হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৪৪+৪৫+৪৬
Tahrim Muntahana
দ্রুত বেগে সময় পেরিয়ে গেছে পাঁচ মিনিট। নোমান, আফীফের চোখে মুখে বিস্ময়। অনুমতির জন্য অপেক্ষা করেনি আফরা। তেতরে ঢুকে অপেক্ষা করছে কারো কন্ঠ শোনার জন্য। তবে বিস্ময়ের রেশ টা একটু বেশীই বোধহয়। আফরা বিরক্তির শ্বাস ফেললো। ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকাতেই নোমান অবাক মিশ্রিত অস্পষ্ট স্বরে বললো,
~ আফরা আপনি?
আড়চোখে দেখলো আফরা। ‘মিস’ শব্দ টা বাদ যাওয়ায় নিজের কাছেই কেমন লাগলো। ভাবালেশ কন্ঠে বললো,
~ আসা বারণ নাকি?
নোমান মুচকি হাসলো। ত্যাডা কথা যেন ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে থাকে। বিবস কন্ঠে বললো,
~ এত তাড়াতাড়ি আপনার দর্শন পাবো, ভাবিনি। গুড লাক!
নোমান টের পেল এতক্ষণের বিরক্তি, রাগ, খারাপ লাগা সব একটুতেই পালিয়ে গেছে। সেসবের পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে ভালোলাগা, মুগ্ধতা। মেয়ে টা তার প্রশান্তি’র কারণ হয়ে ধরা দিচ্ছে। খানিক বিচলিতও হলো না নোমান। সাদরে গ্রহণ করলো পরিবর্তন টা। আপ্লুত কন্ঠে বললো,
~ তা কেন এসেছেন?
চোখ ছোট ছোট করে নোমানের ভঙ্গিমার পরিবর্তন দেখছে আফরা। ঠিক সুবিধার লাগছে না। দু’পা এগিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
~ পিকনিক করতে এসেছি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ভীষণ হাসি পেল আফীফের। এতক্ষণ গম্ভীর মুখে দুজন কে পরখ করছিলো।ভাবছিল কেমন পরিচিত। তবে আফরা’র বিরক্তি কন্ঠস্বর বিষয়টি বুঝতে সময় লাগে নি। সুক্ষ্ম খোঁচা টা আফীফের সামনে হজম করে নিলো নোমান। অস্বস্তি তে পড়ে গেল সে। থমথমে মুখে কিছু বলবে, পূর্বেই আফীফ বলে উঠলো,
~ আমার অতি পরিচিত মি. নোমান। আপনি এখন আসুন।
চমকিত দৃষ্টিতে তাকালো নোমান। অতি পরিচিত বলতে কি বুঝাতে চাইলো ঠিক ধরতে পারলো না। তবে তাকে যে তৃতীয় ব্যক্তি ধরেই ‘আসুন’ শব্দটি ব্যবহার করেছে বেশ বুঝতে পারলো। তার মাথায় এই মুহূর্তে ঢুকলো না, ‘সে সত্যিই সম্পূর্ণ অপরিচিত। তার সামনে কুশল বিনিময় ছাড়া অন্যান্য দরকারি কথা বলা যায় না।’ অপমান মনে করে থমথমে মুখ নিয়েই বেরিয়ে গেল নোমান। বিষাদেরা উঁকি ঝুঁকি মারছে হৃদয়ে। তবে কি সে খুব দেরী করে ফেললো?
নোমান চলে যেতেই গাম্ভীর্য পায়ে দরজায় এসে দাঁড়ালো আফীফ। অতি সন্তর্পণে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে নিজ বেডে এসে বসলো। বেডের পাশে রাখা টুলে বসতে বসতে আফরা কিছুটা কৌতুক করেই শুধালো,
~ অতি পরিচিত?
~ যার বেনামি চিঠি পেয়ে আফীফ মুনতাসির ঢাকা থেকে বান্দরবান চলে এলো, সে অতি পরিচিত নয় বলছেন?
চরম দৃঢ়তা মেশানো কথা শুনে বিনয়ী হাসলো আফরা। ‘আফীফ মুনতাসির’, ‘আদিল মাহমুদ’ দুটো ব্যক্তিত্ব কে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে ভাবতে বসলো। কোথাও একটা মিলে যায়। বিচলিত ভাব হীন দুটো ব্যক্তিত্ব। আগুনে ঠেলে দিলেও তারা চিৎকার চেঁচামেচি করে সহানুভূতির আশা করবে না, নিজ বুদ্ধি তে বাঁচার চেষ্টা করবে নাহয় গাম্ভীর্য ধরে রেখেই মৃত্যু কে বেছে নিবে। প্রতিপক্ষের নিকট ‘আপোষ’ শব্দটি যেন তাদের সাথে যায় না। আবার হুট করে আফরা লক্ষ্য করলো দুজনের মাঝে অমিল অনেক। আফীফ মুনতাসিরের হৃদয় নির্মল এক হাসিতে ভরা। পাত্র ভেদে নির্মল হাসিটা ছড়িয়ে দিয়ে নিজ ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে বেশ সচেতন। কিন্তু আদিল মাহমুদ একরোখা, কঠোর, জেদী, নির্দয়। যদিও দুদিন বেশভূষায় পরিবর্তন এনেছে, সেটা যে স্বার্থের টানেই; তার চেয়ে ভালো কে জানে?
ভাবুক আফরা কে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আফীফ। মেয়ে টা তার দিকে তাকিয়েও তাকিয়ে নেই। নয়ন যুগল তার উপর তবে নয়ন যুগলের কেন্দ্রীকতা যেন শূণ্যে মিলিয়ে গেছে। মেয়ে টাকে দেখতে ভালো লাগছে। হৃদয়ের গভীরে সুপ্ত এক আনন্দ খেলা করছে। বিশেষ পাত্তা দিল না আফীফ। পথ থেকে বেঁকে যাওয়া সে শিখে নি। শান্ত গলায় শুধালো,
~ ভাবুক রানীর ভাবনা টা শেষ হবে কখন?
লজ্জা পেল আফরা। মুখশ্রী নত করে নিজেকে শাসালো। কি সব ভাবছিলো সে! আগের কথার রেশ টেনে বললো,
~ বেনামি চিঠি খানা আপনার জন্য ছিল না মি. আফীফ মুনতাসির। আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যার নামে চিঠি তাকে পৌঁছে দেওয়া ভদ্রতা।
~ আমি তো কখনোই নিজেকে ভদ্র প্রমাণ করতে যাইনি মিস আফরা। আপনি ধরে নিচ্ছেন কি করে আমি ভদ্র? চিঠি খানা আপনার ঠিকানা মতোই পৌঁছেছিল, সৎ অফিসার নামে অল্প একটু নামডাক আছে বোধহয়। এখন আপনি যদি মুখে খাবার তুলে দিয়ে, স্বাদ গ্রহণের কৌতুহল বাড়িয়ে দিয়ে তা ফেলে দিতে বলেন। ব্যাপার খানা পাশাপাশি যায় বলুন? ক্ষুধার রাজ্যে সব মাফ, সে হোক খু*ন।
চমৎকার ভঙ্গিমায় কথা গুলো শেষ করে মাথা দুলিয়ে হাসলো আফীফ। আফরার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে এসেছে। পাশে তাকিয়ে ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মেয়েকে দেখে মুচকি হাসলো। তাচ্ছিল্য কন্ঠে বললো,
~ মিস অনান, ঘোমটার নিচে খেমটা আর কত নাচাবেন?
চমকালো তিনজনই। কিছুক্ষণ হলো জিয়াউল ঘুম থেকে উঠেছে। চুপচাপ শুনছিলো। অনান কে চিনে ফেলায় ঘুম ঘুম চোখ তার বড় হয়ে গিয়েছে। মুখ কিছুটা হা করে বোকামির পরিচয় দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আফরার দিকে। অনান মাথার কাপড় টা ফেলে দিয়ে ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। এতক্ষণ ঘোমটা দিয়ে যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছিলো না এমন ভাব। সহজ ভঙ্গিমায় হেসে বললো,
~ চিনে ফেলেছেন?
~ যাকে বেনামি চিঠি পাঠিয়ে বান্দরবানের মাটিতে এনে দাঁড় করালাম, তার খবরাখবর রাখা অস্বাভাবিক নয়। আপনি যেদিন গোবেচারা মি. জিয়াউলের থেকে তারই ফোন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন, সেদিনই সন্দেহের তালিকায় পড়ে গিয়েছিলেন। ভালো এগোচ্ছেন!
কথাটা শেষ করে একপলক জিয়াউলের দিকে তাকালো আফরা। হা করা মুখটা বন্ধ হয়ে গেছে। গোবেচারা বলায় অপমানিত হয়েছে এমন একটা ভাব ধরে তার দিকে রেগে তাকিয়ে আছে। হাসলো আফরা। অনান কিছু বললো না, মুখ গম্ভীর করে বসে রইলো। আফীফের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় আফরা বললো,
~ জেনারেল আফীফ মুনতাসির কে ছিনতাইকারী জখম করেছে, বিশ্বাস করবো?
~ বলিনি তো, চাইলে করতে পারেন! তবে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাবেন, বিশ্বাস করা ভুল হবে। এখানে আসার কারণ?
~ মিসেস কামিনীর কাছে গিয়েছিলাম। বললেন উনি। আমিও চলে এলাম দর্শন দিতে। হসপিটাল আসতে বলায় উনার চোখ মুখ হঠাৎ পাল্টে গেল কেন? ঠিক তাবু তে যেমন অনল মাহমুদের নাম শুনে হয়েছিল। সামথিং ইজ রং।
আফরা’র চিন্তিত কন্ঠস্বর আফীফকে আবার ভাবনায় ফেলে দিলো। অনল মাহমুদের সাথে তাদের কিসের সম্পর্ক? কিছু ঘটেছিল অতীতে? কিই বা ঘটবে? মায়ের ভীতি নিয়ে বাইরের কারো সাথে আলোচনা করা টা ঠিক মনে করছে না আফীফ। খুব দ্রুত মুখশ্রী কঠোর করে নিলো। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে উঠলো,
~ ধস্তাধস্তি করতে দেখেছিলাম আপনাদের দুজন কে। অন্ধকার দূর করতে এত টর্চ ব্যবহার হয়েছিল, নিচের পাহাড় থেকে কোনো কিছুই নজর এড়ায়নি। ক্যামেরা টা ফেলে দিতে দেখেই খুঁজে বের করেছি। ইচ্ছে করেই ওপেন করেছিলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল আপনি আমাকে ছবিগুলো সম্পর্কে জানাবেন। অভদ্রতা করেই বসলাম। যার ফল আজকে হসপিটালে থাকা। আপনি তো তেমন টাই চেয়েছিলেন মিস আফরা। আপনার সীমাবদ্ধতা গুলো আমার পক্ষে দূর করা সম্ভব! এর জন্যই তো বেনামি চিঠি?
এরকম টাই ভেবেছিল আফরা। কিন্তু কোথাও যেন গন্ডগোল টের পেল। আনমনেই বললো,
~ জেনারেল পরিচয়ে এসে ভুল করেছেন। ফণা তোলা সাপের মাথা থেকে মণি নিয়ে আসা দুষ্কর!
~ সাপটাকেই যদি নকল চকচকে মণির লোভ দেখানো হয়?
রহস্যময় কন্ঠস্বর। আফরা আর এই বিষয়ে কথা বললো না। হুট করেই কিছু একটা মনে হতেই মৃদু চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ সর্বনাশ! প্রত্যেক টা ঘরে সিসি ক্যামেরা লাগানো, মি. আফীফ!
আফীফ দুর্বোধ্য হাসলো। হাসিটাই কেমন একরোখা জেদ মেশানো ছিলো। নিরস গলায় বললো,
~ অসুস্থ শরীর নিয়ে দু ঘন্টা দাঁড়িয়ে সিসি ক্যামেরা’র কার্যক্ষমতা নষ্ট করেছি মিস আফরা! আফীফ মুনতাসির এত কাঁচা কাজ করে না।
স্বস্তির শ্বাস ফেললো আফরা। কিছুটা হেঁয়ালি মিশ্রিত কথা শুনে ঢের বুঝেছে আটঘাট বেঁধেই নেমেছে আফীফ। টুল থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে জিয়াউল দিকে তাকালো। ছেলেটা এখনো তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুটা হেসেই বললো,
~ এতটা সরলতা আপনার মানায় না মি. জিয়াউল। আপাতত আপনার প্রফেশনের সাথে যায় না!
শরীর টা পড়ে আছে তুলতুলে নরম বিছানায়। চেহারায় নিদারুণ কষ্ট, যন্ত্রণা। একমাস অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকা শরীরের মতন মনে হচ্ছে নাদিয়ার নিথর শরীর টাকে। ইজি চেয়ারে বসে গম্ভীর দৃষ্টিতে দেখছে আদিল। ডাক্তার এসেছিল। আজকের দিন টা দেখতে বলেছে, জ্বর না কমলে হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে। ঔষধ বাড়িতেই ছিল, তবে জ্ঞান ফেরে নি বলে খাওয়ানো হয় নি। একবার ভেবেছিল অফিস চলে যাবে, থাকুক মরার মতো পড়ে। আবার কি এক টানে পা চললো না, সে ইজি চেয়ারে বসেই রইলো। বাইরের জামা কাপড় ছাড়া হয়নি, নাদিয়ার শরীরের ধুলো শরীরে লেগে আছে। সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা আদিল শক্তি বা ইচ্ছে কোনো টাই পাচ্ছে না। জীবনের সমীকরণ সে কখনোই মেলায় না, আজও শেষ খুঁজলো না। জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় হিংস্রতা নিয়ে বসে রইলো।
চোখের পাতা পিটপিট করছে। আধবোজা চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করছে, সে কোথায় আছে। তবে জ্বরের ঘোরে একটার জায়গায় দুটো দেখার জন্যই হয়তো ঠাহর করতে পারলো না। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ঢোক গিললো নাদিয়া, তিক্ত স্বাদ অনুভব হতেই চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না। অস্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠলো,
~ পা__নি! খা__বো!
আদিলের কানে পৌঁছালো। দ্রুত উঠলো না, বরং বেশ সময় নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আগ থেকে রেখে দেওয়া গ্লাস টা হাতে তুলে নিলো। নাদিয়ার পাশে বসে গমগম কন্ঠে বললো,
~ তোমার উচিত ছিল ‘মদ খাবো’ বলা নাদিয়া!
অসুস্থ শরীর টা থরথর কেঁপে উঠলো নাদিয়ার। জ্বরের ঘোরেও যে কন্ঠটা ঠিক ঠাহর করতে পেরেছে, বুঝতে পেরে বাঁকা হাসলো আদিল। ঘাড়ে হাত গলিয়ে দিয়ে মাথাটা খানিক উঁচু করে ডান হাতে থাকা গ্লাস ঠোঁটের ভাজে রাখলো। তেষ্টায় চুমুক দিতেই, আধবোজা চোখ খুলে গেল নাদিয়ার। আশ্চর্য চাহনিতে আদিলের নিরস মুখের দিকে তাকালো। সে তো পানি চেয়েছিল, মদ দিলো কেন? প্রশ্নটা চোখের দৃষ্টি তে ঘুরতে লাগলো। আদিল তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
~ তোমার জন্য এটাই ঠিক নাদিয়া। তোমার জীবনের থেকেও অতি প্রিয়, ওমন করে তাকাচ্ছো কেন?
কথাটা বলে গ্লাসের পুরো তরল পদার্থ ঢেলে দিলো জোর করে। নাদিয়ার গলা মনে হয় জ্বলে গেল। পেটও কেমন মেঘেদের মতো গর্জন করে উঠলো। কার্ণিশ বেয়ে তপ্ত জল গড়িয়ে পড়লো। আদিল নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো নাদিয়ার পাশ থেকে। অসুস্থ মেয়েটার সাথে এরকম একটা কাজ করেও তার মাঝে কোনো অনুশোচনা নেই। গ্লাস টি-টেবিলে রেখে, হনহন করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। চোখ বুজেই হাঁটার গতিতে বুঝতে পারলো নাদিয়া। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। হাহাকারে বুকটা কেমন খালি খালি লাগছে। তার কেউ নেই, কেউ না।
কিছুটা সময় যেতেই ফিরে এলো আদিল। নাদিয়া কে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো। সুপের বাটি টা হাতে তুলে দিয়ে, পাশেই পানির গ্লাস, ঔষধের পাতা রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
~ আদিল মাহমুদের থেকে কিছু আশা করো না নাদিয়া। তোমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। খাওয়া শেষ করে ঔষধ খেয়ে নিবে!
নিভু নিভু চোখে সুপ খেতে থাকলো নাদিয়া। আদিলের অর্ডার পালন করায় যেন মুখ্য। কথাটা বলেই ঘর ছেড়েছে আদিল। হুট করেই নাদিয়ার ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম এক হাসি দেখা গেল। গম্ভীর, একরোখা ছেলেটা আজ তাকে কতটা শান্তি দিলো সে কি জানে? একটু আগেও যেখানে মনে হচ্ছিলো তার পাশে কেউ নেই। সেখানে এখন মনে হচ্ছে তার আছে, তাকে ভালোবাসার মানুষ ও আছে। শুধু প্রকাশ করে না। নাহলে আদিল মাহমুদের কি দরকার ছিল তাকে এনে তার ফ্লাটেই রাখা? সেবা করা, হোক সেটা গম্ভীরতায় লুকিয়ে; তবে যে নাদিয়া বুঝেছে। ঔষধ খেয়ে অলস ভঙ্গিমায় শুয়ে পড়লো নাদিয়া। চোখ বুজে আসছে। ঘোরের মাঝেই বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগলো। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট শুনলো আদিল,
~ আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি ভাইয়া। যতটা ভালোবাসি আহিশ কে। কিন্তু তুমি আমাকে ভালোবাসলেও, আহিশ বাসে না ভাইয়া। ঘৃণা করে; খুব ঘৃণা করে। আমার ভালোবাসাটা ধুঁকে ধুঁকেই শেষ হয়ে গেল। একদম নিঃশেষ!
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। তেজী সূর্য টা হুট করেই নিভে গেছে। অন্তরীক্ষে ডানা মেলে উড়ছে কালো মেঘেরা। ছড়িয়ে দিচ্ছে অন্ধকার। যখন তখন আকাশ কেঁদে উঠতে পারে। ছড়িয়ে দিতে পারে মন খারাপের ছোঁয়া। ছোঁয়াচে মন খারাপ হয়তো অন্য কারোর মনেও দোলা দিবে। খুঁজে বেড়াবে এক মুঠো সুখ। সুখ খুঁজতে খুঁজতে কখন দুঃখের সাগরে ডুব দিবে, গগণ কাঁপিয়ে আকাশও সায় দিবে যেন। একপলক আকাশের অবস্থা দেখে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে লাগলো আহিশ। মুখে গম্ভীরতার সাথে একটুখানি ব্যাথার ছাপ। পায়ে ধুলোর আস্তরণ। পা টা একটু চিনচিনও করছে। অনেকটা পথ হেঁটেছে সে। খুঁজে বেড়িয়েছে প্রেমপিয়াসী কে। কিন্তু প্রেমপিয়াসী যে প্রখর অভিমানে নেতিয়ে পড়েছে, নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছে অন্ধকারে, হারিয়ে ফেলেছে নির্মম সত্যের কালকুঠিরে। এত খুঁজেও পেল না। নিরাশ হয়ে একটু আনন্দের আশায় এগিয়ে যাচ্ছে সে।
একতলা বাড়িটির গায়ে গোলাপি রঙের ছোঁয়া। চারপাশের দেয়াল নিরাট অবহেলায় দাঁড়িয়ে আছে। রঙ খসে গিয়েছে, বাচ্চাদের হাতের আঁকাবাঁকা দুষ্টুমি, বিভিন্ন পোষ্টার; বিশ্রী এক রূপ পেয়েছে দেয়াল। তবুও মাথা উঁচিয়ে বাড়িটিকে প্রটেক্ট করছে যেন। দেয়াল পেরিয়ে বুঝার উপায় নেই ভেতরে কারো স্বপ্ন গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশ ফুলে ভরপুর। আশে পাশের রাস্তা জুড়ে গাছের সারি দেখেই হয়তো বাড়ির মালিক গাছগাছালি লাগায় নি। তবুও কলকল করে বাতাস ঢুকে জানালার বুক ঘেঁষে ঝুলে থাকা পর্দা গুলোকে দুলিয়ে দিচ্ছে। অদ্ভুত নিরব, শান্ত বাড়িটি। গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেই চারপাশ নজর বুলালো আহিশ।
এই বাড়িটা তার হৃদয়ের সুপ্ত এক আবেগ। ধীরে ধীরে পা ফেলে এগোতে থাকলো আহিশ। দু হাত মেলে ফুল গুলো ছুঁয়ে দিলো। অনেক দিন পর চিরচেনা স্পর্শ পেয়ে ফুল গুলোও কেমন হেসে উঠলো, আবার যেন কারো অনুপস্থিতে নেতিয়ে পড়লো। আহিশের তো তাই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার হৃদয়ের অন্তরালের সুক্ষ্ম ব্যাথাটা বাড়িটিও টের পেয়েছে। বাগান পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। কয়েকটি ছবিফ্রেম ঝুলে আছে দেয়ালে। প্রায় সবগুলোই ফুলের ছবি। কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সে। তিন রুমের বাড়িটি, একপাশে রান্নাঘর, আরেকপাশে মস্ত বড় বারান্দা। কোনো দিক তাকালো না আহিশ, এলোমেলো পায়ে একটা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। চটপট ভীতি মুখে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। যেন অদৃশ্য কেউ তাকে নোংরা দেখে শাসাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের সাথে সাদা গেঞ্জি পড়ে চুল মুছতে মুছতে বের হলো। ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বলে উঠলো,
~ ইশ, আজকেও ভুল করে থ্রি কোয়া.. না না হাফপ্যান্ট নিয়েছি, বউ! তুমি রাগ করেছো না? পুরোনো অভ্যাস, এত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন করা সম্ভব?
আহিশের মনে হলো কেউ চোখ রাঙিয়ে তাকে বলছে,
~ এত তাড়াতাড়ি, আহি? চারটে বছর তোমার কম মনে হচ্ছে? আমি কিন্তু সবগুলো কুঁচি কুঁচি করে কাটবো। বেশ রাগাচ্ছো আমাকে।
শব্দ করে হাসলো আহিশ। দুষ্টুমির সুরে বললো,
~ রাগলে তোমাকে একদম সিগারেটের মতো জ্বলন্ত লাগে, বউ! মনে হয় এক টানে কাছে নিয়ে আসি! ধোঁয়া উড়াতে যেমন শান্তি লাগে, তোমাকে ছুঁলে তেমনই শান্তি লাগে।
জবাবে কোনো শব্দ না পেয়ে আহিশ সারা ঘরে চোখ বুলালো। কেউ নেই। উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজতে খুঁজতে বললো,
~ বেশী রেগেছো বউ? সিগারেট আমার প্রথম লাভ। তুমি যখন ছিলে না, সিগারেট আমার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিলো। এক্স ভেবে ফেলে দিই কি করে? কষ্ট পাবে তো। কথা বলো বউ, কোথায় গেলে? আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না মিহা। কথা বলো প্লিজ! আমি তোমা..
দরজায় ঠক ঠক শব্দ। আচমকায় থেমে গেল আহিশ। কপাল বেয়ে ঘামের ধারা বয়ছে। শরীর মৃদু কাঁপছে। চোখ বুজে পরপর কয়েকবার জোরে দম নিলো। নিজেকে ধাতস্থ করে গম্ভীর মুখে দরজার দিকে এগোলো। পুরোটাই তার কল্পনা! ভীতি মুখশ্রীতে দরজার অপাশে দাঁড়িয়ে আছে আসমানী। আহিশের চিৎকার কানে পৌঁছানো মাত্রই ছুটে এসেছে সে। রান্নাঘর থেকে একপলক দেখেছিল ঘরে ঢুকতে, রান্না ছেড়ে আসতে পারেনি তৎক্ষণাৎ। দরজা খোলা মাত্রই ঘরে ঢুকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো আহিশের দিকে। বিদ্রুপ করে বলে উঠলো,
~ তোমার আর মাতলামির শেষ নাই! একজন মদ খেয়েও মাতাল হয় না, আরেকজন মদ না খেয়েই মাতাল হয়ে ভুল ভাল দেখে। আজব মাইরি।
ভাষা’র শ্রী দেখে চোখ রাঙালো আহিশ। আসমানী আমলে নিলো না, নিজেকে সব দিক থেকে পরিবর্তন করা যায় না। শৈশব, কৈশরের একাংশ যে অধ্যায়ে কাটিয়েছে, তা কেবল কয়েকদিনের ব্যবধানে পাল্টানো যায় না। তবে সে যে চেষ্টা করে না তেমন না। যতটুকু করা দরকার করে, বাকি টা নিজের স্বাচ্ছন্দের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। আহিশ কিছু না বলে বিছানায় বসলো, নিজেকে একপলক দেখে বললো,
` তোর লজ্জা করছে না আমাকে এমন হাফপ্যান্টে দেখে?
~ কেন আমি কি তোমার গার্লফ্রেন্ড লাগি নাকি বন্ধু লাগি যে লজ্জা লাগবে? তোমার আমার সম্পর্ক মা-ছেলছ অথবা বাবা-মেয়ের মতো।
খোঁচা টা বুঝতে পেরেও জবাব কাটলো না। বরং সম্পূর্ণ নিজ ভাবনা থেকেই বললো,
~ মিহা’ও লজ্জা পেত না, তার নাকি রাগ লাগতো। হাঁটুর নিচে প্যান্ট পড়লেও তার নাকি উলঙ্গ লাগতো! ওদের ভাষায় কি যেন বলে। ওহ হ্যা মনে পড়েছে, ল্যাংটু!
স্বশব্দে হাসলো আহিশ। আসমানী বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ভেজা চোখের পল্লব কেঁপে কেঁপে উঠছে। নিয়ন্ত্রণ হীন হয়ে পড়ছে সে। ঝাঁপিয়ে পড়লো আহিশের বুকে। থমকালো আহিশ, আগলে নিলো না। কান্নার ধুঁকে পীঠ উঠানামা করছে, অঝোরে কাঁদছে মেয়েটা। কতদিনের আর্তনাদ যেন আজ তপ্ত জল হয়ে হাওয়ায় মিলে যাচ্ছে। কান্না থামলো বেশ কিছুক্ষণ পর। আসমানী আহিশের বুকেই লেপ্টে থেকে বললো,
~ তোমার অবশ্যই সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো উচিত। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছো তুমি। এভাবে চলতে থাকলে এসাইলাম ছাড়া তোমার গতি থাকবে না।
আহিশ মুচকি হাসলো। মেয়েটা তাকে পাগল ভাবছে। তাকে কোন দিক থেকে পাগল মনে হয়? সুস্থ, সবল, সুদর্শন এক যুবক। যার মস্তিষ্ক বড়ই চঞ্চল। শান্ত কন্ঠে বললো,
~ আমি কল্পনা সাজাই, কল্পনায় সংসার গড়ি। কারণ আমি চাইনা আমার প্রেমপিয়াসী নেই তা ভাবতে। আমার প্রেমপিয়াসী আমার সর্বত্রই মিশে থাকে। শিরা উপশিরায় যে লাল রক্ত প্রবাহিত হয় না? সেই রক্তও জানে মিহা নামক অধরা মেয়েটা এই আহিশের জীবনে কি। আমি ভাবতে চাই, মিহা আছে। আমি কথা বলি ওর সাথে, ঝগড়া করি কিন্তু অভিমানী বউ টা আমার ছুঁতে গেলেই মিলিয়ে। হারিয়ে যায়, অন্ধকারে মিশে যায়। আবার ফিরে আসে, এভাবেই সে আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফিরে আসবে। আমি যখন জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়বো, প্রেমপ্রিয়াসী তখনো আমার পাশে থাকবে। আমাকে চুপিচুপি ডেকে তার কাছে নিয়ে যাবে। আমরা আবার একসাথে থাকবো। এক সাথে!
আহিশের দৃষ্টি শূণ্যে। আসমানী বুক থেকে উঠে এসেছে। তার ধারণা ভুল ছিলো। মিছে পাগল সেজেছে সে বুঝতে পারেনি। এমনও ভালোবাসা হয়? তার জানা ছিলো না। প্রসঙ্গ টেনে বললো,
` তোমরা এখানে থাকতে?
~ হ্যাঁ! এই ঘরটা আমার আর মিহা’র ছিলো। পুরো বাড়িটায় মিহার স্পর্শ মিশে আছে। যত্ন নিয়ে সাজিয়েছিল। কেউ তো জানতো না বিয়ের কথা, সপ্তাহে দু দিন মিহা হোস্টেল থেকে এখানে চলে আসতো। ওই দু’দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম আমরা। প্রত্যেক টা সময় ছিল বাঁধিয়ে রাখার মতো। মেয়েটা এত অভিমানী ছিল, ছোট্ট ধমক সইতে পারতো না। চোখ টলমল করতো। আমি জানতাম! তারপরেও ভুল টা করেছি। কাজের চাপ এতটা ছিল, ধমকে ভুল ভাল বলে ফেলেছি। অভিমানী বউ টা আমার সেই যে গেল, আর এলো না!
ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো আহিশ। আসমানী দেখলো ঘরের পুরো দেয়াল জুড়ে মিহা’র ছবি। আহামরি সুন্দর ছিল না। না ছিল নজর কাড়া কাজল চোখ। কিন্তু কি একটা যেন আছে এই মেয়ের মধ্যে। আসমানী অনেক টা সময় নিয়ে ভেবে বের করলো। অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটার হাসি। আসমানী ঘোরেই বললো,
~ তোমাদের প্রেম শুরু হয়েছিল কি করে? তোমার আর তার হোস্টেল তো সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে।
~ অদ্ভুত এক সন্ধ্যায়, অদ্ভুত হাসির অধিকারী এক মেয়ের সাথে পরিচয়। ঘটা করে নয়, পথচারী হিসেবেই। তারপর অনেক দিন দেখা হয়নি। আবার এক সন্ধ্যায় দেখা হয়েছিল শপিং মলে। গম্ভীর মুখশ্রীর মেয়েটা হুটহাট মুচকি হাসতো। সেই দেখা থেকেই কৌতূহল, কথা বলা, নম্বর আদান প্রদান, বন্ধুত্ব, একসময় দুজন দুজনার নিঃশ্বাস হয়ে উঠা। সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার কি জানিস? মন বিনিময় হলো, কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে হলো, ছোট্ট সংসার হলো কিন্তু কেউ কারো বংশ পরিচয়, বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইনি।
চাইনি বাবার পরিচিতি, পরিবারের সাথে দেখা করতে। অদ্ভুত এক মায়াজালে দুজন বন্দি থেকে দুটো বছর কাটিয়েছি একসাথে। মাঝে মাঝে মনে হতো এই মেয়েটাকে আমি তার মতো ভালোবাসতে পারবো না, মেয়েটার ভালোবাসা ছিলো সুপ্ত এক আবেগে ঘেরা। হুটহাট শাসন, হুটহাট আদর, আবার হুটহাট আদেশ। যখন কিছু তার পছন্দ হতো, কিন্তু সে সময় আমার সামর্থ্য থাকতো না। কি বলতো শুনবি? “এই জিনিস টা আমার পছন্দ হয়েছে ঠিকই তবে এর চেয়ে ভালো আর দামী কিছু নেওয়ার লোভ ছাড়তে পারছি না। তাই ওমন কিপ্টামো বাদ দাও। বেশী বেশী টাকা জমিয়ে রাখো। যখন তখন ভাগ বসাবো!” কখনোই আমাকে বুঝতে দিতো না এই শহরের আমি মাত্র ১৫ হাজার টাকার ওয়েটারের চাকরি করছি। মহারাজা’র মতো সম্মান করতো। বিনিময়ে মেয়েটা কে আমি কিছুই দিতে পারিনি। হুটহাট একটা চকলেট, ত্রিশ টাকার ফুচকা, পঞ্চাশ কি একশো টাকার ফুল, বিশ টাকার লিপবাম! এই ভালোবাসা গুলো ছাড়া শুধু দুটো শাড়ি, চারটে থ্রিপিস, দু সেট জুয়েলারি! দু বছরের সংসারে আর কিছুই পায় নি মিহা। তবুও ভালোবেসেছে! যতনে আগলে রেখেছে।
দু বছর পূর্বে ফিরে গেছে আহিশ। চোখে মুখে কি উচ্ছাস! আহিশ আবার কাতর কন্ঠে বললো,
~ এই মেয়েটাকে ছেড়ে আমি কি করে অন্য কাউকে নিজের সাথে জড়াবো? নিঃস্বার্থ ভাবে যে মেয়েটি ভালোবেসেছে, পাশে থেকে; তার অনুপস্থিতিতে অন্য কেউ কি করে আসে? অন্য কেউ কি করে বুকে লুকায়? প্রেমপিয়াসীর স্থানে অন্য কেউ শব্দ টা ব্যবহার করতেও আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে, সাতরঙা! বাঁচার আশা খুঁজে পাই না!
অনেক দিন পর এই নামে ডাকলো আহিশ। ‘সাতরঙা’ ভীষণ সুন্দর নামটি আহিশ রেখেছে। আসমানী সেদিন অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরিয়েছিল। আজ মনটা ভালো হয়ে গেল। আহিশ কে নিজের কল্পনার জগতে একা রেখে সে গুটিসুটি পায়ে বাইরে চলে এলো। দরজার বাইরে পা রাখার সাথে আহিশের করুণ কন্ঠের ভালোবাসা টাও এড়িয়ে যেতে পারলো না। বিড়বিড় করে বলছে,
~ আমার মৃত্যু হোক, আমি পরপারে ঘর বাঁধবো তোমার সনে।
আসমানী ঢুকলো পাশের ঘরে। দরজা খোলা ছিলো। বিছানার উবু হয়ে বসে অনিক কিছু করছে। আসমানী নিঃশব্দে বিছানায় বসলো। কাজে গভীর মনোযোগী অনিক তার উপস্থিতি টের পেল না। একমনে কিছু আঁকছে। জেদ ধরেছিল রং তুলি কিনে দেওয়ার জন্য। নিজেই কিনে দিয়েছে। সারাদিন একটা ডায়েরী আর আর্ট নিয়ে বসে থাকে। কোনো দিন অনিকের ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলেনি আসমানী। আজ কৌতুহল বশতই এসেছে। হয়তো মন ভালো বলেই এমন হয়েছে। নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় কোনো রমনীর ছবি আঁকছে অনিক। ডান কানে শোভা পাচ্ছে লাল জবা। মেয়েটা মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে। পাশেই টানা অক্ষরে লিখা ‘বউ’! আসমানী ভীষণ চমকালো। পাগল ছেলের ভালোবাসা যে কাউকে চমকে দিবে। এত বছর পর, মানসিক ভারসাম্য হারিয়েও কেউ যে মন গহীনের মানুষ টাকে এত সতেজ ভাবে উপস্থাপন করতে পারে ভাবতেও মৃদু কাঁপলো আসমানী’র শরীর। কাঁপা হাতে কাগজ টি তুলে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখলো।
অনিক মিষ্টি হেসে তাকিয়ে আছে। হুট করেই আসমানী র মনে হলো ছবির মেয়েটিকে সে কোথাও দেখেছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছে না। অনেকটা সময় নিয়ে দেখলো আসমানী। একপলক অনিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
~ তোমার বউয়ের গাঁয়ের রং কেমন ছিলো? খুব ফর্সা?
~ না তো। আমার বউ সুন্দর কালো।
কথাটা বলেই দাঁত বের করে হাসলো অনিক। বাচ্চাদের মতো কন্ঠস্বর, তার মাঝেই অদ্ভুত টান। কালো আবার সুন্দর হয়? নাকি ছেলেটা অবুঝ থেকেই বুঝালো তার বউ কালো হলে কি হবে অনেক সুন্দর, তার মন মতো! এমনটাই বুঝালো হয়তো। ঘন ঘন পলক ঝাঁপটালো আসমানী। মনের ভেতর অজানা এক আনন্দ, কৌতুহল তাকে ক্রমশই উত্তেজিত করে তুলছিলো। যার ঝলকে মৃদু কাঁপছিল সে। অনিকের হাত খপ করে ধরে নিলো। কাঁপা আড়স্ট কন্ঠে শুধালো,
~ তোমার বউয়ের নাম অথৈ?
~ নাহ! আমার বউ এর নাম বউ!
উত্তেজনা টা অনিকের পাগলামি কথায় কমে এসেছে। হাসি পেল ভীষণ। হাসলো আসমানী। নিম্ন কন্ঠে বললো,
~ বউ দেখবে?
রাতের গভীরতা মাপা যাচ্ছে না। বর্ষার আগমনী ঝড় শহরের রূপ খানিক পাল্টে দিয়েছে, প্রকৃতি লন্ডভন্ড। গাছগাছালির ভাঙা অংশ এদিক ওদিক ছিটিয়ে আছে। পত্রপল্লবে শিশির বিন্দুর মতো জমে আছে বৃষ্টির পানি। প্রকৃতি নেতিয়ে পড়েনি বরং সতেজতায় চারদিক সৌন্দর্যের ঝিলিক ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঝড় যেভাবে এসেছিল দুম করে, সেভাবেই দুম করেই চলে গেছে। কিছুক্ষণের জন্য রাস্তার রূপ পরিবর্তন হলেও এখন আবার সেই লোকারণ্যে ভরপুর। ভাঙা গাছগাছালি কে উপেক্ষা করে গাড়িটি ছুটে চলছে তীব্র বেগে। তোয়াক্কা করছে না প্রকৃতির হিংস্রতা কে। চোখে মুখে লালাভ আভা। রক্তিম চোখের নিরস দৃষ্টি ঠিক সামনে, এদিক ওদিক হলেই যেন বড় একটা এক্সিডেন্ট ঘটে যাবে। সাবধানতা অবলম্বন করে ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে আদিল। আড়চোখে সামনের মিররে তাকিয়ে পেছনে মাথা কাত করে বসে থাকা নাদিয়া কে দেখছে। দেখে মনে হবে অত্যন্ত অবহেলায় অসুস্থ শরীর টাকে ফেলে রেখেছে আদিল, নির্দয় ছেলেটি নিজের বেশভূষা পাল্টায় নি। কিন্তু একটু খুঁতিয়ে দেখলেই বুঝা যাবে প্রকৃতির হিংস্রতার মুখে নিজে কে সামনে রেখে বোন কে আড়ালে রেখেছে সে।
আর কিছুটা সময়, হসপিটালের সামনে এসে বন্ধ গেইটের মধ্যেই গাড়ি চালিয়ে দিলো আদিল। টুলে বসে থাকা দারোয়ান ছিটকে সরে গেল, এই যাত্রায় হয়তো বেঁচে গেল। কিন্তু নিজেকে ধাতস্থ করে বিশ্রী ভাষায় গালি দিতে ভুললো না। জীবন তো আর হাতের মোয়া নয়! গাড়ি থামিয়ে বাইরে বের হতেই ভেতর থেকে দৌড়ে এলো সিকিউরিটি। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো হুকুম পাওয়ার আশায়। আদিল তেমন কিছুই করলো না, পেছনের দরজা খুলে নাদিয়া কে কোলে তুলে নিলো। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, সম্পূর্ণ অচেতন পড়ে আছে আদিলের কোলে। সারাটা দিন পাশেই বসে ছিল আদিল, নিজ হাতে জলপট্টি করে দিয়েছে, ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে, কিন্তু জ্বর ১০৪ থেকে ১০৩ এ আসে নি। অপেক্ষা করার স্বাদ আর জাগেনি। ঝড় কমে আসতেই রওনা হয়েছে। আদিল মাহমুদ কোনো মেয়ে কে কোলে করে নিয়ে আসছে, দেখে স্টাফ গুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মুখটা দৃশ্যমান হতেই অবাকতা একটু হলেও কমে আসে। রিসিপশনের মেয়েটিকে ডক্টরের কথা বলে আদিল সোজা উপরে চলে আসে। বেডে শুয়ে দিতেই হুড়মুড় করে কয়েকটা ডক্টর একসাথে ঢুকে পড়ে। বিরক্তি তে কপাল কুঁচকায় আদিল। রেষপূর্ণ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
~ একজন থেকে বাকি আউট হন, ফাস্ট।
টু শব্দ করে না কেউ। বড় বৃদ্ধা একজন ডক্টর এগিয়ে যায় নাদিয়ার দিকে। চেহারা দেখেই ডক্টরের মুখ খানিক কালো হয়ে আসে। আদিল কে বাইরে যাওয়ার কথা মুখ খুলে বলার সাহস হয় না। নার্স ডেকে চিকিৎসা শুরু করে। আদিল নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় টুলে বসে। এই মুহূর্তে বসে দেখা ছাড়াও তার একটা কাজ আছে, তবে সে কাজ টা করতে বড্ড ইগোতে লাগছে তার। আবার মন মানতেও চাইছে না। আজ প্রথম বারই এমন দোটানায় পড়তে হচ্ছে তাকে। উঠে দাঁড়ালো আদিল। করিডরে এসে পকেট থেকে ফোন বের করে ফোন লাগালো অচেনা পরিচিত নম্বরে। দুবার রিং হওয়ার পরই রিসিভ হয়, অপাশ থেকে গম্ভীর আশ্চর্য কন্ঠ ভেসে আসে,
~ আদিল মাহমুদ ছাপোষা এক মানুষ কে স্মরণ করেছে? কি সৌভাগ্য আমার!
আদিল ভ্রু কুঁচকায়। পাল্টা গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
~ আমার যাকে পছন্দ হয়, তাকে খুব বেশীদিন দূরে থাকতে দিই না, মি. আহিশ! আপনি স্বইচ্ছায় আসবেন, নাকি আমাকে ব্যবস্থা নিতে হবে?
অপর পাশ থেকে কিটকিট করে হেসে উঠে আহিশ। রসিকতা মিশিয়ে বলে উঠে,
~ আহা! আপনি আমাকে স্মরণ করেছেন, আর আমি দর্শন দিবো না; তা কখনো হতে পারে মি. আদিল মাহমুদ? দুর্ভাগ্য বশত আপনি আমার বড্ড প্রিয়!
~ আই সি! দেখা হোক, হসপিটাল চলে আসুন!
হসপিটালের কথাটা শুনে খানিক বিচলিত হলো। প্রশ্ন করলো না। টুট টুট শব্দে ফোন কেটে যেতেই আদিল নিরব হাসলো। দুর্ভাগ্য বশত হয়তো তারও আহিশ নামক ছেলেটি প্রিয় হয়ে উঠলো। ঘুরে হাঁটা ধরবে, সম্মুখে মেয়েলি ছায়া দেখে থেমে যায় আদিল। বুকের উঠানামা টা ধীরগতি থেকে দ্রুত হয়। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
~ রাজনন্দিনী!
আলোতে আসে মিরা। ঠোঁট এলিয়ে হাসে। হাসিটা ঠিক হজম হয় না আদিলের। বিধ্বংসী হাসি টা তার হৃদয় পুড়ায়। মুখে গম্ভীরতার ছাপ টেনে প্রশ্ন করে,
~ আপনি এখানে?
~ আপনাকে দেখতে আসলাম, ডাক্তার। একদম ভালো লাগছিল না। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো।
ঠোঁট বেঁকানো কথা শুনে হাসলো আদিল। দৃঢ় কন্ঠে বললো,
~ আপনি মিথ্যে গুছিয়ে বলতে পারলেও ফ্লাট টা ঠিক পারেন না। সেটি মিস আফরা’র কাছে শিখে নিবেন। বেশ পারে!
অপমান টা মুচকি হেসে হজম করলো মিরা। আফরা’র সম্পর্কে কিছু বললে তার সহ্য হয় না। কৌতুক মিশিয়ে বললো,
~ তৃতীয় ব্যক্তি ঢুকাচ্ছেন, ডাক্তার?
~ দ্বিতীয় বা এক বলতে আমাদের মাঝে কিছু আছে নাকি? লাইক প্রেমিক-প্রেমিকা!
~ আছে না? এই যে আপনার টানে ঝড় উপেক্ষা করে চলে এলাম। আপনারা পুরুষ মানুষ মন পাল্টাতে উস্তাদ!
ঠোঁট কামড়ে হাসলো আদিল। শুধালো,
~ তাহলে পুরুষ মানুষ কে ভালোবাসেন কেন, রাজনন্দিনী?
~ আমি দু’বছর আগের ডাক্তার কে ভালোবেসেছি, এই ব্যবসায়ী কে নয়। আপনাকে আমি চিনতে পারি না ডাক্তার! আমার ভালোবাসা আপনাকে ছুঁতে পারে না। ব্যর্থতা আমার না আপনার?
আদিল কিছুটা থমকালো। মিরা’র দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। হুট করেই আদিলের মুখ ভঙ্গিতে পরিবর্তন এলো। দু’পা এগিয়ে মিরা’র কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো,
~ কথাটা যদি আমি শুধায়? আমি তো বোকা মিরা কে ভালোবেসেছিলাম! ঠকিয়েছে আমাকে! তবে আপনি মেয়ে নিজের মৃত্যুকে কাছে টানছেন। ভালোবেসে সব ছেড়েছুড়ে দেওয়ার জন্য যে আদিল মাহমুদ জন্মায়নি। স্বার্থে ঘা লাগলে, আপনাকেও ঠিক ততটাই আহত হতে হবে রাজনন্দিনী!
দাঁড়ালো না আদিল। মাথা দুলিয়ে হাসতে হাসতে কেবিনের ভেতর ঢুকে পড়লো। মিরা কিছুক্ষণ বিমুঢ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বুকের ভেতর অসহনীয় এক উত্তাপ টের পেল। গুমোট হয়ে এলো মুখ। তখনি কারো হাতের স্পর্শে ঘোর কাটলো। তাকিয়ে দেখলো আফরা এসেছে। কিছু বললো না, মাথা দুলিয়ে হাঁটতে লাগলো। আফরা ভ্রু কুঁচকে পিছু নিলো। হঠাৎ কি হলো বুঝতে পারলো না। দু কেবিন ডিঙিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়লো তৃতীয় কেবিন টাই। আফীফ, জিয়াউল কিছু একটা আলোচনা করছিলো। দুজন কে দেখে থেমে যায়। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আবার আসা আফীফের ঠিক পছন্দ হয় না। গাঢ় কন্ঠে বললো,
~ খুব মিস করছিলেন মনে হলো, কয়েক ঘণ্টা না যেতেই হাজির!
~ হসপিটাল খুব সুন্দর, তারউপর এসি! গরমে আর গরম বাতাসে থাকতে ইচ্ছে করলো না। তাই বাহানা নিয়ে চলে এলাম!
ঠেস দিয়ে কথা বলেই জিয়াউলের পাশে দুরত্ব নিয়ে বসলো আফরা। মিরা টুল টেনে বসেছে। অনান ঘুমিয়ে পড়েছে, মূলত ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আফরা’র কথা এই মুহূর্তে সহ্য হচ্ছে না আফীফের। বিরক্তি কন্ঠে বললো,
~ আবার আসার কারণ? আপনাকে ঠিক সুবিধার লাগছে না মিস আফরা! তারউপর জোড়া কবুতরের সঙ্গীটাও এসেছে!
এমন বিকৃতি সহ্য হলো না মিরা’র। আফরা’র দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো,
~ নিজেকে পালোয়ান ভাবা বন্ধ করেন। এমনিতেও পার্সোনালি আপনাকে আমার পছন্দ নয়! আপনাকে দেখতে আসার কোনো মোটিভ ছিলো না, না ছিলো হসপিটাল আসার ইচ্ছে। পাগলের পাল্লায় পড়ে আমিও পাগল হয়েছি। যত্তসব।
কথাটা শেষ করেই হনহন করে বেরিয়ে গেল মিরা। আফরা কিঞ্চিৎ কুঁচকানো ভ্রু নিয়ে দরজায় তাকালো। হঠাৎ করে কি হলো বুঝলো না। আফরা’র বোধহয় তাড়া ছিল। ঝটপট নিম্ন স্বরে বলে উঠলো,
~ আপনার আর আমার লক্ষ্য একই মি. আফীফ! আপনার সন্দেহ হতে পারে, আই ডন্ট মাইন্ড। তবে আপনাকে ছোট্ট করে আপনার ঘরের খবর দিতে এসেছি।বিশ্বাস করা আপনার ব্যাপার!
থামলো আফরা। দুজন পুরুষের গম্ভীর মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
~ নুরুল আলম সিদ্দিকী’কে খবর দিন। আপনি যে সত্যের তালাশ করছেন, আপনার বাবার জানার বাইরে নয়।
সময় পেরিয়ে গেছে দু ঘন্টা! করিডরে মানুষের আনাগোনা। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে আফরা, মিরা। চলেই যেত, নাদিয়ার খবর শুনে থেকে গেছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে গেছে, এখন শুধু রিপোর্ট আসার অপেক্ষা!
কেবিনেই বসে ছিল আদিল। অপেক্ষা করছিল একটা ফোনের। সময় যেন যাচ্ছে না। যতটা সময় এগোচ্ছে অস্থিরতা বাড়ছে। উঠে দাঁড়ালো সে, বড় বড় পা ফেলে করিডরের শেষ মাথায় চলে গেল। আবছা-আলো অন্ধকারে হয়তো খেয়াল করেনি মেয়েলি অবয়ব। মিরা তীক্ষ্ণ চোখে আদিল কে দেখলো। অনুসরণ করলো না, তার শরীর অহেতুক রাগে কাঁপছে। কেন এমন টা হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। হয়তো চাইছে না। চাপা শ্বাস ফেলে শূণ্যে তাকালো মিরা।
কালো মেঘেরা দখল করে আছে পুরো দিগন্ত। তারকারাজি, বাঁকা চাঁদ কে লুকিয়ে রেখেছে আড়ালে। মিরা হঠাৎ করেই মেঘের মাঝে মেয়েলি মুখশ্রী আবিষ্কার করে ফেললো। মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে যেন বলছে,
~ রানী, এই রানী। ভুলে গেছিস আমাকে? মনে পড়ে না? তোকে আমি বাইরের দুনিয়া থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম রানী। কেন এলি? আমার সব পরিশ্রম কে এভাবে নষ্ট করলি? ওরা যে তোকে দেখছে রানী। ওরা তোকেও মেরে ফেলবে। তুই চলে যা রানী, আপাই’র কথা শুনবি না রানী? আপাই তোকে খুব ভালোবাসে রানী, চলে যা তুই। কিসের বদলা নিবি রানী, আমাকে ফিরে পাবি? আমি আর ফিরবো না রানী, ফিরবো না। জিইয়ে রাখ না তোদের মাঝে, তুই হারিয়ে গেলে আমি কার কাছে আসবো রানী? চলে যা বহুদূর। ওরা তোর নাগাল না পায়। চলে যা!
ঠিক আগে যেমন টা প্রত্যেক বাক্যে রানী নামটা নিতো, আজও আপাই তাকে সেভাবেই ডাকছে। কঠোর, রাগী মিরা টা নিমিষেই নিভে গেল। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকলো তপ্ত জল। যখন দেখলো মেয়েলি অবয়ব জলের ঝাপসায় হারিয়ে যাচ্ছে, উদ্ভ্রান্তের মতো বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
~ যাস না আপাই, যাস না। তোকে ছাড়া বড্ড কষ্ট হয় আপাই, কেন হারিয়ে গেলি। আমাকে একা করে দিলি আপাই। আমি আগের মিরা নেই আপাই, বোকা মিরা টা হারিয়ে গেছে তোর সাথেই। এখনের মিরা শুধু প্রতিশোধ নিতে পারে, তোর খুনীদের একটা কেও বাঁচিয়ে রাখবো না আপাই। ভয়ংকর মৃত্য দিবো, নিজ থেকে মৃত্যু কামনা করবে, এই মিরা কথা দিচ্ছে তোকে। তুই কি আমার উপর রেগে আছিস আপাই? বাবা কে মেরেছি বলে? কি করবো আপাই? সে যে তোর মৃত্যুর প্রথম দোষী, কি করে ক্ষমা করি? কষ্টের মৃত্যু দিই নি আপাই। তার বুলেট দিয়েই শুধু একবার ট্রিগারে চাপ দিয়েছিলাম। আমি বিধ্বংসী আপাই, আমাতেই সকল বিষ! শাসক, শোষক, কেউ ই এই বিষ থেকে রেহায় পাবে না। ফিরে আয় না আপাই, বহুদূরে চলে যাবো তোকে নিয়ে। এই শহর ছেড়ে…
কেউ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। বুকের মাঝে আগলে নিয়েছে। মিরা ফিরে আসে নিজের কল্পনার জগত থেকে। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আফরা কে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার। আফরা নরম হয়, বুকের উপর ভার টা দ্বিগুণ হয়। তবে চট করে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা টা প্রখর। মিরা’র কানে কানে ফিসফিস করে বলে উঠে,
~ আহিশ কে দেখলাম আদিলের কাছে যেতে! পিছু নিবি?
বুক থেকে মুখ উঠায় মিরা। কিছু না বলেই উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরে। আফরা বুঝে যায় মিরা’র মনোভাব। দৌড়ে গিয়ে হাত চেপে ধরে। ধীর গতিতে পা ফেলে লুকিয়ে পড়ে এক কোণায়। ওই যে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পুরুষালী দুটো অবয়ব। কান পেতে রয়, কথা শোনার অপেক্ষায়! স্বাভাবিক কন্ঠে আদিল বলছে,
~ নাদিয়া আপনাকে ভালোবাসে! এন্ড রাইট নাও, তার ভালোবাসায় আপনিও সাড়া দিবেন। আমাকে চেনেন তো?
হেসে হেসে হুমকি যাকে বলে। আহিশ একটুও ঘাবড়ালো না। বরং তার ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো। শান্ত স্বরে বললো,
~ আপনার বোন কে আমি ভালোবাসি না, তাই প্রশ্নই আসে না সাড়া দেওয়ার। আহিশ আর যাই করুক, ভালোবাসা নিয়ে খেলে না! ওটা আপনার স্বভাব!
~ আমার স্বভাব? ওয়েল! তা আপনার বউয়ের মন নিয়ে খেলে ছিলাম বুঝি?
ফিচেল হাসলো আদিল। মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো আহিশের হাত, শক্ত হয়ে এলো মুখশ্রী। চোখ দিয়ে যেন রক্ত ঝরবে। বেশীক্ষণ এই পরিবর্তন টিকতে দিলো না। রেগে গেলো তো হেরে গেলো। পাল্টা জবাব দিতে বললো,
~ ধরেন সেরকম টাই! শালী তো আধি ঘরওয়ালীই! না? তবে খুব তাড়াতাড়ি ঘরের মালিকানা পুরোটাই পেয়ে যাবে!
বিস্মিত হলো আদিল! শালী? অবাক কন্ঠে শুধালো,
~ শালী?
~ আদিল মাহমুদ জানে না? ইশশশ, মিস করে গেলেন। আচ্ছা, মিরা যখন শুনতে পারবে তার এক ভালোবাসা কে আরেক ভালোবাসা কবরে ঠেলে দিয়েছে! কেমন হবে ব্যাপারটা? ভালোবাসা থাকবে তো?
দু’পা পিছিয়ে গেল আদিল। চোখে মুখে গাঢ় বিস্ময়ের ছাপ, কিন্তু ভয় নেই। আহিশ তো ভয় দেখতে চেয়েছিল। আবার বললো,
~ একজন ধ*র্ষক কখনো জীবনসঙ্গী হতে পারে?
পিলে চমকে উঠলো আদিল। ধক করে উঠলো বুকের ভেতর। আজ পুরো বিষয়টা তার কাছে খোলাসা। চিরকুট সঙ্গীর হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া, আবার ফিরে আসা, রহস্যময় আচরণ; কারণ গুলোর উত্তর আজ তার সামনে। কিন্তু সে মানতে পারছে না, কেন? এমন পরিণতি তো সে ভাবে নি। কাঁপা কন্ঠে শুধালো,
~ মিহা,মিরা দু বোন?
শব্দ করে হেসে উঠলো আহিশ। হাসির ছলকে হাসপাতাল যেন কেঁপে উঠলো। থামলো না, অনেকটা সময় হেসে গেল। চোখের কোণ ঘেঁষে পানির ছিটা। হাসি থামিয়া গম্ভীর কন্ঠে বললো,
~ ফর ইউর ব্যাড লাক, আন্সার ইয়েস!
পাতানো চেয়ারে বসলো আদিল। মাথা নত করে চুল খামচে ধরলো। আহিশ থেমে নেই। আবার গম্ভীর কন্ঠে বললো,
~ ভালোবাসা হারালে কষ্ট হয়, কাছের মানুষদের কষ্ট অসহনীয়। আপনি বুঝবেন আদিল! কিছুটা বুঝতে পারছেন? পারছেন না? আমার এমনই কষ্ট হয়েছিল, যখন শুনলাম আমার বউটা আর নেই! হারিয়ে গেছে, কারো আক্রোশ, কারো হিংস্রতার কবলে পড়ে হারিয়ে গেছে। আমার কষ্ট হয় আদিল মাহমুদ! এখনো হয়, আমি যেমন বেঁচে আছি, ভালোবাসাহীন বেঁচে আছি। আপনিও বাঁচবেন! আপনাকে আমি বাঁচিয়ে রাখবো। আপনি দেখবেন, আপনার ভালোবাসা হাসছে তবে আপনার জন্য নয়। বুকে লাগবে আদিল মাহমুদ? লাগবে না? আপনার ভালোবাসা অন্য কারোর বুকে মুখ লুকাবে, সইবে আদিল মাহমুদ? আপনি ঠিক ততটাই দুঃখ পাবেন! কাতরাবেন, দিশেহারা হয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইবেন। কিন্তু সে যে অধরা!
হাসতে হাসতে হাঁটতে থাকে আহিশ। একপলক আড়ালে লুকিয়ে থাকা মিরা’র দিক তাকিয়ে চলে যায় এলোমেলো পা ফেলে। মিরা সেভাবেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আদিলের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়, এক পা এক পা করে এগিয়ে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে আলতো হাত রাখে আদিলের মাথায়। চমকানোর সীমা এতটা ছিল আর চমকায় না আদিল। শান্ত গাঢ় ভঙ্গিমায় মিরা’র চোখে চোখ রাখে। মিরা ছোট্ট করে ডেকে উঠে,
~ ডাক্তার!
কঠোর আদিলের সাথে এই আদিলের কোনো মিল পাওয়া যায় না। মিরা পাশে বসে, আদিলের বুকে মাথা রাখে। দুটো শরীর একদম অসাড়, কি করছে তারা যেন জানে না। মিরা কিছুক্ষণ চুপটি করে হৃদস্পন্দন শুনে। সরল কন্ঠে বলে উঠে,
~ আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম ডাক্তার! ছোট্ট সংসার, দুটো থেকে তিনটে মানুষ, হাসি, আনন্দ, সুখ, শান্তি! আমাদের পরিবার! বোকা মেয়েটা বড়লোকের ভালোবাসার পরিণতি জেনেও আপনাকে মন দিয়েছিল ডাক্তার। কিন্তু বোকা মেয়েটা কি জানতো, আপনার প্রেম বিষাক্ত! আদিল মাহমুদ ভালোবাসতে জানে না। ঠিক বাবা’র মতো নারী দেহে সুখ খুঁজে? জানতো না, ডাক্তার। জীবনের প্রথম ভুল কি ছিলো জানেন? বাবার ঔরসে জন্ম নেওয়া। জীবনের দ্বিতীয় ভুল আপনাকে ভালোবাসা। এটাই শেষ ভুল, এরপর আর ভুল হবে না। যা হবে সব ঠিক হবে!
তোতা পাখির মতো বুলি গুলো আওড়িয়ে চুপ করে রইলো। আদিলের মুখে কোনো রা নেই। মিরা কিছুক্ষণ পর আবার বললো,
~ আমার আপাই খুব সহজ সরল ছিল ডাক্তার। বাবা যে আপনাদের গোলাম ছিল ঠিক জানতো, জানতে দেয় নি আমাকে। সেই অদূর বরিশালের মাটিতে একা একা মানুষ হয়েছি আমি। আপাই তার রানী কে সেইভ রেখেছিল। কিন্তু ভালোবেসে ঠকে গেল। এতদিন জানতাম অনল মাহমুদ, আদিল মাহমুদের সাথে আহিশও ছিল; কিন্তু আজ জানলাম ছেলেটা ভালোবাসা হারিয়ে কাতর। ভালোবাসা শুধু কষ্ট দেয় ডাক্তার। এইযে আপনি পাচ্ছেন, আমি পাচ্ছি, আপনার বোন পাচ্ছে। ভালোবাসা ভালো না ডাক্তার। বড়লোকের ভালোবাসা তো পাপ! তারা পেছন থেকে আঘাত করতে ভালোবাসে, পেছন থেকে ছুরি ঢুকাতে ভালোবাসে! ঠিক এভাবে!
শব্দ দুটোর ব্যবহার শেষ হতেই আদিলের বুকে ছু* রি বসিয়ে দেয় মিরা। শক্ত করে ধরে রাখে আদিলকে, বুকে এখনো মাথা এলানো। আদিল কিঞ্চিৎ কেঁপে চুপ করে যায়। পর পর তিনবার ঘা বসিয়ে, বুক থেকে মুখ তুলে মিরা। ঠোঁটের ভাজে কৃত্রিম হাসি। মাথা নত বুকের বাম পাশে শব্দ করে চুমু খায়। হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
~ এতটুকুতে মরবেন না ডাক্তার, তবে আপনার কষ্ট হবে। ভালোবাসা’র মানুষ থেকে পাওয়া আঘাত আপনার কাছে মৃত্যুসম হয়ে ধরা দিবে। আপনার চোখে আমি এক আকাশ পরিমাণ আফসোস দেখতে পাচ্ছি! এতকিছুর পরেও আপনাকে ভালোবাসি ডাক্তার!
ছু* রি থেকে লাল রক্ত টপটপ করে ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে। ঘুরে হাঁটা ধরে এলো মেলো পা ফেলে। উড়নার একাংশ মাটিতে গড়াগড়ি খায়। আদিল চোখ মেলে দেখে। হাঁটার ভাঁজে বিষাদের পাহাড় দেখতে পায় আদিল। মুচকি হাসে, বিড় বিড় করে বলে উঠে,
~ নারী’র ভালোবাসা ভয়ংকর! বিধ্বংসী নারীর প্রেম ছু*রি’র আঁচড়ে আদিল মাহমুদ কে নিঃশেষ করতে পেরেছে। আপনি সফল রাজনন্দিনী!
চোখ বুজে আসতে চায় আদিলের। জোর করে খুলে রাখে। মিরা তখন এক কেবিন ডিঙিয়ে গিয়েছে। এত দুরত্ব সহ্য হয় না আদিলের। ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে চেয়ারের হাতল চেপে উঠে দাঁড়ায়। হাত গলিয়ে দেয় কোমরে। প্যান্টের ভাঁজে রাখা ‘বেরেটা টমক্যাট’। ছোট একটা অস্ত্র। অথচ ক্ষমতা বিশাল। বেশী দূর গু*লি না করা গেলেও খুব দ্রুত কাজে দেয়। হাতে ধরতে বেশ সুবিধা। আদিলের পছন্দের রিভল* বার! হাতে তুলে নিয়ে ঢুলে পড়ার আগেই মিরা কে তাক করে বুলেট ছুড়ে আদিল। শব্দ হয়, হাসপাতালের প্রতিটা ইট যেন কেঁপে উঠে। পীঠ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। মিরা অবিশ্বাস্য চোখ নিয়ে পেছনে ঘুরে। আদিলের ঠোঁটের ভাজে দুর্বোধ্য হাসি। অস্পষ্ট সুরে বলে উঠে,
~ বিপরীতমুখী দুজন মানুষ, তবুও কাছাকাছি! আমি একা হাসপাতালে পড়ে থাকবো, আপনি আলো বাতাস মেখে ঘুরে বেড়াবেন তা কি করে হয় রাজনন্দিনী? বলেছিলাম না, আহত আপনাকেও হতে হবে! আদিল মাহমুদ যে বড্ড হারামি!
মিরা’র কাছে কথাগুলো পৌঁছাতে পারে কিনা বুঝা যায় না। আদিল এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে। মিরা’র মুখোমুখি দাঁড়ায়। অন্ধকার নেমে আসে, দিক বুঝে মিরা’র মুখশ্রী টা হাতের আজলে তুলে নিয়ে কপালে শব্দ করে চুমু খায়। নিভু নিভু চোখে প্রতিক্রিয়া করতে পারে না মিরা। ঢুলে পড়ে আদিলের বুকে। ঠিক যেখান টাই আঘাতে জর্জরিত করেছে, সেখানেই স্থান হয় মিরা’র। আদিল ফিসফিস করে বলে উঠলো,
~ আঘাতের বিনিময়ে আঘাত, ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা! হিসেব বরাবর করতে আদিল মাহমুদ বড়ই পাকা! এতকিছুর পরেও আপনাকে ভালোবাসি, রাজনন্দিনী!
গু* লির শব্দ হসপিটাল ছড়িয়ে গেলেও সিকিউরিটির কড়া হুমকি তে কেউ ই ছুটোছুটি করতে পারছে না। পারছে না হইচই করতে, যার যার কেবিনে বসেই ভয়ে ছটফট করছে। ইচ্ছে করেই বের হয়নি আফীফ। আদিল মাহমুদ এসেছে শুনে তার বুঝতে অসুবিধা হয়নি শব্দের উৎসের কারণ! অবহেলায় ফেলে, শুয়ে আছে সে। কিন্তু দরজায় একেরপর এক করাঘাত, শুয়া থেকে উঠে বসতে বাধ্য হলো। খানিক কৌতুহল নিয়ে দরজা খুলতেই দরজায় সিটে থাকা আফরা ঢুলে পড়লো আফীফের বুকে। আগলে নিলো আফীফ। ক্ষত স্থানে ব্যাথা পেলেও কৌতুহলের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো সেটা। আফরা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আফীফের হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসলো। কন্ঠনালী তার রোধ হয়ে গেছে, আওয়াজ বের করতে পারছে না।
মিরা’র খামখেয়ালি পনা স্টেপ তাকে তাজ্জব করে দিয়েছে। আফীফ অবাক হয়ে আফরা’র সাথে ছুটছে, প্রশ্ন করে যাচ্ছে কিন্তু উত্তর মিলছে না। করিডরের শেষ মাথায় এসে থেমে গেল আফরা। আঙুল উঁচিয়ে সামনে দেখাতেই কপালে ভাঁজ পড়লো আফীফের। দেয়ালে হেলান দিয়ে মিরা কে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আদিল; তেমন কিছু না পেলেও এগিয়ে গেল আফীফ। দুজনের চোখের পাতায় বন্ধ। মিরা’র পীঠ বেয়ে রক্তের ধারা নজর এড়ায় নি। চুপচাপ নিচে নেমে গেল সে, প্রতীক্ষমান আফরা আর এগোনোর সাহস পেল না। দোটানায় পড়ে সে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হিসেব মেলাতে পারছে না সে।
বিপরীত গোছের দুটো মানুষ, কি করে এক হবে? সম্ভব? আফরা’র খুব কান্না পাচ্ছে, শক্ত আফরা নিজের দিক ভুলে যাচ্ছে, মিরা’র ক্ষত আফরা কে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। বুকের হাহাকারে আফরা টের পাচ্ছে আরো একটা প্রাণের মৃত্যু। বেঁচে থেকেও মৃতের মতো জীবন! ভেতর থেকে কান্না রা দলা পাকিয়ে এসে ভিজিয়ে দেয় গাল। ঝাপসা চোখে আফীফ কে দৌড়ে আসতে দেখে, ধরাধরি করে দুটো নিথর দেহকে নিয়ে কেবিনে ঢুকে পড়ে কিছু লোক। আফরা টের পায় কেউ তাকে হাত ধরে টেনে তুলছে। নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে হাঁটছে। গভীর স্পর্শ নয়, নিরাট এক আগলে রাখার অধিকার বোধ। নিজেকে আচমকাই স্বাভাবিক করে নেয় আফরা। দাঁড়িয়ে যায়, আফীফ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আফরা স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠে,
~ মিরা কোথায়?
~ অপারেশন হচ্ছে!
~ আমি আসছি! থ্যাংকস ফর ইউর হেল্প!
আফরা দাঁড়ায় না এক মুহুর্ত। বড় বড় পা ফেলে অপারেশন থিয়েটারের সামনে এসে দাঁড়ায়। লাল বাতি জ্বলে আছে, আফরা তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ছোট্ট ঘটনা টা কত বড় রূপ নিলো। পরিণতি যে খুব খারাপ হবে!
নিজের কেবিনে ঢুকে দুটো মানুষের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আফীফ কে। কিন্তু সে যেন জবাব দেওয়ার মাঝে নেই। চুপচাপ শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে। ভেতর টা আজ এলোমেলো। জিয়াউল এগিয়ে এসে অস্থির কন্ঠে বলে উঠে,
~ স্যার, ঠিক আছেন আপনি? স্যার শুনতে পাচ্ছেন? ডক্টর ডাকবো? অসুস্থ লাগছে? স্যার?
আফীফ চোখ খুলে। জিয়াউল চুপ হয়ে যায়। এই মানুষটির চোখের ভাষা সে মাঝে মাঝে বুঝে যায়। অনান এগিয়ে আসতে চাইলেও হাত ধরে আটকে দেয় জিয়াউল। দুজনের মাঝে ঝগড়া এখন খুব একটা হয় না। আফীফ কিছুক্ষণ ভেবে ফোন তুলে নেয় হাতে। রিসিভ হয়, অপাশ থেকে কোনো শব্দ আসে না। আফীফ কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে,
~ আম্মা, ওই সর্বনাশী কে বলে দিও আমার কংক্রিটের বুকটা কে মিথ্যে প্রমাণ করার অপরাধে তার বুকটা কে আমি ঝাঁঝরা করে দিবো।
কেটে দেয় ফোন! জিয়াউলের চোখে চোখ রাখতে পারে না। হনহন করে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। জিয়াউল হা হয়ে তাকিয়ে থাকে বন্ধ দরজার দিকে! হয়তো তার মাথায় এখনো ঢুকেনি!
অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে থানাটাকে। ছোট্ট একটা রুমে এখনো আলো জ্বলছে। ব্যস্ত হাতে রিপোর্ট তৈরি করছে নোমান। উপর থেকে অনেকবার ফোন এসেছে। আতিকুরের মৃত্য, আশরাফ উদ্দিনের মৃত্যু, আরাফের পালিয়ে যাওয়া; কিছুর সমাধান সে বের করতে পারেনি। মূলত সে চায়ই নি বের করতে। লোক দেখানো ঘুরা ঘুরি করে গেছে। আজ মনে হলো একটা রিপোর্ট তৈরি করা দরকার। উপরতলার বড় বড় কথা শুনতে নারাজ সে। রিপোর্টের ভাষ্যমতে,
“মিসেস আতিকুরের উপর আরাফের খারাপ নজর ছিলো। মানতে পারেনি আতিকুর। ঝামেলা হয় দুই ভাইয়ের। আরাফ রেগে নিজ সহোদর ভাইকে খু* ন করে। ধরা পড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বাবার হুমকিতে দেখা করতে আসে। আশরাফ উদ্দিন বড় ছেলের হ* ত্যার জন্য দোষারোপ করতে লাগলে রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বাবাকে গুলিবিদ্ধ করে হ* ত্যা করে আরাফ। পলাতক আরাফের খোঁজ করা হচ্ছে, খুঁজে বের করলেই দন্ড কার্যকর হবে।”
দু’বার রিপোর্ট টি পড়লো নোমান। একদম সুক্ষ্ম হয়েছে কিনা তাই দেখছে। যদিও উপরতলা সেভাবে না দেখেই সাইন করে কেস ক্লোজ করে দিবে তবুও বোকামি করতে চায় না সে। বোকামির ফলে হয়তো সেই ধরা পড়ে যাবে। প্রকাশ্যে চলে আসবে ঠিক তার ইচ্ছেতেই আরাফ পালাতে পেরেছে। চাকরী নিয়ে টানাটানি হবে। যা সে মুটেও চাইছে না। ফিনিশিং টাচ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় নোমান। অনেকটা রাত হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরতে হবে। দরজা ছেড়ে বের হতে যাবে ফোনের টুং টুং শব্দে থেমে যায় সে। বিরক্তি তে ‘চ’ শব্দ করে চেয়ারে বসে। ক্লান্ত শরীরে ঝিমুনি ধরে, অলস ভঙ্গিতে ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই অপাশ থেকে কৌতুক মিশ্রিত কন্ঠ ভেসে আসে,
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৪১+৪২+৪৩
~ শালাবাবু!
চমকিত দৃষ্টিতে ফোন দেখে নোমান। অচেনা নম্বর, কিন্তু কন্ঠ তার চেনা। অপাশ থেকে আবার বলে,
~ চুপ কেন শালাবাবু? আমি জানি তুমি চিনেছো আমাকে?
নোমান অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
~ আহিশ!