স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৬
সানজিদা আক্তার মুন্নী
তৌসিরের মুখ থেকে নিঃসৃত হওয়া বাণী বিবিজানের কর্ণপাত হতেই তিনি চোখ পাকিয়ে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় ধারণ করেন, “তোমারে বিয়া করাইয়া দিছি বইল্ল্যা চাঙ্গে উইঠা গেছো? কই ছিলি তোরা? কই থাকস? এই মা**গি কুঠির থাইকা বের হইয়া গেইট অবধি আইয়া গেছিলো। আমি ধইরা বাড়িতে আইন্না কুপাইছি।”
তৌসির বিবিজানের থেকে এ কাহিনি শুনে নাযেম চাচার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি কী কইতাম? ছোট চাচার দায়িত্বে ছিল না এই মহিলা? এরে তো দাদাজান ধইরা আনছিল।”
বিবিজান কটমট করে নাযেম চাচার দিকে চেয়ে বলেন, “হ্যাঁ, তোর দাদাজান এরে আটকাইয়া রাখছিল। আমি না পারতে মারছি। এখন তোর দাদাজান না আমার লগে মাইর লাগাইয়া দেয়।”
তৌসির ফুস করে শ্বাস ছেড়ে বলে, “আমি এসব কোনোতা জানি না। তোমার ছোট ঢেখারে বলো যা বলার।”
বিবিজান হাত থেকে কুঠারটা ফেলে দিয়ে দু কদম এগিয়ে এসে নাযেম চাচার কান টেনে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন, “সারাদিন আছোস এক মদ গিলতে আর আকামু-কুকামের কথাবার্তা বলতে। কামের তো কোনো বাল ফালাস না।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
এ বলে নাযেম চাচার কান ছেড়ে ‘টাশ’ করে একটা থাপ্পড় মেরে দেন তার গালে। নাযেম চাচা মায়ের হাতের মার খেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। এটা প্রথম না তৌসির, মিনহাজ মামা, রুদ্র, এমনকি তৌসিরের আব্বা সহ এখনও বিবিজানের হাতের মার খান। তো নাযেম চাচার খাওয়া বড় কোনো বিষয় নয়। উনি থাপ্পড় খেয়ে বলেন, “আম্মা, আম্মা! আর মাইরো না। আমি বুঝি নাই এমন হইবো।”
বিবিজান এবার রুদ্রের দিকে হাত বাড়ান তাকে মারতে। সাথে দাঁত চেপে বলেন, “এ বদমাশ, তুইও এদিকে আয়। তোরেও দেই কয়টা।”
রুদ্র মাইরের ভয়ে লাফ দিয়ে সরে গিয়ে আমতা আমতা করে বলে, “আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আমাদের ক্ষমা করে দিন, ফিলিজ মিসেস শিকদার।”
এ শুনে বিবিজান রুদ্ধ ক্রোধে চোয়াল শক্ত করে তীব্র স্বরে বলেন, “মনে মনে কইছিলাম তোর হাতে আমার সিমরানরে তুইল্লা দিতাম, কিন্তু তুই যেই লেভেলের বাইন**ত, তোর কাছে দিলে আমার নাতিন সুখে থাকবো না।”
সিমরানের কথা শুনে রুদ্র এক লাফে আবারও জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় বলে, “না না! আমি সব কাম পারি। আমি এখন থাইকা ভালা হইয়া যামু।”
বিবিজান আর তর্কে জড়ান না। কারণ সময় এখন রজনীর অন্তরতম ক্ষণে, ফজরের আগেই লাশটা গুম করতে হবে। তিনি নাযেম চাচা ও রুদ্রকে বলেন, “তোরা এই লাশ গুম কর।”
এ বলে তৌসিরের দিকে তাকিয়ে বলেন, “আর তুই আমার লগে কুঠিরে আয়, কথা আছে।”
তৌসির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে, “এত রাইতে না গেলে হয় না, বিবিজান? আমার বউ ঘরে একলা, ডরায় যদি!”
বিবিজান এ শুনে মুখ ভেংচিয়ে বলেন, “বাহ! প্রথমে বিয়া করতে চাইলি না, এর এখন এত পেরেম বউ লাগি?”
তৌসির খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “না না, কী যে কও! ও ডরায় আরকি।”
“আইচ্ছা, তাইলে তুই যা। কাইল কথা কইমু নে। বাইচ্চা মানুষ, ডর বুকত লাগতেই পারে।”
তৌসির মাথা নাড়িয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় আর মনে মনে বলে, “বুড়ির বুড়ি! এক পা কবরে আর এক পা রাইখা কী রাজত্বটাই না করতাছে।”
নাযেম চাচাকে রুদ্র ফিসফিসিয়ে বলে, “আইজ একটা বউ থাকলে আমরাও এমন বউয়ের উসিলা দেখাইতে পারতাম।”
নাযেম চাচা রুদ্রের দিকে বিরক্তি চোখে চেয়ে বলেন, “আমাদের মতো বিশ্ব বদমাশদের বউ দিয়া ঠেকতনি মানুষ? কাম কর ব্যাটা।”
তৌসির ঘরের দরজা আলগোছে খোলে, ঘরে প্রবেশ করে। আলগোছেই খুললো, যাতে নাজহা টের না পায়। ঘরে ঢুকে সামনে তাকাতে দেখে, নাজহা জায়নামাজে বসে আছে, ওর পাশে ওর তিন বিড়ালও বসে আছে। তৌসির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চুপচাপ এগিয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। খুব ঘুম পাচ্ছে! নিদ্রার তলদেশে ডুবা অতি প্রয়োজন। এ ভেবে তৌসির বালিশে মাথা রাখতেই, নাজহার গলা কানে ভেসে আসে, “শখ মিটিয়ে এলেন নাকী পরনারীর থেকে?”
এ প্রশ্নে তৌসিরের মনে বেজায় ক্রোধ জন্ম নেয়, কেন এমন কথা বললো নাজহা? সবসময় শুধু মন্দ ভাবনা ভাবে তৌসিরের সম্পর্কে। ক্রোধ জন্ম নিলেও তথাপি নিজের ক্রোধ সংকোচ করে শান্ত গলায় বলে, “অন্য কামে গেছিলাম বাইরে, তুমি যা ভাবতাছো তা না।”
নাজহা ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না তার কথাখানি, তাই আবারো ক্ষীণ গলায় শোধায়, “ধোঁয়া তুলশি সেজে কী লাভ? সত্য আমাদের দুজনেরি জানা।”
তৌসির নাজহার এই কঠিন্য কথায় এবার ক্রোধভরে উচ্চারণ করে, “অতিরিক্ত কিছুই ভালা না, তালুকদারের মাইয়া। তুমি বেশি বলতেছো।”
“বাহ! দোষ করবেন, আর দোষি বললেই বেশি হয়ে যায়!”
তৌসির শান্ত স্বরে শোধায়, “নারীদোষ ব্যাতিত জগতের সমস্ত দোষের বিষ আমার রক্তে মিশা।”
নাজহা আর তর্কে যায় না, চুপ হয়ে যায়। হয়তো এটাই সত্য। তথাচ মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারলেও, অন্তর ঠিকই বলে, এগুলো মিথ্যা, সব মিথ্যা। নাজহার এই নীরবতা দেখে তৌসির সিলিং এর তাকিয়ে তাবাসসুম হেসে বলে, “বিশ্বাস করলা না আমারে?”
নাজহা ম্লান হেসে মৃদু আওয়াজে ধারণ করে, “বিশ্বাস করতে তো চাই। কিন্তু পরক্ষণেই কানে বাজতে থাকে আপনার নামে শোনা দুর্নামের কাঁসর-ঘণ্টা।”
তৌসির দুর্নামের কথা শুনে খানিকটা হাসে, অতঃপর বলে, “তিরস্কারের লীলাভূমিতে মুখোশ ছাড়া বাস করি, দুর্নাম তো থাকবেই।”
এ বলে কিছু মুহুর্ত চুপ থেকে ফের বলে, “তাই বইল্যা এগুলা বিশ্বাস কইরা আমারে ঘেন্নাইবা?”
“আপনার প্রতি আমার কোন ঘৃনা নেই।”
“তাইলে আমারে দোষ দিয়া সবসময় কথা ক্যান কও?”
ওটা আপনার অভ্যাসেই বলি।” এ বলে নাজহা একটু দম নেয়। যে অভিমানটা এতক্ষণ সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলো, তা এবার প্রকাশ করে, “এই মাঝরাতে আমায় একা এই ঘরে কোন বিবেকে রেখে গেলেন? এটা তো আমার বাপের বাড়ি না। ভয় হয় আমার একা থাকতে।”
তৌসির এ শুনে মনে মনে ভাবে, ‘ওহহোউ এই ব্যাপার! এই কারণে আমার নাগিন আমার লগে এমন ত্যাড়ামি করতাছে।’ তৌসির আলতো হেসে বুনে, “আইচ্ছা, আর জীবনেও যাইতাম তোমারে তইয়া। এখন আও, ঘুমাই।”
“আপনার মতোন তো বেদিন না আমি, ফজরের নামাজ না পড়ে ঘুমিয়ে যাব।”
বেদিন’ শব্দটা শোনামাত্র তৌসিরের আত্মসম্মানে লাগে। সে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলে,”এ ব্যাটি মুখ ছিনাল! আমারে বেদিন কইস না। আমি শুক্রবার নামাজ পড়ি।”
নাজহার সর্বাঙ্গ যেনো জ্বলে যায় এই অদ্ভুত যুক্তিতে। সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলে, “সারা সাপ্তাহ বুঝি পিরিয়ড থাকে আপনার? তাই শুধু শুক্রবার নামাজটা পড়েন!”
এ কথা শুনে তৌসিরের রাগ আর বিস্ময়ে থম মেরে যায়। সেই ঊনিশ-বিশ সালে ফেসবুকে সে এমন টাইপ নামাজ না পড়া নিয়ে কথায় কতো পোস্ট দেখেছে, নিজেও কতটায় ‘হাহা’ রিয়েক্ট দিয়েছে। সে সময় সে নিজেও অন্যদের এসব বলে ঠাট্টা করতো। কারণ তখনকার তৌসির সব ‘জাউরামি’ একপাশে রেখে নামাজটা নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করতো, কিন্তু এখন আর তা হয় না। যদিও একেবারে ছাড়েনি। হায় রে কপাল! সে মানুষকে যা বলে তামাশা করতো, আজ তার নিজের বউ-ই তাকে সেই কথা ফিরিয়ে দিচ্ছে! এ দুঃখ কই রাখবে তৌসির? এই মাইয়া তো বহুত বেত্তমিজে!তৌসির এবার থমথমে, কড়া গলায় বুনে, “তোরে এত দিন ভাবতাম খারাপ, কিন্তু এখন দেখতেছি তুই বিশ্ব খারাপ।”
খারাপ কথাটা শুনে নাজহা দমন করা রাগে কড়া গলায় ছুঁড়ে, “আমি যখন এতই খারাপ, তাহলে কইরেন না আমার সাথে সংসার।”
তৌসির বড্ড বিরক্তি হয় এ কথায়। মনে মনে ভাবে, ‘তোর মতো দুষমনের মাইয়ারা লগে সংসার কি আর ইচ্ছে করে করতাছি নাকি? বিবিজান আর আমার বাদাইম্মা বাপ জোর কইরা গলায় ঝুলাইছি বইলাই আইজ আমার এই অবস্থা।’ তৌসির উপেক্ষার তিক্ত সুরে বলে, “লুঙ্গিতে আগুন লাগলে যেমন, খুললেও বিপদ, না খুললেও বিপদ। ঠিক তেমনি, তোমার লগে ঘর করলেও বিপদ, না করলেও বিপদ।”
তৌসিরের কথার উত্তরে নাজহার ঠোঁটে একফালি শুষ্ক হাসির রেখা ফুটে ওঠে, এখন আর তর্ক করে না নিরুত্তর থাকে। ইদানীং তার বড় অবসন্ন লাগে প্রতিদিনের এই অন্তহীন বিতণ্ডা নিজের সবটুকু জীবনীশক্তি নিংড়ে নিচ্ছে। এই তর্কের কোনো কূল-কিনারা নেই।’নাহ, এভাবে নিজেকে ক্ষয় হতে দেওয়া যাবে না,’ ও মনকে শক্ত করে। ‘নিজেকে সামলাতে হবে।’ তৌসিরের সাথে বাদানুবাদে জড়ালে সেই আগুনেই ঘি ঢালা হবে। তার চেয়ে এই নীরবতাই শ্রেয়। এই বৃথা বাক্যব্যয় করে আর কী-ই বা হবে?দিনশেষে, মানুষটা যেমনই হোক, তাকে আঁকড়েই তো নাজহাকে এই সংসার-সমুদ্রে ভাসতে হবে। তাকে মেনে নেওয়া, মানিয়ে চলাই এখন তার নিয়তি। এই ছটফটানি, এই অস্থিরতা এখন বড্ড অর্থহীন।
ফজরের পর,
নাজহা ফজরের নামাজ শেষ করে তেলাওয়াত করে একটু বাগানে হাঁটতে গিয়েছিল, কিন্তু হালকা ঠান্ডা লাগায় আর বেশিক্ষণ হাঁটেনি। ফের ঘরে চলে এসেছে। একটু ঠান্ডা লাগলেই ওর আবার হাঁচি দেওয়া শুরু হয়ে যায়, আর হাঁচি দিতে দিতে সারা শরীর নড়ে, জ্বর উঠে যায়। এই সমস্যা নাজহার ছোটবেলা থেকেই। সিজারে জন্ম হওয়ায় অল্পতেই অসুস্থ হয়ে যায়। ও আর ওর ভাই নাজহারেরও একই সমস্যা। ওরা ছুঁইতে মরা পাতার মতো, একটু আঘাতেই নুইয়ে পড়ে। ঘরে এসে এখন শুয়ে শুয়ে রিলস দেখতেছে, বাড়ির রান্নাঘরে আজ আর যায়নি।
তৌসির পূর্ব দিকে পা দিয়ে বিছানায় সটান ভঙ্গিতে শুয়ে আছে, আর নাজহা তার বুকের মধ্যস্থলে মাথা রেখে দক্ষিণ দিকে পা দিয়ে বা পায়ের হাঁটুর উপর ডান পা তুলে আয়েশ করে শুয়ে ইনস্টাগ্রামে রিলস দেখতেছে, তাও সাউন্ড ফুল দিয়ে। তৌসির নাজহার এই সব কান্ড খুবই বিরক্ত, খুবই। আর হবেই না কেন! তৌসিরকে যে বড্ড জ্বালাচ্ছে নাজহা।
এই যে তৌসিরের বক্ষে মাথা রেখে শুয়ে আছে, তাতে তৌসিরের অসুবিধে নেই, আপত্তিও নেই, কিন্তু নাজহা শান্তিতে শুয়ে নেই। বারবার মাথা নড়াচড়া করাচ্ছে। এর উপর নিজের লালচে কালো চুলগুলোর খুপা খোলে তৌসিরের চোখে, মুখে, গলায় ছড়িয়ে দিয়েছে। সাথে তো ফোনের সাউন্ড আছেই! এই সাউন্ডটাই বেশি বিরক্ত করতেছে তৌসিরকে। ঘুম লাগলেই ভেঙে যাচ্ছে। তৌসির কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে, তার সাধ্যও নেই। মুখ খুললেই নাজহার চুল তার মুখের ভেতর চলে যায়।
তৌসির হাত দিয়ে নিজের মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে আধোঘুমি গলায় বলে, “নাজহা, সাউন্ড কমাও।”
সাউন্ড কমানোর কথা শুনে নাজহা কিছু সময় নীরব থাকে, তারপর কমায়। এ দেখে তৌসির আর কিছু বলে না। তথাপি খানিক মুহূর্ত পর নাজহা ফাইজলামি করে আবারো ভলিউম বাড়িয়ে দেখতে থাকে। তৌসির কানের কাছে ফোন নিয়ে ধরে, তারপর আবার সরিয়ে আনে। ওর নিয়ত করে নিয়েছে তৌসিরকে এখন আর ঘুমাতে দেবে না। তৌসির নাজহার শয়তানি ধরতে পেরেও চোখ বুঁজে রয়, ভাবে হয়তো কিছু সময় পর ফাইজলামি বন্ধ করে দিবে। কিন্তু তা আর হয় না, নাজহা অনবরত এমন করতে থাকে।
নাহ, এবার আর সহ্য করা যায় না! এই মেয়ে চরম থেকে চরম বেয়াদব। তৌসির বেশ বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে ধমকায়, “এই ছিনাল, তোর সাউয়াটার সাউন্ড কমা! আমারে ঘুমাইতে দে।”
কিন্তু নাজহা এসবের তোয়াক্কা করছে না। ও রিলস সাউন্ড দিয়েই দেখে যাচ্ছে। তৌসির চোখ বুজে তাও শুয়ে আছে। মনে মনে ভেবেছে, “বদমাশনির যা ইচ্ছে করুক, আমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করি।” তথাপি ঘুম কি আসে? সাউন্ডে কানে জ্বালা ধরে যাচ্ছে। তৌসির চোখ খুলে নাজহার দিকে চেয়ে বলে, “এই চুতমারানি ছিনালন, তোর সমস্যা টা কি ক তো? এমন করাতোছস ক্যান? ঘুমাইতে দেস না ক্যান আমারে? কতবার বলছি সাউন্ড কমাইতে।”
নাজহা তৌসিরের গালি শুনে চোখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায় আর বলে, “বেলা সাতটা বাজে, আর ঘুমানোর প্রয়োজন নেই, উঠুন।”
“নাজহা, রাতে আমার ঘুম হয় নাই, তুমি জানো। তাই ঘুমাইতে দাও। হয় আমার বুকের উপর থাইকা সরো, নয় ফোন রাখো।”
“আরো সুন্দর করে বলুন, তাহলে কমাবো।”
“আচ্ছা, ম্যাডাম ডাকাইতনি, দয়া করে আপনার চ্যাটের বালের সাউন্ড কমান।”
নাজহা আর তৌসিরের কথায় কিছু বলে না, ফোনের সাউন্ড আলগোছে কমিয়ে রিলস দেখতে থাকে।
নাজহাকে এমন শান্ত থাকতে দেখে তৌসির আবারো চোখ বুজতে বুজতে নিজের ডান হাতটি আলতো করে বাড়িয়ে দেয় নাজহার পেটের ওপর। হঠাৎ এই স্পর্শে নাজহা সামান্য কেঁপে উঠে, শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল স্রোত বয়ে যায়। এই অনুভূতি তার কাছে নতুন নয়। যখনই তৌসির তাকে স্পর্শ করে, এমনি কেমন এক অদ্ভুত শিহরণ জাগে নাজহার ভেতরে। সারা শরীর মৃদু কাঁপতে থাকে, লোমকূপগুলো পর্যন্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। দেহজুড়ে এক অবসন্নতার রেখা বয়ে যায়, মনে হয় কেউ সপ্রায় স্থবির হওয়ার ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে ওকে। এরমধ্যে তৌসিরের স্পর্শগুলো বড্ড চঞ্চল যেমনটা সে নিজে। সারাদিন টইটই করে ঘোরে, এক জায়গায় কোমর শক্ত করে বসে না, ঠিক তেমনি তার স্পর্শও কোথাও স্তব্ধ হয়ে থাকে না।
তৌসিরের হাতের চঞ্চল আঙুলগুলো নাজহার উদর জুড়ে এক মায়াবী বৃত্ত আঁকতে শুরু করে নাজহা মুহূর্তের অস্বস্তি কাটিয়ে নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে তৌসিরের হাতের ওপর নিজের হাতটি রাখে আর তৌসিরের হাত সরিয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বলে ” উহু, হাত সরান।”
তৌসির হাত সরায় না, উল্টো মুঠো করে ধরতে ধরতে বলে, “তুমি তোমার হাত সরাও।”
মুঠো করে ধরায় নাজহা অল্প ব্যথায় তৌসিরের হাতের আঙুলগুলো চেপে ধরে কাতর হয়ে বলে, “আরেহ, এভাবে ধরবেন না, কাতুকুতু লাগে।”
তৌসির ওর এসব কথা কানে তুলে না, আগের মতোই ধরে রয়। তৌসিরের এই কার্যে নাজহা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নিজের হাত সরিয়ে আনে এবার। যা ইচ্ছে করুক এই লোক, নিজের সবকিছুই তো এ লোকেরই। তাহলে এত সংকোচ দিয়ে কি হবে? প্রয়োজন নেই তো এই সংকোচের, এই বিরক্তির। তৌসির ঘুমের দেশে তলাতে শুরু করে ওর হাতের ছুঁয়া আলতো হয়ে আসে। এমনি সময় বিবিজান চিৎকার করে উঠেন, “তৌসির রে, তাড়াতাড়ি উঠ! বারোটা বাজে গেছে তোর জীবনের!”
স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৫
এ বলেই দরজা টাশ করে মেলে বিবিজান ঘরে প্রবেশ করেন। দরজার ছিটকিনি নাজহা দেয়নি বিধায় তিনি এভাবে প্রবেশ করতে পারলেন। হঠাৎ বিবিজানের এই আগমনে নাজহা এক লাফে উঠে বসে। এমন আপত্তিকর একটা পরিস্থিতির মধ্যে কিভাবে যে বিবিজান প্রবেশ করলেন, আর কীই বা হয়েছে, বুঝতে ওঠতে পারে না নাজহা।
