হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১৩
Tahrim Muntahana
রান্নাঘরের মেঝেতে বসে পানিতে বিস্কুট ভিজিয়ে খাচ্ছিলো আসমানী। সকাল সকাল খাওয়ার অভ্যাস তার। নতুন পরিবেশ তো কি হয়েছে? ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে, খুঁজে খুঁজে রান্না ঘরে চলে এসেছে। যদিও নাদিয়ার ঘরে টুকা দিয়েছিল, রেসপন্স পায় নি। তাই আর না ডেকে নিজেই বিস্কুট বের করে খাচ্ছে। আগে পেট শান্তি করা যাক।
ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছে মিসেস নুরি। রাতে ঘুম হয়নি, ঘুমানোর মতো করে পড়ে ছিল বিছানায়। চা খাওয়ার তীব্র স্বাদ জাগতেই কাজের মেয়েটিকে বলতে এসেছিল। তবে রান্না ঘরে এসেই অচেনা মেয়েটাকে দেখে নিজেও খানিক ভয় পেয়ে যায়। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ এই মেয়ে কে তুমি? এই বাড়িতে ঢুকলে কি করে? গার্ড গার্ড, সবগুলো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। একটাকেও চাকরিতে রাখবো না। অচেনা যে কেউ বাড়িতে ঢুকে পড়ছে, বিপদ কি বলে কয়ে আসবে নাকি?
আকস্মিক চিৎকারে ভয় পেয়ে যায় আসমানী, হাতে থাকা বিস্কুটের ভেজা অংশ টা পানিতে পড়ে যায়। হুট করেই রাগ হয় তার, মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায়, অথচ এই মহিলার জন্য তার পছন্দের বিস্কুটটা পানিতে সাঁতার কাটছে। উঠে দাঁড়ালো সে, চট করে বলে বসলো,
~ এই এই আপনে কেডা? অচেনা মানে, আমারে চেনেন? আসমানী আমার নাম।
মিসেস নুরি কিছুক্ষণ আসমানীর দিকে তাকিয়ে রেগে চিৎকার করে উঠলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
~ চুপ করো বেয়াদব মেয়ে। এই মেয়ে তোর সাহস কি করে হয় আমি কে জিজ্ঞেস করার? কে নিয়ে এসেছে তোকে?
নিজের বাড়িতে এসে অচেনা কেউ মিসেস নুরিকে চিনতে পারেনি এটা যেন কোনো ভাবেই সে মানতে পারছে না। আহমেদ বাড়ি মালিকানা তার হাতে, আর এই মেয়ে তাকে বলছে সে কে? স্ত্রীর চেঁচামেচি শুনেই অনল মাহমুদ ঘুম থেকে উঠেছে। তড়িঘড়ি করে নিচে নামতেই ভ্রু কুঁচকে আসে তার। মিসেস নুরি স্বামীকে দেখেই আহ্লাদ করে বললো,
~ অনল তুমি এসেছো? দেখ, এই অচেনা মেয়েটা বাড়িতে ঢুকে আমাকেই জিজ্ঞেস করছে আমি কে!
আসমানী ঘুরে দাঁড়ালো। খালি গাঁয়ে হাঁটু সমান প্যান্ট পরিহিত পুরুষ মানুষ দেখেই জিভে তে কামড় বসালো সে। কি যেন মনে হতেই শাড়ির আঁচল টেনে মুখ ঢেকে ফেললো। ব্যাপার টা দেখে মিসেস নুরি কেমন শান্ত হলেন, স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন দৃষ্টি মেয়েটার দিকেই। ঠিক মেয়েটার দিকে নয়, তাড়াহুড়ো করে আঁচল টানার ফলে ফর্সা পেটের একাংশ বের হয়ে আছে, সেটাই চোখ বড়বড় করে দেখছেন অনল মাহমুদ। চোখ মুখে কেমন একটা ভাব! তবে মিসেস নুরি স্বামীর চাহনী ধরতে পারলো কিনা বুঝা গেল না। শান্ত স্বরে বললো,
~ কি দেখছো? গার্ড ডাকো, এই মেয়ে নিশ্চিত কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে। আমাদের ক্ষতি করে দিবে।
~ ও আমার পরিচিত। তোমার বোকা মাথায় ঢুকে নি আহমেদ বাড়িতে যে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। ঢুকবে কি করে? সারাক্ষণ তো অনল অনল করতেই যায়! অসহ্য!
মিসেস নুরির কথা শেষ হতেই পেছন থেকে উক্ত কথাটি বলে উঠলো নাদিয়া। দেরী করে ঘুমানোর ফলে চোখ ফুলে আছে তার। চেঁচামেচি শুনেই বুঝতে পেরেছিল আসমানী কে নিয়েই কিছু হয়েছে। ড্রয়িং রুমে এসেই মায়ের এমন আদিখ্যেতা দেখে শরীর যেন জ্বলে উঠেছে। মিসেস নুরি মেয়ের কথায় কিছুই মনে করেন নি, তবে অনল মাহমুদ বিতৃষ্ণা কন্ঠে বললেন,
~ মা হয় তোমার, ঠিক ভাবে কথা বলো। ম্যানারস শিখো নি?
~ হাফপ্যান্ট পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের কাছ থেকে নিশ্চয়ই নাদিয়ার ম্যানারস শিখতে হবে না! বউ নিয়ে উপরে যান, আপনাদের কোয়ালিটি টাইমের অর্ধেক তো এখানেই চলে গেল!
মেয়ের খোঁচা দুজনই বুঝতে পারলো। তবে আমলে নিলো না, অনল মাহমুদ উল্টো প্রশ্ন করলো,
~ কার অনুমতি নিয়ে বাড়িতে এনেছো?
~ প্রয়োজন মনে করি নি অনুমতি নেওয়ার!
নাদিয়ার ভাবালেশ উক্তি। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো অনল মাহমুদ। চেঁচিয়ে বললো,
~ আমার বাড়িতে এনেছো, অনুমতি তো নিতেই হবে। সাহস এত বেড়েছে কেন?
~ ভুল! এ বাড়ির একাংশ মালিকানা আমার হাতে! তাই আমি যে কাউকেই এ বাড়িতে আনতে পারি, রেখে দিতে পারি! আপাতত আপনাকে বলার কোনো প্রয়োজন পড়বে না। আমার একাউন্টে যতগুলো টাকা আছে ব্যাংকে ফেলে রাখলেও মাস প্রতি অভাবে পড়তে হবে না। তাই নিজের টাকার গরম আমাকে দেখাবেন না। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন, আপনাদের জন্যই ভালো।
আসমানীর হাত ধরে নাদিয়া নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। আসমানীর মুখে হাসি, পেছন ঘুরে মিসেস নুরি কে মুখ বেঁকালো। তা দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো মিসেস নুরি। হয়তো মনে মনে পণও করলেন এই মেয়েকে একা পেলে ছাড়বেন না!
নাদিয়ার যাওয়ার দিক তাকিয়ে থেকে অনল মাহমুদ হনহন করে উপরে চলে গেলেন, বিড়বিড় করে গালি দিতেও ভুললেন না। সেটা নাদিয়া নাকি আসমানী নাকি অন্য কাউকে সে ছাড়া কেউ বুঝতে পারলো না। নিজের ঘরে যেতেই টের পেলেন তার ফোন বাজছে, জলদি করে উঠালেন। তবে ফোনের উপরে জ্বলজ্বল করা নামটি হয়তো তিনি আশা করেন নি, চমকে গেছেন। সেই সাথে একটু আগের রাগের মিশ্রণে যেন আরো কিছু কারণ যুক্ত হলো। রিসিভ করলেন না, কেটে দিলেন। অস্থির চিত্তে পাইচারি করতে করতে ফোন লাগালেন আদিলের নম্বরে।
সাথে সাথেই রিসিভ হলো। তিনি প্রচণ্ড রেগে বলে উঠলেন,
~ দ্বিতীয় বারের মতো তুমি ফেইল আদি! আবারো আমাকে হারিয়ে দিলে! মৃত মানুষ নিশ্চয়ই আমাকে ফোন দিতে পারবে না।
আদিল চুপ করে থাকে। তার বলারই বা কি আছে? সত্যিই সে অসফল। দুদিন দুটো মেয়ের জন্য তার কাজে অসফল হয়েছে সে। আদিলের চুপ থাকা দেখে অনল মাহমুদ জোরে শ্বাস নিলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
~ লাঞ্চ টাইমের আগে খবর শুনতে চাই। আশা করছি এইবার নিরাশ হতে হবে না। এবারও নিরাশ হলে তোমার উপর ভরসাটাই শেষ হয়ে যাবে আদি, আমি হেরে যাবো। নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবো আমি।
শেষের কথাগুলো কেমন করুণ শোনালো। আদিল বার কয়েক চোখের পলক ফেললো। শান্ত স্বরে বললো,
~ আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি আব্বু। আমার ভুলের জন্যই এমন হয়েছে। আজ আর ভুল হবে না। আমি নিজের হাতে ওর গলা কা* টবো।
অনল মাহমুদ স্বস্তিতে বিছানায় বসলো। প্রসন্ন কন্ঠে বললেন,
~ নিজের খেয়াল রেখ আব্বু। ওরা কিন্তু ভালো না। বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসে জানো তো! তোমার কিছু হলে এত কিছুতে আমার সংগ্রামের কোনো মূল্য থাকবে না। আহমেদ বংশের যোগ্য উত্তরসূরী, পরবর্তী প্রজন্মের মাথা তো তুমিই আদি। তোমার জন্যই তো এত কিছু করা। খেয়াল রেখো।
ফোন কেটে দিল অনল মাহমুদ। আদিলের মুখে হাসি, বাবার সাথে কথা বললেই প্রশান্তি বয়ে যায় মনে। নিজেকে তো সে ভালো বাসে না, শুধু মাত্র এই মানুষ টাকে ভালোবাসে সে। তাকে দু বার কষ্ট দিলো। বাবাকে কষ্ট সে দিতে চাইনি। যেদিন থেকে আফরা নামক মেয়েটা তার জীবনে এসেছে সেদিন থেকে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। আর এলোমেলো করার সুযোগ সে এই মেয়ে কে দিবে না, চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দিবে। তার আগে হাতের কাজ শেষ করে নিক!
ধীর গতিতে হাঁটছে আদিল। সময় টা দশ টা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। তার বেশ তাড়া, তবে দ্রুত হাঁটছে না সে। কারণ টা এক্সারসাইজ করতে গিয়ে পায়ে আজ চোট পেয়েছে। হঠাৎ করে কেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সে জানে না। তবে হুট করে মনে হচ্ছিলো, তার জীবনে বেশ পরিবর্তন আসতে চলছে। কেমন পরিবর্তন তাও বুঝতে পারছে না, কয়েক বছরের এক্সপেরিয়েন্সে ধারণা করতে পারছিল তার অগোচরে তারই পিঠে কেউ ছুরি বসানোর জন্য উঁত পেতে আছে। রহস্য রহস্য গন্ধ তো চারদিকে, তা সময় যেতেই জোড়ালো হচ্ছে। চেনা পরিচিত বোন টাও কেমন বদলে যাচ্ছে, মুখে মুখে তর্ক করা শিখেছে। এখন দেখার পালা তর্ক করার মুখটা কতদিন থাকে!
বাঁকা হাসলো আদিল, মাস্কে ঢাকা হাসিটা সবার অগোচরেই মিলিয়ে গেল। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো তার শিকার আধা ঘন্টা পরই তার হাতে চলে আসবে। রিলেক্স মুডে হাঁটতে থাকে। তবে নিয়তি হয়তো অন্যকিছু ঠিক করে রেখেছিল, নাহয় কেউ নিজ হাতে নিজের নিয়তি পালাক্রমে অদলবদল করছিলো। এমন না হলে আদিলের রিলেক্স মুডের বারো টা বাজিয়ে আফরা কেন হাজির হবে? আশপাশ দেখে আদিল আফরার দিকে দৃষ্টি ঘুরায়। হাঁপাচ্ছে, হয়তো দৌড়ে এসেছে। মেয়ে টাকে আজ কেমন খুশি খুশি লাগছে। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
~ আসলেই কি জানেন? বাঙালি কে বসতে বললে খাওয়ার আবদার রাখবেই! আবার খেতে দিলে থাকার আবদার করার জন্যও গড়িমসি করবে। আপনার সাথেও ঠিক এমন টা হয়েছে। আপনাকে ছাড় দিয়েছি বলেই হয়তো আপনার এত সাহস বেড়েছে। এরপর কিন্তু ছাড় পাবেন না!
আফরা সেই প্রসঙ্গে গেলই না। বরং মিষ্টি হেসে নিজের হাতে থাকা টিফিন বক্স দেখিয়ে বললো,
~ আপনার জন্য সেই ভোরে উঠে রান্না বসিয়েছি। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই দেখি আপনি বের হয়ে অনেকটা পথ চলে এসেছেন। দৌড়ে এসে শেষ পর্যন্ত ধরতে পেরেছি। আপনি আমার কষ্ট টা বৃথা করে দিবেন?
~ আমার কাছে আপনারই কোনো মূল্য নেই, সেখানে আপনার কষ্টের মূল্য থাকবে আশা করলেন কি করে? হাউ ফানি!
আফরা মুখ বেজার করে নিল, একপলক টিফিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
~ আপনি কেন বুঝতে পারছেন না আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে!
~ আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারছি! পছন্দ হয়েছে টা যখন ভালোবাসি তে রূপ নিবে তখন নাহয় যোগাযোগ করবেন। তবে সে পর্যন্ত যদি বেঁচে থাকেন!
মনে মনে হাসলো আফরা। পছন্দ হয়েছে বলাটা কত সহজ! অথচ ভালোবাসি বলাটা! এ জীবনে মনে হয় না কোনো পুরুষ কে এই শব্দ টা সে বলতে পারবে। তবে আদিল কে যে মানাতে হবে। আদিলের দিকে তাকাতেই আফরার দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। বারবার ঘড়ি দেখছে কেন? আবার চোখ ঘুরিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের দিকেও তাকাচ্ছে। আফরা’র আর বুঝতে বাকি রইলো না আদিল কাজে এসেছে, সিক্রেট কাজ! ঠোঁটের ভাজে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
~ আপনি না খেলে আমি আপনার পিছু ছাড়ছি না আজ!
আদিল রক্তিম চোখে আফরার দিকে তাকালো। আফরা’র উদ্দেশ্য টা না জানা পর্যন্ত কেন জানি মেয়েটার ক্ষতি করতে সায় দিচ্ছে না। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
~ আমার রাজ্যের একমাত্র রাজা আমি, সুউচ্চ সিংহাসনের একমাত্র অধিকারী আমি। আমার রাজ্যে প্রবেশ করার সাধ্য দেখিও না মেয়ে। পুড়ে যাবে, ক্ষয় হয়ে যাবে, নিঃশেষ হয়ে যাবে!
শব্দ করে হেসে উঠলো আফরা। জোর করে আদিলের হাতের ভাজে টিফিন বক্স টা ধরিয়ে দিল। অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে একটুও দুজনের হাত স্পর্শ হলো না। টিফিন বক্স টা আদিল আকড়ে ধরতেই আফরা বললো,
~ রাজা ছাড়া যেমন রাজ্য হয় না, প্রজা ছাড়া তেমন রাজা হয় না। আর এই রাজা মূল্যহীন পড়ে থাকে রানী ছাড়া। প্রজা যে রাজার মাথায় মুকুট দেখে না!
আফরা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তবে বলা হয়ে উঠে না। একটু আগেও যে টিফিন বক্স টা আদিলের হাতের ভাজে ছিল, সেটা এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর আদিল সে তো এক দৌড়েই হাওয়া হয়ে গেল। কোথায় গেল, এত তাড়াতাড়ি কিভাবে গেল আফরার বুঝ এলো না। রেগে টিফিন বক্স টা তুলে বিড়বিড় করে কি যেন বললো। নিজেও আর দাঁড়ালো না। উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরলো। ভার্সিটি মিস করে এসে কোনো লাভ ই হলো না, বরং সময়টাই অবহেলায় চলে গেল!
~ আম্মু বাবা এখনো আসছে না কেন?
মেয়ের প্রশ্নে বিরক্ত হলো মনিরা। সেই কখন থেকে বাবা বাবা করে তার মাথা খাচ্ছে। মেয়ে কি বুঝতে পারছে না তার রাগ লাগছে। চোখ রাঙিয়ে মেয়ের দিকে তাকালো সে। মিহি নিভে গেল, বাবাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে, চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক। রাতে বাড়ি ফেরে নি, সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চললো এখনো বাবার খোঁজ জানে না। চিন্তিত মুখ নিয়ে সোফায় বসলো মিহি। মেয়েটার বয়স ই বা কত? আট বছরের মেয়েটা যে এমন পরিবেশেও বেঁচে আছে তাই অনেক। আরো আধ ঘন্টা চলে গেল, মিহি ছলছল চোখ নিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিতেই মনিরা গম্ভীর কন্ঠে বললো,
~ আরেক বার একই প্রশ্ন তোমার মুখ থেকে বের হলে, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। চুপচাপ পড়ার টেবিলে বসো, তোমার ম্যাম চলে আসবে।
ভয়ে ঢোক গিললো মিহি, আর এক মুহূর্ত দাঁড়ানোর সাহস পেল না। দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়েই ঝরঝর করে কেঁদে দিল। সকাল থেকে মায়ের এমন অবহেলায় পেয়ে আসছে সে। তার উপর বাবাও নেই। মেয়ের যাওয়ার দিক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মনিরা। তারই বা কি করার আছে? কে জানে কোথায় পড়ে আছে! আবার রান্নায় মনোযোগ দিল, শাশুড়িকে একটু পরেই খেতে দিতে হবে। ঔষধ আছে, সময় মতো না খাওয়ালে আবার সমস্যা। চরিত্রহীন শশুড় ও নিজের ঘরে বসে কি করছে কে জানে? মনিরার তো সামনে গেলেই গা গুলিয়ে আসে। ব্যস্ত হাতে রান্না শেষ করতেই কলিং বেলের শব্দ ভেসে আসে। মুখে হাসি ফুটিয়ে দরজা খুলে দেয় মনিরা, আফরা এসেছে। মিষ্টি হেসে মনিরা বললো,
~ কেমন আছো আফরা?
~ আমি সবসময় ভালো থাকি আপু। আপনি ভালো আছেন?
আফরার উত্তরে মনিরার হাসি চওড়া হলো। দরজা লাগাতে লাগাতে বললো,
~ আমি তো বিন্দাস!
মনিরার এমন ঝলমলে হাসি দেখে আফরার ভ্রু কুঁচকে এলো। এত খুশি কেন মেয়েটা আজ? কুঁচকানো ভ্রু নিয়েই বললো,
~ আজ মনে হচ্ছে আপু একটু বেশীই খুশি?
~ তাই তো মনে হচ্ছে। অনেক দিন পর বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ পেয়েছি গো!
বুঝলো না আফরা। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাতেই মনিরা বললো,
~ তোমাকে বলায় যায়, ডিভোর্সের এপ্লাই করেছি। এবার একটু শান্তি তে থাকতে চাই গো। শাশুড়ি, মেয়ে নিয়ে নতুন একটা সংসার গড়বো! তুমি কিন্তু শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকলে!
বিনিময়ে আফরা মুচকি হেসে উপরে চলে গেল। মনিরার হুটহাট এমন কাজে অবাকও হয়েছে। তবে প্রশ্ন করার কিছু খুঁজে পায় নি। ছাত্রীর ঘরে ঢুকতেই মিহিকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে। এক ছুটে বুঝে নেয় আজ মেয়ে পড়া শিখে নি! বসতে বসতে বললো,
~ পড়া শিখ নি?
~ শিখেছি!
মন খারাপ করেই জবাব দিল মিহি। আফরা পাল্টা প্রশ্ন করলো,
~ তাহলে মন খারাপ কেন?
~ বাবা কে মিস করছি আমি, এখনো বাড়ি ফেরেনি।
~ তোমার বাবা কি নতুন এমন করে? প্রায় ই তো দেখি বাড়ি ফেরে না।
~ বাড়ি না ফিরলেও আমাকে ফোন করে বলে, আজ বলেনি।
গম্ভীর কন্ঠের জবাব শুনে আফরা হেসে উঠলো। বাবা’র প্রতি এই মেয়ের ভালোবাসা দেখে কেমন শরীর জ্বলছে তার! সেও তো বাবা কে খুব ভালোবাসতো। বাসতো? এখনো তো বাসে! তবে তার ভালোবাসার প্রকাশ টা যে ভিন্ন। হঠাৎ করে আফরার মনে পড়ে মনিরার কিছুক্ষণ আগে বলা কথা। কিছুটা আনন্দও পায় সে, মেয়েটার সাথে একটু মজা করা যাক। শান্ত স্বরে বললো,
~ ধরো আমি আর তুমি একটা খেলা খেলছি। সেখানে তোমাকে অপশন দেওয়া হলো মা অথবা বাবা’র মধ্যে কাউকে বেছে নিতে হবে। কাকে নিজের সাথে নিবে তুমি? আর হ্যা এই খেলাটাই কিন্তু যাকে বাছবে না তাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে!
মিহি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর হুট করেই বললো,
~ আম্মু, আমি আম্মুকে চাই।
আফরার মুখটা পাংশুটে হয়ে গেল। মেয়েটা তার মজাটাই নষ্ট করে দিল। বিরক্ত হয়ে বললো,
~ বাবা কেন নয়? তুমি না বাবা কে ভীষণ ভালোবাসো?
~ বাবা আমাকে ভালোবাসে, আম্মুকে তো না। কিন্তু আম্মু আমাদের দুজন কেই ভালোবাসে। তাই আমি আম্মুকেই চাই।
কি কঠিন উত্তর। আফরার পাংশুটে মুখটা যেন খুশিতে ভরে গেল। এই টুকু মেয়েও কেমন পরিস্থিতি, পরিবেশ বুঝে ধরে ফেলেছে তার বাবা তার মা কে ভালোবাসে না। হাত বাড়িয়ে গাল টেনে বললো,
~ তাহলে মন খারাপ করে আছো কেন? হাসি দাও। শুনো মিহি, তোমার বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসে জানো? তাই তোমার বাবা কে কখনো ভুলো না। তবে তোমার মা তোমাকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসে, তাই তোমার মা কে কখনো ছেড়ে যেও না! কেমন?
মিহি বুঝেছে কি না বুঝা গেল না, তবে দুবার মাথা নেড়ে সায় জানালো। পড়ায় মনোযোগ হতেই আফরা হেসে দরজায় তাকালো। ছলছল চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনিরা। মেয়ের কথাগুলো শুনে মনিরার মনে হলো এই বুঝি সুখের শুরু তার। আফরার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মনিরা চলে যায় নিচে। এই প্রাপ্তি তার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি!
মনিরা নিচে নামতেই আরাফ কে বসে থাকতে দেখে ডাইনিংয়ে, সাথে আশরাফ উদ্দিন। মনিরা কে দেখেই তিনি বললেন,
~ খাবার দাও!
মনিরা রান্নাঘরে ঢুকে গেল, কোনো রকম শব্দ ব্যয় না করে রান্না করা খাবার গুলো টেবিলে রাখলো। নিজের মতো দুটো প্লেটে খাবার নিয়ে বললো,
~ নিজেদের মতো নিয়ে খান, আম্মার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে।
তেতে উঠলো আরাফ,
~ মুখের উপর কথা বলবা না, বাবা যা বলছে তাই করো। ওই মহিলা পরে খাবে।
~ সম্পর্কে ভাবী হই আপনার, ঠিক করে কথা বলুন। হুকুমের গোলাম না আমি। নিয়ে খেলে খান না হলে না খেয়ে থাকুন। আপনাদের মতো চরিত্রহীনদের জন্য যে রান্না করেছি এই অনেক! বাম হাত তো গেছে, গলার মাঝখানে যখন কা* টা পড়বে তখন বড় বড় কথা বের হবে। বাপ কা ব্যাটা!
কথাটা বলেই মনিরা শাশুড়ির ঘরে চলে যায়। গলার স্বর উঁচু হওয়ায় কথাগুলো আফরা’র কর্ণকুহরেও পৌঁছেছে। হুট করে মনিরার এমন পরিবর্তনে রহস্যময়ী মেয়েটিও হতবাক। আর কত রহস্যের জাল বেছানো এই দুনিয়ায়? এই খেলা যে কবে শেষ হবে! আদও হবে কিনা!
অপমানে থমথমে মুখশ্রী নিয়ে আরাফ চেয়ারে বসে আবার। ডান হাত বাড়িয়ে কাঁচের গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে ছুড়ে মারে ফ্লোরে। বিকট শব্দে কাঁচ গুলো টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তবে আশরাফ উদ্দিন ভাবালেশ। নিজের প্লেটে ভাত, তরকারি উঠিয়ে নিয়ে ছেলের পাতেও উঠিয়ে দেয়। খাওয়ার কথা বলে না, নিজেই আগে আগে খেতে শুরু করে। আরাফ ও আর রেগে বসে থাকে না, আগে পেট শান্তি করা যাক। পরে না হয় এই মহিলা কে দেখা যাবে। সময় অনেক!
খাওয়ার পর্ব শেষ হয়, মনিরা এঁটো থালা নিয়ে আবার ডাইনিংয়ে আসে। তখনো বাবা-ছেলে কে খেতে দেখে মনে মনে ‘খাদক’ বলে গালিও দেয়। খেয়ে খেয়ে চর্বি জমিয়েই তো এত লিলা খেলা দেখাতে পারে! রান্নাঘর থেকে বের হতেই কলিং বেলের শব্দ ভেসে আসে। মনিরা ভাবে আতিকুর এসেছে, দ্রুত না গিয়ে একটু আস্তেই পা চালায়। আতিকুর আসে নি, বাড়ির দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মাঝারি সাইজের পার্সেল। মনিরা দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
~ মেডাম কে যেন বাড়ির সামনে ফেলে গেল। আপনার নাম লিখা।
মনিরা হাতে নিল, দারোয়ান যেতেই দরজা বন্ধ করে ভেতরে যেতেই শশুড় কে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলো। কিছু বললো না, নিজের ঘরের দিকে যাবে তার আগেই আশরাফ উদ্দিন বললো,
~ কি আছে ওটাতে? কে পার্সেল পাঠালো তোমায়? আমাদের তো চরিত্রহীন বলো, নিজের চরিত্র ঠিক আছে তো? দেখি কে কি পাঠিয়েছে!
ঘৃণায় চোখ মুখ অসম্ভব কুঁচকে আসে মারিনার। অবাধ্য হয়ে বলে উঠে,
~ আমার চরিত্রের বিচার আপাতত আপনার কাছ থেকে পেতে হবে না। ভদ্রতা শিখেন নি? অন্যের পার্সেল আপনি দেখবেন কেন?
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১২
আশরাফ উদ্দিন কথাগুলো গাঁয়েই মাখলো না। বরং জোর করে কেড়ে নিলো পার্সেল টা। সোফায় বসে মোড়ানো কাগজ খুলে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো। হয়তো সে মনে করছে মারিয়ার কোনো প্রেমিক গিফট পাঠিয়েছে। হয়তো মনে মনে এও ঠিক করে নিয়েছে এমন হলে মনিরা নামক মেয়েটির আজ রক্ষা নেই! ভেতরের কাগজ টা খুলতেই হাসি হাসি মুখটা পাল্টে যায় আশরাফ উদ্দিনের। হাত থেকে পড়ে যায় পার্সেল, শব্দহীন সোফায় বসে পড়েন তিনি। মোটাসোটা শরীর টা ঢুলে পড়তেই মনিরা চমকে যায়। এগিয়ে এসে পার্সেলে দৃষ্টি ফেলতেই নিজেও ছিটকে পড়ে পেছনে, চিৎকার করে উঠে। কাঁপতে থাকে তার শরীর! কি দেখলো সে? কিভাবে হলো?