইও না। ঘুমাও এখন।”
“উচিত কথা বলছি বলে গায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে নাকি?”
“ এত ঝগড়া করো ক্যান তুমি?”
“কী বললেন? আমি ঝগড়া করি?”
তৌসির বুঝে যায়, এ মহিলা বেজায় রেগে গেছে। ওর কথার ঝড় সামলাতে না পেরে তৌসির মনে মনে অসহায় হয়ে ভাবলো, “বোম কিনতে যদি টাকা না লাগতো, তবে এই গজবের মুখে একটা ফাটায়ে দিতাম!”
কিন্তু মুখে ও বুদ্ধি খাটিয়ে বলে, “তুমি সুন্দরী বইলা লাইনে-বেলাইনে ছোট খুঁত ধইরা ইচ্ছে তাই কইবা।”
ব্যাস, ঝগড়া থেমে গেলো। নাজহা আর কোনো কথা বলে না। তথাচ কিছু সময় চুপ থেকে আবারো বলে, “আমারে পাম দিতে আইসেন না।”
“আচ্ছা ম্যাডাম, এখন একটু দয়া করে আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”

ঘড়ির কাঁটায় সকাল এগারোটার কাছাকাছি।
তৌসির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাদ্রের মেঘলা দিনেও কেমন একটা ভাপসা গরম। কিন্তু এ গরমের চেয়েও তীব্র একটা তেতো ভাব তৌসিরের চোখে-মুখে এঁটে আছে। বিষমাখা তিক্ত নজরে বাড়ির গেটের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। বিরক্তি আর তিক্ততা মিশে তৈরি হয়েছে এই চাহনি এই বিরক্তির কারণ শুধু দেখতে পাচ্ছে না, বরং অনুভব করছে। এক বিরক্তিকর, অনিবার্য ঘটনাকে। তা হলো শ্বা… শ্বা… শ্বা… করে গেট পেরিয়ে একের পর এক তীক্ষ্ণ, যান্ত্রিক শব্দ তুলে হুড়মুড় করে প্রবেশ করতেছে মোটর বাইক। বিশ থেকে পঁচিশটি বাইক! সংখ্যাটা তৌসিরের বিরক্তিকে আরও শানিত করে তুলেছে এত মানুষ কেন আসবে? কত টাকা খরচ হবে এদের খাওয়াতে।

এই বাইকগুলো তালুকদারদের।তালুকদাররা এসেছেন বলে কথা একটু ঝাঁকঝমক তো থাকবেই।ওদের সবকিছুতেই একটা ‘তালুকদারি’ ঠাঁট! প্রতি বাইকে দুজন করে বসা, চালক আর আরোহীর সম্মিলিত ভারে বাইকগুলোও আরও দাপুটে। যান্ত্রিক গর্জনে লন-বাগান পেরিয়ে তারা এগিয়ে আসছেন মূল ভবনের দিকে।বাইকগুলোর পেছনেই প্রবেশ করে একটি কালো সেডান। গাড়িটি এসে শিকদার বাড়ির উঠনের মাঝমাঝি থামে। থামা মাত্রই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন কালো পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত নো’মান। তিনি গাড়ির বাইরে পা রেখে কিছু মুহূর্তের জন্য থমকান। তারপর আলতো করে হাত বাড়ান গাড়ির ভেতরের দিকে।অতঃপর নোমানের হাত ধরে সলজ্জ, সাবধানে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন সাফা তৌসিরের ছোট ফুফু, নোমানের স্ত্রী।

নোমান এবং তার পরিবারের যারা এসেছেন তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত মিলও আছে বটে। আগত সকল পুরুষই কালো পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত। তার উপরে কালো পাথরের কারুকার্যে শোভিত মুজিব কোট সবার জন্য একই পোশাক, মনে হচ্ছে কোনো সুশৃঙ্খল সেনাদল যারা উনারা বিয়ে খেতে এসেছেন। উনারা সবাই কালো পড়েছেন আর সাফা পড়েছেন সাদা পাথরের বোরকা আর হিজাব। এই দূশ্য টা তৌসিরের নজর কাড়ে। বেশ সুন্দর লাগছে ওর ফুফু কে ওর মনে হচ্ছে হাজারো কালো পোকার মধ্যে একটা সাদা পবিত্র ফুল। ওদের এই মেচিং ড্রেসের কাহিনি দেখে তৌসির ঠোঁট বাকিয়ে বলে,” মাঙ্গের নাতিদের কত সাউয়া।”

উনাদের উপস্থিতির তালিকাটা মনে মনে সাজায় তৌসির।ভালো করে দেখে নাজহার পনেরো জন চাচার মধ্যে নয় জন এসেছেন। চাচাতো বড় ভাইদের মধ্যে আটাশ জনের মধ্যে এসেছে সতেরো জন, আর ছোট চাচাতো ভাইদের তেরো জনের মধ্যে এসেছে ছয় জন। ভাগ্নে উনিশ জনের মধ্যে এসেছে দশ জন। ভাতিজাদের পঁচিশ জনের মধ্যে এসেছে বারো জন। এছাড়াও, ভাগ্নে-ভাতিজা মিলে তাদের দশ-বারোজন ছোট ছেলে মেয়ে আছে, তাদের মধ্য থেকে এসেছে সাত-আট জন।এই বিপুল জনসমাবেশের হিসেব করতে করতে তৌসির বিরক্ত গলায় বলে, ” হালা তালুকদার দিছে রে মন মতো জন্ম। পাঁচ গরুর ওর এক পারিবারেই খাইয়া নিত পারব এক বেলায়।”

নাজহা ওয়াশরুমে গোসল দিচ্ছিল। গোসল সেরে বেরিয়ে আসে আশেপাশে এক নজর থাকায় তারপর চুল মুছতে মুছতে বেলকনির দিকে পা বাড়ায়। বেলকনির কাছাকাছি যেতেই ওর সাথে ধাক্কা লাগতে যায় তৌসিরের, তথাপি ধাক্কা লাগে না। তৌসির কিছুটা পিছনে সরে যায়। তৌসিরকে এই অ-বেলায় রুমে দেখে নাজহা ভুরু কোঁচকায়, সন্দিহান দৃষ্টিতে মুখ তুলে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি এখানে কেন?”
তৌসির অবাক হয়। কি বলে এই মেয়ে! আজ বাড়িতে মেহমান আসবে, আর আজ তৌসির বাড়িতে থাকবে না? তৌসির চমকে গিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করে, “কিতা লো, মাথার স্ক্রু ডিলা হইয়া গেছেনি কিতা? জানো না আইজ বাড়িতে কি?”

নাজহা থমকায়। সত্যি বলতে আজ বাড়িতে কি হচ্ছে তা তার অজানা। সকাল থেকে আয়োজনের দৌড়াদৌড়ি দেখছে, তথাচি দেখে কৌতূহল হলেও কাউকে জিজ্ঞেস করেনি কিসের জন্য এত আয়োজন। এই বাড়িতে কারো সাথে প্রয়োজন ব্যতীত কোনো আলাপ হয় না ওর। রান্নাঘরে গেলে যে কাজ ওকে দেওয়া হয় তা চুপচাপ করে, তারপর বেরিয়ে আসে। তিতা-মিঠা একটা বাক্যও কারো সাথে অপ্রয়োজনে ব্যয় করে না। তৌসিরের কথায় নাজহা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে বলে, “না তো!”

তৌসির বুঝে যায় সত্যি নাজহা এই বিষয়ে অজান্তা। এই সুযোগে খোঁচা মেরে বসে, “জানবা কেমনে, কারো লগে কথা কও না, মিশো না, খন্নাসদের মতো একানঙ্গি হইয়া থাকো।”
তৌসিরের কথায় খুবই বিতৃষ্ণা অনুভব করে নাজহা। একটা মানুষ কীভাবে সবসময় ফাজলামির উপর ভেসে থাকে? কিভাবে? সত্যি, অসম্ভব ধৈর্যচ্যুতি ধারণ হয় এমন আচরণে, এমন কথাবার্তায়। নাজহা আর কথা না পিছনে ঘুরে বাড়িয়ে টাওয়ালটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে চাপা রাগ নিয়ে বলে, “আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করছি, আপনার বলা লাগবে না।”

বলে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তৌসির ওকে যেতে দেখে তড়িৎগতিতে নিজেও পা বাড়িয়ে বলে, “চলো, আমিও যাই।”
রুম থেকে কৌতূহল নিয়ে বের হয়ে যখন করিডরে দাঁড়ায় আর লিভিং রুমের অবস্থায় দৃষ্টিপাত হয়, সাথে সাথে তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে। নিজের পরিবারের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে দেখে বাকরুদ্ধ নাজহা। তাকে দাঁড়াতে দেখে তৌসির পিছন থেকে মিঠার মোড়কে দুষ্টুমি গলায় বলে, “আশ্চর্য হলে?”
নাজহার ঠোঁটে নিজের অজান্তেই এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। নিজের সর্বপ্রিয়জনদের যে দেখছে! আহা, মনে হচ্ছে শত যুগ পর এই চেনা মুখগুলো চোখে ধরা দিলো। তৃপ্তিদায়ক চোখে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে উচ্ছল গলায় বলে, “অতিশয় আশ্চর্য হলাম।”

তৌসির নাজহার কথায় কোথা থেকে এক ঝাঁক শান্তির দেখা পায়। তার বউ এই প্রথমবার তার সাথে এত সুন্দর করে কথা বললো। শান্তি তো পাওয়ারই কথা।
নাজহা নিজের ওড়নাটা মাথায় টেনে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করে। ওর পাশ ঘেঁষে তৌসিরও নামে। ইকরাব আর সাহেব ভাইও এসেছেন। তারা তৌসির আর নাজহাকে একসাথে দেখে উভয়ই মুচকি হাসেন।
উনারা আসতে চাননি, মন চায়নি। তথাপি আসতে না চাইলেও প্রিয়তমাকে দেখার লোভ সামলানো সম্ভব হয়নি উনাদের পক্ষে। তাই মন পুড়বে জেনেও এসেছেন।

নাজহা ধীরে ধীরে নিচে নামে। ও নামতেই সবার আগে ওর মাস্টার চাচ্চু আর ছোট চাচ্চু এগিয়ে আসেন। নাজহা অবাক হয়ে তাদের দিকে চেয়ে রয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে উনারা দু’জনে হাত বাড়ান নাজহার ন্যায়। নাজহা নিজেকে আর আটকাতে পারে না। সবার প্রতি অভিমান জমলেও এই দু’জনের প্রতি কোনো অভিমান বা অভিযোগ ওর নেই। নিজের ছেলের মতো মনে করেন উনাদের। উনাদের খাওয়া-দাওয়া, সব খেয়াল রাখত সে। বড্ড বেশিই ভালোবাসে এই দুই চাচাকে।নাজহা এগিয়ে গিয়ে দুই হাতে আগলে উনাদের গলা জড়িয়ে ধরে। নাজহার ধরা অনুভব করেই উনারা বুঝে নেন, কতটা কাঙাল হয়ে আছে উনাদের জন্য নাজহা। মাস্টার চাচ্চু আর ছোট চাচ্চু দু’জনেই স্নেহভরা ছুয়ায় হাত বুলিয়ে দেন ওর পিঠে, আর জিজ্ঞেস করেন, “কি অবস্থা তোর? ভালো আছিস তো?”

নাজহা উনাদের বুক থেকে মাথা তুলে মাথা নাড়িয়ে বলে, “আলহামদুলিল্লাহ, তোমরা?”
পাশ থেকে তানভীর চাচ্চু, মোল্লা চাচ্চুরা বলে ওঠেন, “বাহ! চাচ্চু বুঝি শুধু এই দুজন!”
নাজহা উনাদের কথায় মেকি হেসে সালাম দেয়, “আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছো তোমরা? নিশ্চয়ই খুব ভালো আছো, তাই না?”

ওর প্রশ্নে নোমান সাহেব আর ওদের সবার বড় ভাই তানিম ভাই তার পাশে এসে দাঁড়ান। নাজহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, “এভাবে বলছিস কেন? তুই বাড়িতে নেই তো কেউ আর কারো খেয়াল রাখে না, যত্ন নেয় না। সত্যি অর্থে তোকে ছাড়া পূর্ণ তালুকদার মহলও শূন্য।”
তাঁদের বাক্যবাণে নাজহা শুধু মাথা নিচু করে। সেই নতমুখে ফুটে উঠে এক তাচ্ছিল্যের হাসি, যা বড় শূন্য, বড় করুণ। আজ এ কথা বলছে অথচ নিজ স্বার্থের কদর্য খেলায় তাঁরাই ওকে কুকুরের মতো বিলিয়ে দিয়েছেন।
চক্ষু তুলে নাজহা চারপাশে তাকায়, খুঁজে ফেরে দুটি মানব প্রতিকৃতিকে। তারা হলেন ওর আব্বা আর তালহা ভাই। মন চায় একবার তাদের উপস্থিতি! কিন্তু নাহ, এই দুই আশ্রয়দাতার দেখা মিললই না।তাদের অনুপস্থিতি নাজহার অন্তরে এক কঠিন প্রশ্ন বুনলো, ‘এঁরা কত নিষ্ঠুর! যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, যে তাদের প্রাণ, তাকেই এত সহজে অবহেলা করলো?’

‘তালহা ভাইয়ের না আসা মানাই গেলো, কিন্তু আব্বা? মেয়ের কথা বুঝি একবারও মনে পড়ে না তাঁর?’
অথচ প্রতিদিন দু’বার-তিনবার ফোন করেন! কিন্তু তিনি মেয়েকে একবার দেখতে আসেন না। আজ সবাই এলো, সবার সাথে, আর আব্বা এলেন না।বাবার মুখটা দেখার জন্য, উনার বুকে মাথা রাখার জন্য নাজহার ভেতরটা হাহাকার করছে। কতদিন হলো ও আব্বার দেখা পায়নি, কতদিন হলো বুক ভরে ‘ও আব্বা’ বলে ডাকতে পারেনি।
এইসব ভাবনার অতল গহ্বরে যখন ডুবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল, তখনই চোখ পড়ে সাহেব ভাইয়ের উপর, যিনি ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন। উনার তাকানোটা অসহায় হলেও নাজহার বোধগম্য তা হয় না। সে এই চাহনিকে স্নেহেরই ভেবে বসে, উনাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে, “কি অবস্থা, সাহেব ভাই?”
সাহেব ভাই ওর ইশারার প্রতিত্তোরে মিটি হেসে মাথা নাড়িয়ে জবাব দেন, “ভালো, তোর?”
নাজহা একগাল হেসে ইশারায় উত্তর দেয়, “ভালো!”

সাহেব ভাইয়ের থেকে চোখ সরতেই ইকরাবের উপর নজর পড়ে, যে কিনা গ্লানিসিক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নাজহা ওর তাকানো দেখে দ্বিতীয়বার আর ইকরাবের ন্যায় চোখ বুলায় না, মাথা নিচু করে নেয়। ইকরাবের দিকে তাকালে নিজেকে ভারী অপরাধী মনে হয়। কেন জানি মনে হয়, এই উন্মাদ পুরুষটিকে নাজহা নিজেই ঠকিয়েছে।আর এই উন্মত্ত পুরুষটিকে নাজহা কেবল ঠকায়নি, সে তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। এই হতভাগ্য পুরুষটিকে নাজহা চরমভাবে প্রতারিত করেছে।

যে কিনা কেবল তাকে একান্তে পাওয়ার উন্মত্ত বাসনায় জন্মদাত্রী মা-বাবার কোল ছেড়েছিল, তুচ্ছ করে দিয়েছিল নিজের সমস্ত ভবিষ্যৎ, বিসর্জন দিয়েছিল জীবনের সব স্বপ্ন শুধু নাজহাকে নিজের করে নেবে বলে। সে তো সেই চরণেও মাথা নত করেছিল, যেখানে তার নিজের আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ হওয়া নিশ্চিত ছিল।তার সমগ্র সত্তা, তার বাঁচা-মরা, সবকিছুই নাজহাকেন্দ্রিক ছিল। তার অস্তিত্বের প্রতিটি কণা, তার বেঁচে থাকার প্রতিটি কারণই ছিল নাজহাময়।তথাচ, এত প্রেম, এত ব্যাকুলতা, এত তীব্র আর্তি সবই আজ নিষ্ঠুর পরিহাস।শূন্যতার হিমশীতল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ইকরাব। নিজের জীবনের শেষ অবলম্বন, শেষ আশ্রয়টুকুও আজ অন্যের ভোগ্যবস্তু।
তার ভালোবাসার মহাকাব্য আজ এক অপমানের মর্মান্তিক উপসংহারে এসে থমকে গেছে। আর এই পরিণতির দায় শুধু নাজহার, শুধুই নাজহার। কারণ সে তাকে ভালোবাসতে পারেনি, সে তো নিজের অজান্তে তালহা ভাইকে আপন বক্ষে বুনে নিয়েছে।

এবার সবাই নাজহাকে ছেড়ে একে একে তৌসিরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তৌসিরও বিনয়ের সাথে কুশল বিনিময় করে।
রুদ্র আর নাযেম চাচা দাঁড়িয়ে আছেন লিভিং রুমের এক কোণে।রুদ্র দেখছে এক দৃশ্য, সিমরান নাজহার এক চাচাতো ভাই তূর্যের সাথে কথা বলছে। তূর্য বারবার সিমরানের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলছে, এটা-ওটা বলছে, হাসছে।এসব দেখে রুদ্রের শরীরের চামড়া জ্বলতে জ্বলতে ব্যথা ধরে যাচ্ছে। সিমরানও মাথা নাড়াচ্ছে, হ্যাঁ-না উত্তর দিচ্ছে। এসব কীর্তি দেখে রুদ্রের মন চায় সিমরানের গাল ফাটিয়ে নিতে, হাত-পা ভেঙে চুলায় ঢুকিয়ে লাকড়ির সাথে জ্বালিয়ে দিতে।রুদ্র আর সহ্য করতে না পেরে নাযেম চাচাকে ডাক দেয়, “ও চাচা, ঐদিকে দেখো!”

নাযেম চাচা উনার কথায় উত্তর দেন, “কিতা দেখতাম? এখানে তো দেখার মতো কোনো সুন্দরী রমণী নাই।”
রুদ্র উনার কথায় অতিশয় বিরক্ত হয়ে বলে, “তুমি মিয়া বিশ্ববদমাশ! তোমার নজরে ভালা না!”
নাযেম চাচা মুখ থেকে তিক্ত আওয়াজ বের করেন, “আমি আবার কিতা করলাম রে?”
“তোমারে কইছি, তোমার ভাতিজির দিকে দেখো, ও কেমন টিংটিং করে কথা বলছে ঐ গাদ্দারদের সাথে!”
“কথা আবার টিংটিং করে বলে কেমনে?”
রুদ্র এবার রাগ নিয়ে বলে, “চাচা, ফাইজলামি করিও না! ওরে এন থেকে সরাইয়া আনো, আমার গা জ্বলছে!”
নাযেম চাচা রুদ্রের দিকে পাশ ফিরে চেয়ে বলেন, “এবার লাইনে আইলো সোজা কথা! সোজাসাপ্টা কবি, ঘুরাইয়া কস ক্যান? দাঁড়া, আনতেছি।”

এ বলেই উনি সাথে সাথে জোরে ডাকেন, “সিমরান! এদিকে আয়! রুদ্র তোরে ডাকতেছে!”
শেষ রুদ্রের মানে ইজ্জতে ইজরায়েলি বোমা মাইরা দিলেন নাযেম চাচা। উপস্থিত সবাই একবার রুদ্রের দিকে তো আরেকবার সিমরানের দিকে তাকান।রুদ্র নাযেম চাচার এই কান্ডে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “এ ব্যাটা গরু, কি কইলি এডি? তাড়াতাড়ি কথা ফেরা!”
নাযেম চাচা চারপাশের পরিস্থিতি দেখে আমতা আমতা করে বলেন, “না রে, রুদ্র ডাকছে না! গতকাল যে রুদ্রের শার্ট রাখছিলি, ঐটা দে তো!”

এটা শুনে সবাই স্বাভাবিক হন। রুদ্র তাও মনে মনে বলে, “আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ, আল্লাহ!”
তূর্য এসব শুনে সিমরানকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি উনার ওয়াইফ?”
সিমরান তূর্যের কথায় চোখ তুলে রুদ্রের দিকে তাকায়, যে কিনা সন্দিহান দৃষ্টিতে ওর পানে চেয়ে আছে।সিমরান বুঝতে পারে তূর্য ওর সাথে একটু লাইন মারছে, তাই মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “না, কিন্তু হবো।”
তূর্য মনে মনে হতাশ হয়ে ভাবে, “শালার একটা জীবন! যে দিকেই চোখ দেই, ওদিকেই প্রি-বুকিং মারা!”
সিমরান চুপচাপ রুদ্রের পাশে এসে দাঁড়ায়। সিমরানকে নিজের পাশে দাঁড়াতে দেখেই রুদ্র ছ্যাত করে বলে ওঠে, “এনে কি করস তুই? যা, তোর কাটুমের লগে কথা ক, গিয়া!”

সিমরান রুদ্রের কথায় পাত্তা না দিয়ে মিনমিন করে বলে, “তূর্য জিজ্ঞেস করেছিল আমি আপনার বউ কি না।”
রুদ্র সিমরানের মুখে ‘বউ’ কথা শুনে চমকে সিমরানকে প্রশ্ন করে, “তুই কি বলছিস?”
“আমি ‘না’ বলেছি।”
সিমরানের কথায় রুদ্রের দিল খচ করে ওঠে। সিমরানকে ম্লান স্বরে বলে, “নাই তো বলবি।”
এ বলেই রুদ্র চপাট রাগ দেখিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। সিমরান একটু মজা করছিল, ব্যাস, এতেই কিচ্ছা ঘেটে গেল!সিমরানও রুদ্রের পেছনে পেছনে যায়।

ছিদ্দিক সাহেব এবং নাজহার চার নম্বর চাচা ইকবাল সাহেব। উনারা ছদ্মবেশ ধারণ করে রংপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। ছদ্মবেশ ধারণের একটাই কারণ তা হলো ছাত্রলীগের এক ‘পিওর গাদ্দার’কে ধরা। দীর্ঘদিন ধরে খুঁজেও যাকে পাওয়া যায়নি, আজ হঠাৎই এক গুপ্তচর মারফতে জানা গেল, সে রংপুরে আছে। লোকটির নাম সাহেদ, তাদেরই গ্রামের মানুষ।তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় কী করেছে এই সাহেদ যে তাকে ধরার জন্য এভাবে পায়তারা করা হচ্ছে? আর কেনই বা তাকে ধরতে হবে?

তাকে ধরার প্রণোদনা হলো তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, নয়তো চাপাতি দিয়ে ইচ্ছেমতো পিস পিস করে কেটে ফেলা। তার রক্ত বোতল ভরে নিজেদের বাবার কাছে নিয়ে যাওয়া।
নাজহার চাচাদের মধ্যে পনেরোজন জীবিত আছেন, আর বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সারওয়ার তালুকদার। সারওয়ার ছিলেন তালুকদার পরিবারের মধ্যে একমাত্র আওয়ামী লীগ নেতা। বয়স ছিল সাতাশ। পরিবারের সবাই উনার এই দল করার বিরুদ্ধে হলেও উনি দল কখনোই ছাড়েননি। উনারই বন্ধু ছিল সাহেদ আর ইমতিয়াজ। তাদের তিনজনের খাতির যেমন রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মজবুত ছিল, তেমনি ব্যবসায়িক দিক থেকেও ছিল ঘনিষ্ঠতা।

দু-হাজার চব্বিশের জুলাইয়ে যখন কোটা আন্দোলন শুরু হয় সারওয়ার সে সময় প্রথম দিকে তার বিরুদ্ধেই ছিলেন। তাদের ক্ষমতাসীন দল তখন এসবকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিল, সঙ্গে উনিও। কারণ একটাই তাদের দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী শাসনের অহংকার তাদের চোখে পর্দা ফেলে দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল, অতীতের মতোই ছাত্রলীগের লাঠি আর পুলিশের ধাওয়ায় ছাত্ররা মুখ ঢেকে ফিরে যাবে।কিন্তু এরপরেই তারা দেখলেন তরুণ প্রজন্মের এক অদম্য স্পৃহা, যা শুধু কোটার বিরুদ্ধে নয়, ছিল দীর্ঘ পনেরো বছরের বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে। ছাত্র-জনতার এই গর্জন যখন সরকারের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিতে শুরু করে, তখন ভীত দল ও ক্ষুব্ধ প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিলো, নির্মমতাই হবে এর একমাত্র জবাব। শুরু হলো রাষ্ট্রযন্ত্রের বেপরোয়া ক্ষমতার অপব্যবহার।
পুলিশ, র‍্যাব এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীরা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র জনতার ওপর। লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, সবকিছু ব্যবহার করা হলো। কেবল লাঠি নয়, আন্দোলনের সম্মুখসারিতে যারা ছিলেন, তাদের লক্ষ্য করে চলল সরাসরি গুলিও।

এই নির্মমতা থেকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হলো না মেয়েদেরও। বিক্ষোভকালে ছাত্রী ও সাধারণ নারীদের ওপর হামলা করা হয়, লাঞ্ছিত করা হয় এবং অনেককে টেনে-হিঁচড়ে আটক করা হয়। ক্ষমতা ও পেশীশক্তি ব্যবহার করে যাকে যেভাবে ইচ্ছে, সেভাবে হেনস্থা করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থীদের জোর করে হল থেকে বের করে দেওয়া হলো। বহু আন্দোলনকারীকে প্রকাশ্য রাজপথ থেকে তুলে নেওয়া হলো, যাদের অনেকের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। হাসপাতালগুলোতে গোপনে দাফন করা হলো অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহ।শুধু প্রকাশ্যে হত্যা নয়, জুলাই মাসে ঢাকার রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন কবরস্থানে বহু বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়। হাসপাতালের কর্মীরা জানান, পুলিশের অনুমতি ছাড়া অনেক লাশ সরাতে হতো অনেক ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দাফন করা হয়, যার কোনো দাপ্তরিক রেকর্ড রাখা হয়নি। ক্যাম্পাসের হলগুলোতে ঢুকে নির্যাতন করা হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ সদস্যরা প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যা ইচ্ছে তাই করা শুরু করে।

নিজের দলের এই অমানবিক নির্যাতন সহ্য হয় না সারওয়ারের। সহ্য না করতে পেরে তিনি বেরিয়ে আসেন দল থেকে। বাইশে জুলাই রাস্তায় ছাত্র-জনতার পক্ষে নেমে পড়েন। পারেননি এই অবিচার সহ্য করতে। মৃত্যু হাতে নিয়ে লড়ে যান ছাত্র-জনতার হয়ে।
তিনি জানতেন, রক্ষা কখনোই পাবেন না। উনার দলের লোকই উনাকে মারবে। তবে নিজের বন্ধুদের হাতেই মরতে হবে, তা বুঝতে পারেননি। ২৩ জুলাই সকালে উনার দুই বন্ধু উনাকে নিজেদের পুরোনো আড্ডাখানায় ডাকেন। যাওয়ার আগে নাদের সাহেবকে সম্পূর্ণ ঘটনাটা বলেও গিয়েছিলেন সারওয়ার।
সেই যে গিয়েছিলেন, আর ফেরা হয়নি উনার বাড়ি। তালুকদাররা লাশটা অবধি পাননি। পাবেনই বা কী করে? সাহেদ আর ইমতিয়াজ যে উনাকে মেরে গুম করে দিয়েছিল!

ইমতিয়াজ রাতারাতি দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় এবং চলেও যায়। কিন্তু সাহেদ যায় না। তার মনে মনে ছিল, বিদেশ গিয়ে আর কী হবে? এখানে এগুলো কিছুদিন পর থেমেই যাবে। তারপর নাহয় নেতাদের পা চেটে-চুটে নিজেও একটা নেতার পদ হাতিয়ে নেবে।
কিন্তু তা আর হয় না। স্বৈরাচারের পতন হয়, সঙ্গে সাহেদও লুকিয়ে বেড়ায়। ওরা নিজের হাতে নিজের বন্ধুকে কুপিয়েছিল। ওদের ইচ্ছে ছিল না কুপানোর, কিন্তু ওপর মহলের আদেশ যে, যে দল থেকে বেরিয়ে গেছে, সে নিশ্চিত গাদ্দার। দলের বিভিন্ন পরিকল্পনা, ক্রাইম এক্সপোজ করে দিতে পারে। বাধ্য হয়ে তারা সারওয়ারকে মারে নয়তো তাদেরও মরতে হতো।যখন ওরা দু’জন সারওয়ারকে কুপিয়েছিল, সারওয়ার শুধু হেসেছিলেন আর বলেছিলেন, “তোরা বন্ধুত্বের এত নিষ্ঠুর পরিনতি কেন দিলি?
সাহেদকে পেলে তালুকদাররা আর আস্থ রাখবেন না প্রতিজ্ঞা করেছেন। আজ একবার শুধু হাতে পান তারপর হবে রক্ত দিয়ে করা গোসল৷

নিচে সবাই খাওয়া-দাওয়া করছে। নাজহার রুমের বারান্দায় মাস্টার চাচ্চু, ছোট চাচ্চু আর নাজহার মোল্লা চাচ্চু দাঁড়িয়ে আছেন। নাজহাও আছে এখানে। সবার সঙ্গে ফাইজানও আছে। মোল্লা চাচ্চু গম্ভীর গলায় নাজহাকে জিজ্ঞেস করেন, “কাজ হচ্ছে তো? সব ঠিকঠাক?”
​নাজহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আশেপাশে তাকায়, তারপর বলে, “হচ্ছে, হচ্ছে।”
​ছোট চাচ্চু বলেন, “আর কত সময় লাগবে?”
​নাজহা তিক্ত সুরে বলে, “সময় তো লাগবে, ধীরে ধীরে তো করতে হবে, তাই না?”
​নাজহার এই আলসে কথায় ফাইজান বিরক্ত হয়। “আচ্ছা ফুফু, তুমি এত অলস কেন? তাড়াতাড়ি কিছু করো না! আর যদি না পারো, তাহলে পণ্ডিতি কেন করেছিলে?”
​ফাইজানের কথায় মেজাজ তির্যক হয়ে যায় নাজহার। বুকে দু’হাত গুঁজে শান্ত গলায় ওকে চোখ দিয়ে ইশারা করে, “এদিকে আয়।”

​ফাইজান ওর কথায় সরল মনেই ওর দিকে আগায়। ভাবে, হয়তো কিছু বলবে। ও আগাতেই নাজহা হাত বাড়িয়ে ওর চুলগুলো চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে ফাইজানের ডান গালে ‘টাশ’ করে একটা থাপ্পড় মেরে বলে, “তাহলে তুই কর! আয়, তুই আমার জায়গায় আয়!”
​থাপ্পড় মেরে ফাইজানকে ছেড়ে দেয়। ফুফুর নরম হাতের ঝাক্কাস গরম থাপ্পড় খেয়ে ফাইজান তিক্ত গলায় বলে, “আল্লাহ! তোমার মরা হাড্ডিতে এত শক্তি! আমার দাঁত নড়ে গেল রে!”
​নাজহা ওকে এমন কাতরাতে দেখে ভ্রুক্ষেপ না করে মাস্টার চাচ্চুর দিকে তাকায় আর বলে, “আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট কিছু আছে।”

​ওর মুখে ‘ইম্পর্ট্যান্ট’ শব্দটা শুনেই মাস্টার চাচ্চুর হালকা রাগ হয়। আর উনি জ্ঞান দেওয়া শুরু করেন, “নাজহা, অ্যাভয়েড সেয়িং ইম্পর্ট্যান্ট। আই সেড, মেক ইওর ইংলিশ স্ট্যান্ড আউট সে ক্রুশাল ইনস্টেড।”
​নাজহা উনার দেওয়া উপদেশ শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই মাস্টার চাচ্চু মারাত্মক মানুষ। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে, সিরিয়াস সময়েও উল্টোপাল্টা বা কমন ইংরেজি বললে উপদেশ দেওয়া শুরু করেন। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু করলেন না। জীবন চলে যাওয়ার মুহূর্তেও উনি বলবেন, ‘ইংরেজি ঠিক কর’। নাজহা মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বলে, “আই শ্যাল এনশিয়োর দ্যাট আই আর্টিকিউলেট দিস ভিউপয়েন্ট অ্যাট দ্য নেক্সট জাঙ্কচার।”
​ওর কথায় মাস্টার চাচ্চু সন্তুষ্ট হয়ে বলেন, “দ্য রিভিশন ইজ কমেনডেবল। ইট ইজ নাও অ্যাবসোলিউটলি অ্যাপ্রোপ্রিয়েট।”

​নাজহা উনার কথায় আবারও মাথা নেড়ে রুমে আসে। উদ্দেশ্য ফোন বিছানার ওপর থেকে নেওয়া। যখনই ফোন হাতে নিতে যাবে, তেমন মুহূর্তে নোমান, সাফা আর তৌসির তাদের রুমে প্রবেশ করেন। সাফা নোমানকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করতে করতে বলেন, “এটা হলো তৌসিরদের রুম।”
​নাজহা তাদের দেখে আর ফোন হাতে নেয় না। উনাদের গলার স্বর পেয়ে মাস্টার চাচ্চুটা স্বাভাবিক, হাসিমাখা মুখে রুমে আসতে আসতে বলেন, “তোমার রুম দেখতে এসেছো, আমরাও এলাম এই।”
​তৌসির ওদের এই হাসিমুখের মিষ্ট বাণী শুনে একবার নাজহার দিকে তাকায়। তারপর আবার উনাদের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে মনে মনে বলে, “সু**দানির পোলারা কী গদ্দারির প্ল্যান করছিলি কে জানে? এখন পুঁটি মাছের মতো ভেল্কি মারতাছো।”

​নাজহা সাফার দিকে দু’কদম এগিয়ে এসে বলে, “আসুন না, এদিকে বসুন।”​সাফা মৃদু হেসে নাজহার কাঁধে হাত রেখে বলেন, “না মা, বসব না। তোমার চাচ্চু দেখতে চেয়েছেন, তাই নিয়ে এলাম।”​নাজহা আলতো মাথা নাড়ায়। সাফা আশেপাশে এক পলক তাকান। তখনই উনার চোখ পড়ে নাজহার হাতের দিকে। এক হাতে চুড়ি আছে, অন্য হাতে নেই। এই বিষয়টি নজরবন্দী হতেই নাজহাকে সাফা জিজ্ঞেস করেন, “তোমার আরেক হাতের চুড়ি কোথায়?”​চুড়ির কথা শুনতেই নাজহার স্মরণ হয় গতকাল রাতে যে বালিশের নিচে রেখেছিল আর পরা হয়নি। আমতাআমতা করে বলে, “খ খুলে রেখেছি।”

​সাফা এ কথায় নাজহাকে বোঝান, “বিবাহিতদের চুড়ি এভাবে খুলে রাখতেই নেই। হাতে পরতে হয় সবসময়।”
​এবার নাজহার মাথায় চটজলদি একটা বুদ্ধি আসে। তৌসিরের দিকে আড়চোখে এক নজর তাকায়। এই সুযোগ তৌসিরকে শরম দেওয়ার। এই লোক সবসময় বেশরমের মতো গালগালি করে। আজ বাঁশ দেওয়ার সুযোগ এসেছে। যদিও এতে নাজহাও লজ্জা পাবে, কিন্তু সবাই তো বুঝবে ও ছোট মানুষ, না বুঝেই বলে দিয়েছে। আর শরমের তকমা তৌসির পাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। নাজহা বলে ওঠে, “আরে না, আমি খুলিনি তো চুড়ি। উনি খুলেছেন। গতকাল রাতে।”

​এটা শুনে উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কী বলা উচিত খুঁজে পান না। নাজহা হুট করে এমন লজ্জা দেবে কল্পনাও করেননি। অতঃপর নাজহার কথায় মিটিমিটি হেসে উনারা পিছনে তৌসিরের দিকে তাকান। তৌসিরের দিকে তাকাতেই চোখ কপালে ওঠে যায়। কারণ, ওখানে তৌসির নেই। এক মুহূর্তের মধ্যে গায়েব হয়ে গেছে। এতে একটু স্থির শ্বাস ফেলেন সবাই। এদিকে নাজহার মুখ থেকে এমন ডাহা মিথ্যা শুনে তৌসিরের হৃৎপিণ্ড বেরিয়ে আসার উপক্রম। ওর কথা শুনেই ইজ্জত বাঁচাতে আলগোছে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। করিডরে দাঁড়িয়ে আশেপাশে নজর তাকায় আর বলে, “লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ! আমার ডাইকাতনি আমার ইজ্জতের ডাকাতি কইরা দিল রে!”

এক পর্যায়ে ​সবাই রুম থেকে বেরিয়ে যান। সবাই যাওয়ার পর এবার রুমে ফিরে আসে তৌসির। আজ নাজহার সঙ্গে কিছু একটা হয়ে যাবে। কেন এত মিথ্যা বললো ও? রুমে এসেই দেখে নাজহা রুম থেকে বেরোতে নিচ্ছে। তৌসিরকে দেখে দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি এখন এখানে কী করেন? নিচে যান। মেহমানদের সাথে থাকুন।”
​তৌসির ওর ন্যায় চঞ্চল চোখে চেয়ে থাকে কিছু সময়। বাহ, আজ তো মারাত্মক লাগছে এই নিরুপমাকে। কালো সুতির একটা গাউন আর লাল পাজামা-ওড়না পরেছে। তৌসিরের ভেতর হঠাৎই কিলবিল করতে থাকে। উঁহু, এই মেয়েটা জাদু জানে। প্রতিদিন নতুন নতুন রূপ ধারণ করে আর তৌসিরকে পুড়িয়ে মারে। এই জাদু করার দায়ে একে দু-একটা মামলা দেওয়া উচিত। ডাকাত কি আর এমনি এমনি বলে? তৌসিরের অন্তর এই নারী ডাকাতি করে নিয়েছে। কঠিন থেকে কঠিন সাজা হওয়া উচিত এই নারীর। তৌসির শিকদারকে নিজের মায়ায় ফেলে দিচ্ছে। কঠিন পাপ করে ফেলছে। তৌসির এই মহাভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে এবার হাত বাড়িয়ে নাজহার হাত টেনে নিজের নিকট নিয়ে আসে। নাজহা আসতে চায় না, উল্টো তৌসিরের থেকে ছিটকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলে, “ধুর, নিচে যান। মেহমানদের সাথে কথা বলুন।”

তৌসির নাজহার এই ছোটাছুটি দেখে মৃদু হেসে ওর কোমরে দু’হাত শক্ত করে রাখতে রাখতে বলে, “মেহমানদের সামনে যাওয়ার মুখ রাখছো? মিথ্যা বললা ক্যান আমি তোমার চুড়ি খুলছি?”
​নাজহা তৌসিরের প্রশ্নে আলতো ঘাড় কাত করে। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে নাজহার। তৌসিরের হাত দুটো ভারি বেপরোয়া। কোমরে রাখা হাতের আঙুল দিয়ে বারবার নাজহার কোমরে-পেটে খোঁচাছে। নাজহা ছটফট করে ওঠে বলে, “আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই আমি বললাম। সত্যিটা তো আপনি জানতেন, তাহলে বাঁধা দিলেন না কেন?”
​তৌসির ওর কথায় ওর চোখে চোখ রেখে আড়চোখে বলে, “বেইজ্জত করছো আর করানোর ইচ্ছা আছিল নাকি? যে এমন পরামর্শ দিতাছো!”

​এ বলে নাজহাকে পেঁচিয়ে রাখা হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে, নাজহাকে নিজের আরেকটু কাছে টেনে আনে। তৌসিরের এই কাজে বিরক্তির এক সূক্ষ্ম রেখা নেমে আসে নাজহার মুখপানে। অন্তরে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে বলে, “ছোঁয়া, কাছে টানা পছন্দ না আমার। অস্বস্তি লাগে, বিরক্ত হই।”
​নাজহার কথায় তৌসির কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। এতটুকু অন্তত বোঝে, নাজহা এসবে অভ্যস্ত নয়। তদ্ফলে নাজহার এই বাণী উচ্চারণ। তৌসির আলতো হেসে ধারণ করে, “আমি জানি তুমি এইসব পছন্দ করো না। তোমার বয়সটাই এমন। কিন্তু কি করতাম কও তো? আমিও তো পুরুষ।”

​এ বলে অন্য কিছু বলতে যাবে, তার আগেই নাজহা তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে ক্ষীণ অনুনাদে বলে, “আপনার নিজেকে গুটিয়ে রাখার সংগ্রাম আমার অজানা নয়, তৌসির। আমার সন্তুষ্টি শুধু এইটুকুতেই যে, আপনি আমার মানসিক শান্তিকে সম্মান করেছেন, যথাসম্ভব আমার থেকে দূরে থেকেছেন বা থাকছেন। আপনার এই নিরাসক্তিই, আপনার করা অন্যান্য সকল ঘাটতির ঊর্ধ্বে, আমার ভালো লাগার একমাত্র কারণ। হয়তো এক প্রকার করুণাই দেখাচ্ছেন আমার অস্থিরতার প্রতি এটা করে। আপনার নিজস্ব চাহিদা আছে, তা আমি বুঝি। আমি জানি আপনারও আকাঙ্ক্ষা আছে, কিছু পাওয়ার, কিছু চাওয়ার। তবে বিশ্বাস করুন, এই জিনিসটা বুঝতে পেরেও আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। আমি বারংবার চেষ্টা করি নিজের এই ছটফটানিকে অস্বীকার করতে, আপনাকে বর্তমানের সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে চাই, কিন্তু অতীত এবং আমার ভিতরের অস্থিরতা আমাকে বর্তমানের কাছে পৌঁছাতে দেয়ই না।”

​নাজহার এই স্বীকারোক্তিতে তৌসির স্তব্ধ হয়। অচঞ্চল চাহনি নিয়ে শুধু নাজহার পানে চেয়ে থাকে আর ভাবে, “এতদিন ভাবতাম আমার ডাকাইতনির বুঝ কম। কিন্তু আজ তো দেখি আমার দাদার চেয়েও বেশি বুঝ আছে ওর। বাহ তৌসির বাহ! তুই জিতা লইছস মারাত্মক এক ঝি। তোর এই পোড়া কপালে লাল ছন্দের গুঁড়া লাগল কেমনে? না কারো দোয়া-টোয়া লাগলো? জীবনে তো কারো ভালো করিস নাই, তাইলে দোয়া লাগব কেমনে? মনে হয় দয়াল এবার একটু দয়া তরে ভিক্ষা দিছেন। সবই দয়ালের দেওয়া দয়া।”​তৌসিরকে নিজের পানে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে নাজহা ভ্রু কোঁচকায়। নাজহার মুখের প্রতিক্রিয়া দেখে তৌসির বাস্তবে ফিরে আসে। অতঃপর কোনো কথাবার্তা ছাড়াই হুট করে নাজহাকে এক টানে কাছে টেনে অভ্যাসে মতো নাজহার গালে নিজের নাক-ঠোঁট ঠেসে ধরে আর ফিসফিসিয়ে বলে, “আমার কোনটা লাগত না এখন! খালি এমনে দুই-একটা চুমু-টুমু খাওয়ার সুযোগ দিও।”

​নাজহা পড়ে বিপদে। বেজায় খারাপ অনুভূতি অনুভব হচ্ছে, তথাপি কিছু বলতে পারছে না তৌসিরকে। নাজহা ছটফট করতে করতে তৌসিরের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলে, “দাড়িগুলো আমার গাল শেষ করে দিচ্ছে, সরুন।”
​তৌসির ওর থুতনিতে হাত রেখে আরও প্রগাঢ় ভাবে ঠোঁট ঠেসে বলে, “আর কয়দিন সহ্য কইরা নাও, পরে লম্বা হইয়া গেলে আর গালে গাঁথব না।”
​নাজহা ওকে দূরে সরানোর জন্য প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দিতে দিতে বলে, “তাহলে লম্বা হওয়ার পর আইসেন, এখন ছাড়ুন। নিচে যাই, কাজে সাহায্য করি উনাদের।”

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৩

​তৌসির কি আর ছাড়বে এত সহজে? নাজহার অন্য গালে ঠোঁট বসিয়ে হালকা বিরক্ত হয়ে তিক্ত সুরে বলে, “তুমি কার বাল ফালাইবা ওনে গিয়া? বিশ-বাইশ জন মানুষ আছে, কাম করবে নে তারা।”
​”কাজ করার নয় বিষয়টা। বিবেক বলতে কিছু আছে তাই না?
​”বিবেক আর তুমি মারাইও না, চুপচাপ খাঁড়া থাকো। আমি যে সময় ছাড়মু, অই সময় যাইবা। আর কোনো কথা না।”
​ব্যস, নাজহাও চুপ করে যায়। যেটা যেমন হচ্ছে, তেমনি হোক। পরিস্থিতির তালে তালে শুধু তাল মেলাক। ‘সবুরে মেওয়া ফলে’, দেখা যাক ওর ভাগ্য কী দেয়, ওর থেকে আর কী নেয়।

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here