হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫৭+৫৮

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫৭+৫৮
Tahrim Muntahana

নিস্তব্ধতা একটুখানিও কমেনি। ভিড় নেই, হ‌ইহুল্লা নেই, চেঁচামেচি নেই শুধু প্রগাঢ় এক নিশ্চুপতা। একটি ঘরে তিনটে মানুষ; একজন মৃত , দুজন অনুভূতি হীন! দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে আদিল, পাশে হাত পা গুটিয়ে বসে মিরা। সময় ছুটে চলছে নিজ গতিতে। থামার অবকাশ নেই। ছুটতে ছুটতে পৌঁছে গেছে সন্ধ্যা ছয়টার কাঁটায়। খানিক নড়লো আদিল। পকেট থেকে ফোন বের করে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ভাবলো। পরিচিত এক নম্বরে ফোন দিলো। বার কয়েক রিং হয়ে কেটে গেল, উত্তর এলো না। থেমে নেই আদিল, ধৈর্য আজ তার সহায়। সংখ্যা যখন এগারো তে ঠেকলো ফোন উঠালো। অপর পাশের ব্যক্তিও নিশ্চুপ। আদিল বললো,

~ নাদিয়া আর নেই!
আদিল আশা করেছিল মৃদু চিৎকার ভেসে আসবে। সেরকম কিছুই হলো না। বরং শান্ত, ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
~ মাটি চাপা দিয়ে দাও। টু শব্দ যেন না হয়।
চোখ বুজে নিলো আদিল। অস্পষ্ট অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,
~ আব্বু!
অপরপাশে নিস্তব্ধতা। অনল মাহমুদ কাঁপা স্বরে বললেন,
~ মাথা খাটাও আদিল। আমি তোমাকে চিনতে পারছি না! এই আদিল কে আমি তৈরি করিনি। চুপচাপ মাটি চাপা দাও! জানাজানি হলে ফল খুব খারাপ হবে।
উঠে দাঁড়ালো আদিল। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
~ আপনার মেয়ে আব্বু, আমার বোন!
রেগে গেলেন অনল মাহমুদ,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

~ কিসের মেয়ে, কিসের বোন। কেউ হয় না আমাদের। ওই মেয়েটা কেউ হয় না আমার। শুধু মাত্র আশ্রিতা ছিল। শুনতে পাচ্ছো তুমি? ও মরলো কি বাঁচলো আমার কিছুই যায় আসে না। যা বলছি তাই করো। অনেক ভুল করে ফেলেছো। শুধু মাত্র তোমার জন্য আমার সাম্রাজ্যে বিরোধী দল ঢুকার সুযোগ পেয়েছে। তোমার বোকামির জন্য আমার সাম্রাজ্য এখন হারানোর পথে। এমনিই অনেক টেনশনে আছি আদিল। এসব আমার কাছে মেটার করে না। তুমি ভুলে গেছো তোমার কথা। ওয়াদা করেছিলে আমাকে, ভুলে গেছ? তোমার জন্য এতকিছু আদিল, তাহলে? আমার কি ভুল ছিলো? আমার কি অপরাধ?
উত্তেজিত হয়ে ফোন কেটে দিলো আদিল‌। অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে তাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে লাশের দিকে তাকায় আদিল। মেয়েটা তার কেউ হয় না? কেউ না? এতদিন ভুল জেনে এসেছে? আবার ভাবে, তাইতো বাবার কি দোষ? সবটাই তো তার জন্য? সে কেন এতকিছু করেছে? ওয়াদা কি করে ভাঙলো? ভাবনার সমাপ্তি হতেই এক অন্যরকম আদিলের খোঁজ পায় মিরা। গম্ভীর মুখশ্রী, গত দিনগুলোর থেকে ওই মুখে কঠোরতা একটু নয় ঢের বেশী।‌ মিরা বিচলিত হলো, ঘন ঘন পলক ফেললো। আদিল বের হয়ে গেল ঘর থেকে। খানিক পর তিনটে গার্ড নিয়ে এলো‌। স্ট্রেচারে করে তারা নাদিয়া কে নিয়ে বেরিয়ে গেল। মিরা শব্দহীন শুধু দেখে গেল। একপলক ও মিরার দিকে তাকালো না আদিল। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া ধরতেই ছুটে এলো মিরা। ডেকে উঠলো,

~ ডাক্তার!
কঠোর ভঙ্গিমায় ঘাড় ঘুরাতেই ছুটে চলা পা থেমে গেল মিরার। কেঁপে উঠলো সর্বাঙ্গ। ভয়ংকর চোখে তাকানোর সাহস তার হচ্ছে না। এগিয়ে এলো আদিল। বাম হাত গলিয়ে দিলো মিরার কোমরে। দুটো দেহ অতি নিকটে, ডান হাত চেপে ধরলো মিরা’র চুল। ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে ততক্ষণাৎ স্বাভাবিক করে নিলো মিরা। দুটো কপাল মিলিত করে আদিল নিশ্চুপ র‌ইলো কিয়ৎ মুহূর্ত। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে দ্রুত গতিতে। অদ্ভুত গম্ভীরতায় আদিল বলে উঠলো,
~”লেপ্টে আছে দুটো দেহ
হৃদয়ে এক সুর
তবুও বাহির যেন
দূর থেকে বহুদূর।”
শান্ত দৃঢ় দৃষ্টি। আদিল থামলো। চোখ চোখ রেখে আবার বললো,
~ নারী ছলনাময়ী! এক নারী আমার আব্বুর জীবন কে ধ্বংসস্তূপে ছুড়ে ফেলেছে। আরেক নারী আমার জীবন কে ধ্বংসস্তূপ থেকে বাহির করতে চেয়েছে‌। কিন্তু নারী তুমি জানো না, দুইয়ের মাঝেই লুকিয়ে আছে ধ্বংস! আমি ধ্বংস! আমি ধ্বংস! আমি ধ্বংস!

ছেড়ে দিলো আদিল। দেয়াল ধরে নিজেকে পড়ে যাওয়া দেখে বাঁচালো মিরা। ফের বাঁধ ভেঙেছে, জলের ধারা অবিরাম বয়ে চলছে। আদিল তাকালো না। রক্তিম নয়ন যুগল কে লুকাতে চশমা পড়ে নিলো। মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে শাহাদাৎ আঙুল মেলে ধরলো মিরার উপর‌। ঘন ঘন আঙুল নাচিয়ে বেরিয়ে গেল আদিল‌। রেখ গেল সদ্য হেরে যাওয়া এক পিপাসিত আত্মা কে! যে আত্মা চেয়েছিল প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় জীবন টা নান্দনীয় করতে। কিন্তু নিষ্ঠুর যুবক তাকে আবারো হারিয়ে দিয়ে কাটার পাহাড় ছুড়ে মেরেছে। হৃদয় রক্তাক্ত হয়েছে, চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত! ক্ষতবিক্ষত বুকটা শরীর কে নেতিয়ে দিয়েছে। আদিলের বলা ‘আমি ধ্বংস’ শব্দ দুটো কানে বাজছে বার বার‌।

কর্ণকুহরের রহস্যময় ছিদ্র পথ আহত হচ্ছে, মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। কান চেপে ধরলো মিরা, চিৎকার করে উঠলো বিকট শব্দে। সে চিৎকারের সারাংশ টা ইঙ্গিত করছিলো নতুন কিছু সৃষ্টির! যুদ্ধ কি থেমে যাবে? নাকি মর্মান্তিক রূপ নিয়ে ধ্বংসলীলায় শেষ করে দিবে সকল সৃষ্টি?
কিয়ৎ মুহূর্ত যেতেই উন্মাদের মতো বেরিয়ে গেল মিরা। বাড়িটা পড়ে র‌ইলো একা, ভূতুড়ে বাড়ির ন্যায় অন্ধকার। রাতের পূর্ণিমা তাকে আলোকিত করতে পারলো না। সব আলো যেন শুষে নিলো দন্ডায়মান ছায়া প্রদান কারী বৃক্ষ গুলো। মিরা দৌড়াতে র‌ইলো, থেমে নেই। ছুটে চলা গাড়ি, অসংখ্য দোকান, কর্মে ব্যস্ত মানুষ জন কে পিছু ফেলে সে দৌড়াতেই র‌ইলো। থামলো বটবৃক্ষের নিচে। জায়গাটায় অদ্ভুত নিরবতা। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার চিঁচিঁ শব্দ ভেসে আসছে‌। উন্মাদের ন্যায় মাথা ঘুরিয়ে, শরীর নাচিয়ে এদিক ওদিক দেখলো মিরা। কেউ নেই, আসার কথা ছিল জিয়াউলের! হাতে ঘড়ি নেই, ফোন ভুলে রেখে এসেছে। নিজের উপর বিরক্ত মিরা, অপেক্ষা করলো আরো কিছু মুহূর্ত। নাহ আসার খবর নেই! রাত গভীর হচ্ছে, আর দাঁড়ানো সম্ভব নয়। আবার দৌড়ানো শুরু করলো মিরা, কিছুটা পথ পেরোলেই থানা। ঢুকে‌ পড়লো, হাবিলদার তাকে আটকানোর সুযোগ না পেয়ে সেও পিছু ছুটলো। থামলো নোমানের কেবিনে এসে। মিরা’র অপেক্ষায় করছিল নোমান। দেখা মাত্রই উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলো,

~ কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কতবার ফোন করেছি?
মিরা হাঁপাচ্ছে। পটলা মাছের মতো উঠানামা করছে বুক। কোনো রকম বসে হা করে নিঃশ্বাস নিলো মিরা, গ্লাসে রাখা পানিটা এক চুমুকে শেষ করে চুপ র‌ইলো কিছুক্ষণ। হাবিলদার নোমানের ইশারায় ফিরে গিয়েছে। মিরা ভূমিকাহীন বলে উঠে,
~ সময় নেই, কোথায় স‌ই করতে হবে?
নোমান কিছু বলে না, তাকিয়ে থাকে। অধৈর্য হয়ে মিরা চেঁচিয়ে উঠে,
~ বলো, কোথায় স‌ই করতে হবে! আমার তাড়া আছে, জলদি করো!
নোমান একটি কাগজ এগিয়ে দিলো, ঝটপট স‌ই করেই উঠে দাঁড়ালো মিরা। দরজার কাছে গিয়ে থেমে পেছন ফিরে প্রশ্ন করলো,

~ জিয়াউলের সাথে কথা হয়েছে?
নোমান মাথা নাড়ায়। না হয়নি, নিজ আসন থেকে উঠে মিরা কে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলে উঠে,
~ ফোন বন্ধ উনার! ‌
চমকে উঠলো মিরা। দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ বন্ধ মানে? যোগাযোগ হয়নি? কথা ছিল সন্ধ্যা ছয়টার বট গাছের নিচে থাকবে। এখন সাতটা বাজে ভাইয়া। মানে বিপদে পড়েছেন জিয়াউল, জলদি স্ট্রেস করো উনার নাম্বার।
নোমান বোনের উত্তেজনা দেখেও শান্ত। টুপিটা পড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, শান্ত মলিন কন্ঠে বলে,
~ চলো, নাদিয়া কে কবর দিয়ে আসি‌।

মিরা প্রশ্ন করার আগেই নোমান হাত ধরে বেরিয়ে যায় থানা থেকে। নোমানের এই শান্তশিষ্ট রূপ মিরা কে ভাবনায় ফেলে। জিয়াউলের ব্যাপারটা শান্ত ভাবে এড়িয়ে যাওয়াটাও এড়ায় নি তার। কি চলছে আবার? পুলিশ জিপ থামতেই মিরা বিস্মিত দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকায়। নোমান নেমে পড়ে, এগিয়ে যায়। আনমনে মিরাও হাঁটতে থাকে। ওইযে কবর টা দেখা যাচ্ছে। অনেক দিন যত্ন নেওয়া হয়না। মাটি সরে গেছে বৃষ্টির পানিতে। মিরা দেখছে পাশেই আরেকটা নতুন কবর, আজকেই খুড়েছে মনে হয়। ভ্রু কুঁচকে আসে তার, পা চালিয়ে এগিয়ে যায়। ঝোঁপঝাড় গুলো পেরোতেই চোখে পড়ে কয়েকজন মানুষ কে। সাদা পাঞ্জাবি, টুপি পড়ুয়া লোক গুলো দাঁড়িয়ে আছে খাটিয়ার সামনে। খুঁজে খুঁজে সে পরিচিত এক মুখ পেল। সব ভুলে মিরা অপলক তাকিয়ে র‌ইলো মানুষটির দিকে। কি পবিত্র মুখশ্রী! নেই কোনো কঠোরতা, খানিক মলিনতা ছেঁয়ে আছে। জানাযা শেষ করে খাটিয়া নিয়ে লোকগুলো নতুন কবরের পাশে দাঁড়ালো। বোন কে কোলে তুলে নিয়ে মাটিতে শুয়িয়ে দিলো আদিল। কিছুক্ষণ পলকহীন সাদা কাপড়ে মুড়ানো মুখটার দিকে তাকিয়ে দু মুঠো মাটি ছড়িয়ে দিলো। চোখ কি ভিজে এসেছে নাকি? দ্রুত পায়ে সরে গেল কেন? গাছের নিচে একা দাঁড়িয়ে র‌ইলো আদিল, এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল মিরা। মেয়েদের জানাযায় থাকতে নেই ভুলে গেছে সে। সম্মুখে দাঁড়ালো। আদিল মাথা তুললো না। জবাব দেওয়ার মতো করে বললো,

~ বোন বলেছিল কবর টা মিহার পাশে দিতে! মিহার কবর জিয়ারত করতে এসেও যেন আহিশ একপলক তার কবর টাও দেখে যায়!
মিরা’র কান্না পেল খুব। কেউ এতটা ভালোবাসে কিভাবে? এইযে এই মানুষ টাকে সে ভালোবাসে, স্বার্থ নেই। পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই, না পাওয়ার বেদনা নেই। কিছুটা ভয় আছে হারানোর! অতলে হারিয়ে গেলে যে মুখ দর্শন করতে পারবে না। সে বাঁচবে কি করে? আরেকটু এগিয়ে এসে কাতর স্বরে মিরা বললো,
~ ভালোবাসা এতটা অসহায় কেন, ডাক্তার?
আদিল মাথা তুলে তাকালো। চোখে চোখ পড়লো, দুটো রক্তিম চোখের মিলন হলো। আদিলের কাছে উত্তর নেই, নেই জবাব। মিরা মলিন হেসে অদূরে ইশারা করে বললো,

~ ওই যে দেখছেন, দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা ভালোবাসে, এতটা ভালোবাসে দুটো বছর আপন‌ প্রাণের মতো আগলে রেখেছে। সে জানে যে মেয়েটির জন্য রাতের ঘুম ভুলে গেছে, মেয়েটিকে সে পাবে না। হাজার মাথা ঠুকে মরলেও মেয়েটি নির্জীব, নিষ্ঠুর, মায়াহীন থেকে যাবে। তবুও ওই অসহায় প্রেমিক অসহায় বিলীন করে দাঁড়িয়ে যায় রমনীর সামনে। যদি একটু মায়া হয়! কিন্তু হয় না!
আদিল তাকিয়ে দেখলো নোমান কে। হাসলো! মুখ খুলে বললো,

~ এই যে আমি আপনাকে ভালোবাসি! আপনি আমাকে ভালোবাসেন, এতটুকুর দুরত্ব নেই আমাদের মাঝে! তবুও এক রশ্মি আমাদের মাঝে বিশাল দেয়াল তৈরি করে রেখেছে। যে দেয়াল ভাঙার নয়! আদিল মাহমুদ সত্যিই অসহায়!
আদিল মুচকি হেসেই হাঁটা ধরলো। মিরা তাকিয়ে র‌ইলো সেদিকে। কি মনে করে আদিল আবার পিছু ফিরলো, একটু আগের মলিন ভাব নেই। আবার সেই আগের ফর্ম। রহস্য কন্ঠে বললো,
~ কিন্তু নির্বোধ নয়!
মিরা তাচ্ছিল্য হাসলো। এগিয়ে গেল ভাইয়ের দিকে। আদিল মাহমুদ ভেঙে যাবে, মঁচকে যাবে কিন্তু নিজের ফর্ম থেকে কখনোই সরবে না!
ভাইয়ের নিকট গিয়ে মিরা দাঁড়ালো, তবে কোনো প্রশ্ন করতে পারলো না। তার পূর্বেই কেউ ঝড়ের বেগে ছুটে এসে কাঁধ চাপড়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

~ আর ইউ ম্যাড মিরা? তুমি কি করে অনুমতি দিলে? আমার মিহা’র পাশে ওই মেয়েটা কি করে স্থান পায়? কেন করলে এমন টা? কেন?
থরথর করে কাঁপছে আহিশ, চোখ মুখে ছন্নছাড়া এক ভাব। মিরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে র‌ইলো। নজর ঘুরিয়ে আদিল কে দেখলো, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। মিরা’র শব্দ না পেয়ে আহিশ আবার বলে উঠলো,
~ আমি কিছু বলছি মিরা। আমার মিহার পাশে কেন ওই মেয়ে? আমার মিহা পবিত্র, কেন তাকে এই দুঃখ টা দিলে? আমার জায়গা টা রাখলে না মিরা! আমি থাকতে চেয়েছিলাম তার পাশে, কেন আমাকে বঞ্চিত করলে?
মিরা’র চোখে জল এলো। চারদিক শুধু হাহাকার, অসহায়ত্ব, ভালোবাসা’র টানাপোড়েন। কোথাও সুখ নেই, শান্তি নেই, ভালোবাসারাও ভালো নেই। আহিশ ক্রমশ হাইপার হয়ে যাচ্ছে।‌ স্থান, কাল, পাত্র ভুলে মিরা আহিশের গালে হাত রাখলো। শান্ত হয়ে আহিশ অবাক হয়ে তাকালো মিরার দিকে। মিরা শান্ত কন্ঠে বললো,

~ আপনার স্থান আমার আপাইয়ের হৃদয়ে ছিলো‌ আহিশ, আপনি তার মনের সুউচ্চ সিংহাসনের একমাত্র রাজা। তবুও দেখুন, আপনার জায়গা রয়েছে। ওইযে দেখুন আপাইয়ের পাশে! আপনি ইহজীবনের সঙ্গী ছিলেন, কবর জীবনের সঙ্গী ও থাকবেন, পরপারেও সঙ্গী হবেন। সংসার হবে আপনাদের, চিরকাল আপনারা দুজন একত্রে থাকবেন।
আহিশ শিশুদের মতো দাঁত বের করে হেসে উঠলো। মিরা’র দুঃখ বাড়লো বৈ কমলো না। কেউ ভালোবেসে ধ্বংস হয়ে উঠে, কেউ ভালোবাসা না পেয়ে ধ্বংস হয়ে উঠে, কেউ ভালোবেসে সংসার গড়ে, কেউ সে সংসারের সুখ দেখে নিজের ভালোবাসা লুকিয়ে হাসে, আবার কেউ যুগ যুগ অপেক্ষা করে সংসার গড়ার আশায়, অপেক্ষা করে পরপারে দেখা করার। ভালোবাসা যদি না থাকতো? প্রতিটা মানুষ নিজ প্রয়োজনে বাঁচতো, না থাকতো একে অপরের প্রতি মায়া, না থাকতো হিংসা। সুন্দর হতো প্রতিটা মানুষের জীবন। কিন্তু তা হ‌ওয়ার নয়। ভালোবাসা হীন জীবন অসম্ভব! সৃষ্টিকে কেও অস্বীকার করবে কি করে? নিজ ভাবনায় মিরা হাসলো।

অল্প ভিড় ইতিমধ্যে কমে এসেছে। সুযোগ খুঁজছিল মিরা। ফাঁক পেয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। আলো নেই বাড়িতে, কেউ থাকে বলে মনে হচ্ছে না। মিরা’র সন্দেহ হয়, আবার ভাবে মানুষের শব্দ পেয়ে হয়তো আঁখি চুপটি করে আছে। দরজায় দাঁড়িয়ে টোকা দেয় দু’বার। সাড়া শব্দ নেই। এবার একটু জোরেই দেয়, নিস্তব্ধ পরিবেশে শব্দ টা নিজের কানেই বিকৃত লাগে। বুক কেঁপে উঠে মিরার। ছুটে যায় ভাইয়ের কাছে। ফোন নিয়ে আবার ফিরে আসে, দরজায় তালা দেওয়া। দিশাহারা হয়ে যায় মিরা! কোনদিক সামলাবে সে? কি জবাব দিবে আফরা কে? চিৎকার করে নোমান কে ডাকতে গিয়েও মুখ চেপে ধরে মিরা, ডুকরে কেঁদে উঠে। ফোন করে আফরা কে। মেয়েটা ধরছে না। কান্নার বেগ বাড়ে, অথৈ’র কিছু হলে সর্বনাশ কে আটকাবে? আফরা ফোন ব্যাক করে কিছু সময় পর। ব্যাক করেই বলে উঠে,

~ তুই যে খবর টা দিতে ফোন করেছিস, সে খবর টি আমার জানা। আজ থেকে ঠিক চার দিন আগে সে ওই বাড়ি ছেড়েছে। এবং কি বরের সাথে বেশ আছে! আর কিছু জানার আছে?
মিরা বিস্মিত কন্ঠে শুধালো,
~ কি বলছিস আফরা? বরের সাথে ভালো আছে মানে? অথৈ তো অসুস্থ!
অপর পাশের আফরা তাচ্ছিল্য হাসলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
~ সে তো আরো অনেক দিন আগে ভালো হয়েছে। বোন আমার প্রতিবাদ করতে শিখেছে। কৃষ্ণবর্ণের মেয়েটি আদিল মাহমুদের নাকের ডগা থেকে তার‌ই বিশেষ গেস্ট, বিশেষ গার্ড কে মে*রে; প্রমাণ স্বরূপ লিখে আসতো ‘সাদা কন্যা’! অদ্ভুত না? অনল মাহমুদের ছয়টি ডিলার কে গলা কে*টে মে*রে প্রমাণ রাখে নি, না ক্লু রেখেছে! আমার বোন না?
আফরা’র গলায় অদ্ভুত যন্ত্রণা টের পেল মিরা। যে মেয়েটাকে এসব থেকে দূরে রাখতে লড়াই করে গেল; সে মেয়েটি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে তার ত্যাগ, তার যত্ন ভুলে, তার ভালোবাসা কে অস্বীকার করলো! যন্ত্রণা তো হবেই! ভাঙা গলায় মিরা বললো,

~ অনিকের কথা ও জানলো কি করে?
~ আসমানী বলেছে। তার‌ই তো ক্রেডিট বেশী! অবশ্য সে জানে না, অথৈ এতসব কিছু করছে। সে শুধু মাত্র আঁখি কে কব্জা করে বোনের নিকট অনিকের খবর পৌঁছে দিয়েছে। তার দোষ নেই! অথৈ’র দোষ আছে বলবো না, অপর পক্ষের মতামত বিহীন কোনো সিদ্ধান্ত আমি নিই না! তোর আর কিছু বলার আছে? আমি ঘন্টা খানেক পরেই চলে আসবো!
মিরা বলতে গিয়েও চুপ র‌ইলো। ফোন রাখলো আফরা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ি ছাড়লো মিরা‌‌। আর কত জানার বাকি তার? কত রহস্য এই বান্দরবানে?

অস্থির চিত্তে পাইচারি করছে আফীফ। বারংবার কাউকে ফোনে ট্রাই করছে, আবার বিছানায় রাখা সারি সারি পিসির দিকে নজর রাখছে। জিয়াউল এখনো এলো না। অনান একটু পর পর এক‌ই প্রশ্ন করছে, ‘খোঁজ পেয়েছো?’ জবাব দিতে পারছে না আফীফ। ফোন টা যে জায়গায় বন্ধ হয়েছে, সে জায়গায় খোঁজ নিয়েছিল; নেই। ভয়ে বুক কাঁপছে আফীফের। এ সময় টাই কাউকে পাচ্ছে না। এতগুলো পিসি, দু জনে নজর রাখা পসিবল নয়! আফরা নেই; নোমান নিজের কাজ‌ই করছে, মিরা, আহিশ আপসেট! সব সমস্যা একবারে এসে হানা দিয়েছে। কামিনী বেগম একটু পর পর দরজায় গিয়ে বাইরে দেখে আসছে, আরেকবার আফীফের রুমে উঁকি দিচ্ছে। নুরুল আলম সিদ্দিকী চুপচাপ বসার রুমে বসে আছেন। আনমনে কিছু ভাবছেন তিনি। ছোট্ট বাড়িটায় অস্থিরতার আগুনে যেন জ্বলজ্বল করছে।

কলিংবেলের শব্দ, তিনটে মানুষ দৌড়ে বের হলো ঘর থেকে। কামিনী বেগম দরজা খুলে উঁকি দিলেন, কেউ নেই। বাইরের লাইট জ্বালিয়ে আফীফ বের হলো বন্দুক হাতে। মা কে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে এদিক ওদিক খুঁজলো। অন্ধকারে একটি ছায়া হাঁটতে দেখলো সে। ছুটলো না, সে জানে লাভ নেই। বাড়ির দিকে ফিরবে, দরজায় ঝুলানো খাম চোখে পড়ে আফীফের। বন্দুক পকেটে রেখে খাম টা নিয়ে ভেতরে ঢুকে আফীফ। বাবার পাশে বসে, খাম খুলে। ছোট্ট একটি চিরকুট,
“তোমার থেকে বড় বড় পালোয়ান রাও শেষমেষ দুনিয়া থেকে ধূলিসাৎ হয়েছে, অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নি। সেই তুমি দুদিনের ছোকরা আমাকে চ্যালেঞ্জ করো? তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করবে কয়েকবছর আগে ঠিক কি হয়েছিল, আদিল মাহমুদ কে তার মতো কেউ চিনে না! তোমাকে কিছুটা ট্রেইলার দেখাবো, জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ! বাই বেবি!”
চিরকুট পড়ে চমকে গিয়েছেন নুরুল আলম সিদ্দিকী। গম্ভীরতা তাকে জাপটে ধরেছে। আফীফ অপেক্ষা করছে বাবার মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য। নুরুল আলম সিদ্দিকী মুখ খুললেন না, চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। দুর্বল পায়ে হেঁটে ভেতরে চলে গেলেন। আফীফ নির্বাক দেখে গেল! কিছুই বলতে পারলো না!

আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। রূপালী থালার মতো বড় চাঁদ টা অন্ধকার দূরীভূত করেছে। চারটে মানুষ নিঃশব্দে হাঁটছে। পায়ের গতি অত্যন্ত ধীর। নিশ্চুপতা কাটিয়ে মিরা প্রশ্ন করে,
~ আমি তো পাশের ঘরে ছিলাম, হুট করে কি হলো?
আবছা অন্ধকারে মিরা’র মুখটা দেখে আদিল। চাপা শ্বাস ফেলে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
~ পিনিক এট্যাক! বাইরে ছিলাম, বুঝিনি। ভুলে যাচ্ছিলো সবকিছু, কিছু হয়তো মনে করার চেষ্টা করেছে। না পেরে…
আদিল কথা শেষ করতে পারে না। পূর্বেই আহিশ চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে উঠলো,
~ ভালো হয়েছে, মরেছে!
চমকালো মিরা, নোমান। আদিল গম্ভীর দৃষ্টিতে শুধু দেখলো। আহিশের এই চাপা ক্ষোভ মিরা দিন কয়েক থেকে দেখছে। ভ্রু কুঁচকে খানিক উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে,

~ কি বলছেন কি আহিশ? মৃত একজন কে নিয়ে এমন বলতে আপনার বাঁধছে না? কিসের এত রাগ ওর প্রতি? মৃত্যু তে আমাদের হাত না থাকলেও ইনডাইরেক্টলি নাদিয়ার হঠাৎ মৃত্যুতে আমি আপনি দুজনে খানিক হলেও দায়ী। কেন সেদিন ওরকম একটা কাজ করলেন?
~ যার যেমন প্রাপ্য সে পাবেই!
নিরব কন্ঠস্বর আহিশের। তাচ্ছিল্যের সুর। আদিল কিছু বলছে না। নোমান বললো,
~ প্রাপ্য? তুমি ভালোবাসো না ঠিকাছে কিন্তু মৃত্যু পথযাত্রী একজন কে এভাবে কষ্ট কেন দিলে? সে রাইট তোমার আছে?
~ যে আমার এমন জীবনের একমাত্র কারণ তাকে কষ্ট দেওয়ার রাইট আমার নেই? হাসালে শালা বাবু!
আহিশের হেঁয়ালি পছন্দ হলো না মিরা। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ কি বলতে চাইছেন, পরিষ্কার করে বলুন আহিশ!
চাপা ক্ষোভ এবার মাত্রা ছাড়ালো। দাঁড়িয়ে পড়লো আহিশ‌। দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ কি পরিষ্কার করে বলবো? কি শুনতে চাইছো? যে লক্ষ্যে তোমরা এতকিছু করছো, যার হত্যার প্রতিশোধ নিতে এত কিছু করছো; সেই আসল দোষীর জন্য‌ই তোমরা চোখের জল ফেলছো! হাস্যকর নয়? হাসবো না?
বুঝতে পারছে না নোমান, মিরা। অবাক প্রশ্নাত্মক চাহনি নিক্ষেপ করে র‌ইলো আহিশের প্রতি। কংক্রিটের রাস্তায় বসে পড়লো আহিশ। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা অশ্রু। অসাড় কন্ঠে বললো,

~ হ্যাঁ ওই মেয়েটাই আমার মিহার হত্যাকারী। একমাত্র ওই মেয়েটার জন্য আমার ভালোবাসা কে হারিয়ে আজ আমি পাগল প্রায়। যে দোষে তুমি তোমার বাবা কে মেরেছো, সে দোষের ভাগীদার আমিও! আমার ভালোবাসা ওকে মেরে ফেললো।‌ এখন কি আমিও মরে যাবো, মেরে ফেলবে? মারবে তো; তবে একটু সময় চাই! নিজ চোখে অনল মাহমুদের গলা কা*টা লাশ দেখবো; তারপর আমাকেও আমার মিহার কাছে পাঠিয়ে দিবে। পারবে না?
ছেলেটা উন্মাদ হয়ে গেছে। নোমান বসে পড়লো আহিশের সামনে। গলায় হাত রেখে উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
~ ভালো করে বলো, আহিশ। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না!
~ ওইযে দাঁড়িয়ে আছে মনুষ্যত্ব হীন! তাকেই জিজ্ঞেস করো না! আমি সত্যি বলছি কিনা!
নোমান, মিরা’র দৃষ্টি গিয়ে পড়লো আদিলের উপর। মিরা’র এই দৃষ্টি যেন আদিল কে ভেঙে ফেলতে যথেষ্ট। শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো,

~ আমি জেনেছি পরে, তার অন্যায়ের শাস্তি সে পেয়েছিল। যাকে ভালোবেসে পাওয়ার জন্য এতকিছু করলো, তাকে সে পায়নি। মৃত্যু তখন নিকটে ছিল!
আদিল আর অপেক্ষা করে না। পা চালিয়ে প্রস্থান করে। বিস্মিত মিরা নোমানের পাশে বসে প্রশ্ন করে,
~ আমার আপাই কে নাদিয়া মেরেছে?

~ মিহা রাগ করে বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে এসেছিল। মাঝপথে যে এক্সিডেন্ট হয়, গাড়ি নাদিয়া চালাচ্ছিল। ইচ্ছাকৃত ধাক্কা দিয়ে আহত করেছে। নিজেই হসপিটাল ভর্তি করেছে। মি. মুখার্জি ছিল তখন ডিউটিতে। তাকে টাকা দিয়ে বলে, মিহার শরীরে এমন একটি বিষ প্রয়োগ করে তাড়াতাড়ি নয়; যেন ধুঁকে ধুঁকে মরে যায়। রাজি হয় নি মি. মুখার্জি। নাদিয়া আগ থেকেই জানতো মোহনলাল আর অনল মাহমুদের ঝামেলার কথা। মুখার্জি যখন রাজি হলো না তখন সে নিজেকে গোপন করে মিহার পরিচয় ফাঁস করে দিল। অনল মাহমুদ সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে! আমাকে সর্বশান্ত করে কেড়ে নেয় বাঁচার আশা কে! মেয়েটি আমার নিকট ভালো সাজতে নিজের কাজ কে লুকিয়ে অনল মাহমুদের দোষ তুলে ধরে আমার কাছে। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে মনে জায়গা করতে চেয়েছিল। আমার সংগ্রামের সঙ্গী হয়ে আমার জীবনে ঢুকতে চেয়েছিল। ও আমাকে কখনোই ভালোবাসি নি, স্বার্থপরের মতো নিজের ভালোবাসা দেখে আমার ভালোবাসা কে কেড়ে নিয়েছে।

হসপিটালে গিয়েছিলাম মেয়েটাকে সঙ্গ দিতে। ভেবেছিলাম শেষ সময় টায় একটু শান্তিতে থাকুক। কিন্তু সেদিন মি. মুখার্জি যখন আমাকে ডেকে নিয়ে কথাগুলো বললো, বিশ্বাস করো আমার মাথা ঠিক ছিল না। প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। কষ্ট দিতে চেয়েছি বারংবার। যে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সে একটা মেয়েকে বেঁচে থাকতেই নরক যন্ত্রণা ভোগ করালো; সেই ভালোবাসা না পেয়ে আমি ওর ধুঁকে ধুঁকে মরাটা দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখ, কপাল আমার! মরে গেল, আর ওই মেয়েটার কবর আমার মিহার পাশে দিয়ে আমাকে একেবারেই মেরে ফেললে। আমি সহ্য করতে পারছি না, পারছি না সহ্য করতে! কবর খুড়ো, ওই মেয়েটাকে এখান থেকে সরাও‌। আমার মিহার পাশে ওই মেয়ে থাকতে পারে না।
নিজের হাত কামড়ে ধরে আহিশ!

পরপর কামড়াতে থাকে দু হাত! নোমান, মিরা স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে দেখে পাগলামি। মানতে তাদের কষ্ট হচ্ছে। এতক্ষণের কষ্ট পাওয়া, আফসোস সব বৃথা। জীবনের চরম আফসোস হয়তো আজকের দিনটা হয়ে থাকবে। কেন আবেগে ভেসে রাজী হলো নোমান? বোনের খুনী কে বোনের পাশেই কবর দিয়ে অন্যায় হলো‌না? মিরা’র মনে হলো পুরো পৃথিবী ঘুরছে। বুকের এই কষ্টটা সে কাউকে দেখাতে পারছে না। একদিকে চরম সত্য, বোনের প্রিয় মানুষ টার এমন পাগলামি, অন্যদিকে বিশ্বাসঘাতকতা। আবারো ভালোবাসার মানুষ টা তার সাথে প্রতারণা করলো। বুকে চাপিয়ে দিলো আফসোস। বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
~ আমি আপনাকে ক্ষমা করবো না, ডাক্তার!

আফীফ’রা বসেই ছিল নির্বাক হয়ে। নুরুল আলম সিদ্দিকী ঘর থেকে বের হোন নি। চিরকুট পড়ার পর কামিনী বেগম থম মেরে বসে আছেন। অনানের অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেয়েটি বসে নেই, একটু পরপর‌ই দরজায় উঁকি দিচ্ছে। পথ চেয়ে বসে আছে। তবে ফিরছে না জিয়াউল। দ্বিতীয় বার কলিংবেলের শব্দ। এক মুহুর্ত‌ও দেরী করে না অনান। ছুটে যায় দরজায়। এবার‌‌ও নিরাশ হয়ে ফিরতে হয় তাকে। আফরা এসেছে। একদিনে এতটা জার্নি করেও মেয়েটির মাঝে ক্লান্তির ছাপ নেই। সদ্য গোসল করে আসায় স্নিগ্ধ লাগছিলো। আফরা নজর ঘুরিয়ে আফীফ , কামিনী বেগম কে দেখে। দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে শব্দ করে চেয়ারে বসে। আফীফ একপলক আফরা’র দিকে তাকিয়ে এগিয়ে দেয় চিরকুট। ভ্রু কুঁচকে হাতে নেয় আফরা, পুরোটা পড়ে! সবার মতো দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে ধরে না, বরং হাসি ফুটে মুখে। পায়ের উপর পা তুলে বসে খানিক চেঁচিয়ে বলে উঠে,

~ লেফটেন্যান্ট নুরুল আলম সিদ্দিকী অতিত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে! অন্ধকার ঘরে মুখ লুকিয়ে বসে আছে! ভাবতেই কেমন রোমাঞ্চিত হচ্ছি আমি!
তাচ্ছিল্য হাসলো আফরা। শব্দ টা ঘর পর্যন্ত পৌঁছেছে ঠিক। নুরুল আলম সিদ্দিকী হয়তো এমন তাচ্ছিল্য মেনে নিতে পারেন নি। ঘরের দরজা খুলে যায়। আফীফ নড়েচড়ে বসে। নুরুল আলম সিদ্দিকী নিজের জায়গায় বসে একপলক আফরা’র দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেন। মেয়ে টাকে ঠিক নিতে পারেন না তিনি। ছেলের কাঁধ চাপড়ে বলে উঠলো,
~ ২০০৬ সাল। শেখ মেহরাব মুনতাসির! নামটা বান্দরবান জেলায় খুব চলতো! একের পর এক মিশন, একেরপর এক জালিয়াতির মাষ্টারমাইন্ড কে খুঁজে বের করা, শাস্তির ব্যবস্থা করা। শেখ মেহরাব মুনতাসির নামের স্থানে বীরসেনা মেহরাব মুনতাসির হয়ে গেল! অপরাধিরা অপরাধ না কমালেও একটু হলেও তোয়াজ করে চলতো‌। আট বছর বয়সী মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে ছুটি নিয়েছিলেন, মেয়ে বায়না ধরেছিল ঘুরতে যাবে। তার স্ত্রী নূন সিদ্দিকী ও জেদ ধরেছিলেন! বিয়ের পর সেভাবে ঘুরা হয়নি। ব‌উ, সন্তান কে ভদ্রলোক ভালোবাসতো খুব। ঘুরতে গেল, ঘুরা ঘুরি হলো।

মেয়ে কে ঘুম পাড়িয়ে রাত্রি বিলাস করতে গিয়েছিলেন দুজন। চোখে পড়ে চোরাচালানের কিছু দৃশ্য। বর্ডার পেরিয়ে অস্ত্র প্রাচার, মানুষের অঙ্গ প্রাচার, সাথে ছিল শিশু ও নারী প্রাচার। নারী প্রাচারের কেস টা তাঁর হাতেই ছিল। পরদিন ই তিনি ফিরে আসেন। চৌকষ সেনা ছিলেন, তার লিংক ছিল নানান জায়গায়। এবং কি সন্ত্রাসীদের সাথেও চেনাজানা ছিল। খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারেন সবকিছুর পেছনে অনল মাহমুদ জড়িত। গোপনে প্রমাণ যোগাড় করতে থাকেন। ছুটি শেষ হলে আবার ডিউটিতে জয়েন হোন, গোপন মিশনের কথা জেনে যায় অনিমেষ মির্জা। দুজনের বন্ধুত্ব বেশ গাঢ় ছিল। অনিমেষ মির্জা নিজেও সাহায্য করেছেন শেখ মেহরাব মুনতাসির কে। যথেষ্ট প্রমাণ তাদের কাছে ছিল না। প্ল্যান করেছিল যতটুকু প্রমাণ রয়েছে ততটুকু নিয়েই রেট করবে। সেনাদের প্রস্তুত করছিলেন, ফোন আসে বাড়ি থেকে। প্রতিবেশী এক লোক ফোন করে জানায় বাড়িতে আগুন লেগে সব ছাই হয়ে গেছে। সাথে পুড়ে গেছে নূন সিদ্দিকী ও তার আট বছরের মেয়ে!

বার কয়েক ঢোক গিললেন নুরুল আলম সিদ্দিকী। গলা আটকে আসছে তাঁর। কথা বের হচ্ছে না। জগ থেকে পানি ঢেলে এক চুমুকে শেষ করলেন। শান্ত পরিবেশ, কাঁচের শব্দ টা ঝনঝন করে উঠে। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলেন,
~ শক্তপোক্ত বীরসেনা মেহরাব মুনতাসির সেদিন ঢলে পড়েছিলেন অনিমেষ মির্জার উপর। তাল রাখতে পারেন নি। যে কারণে স্ত্রী সন্তান থেকে দূরে থাকছেন সেই কারণটাই তার থেকে কেড়ে নিলো তাদের। নিজেকে খুব তাড়াতাড়িই স্বাভাবিক করে নেন। সৈন্যদের প্রস্তুত করতে এক চুল অবহেলাও করেন নি। অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল বারংবার, তবুও থেমে থাকেন নি। শেষ পর্যায়ে যখন অভিযান শুরু করবে তখন দারুণ একটা খবর আসে। শেখ মেহরাব মুনতাসির কে চোরাচালানের সঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার পদমর্যাদা কেড়ে নিয়ে গ্রেফতারের হুকুম ধার্য করা হয়েছে। ঠিক তার ছেচল্লিশ দিন পর ফাঁসি! সুন্দর না?

ছেলের দিকে তাকালেন নুরুল আলম সিদ্দিকী। আফীফ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। প্রশ্ন করলেন না, চুপচাপ র‌ইলেন। আফীফ অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো,
~ নূন সিদ্দিকী? তোমার আর তার পদবী এক, এবং কি শেখ মেহরাব মুনতাসিরের সাথে আমার নামের মিল! কি লুকাচ্ছো আব্বু?
চমকালেন নুরুল আলম সিদ্দিকী। এতকিছুর মধ্যে ছেলে যে এই ছোট্ট বিষয়টা খুঁতিয়ে দেখবে ভাবেনি। আর কিছু আড়াল করতে চাইছেন না। বললেন,
~ আমার বোন নূন সিদ্দিকী! হ্যাঁ আমি সেই শেখ মেহরাব মুনতাসিরের কথায় বলছি যার কারণে আজ আমি এখানে! আমার দুলাভাই! আমি সেই নূন সিদ্দিকীর কথায় বলছি যাকে আমি আমার দ্বিতীয় মা ভাবতাম, আমি সেই ছোট্ট মেয়েটার কথা বলছি যে ভূমিষ্ঠ হয়ে সর্বপ্রথম আমার কোলে উঠেছিল। আমি আমার সেই পরিবারের কথায় বলছি, আমার নীড়ের কথায় বলছি। যার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে ওই অনল মাহমুদ!
নুরুল আলম সিদ্দিকী এবার কেঁদেই ফেললেন। পুরোনো ক্ষত গুলো এত তাজা হয় কি করে? কামিনী বেগম নিঃশব্দে কাঁদছেন। নুরুল আলম সিদ্দিকী একপলক দেখলেন স্ত্রী কে, চোখ দিয়ে ইশারা করলেন না কাঁদতে। আফীফ আবার প্রশ্ন করলো,

~ তখন আমরা কোথায় ছিলাম? আমি তাদের চিনি না কেন?
ঘাবড়ালেন দুজন‌ই। নুরুল আলম সিদ্দিকী’র চোখে মুখে ভয়। তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলেন,
~ আমরা ঢাকায় ছিলাম!
~ মিথ্যে বলছো আব্বু। আমার স্পষ্ট মনে আছে, তোমাকে যখন আমি প্রথম দেখেছিলাম আমার তখন এগারো বছর। হোস্টেলের বাইরে তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে! মানে ওই সময় আমি এই বান্দরবান ছিলাম, আমার পরীক্ষা ছিল। কি লুকাচ্ছো আব্বু?
অপ্রসন্ন হলেন নুরুল আলম সিদ্দিকী। কিছুটা রেগে বললেন,
~ এসব বিষয় কেন প্রশ্ন করছো আফীফ? যে অতিত তুমি জানতে চেয়েছো সে আমি বলেছি। বাড়তি প্রশ্ন না করে নিজের কাজ করো!
পরিবেশ ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে আফরা বলে উঠলো,
~ স্টপ দিস।

থামলো সবাই‌। ব্যাগ থেকে ফাইল বের করে আফীফের সামনে ধরে বলে উঠলো,
~ এখানে অনল মাহমুদের বিরুদ্ধে সকল প্রমাণ রয়েছে। আপনি ছেলেপেলে দের ফিরে আসতে বলুন। নিজের সৈন্যদের তৈরি করুন। সময় নেই হাতে, যে কোনো সময় কিছু একটা হয়ে যেতে পারে!
আফীফের পূর্বেই ফাইল টা নিজের হাতে নিয়ে নিলেন নুরুল আলম সিদ্দিকী। দেখলেন ভালো করে, মুখে এক ছিটে হাসি ফুটলো। দেরী করলেন না, ঘর ঢুকে পড়লেন। কিছু সময়ের মধ্যেই ইউনিফর্ম পরিধান করে কারো সাথে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি ছেড়ে। আফীফ বুঝলো নুরুল আলম সিদ্দিকী এখন সেনানিবাসে যাবেন। আফীফ‌ও পিসির সামনে বসে রনিত দের জানিয়ে দিল ফিরে আসার। কাজ গুলো এত দ্রুত হচ্ছিলো এক মুহুর্তের জন্য সবাই ভুলেই বসলো জিয়াউলের কথা।

রাত্রি প্রায় দশটা। আফীফ এখনো পিসির সামনে বসে আছে। চল্লিশ জনের মধ্যে পঁয়ত্রিশ জন ফিরে এসেছে ছাউনি তে। এখনো পাঁচ জন আসেনি। দুশ্চিন্তায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে তার।‌ একটু পর পর‌ই মামুনের সাথে যোগাযোগ করছে, প্রত্যেক বার‌ই ফলাফল এক‌ই। এখনো আসে নি। কামিনী বেগম নামাজে দাঁড়িয়েছেন। আফীফ দেখতো, যতবার‌ই তার বা তার বাবার কোনো মিশন থাকতো কামিনী বেগম সামনে আসতেন না; জায়নামাজে বসে থাকতেন। আজ‌ও ব্যতিক্রম হয়নি। আফীফ আর ঘরে বসে থাকতে পারলো না। একটা পিসি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ঘর থেকে। আফরা অনান‌ও পিছু নিলো‌। তবে বেশী টা পথ যেতে হলো না। দরজা পেরোনোর আগেই হাতে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। রনিতের ফোন,
~ স্যার, ছাউনিতে আহেন। তাত্তাড়ি!

গলাটা কেমন শুনালো। আফীফের কিছুটা ভয় হলো। রনিত ফোন কেটে দিয়েছে। আফীফ দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। আফরা অনানের অপেক্ষা না করেই গাড়ি ছুটায়। পেছন থেকে অনান চিৎকার করে উঠে,
~ আমাকে নিয়ে যাও। আমি যাবো!
সে তো অনেক দূর চলে গেল। অনানের কন্ঠস্বর কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। আফরা বাইক নিয়েই এসেছিল। স্টার্ট করে অনানের দিকে তাকায়। মাথা নেড়ে অনান বসে পড়ে বাইকে। বাইক ছুটায় আফরা। বড় বড় ট্রাক, ছুটে চলা মৃদু গতির অটো, রিকশা কে ছাড়িয়ে ছুটতে থাকে সে। আফীফ কে ধরতে না পারলেও গাড়িটা ঠিক দেখতে পারে। সময়ের ব্যবধানে বস্তির পেছন দিকে দুটো গাড়িই থেমে যায়। কারো দিকে তাকানোর সময় পর্যন্ত হয় না। ছুটতে থাকে ছাউনির দিকে!
ছাউনি নিস্তব্ধ পড়ে আছে। মনে হচ্ছে না ভেতরে কেউ আছে। আফীফ আফরা ভেতরে ঢুকেই থেমে যায়। যাদের না আসায় চিন্তা করছিলো তারাও এসে গেছে। তবে এমন নিশ্চুপতা’র কারণ খুঁজে পায় না। ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসে আফীফ। বলে উঠে,

~ সব ঠিকঠাক তো? আমি একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারোর কিছু হয়নি তো?
কথা বলতে বলতে সামনে আসতে থাকে আফীফ। কারো উত্তর না পেয়ে আবার বলে উঠে,
~ কি হলো কথা বলছো না ক…
পুরো বাক্য টা শেষ করতে পারে না আফীফ। চোখ পড়ে তক্তপোষের উপর। লাল বাতির আবছা আলোয় মুখটা ঠিক দেখতে পায় আফীফ। থমকে যায় সে, অনিমেষ তাকিয়ে থাকে। এগোনোর সাহস তার হয় না। ছেলেটা গোমড়া মুখে শুয়ে আছে, এক ফোঁটা হাসি নেই। মানাচ্ছে না এভাবে। আফীফ ধীর গতিতে তক্তপোষের উপর বসে, আলতো ভাবে গালে হাত রেখে বলে উঠে,

~ ওর কি হয়েছে? শুয়ে আছে কেন? অসুস্থ হয়ে পড়েছে? ডক্টর দেখাও নি?
ছিটকে আসে চাপা কান্নার আওয়াজ। আফীফের বুকটাও কেঁপে উঠে। গালে, গলায় হাত বুলায়। এতক্ষণ পেছনে থাকায় আফরা অনান কিছুই বুঝে নি। সন্দেহের বশে এগিয়ে আসে অনান। আফীফের কাতর চাহনি, তক্তপোষের উপর এলানো শরীর দেখে কাঁপা গলায় অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
~ মি. খালেদা জিয়া!
আফীফ একপলক তাকায় অনানের দিকে। চোখ ফিরিয়ে আবার জিয়াউলের দিকে তাকায়। ভালো ভাবে শরীর টা দেখে। কোথাও চিহ্ন মাত্র নেই‌। পালস চেইক করে আফীফ, হাত ছেড়ে দেয়। তক্তপোষ থেকে পড়ে নিতে ধরতেই আগলে নেই আফরা। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আফীফ বলে,

~ বেঁচে নেই তো!
আফরা চোখ বুজে নেয়। শক্তপোক্ত লোকটা কেমন হয়ে গেছে‌। মামুনের দিকে তাকায়। এগিয়ে আসে মামুন। ভাঙা গলায় ফ্যাচ ফ্যাচ কেঁদে বললো,
~ আমাদের পরিকল্পনা আগেই টের পেয়ে গিয়েছিল। হসপিটালের ভেতরে থাকা পাঁচ জন কে আটক করে নিয়ে যায়। সেখানেই ছোট স্যার ছিল। ওদের সামনেই নাকি জীবিত অবস্থায় পেট কেটে লিভার নিয়ে নেয়। অজ্ঞান হ‌ওয়ার পর একে একে অঙ্গ গুলো শরীর থেকে আলাদা করে ফেলে। ভেতরে কাপড় গুঁজে দিয়ে ওদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সাথে একটা চিরকুট।

শেষের কথাটা বলেই মামুন মুখে হাত চেপে কান্না করে দেয়। ছেলেটা তাদের প্রিয় হয়ে উঠেছিল, হাসি তামাশার জন্য। এমন পরিণতি হবে ভাবে নি। আফরা হাত বাড়িয়ে চিরকুট টা নেয়।‌ কিছুটা রক্ত দেখা যাচ্ছে। খুলে দেখে,
“বলেছিলাম না জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ? অপেক্ষার ফল পেয়েছো? তোমার স্পর্ধা’র পরিণতি তুমি কাল পর্যন্ত দেখে যাবে আফীফ মুনতাসির!”

দাঁতে দাঁত চেপে কয়েক টুকরো করে আফরা। রাগ মেটে না! অনান এগিয়ে এসে পেটের কাছে বসে। সাদা শার্ট উপরে তুলতেই পেটে বড় একটা সেলাইয়ের দাগ চোখে পড়ে, তাও অযত্নে করা। উবু হয়ে ক্ষততে চুমু খায় অনান। মেয়েটা থম মেরে আছে, তবে কাঁদতে পারছে না। আকস্মিক মৃত্যু টা মেনে নিতে পারেনি। মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলো,
~ মি. খালেদা জিয়া! এই খালেদা জিয়া। উঠো! দেখ তোমাকে এই নামে ডেকেছি। তুমি রাগ করবে না? আমাকে পাল্টা আদিবাসী বলে ডাকো। আরে ডাকো। আমি একটুও রাগ করবো না, আমার তো শুনতে ভালো লাগে।
টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। অনান থেমে নেই। গালে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বলে,
~কোবাংনা চাগা তোঁখোঁয়াই হিঁয়ে!

বুঝতে পারো নি এবার‌ও? আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই! নাংগো ঙ্গাঁ লোয়ে মি. খালেদা জিয়া! বুঝো‌নি এটাও? আমি তোমাকে ভালোবাসি খালেদা জিয়া। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালবাসো। এবার একটু হাসো, এমন গোমড়া মুখো দেখতে মোটেও ভালো লাগে না।
সাড়া শব্দ নেই। অনান এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। মৃত শরীর টা ঝাঁকাতে লাগলো, আবার গালে মৃদু থাপ্পড় দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আফরা’র নিজেকে দিশেহারা লাগছে। কাকে সামলাবে সে? তার যে হৃদয় পুড়ছে না এমন নয়। ভেতর টা তার‌ও কষ্টে জর্জরিত। হাসি খুশি ছেলেটার এমন পরিণতি তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হুট করেই জিয়াউলের গালে রাখা অনানের হাত ধরে আফীফ মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
~ ধরো না, ব্যাথা পাবে!

বাধ্য মেয়ের মতো অনান আর ধরলো না। স্পর্শ বাঁচিয়ে বসে র‌ইলো। আফরা বিস্মিত কন্ঠে আফীফের দিকে তাকালো। এত কঠোর একজন মানুষের থেকে তাকে এমন বাচ্চামো কথা শুনতে হবে কস্মিনকালেও ভাবে নি। আফীফ উঠে দাঁড়ালো, ধীর গতিতে হেঁটে বাইরে চলে গেল। মামুন কে ইশারা করে আফরা আফীফের পিছু নিলো। আফীফ থামলো খোলামেলা এক মাঠে। পা গুটিয়ে বসলো। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। আফীফের বার বার শুধু একটা কথায় কানে বাজছে, ‘পাতালেও আপনাকে ছাড়ছি না স্যার’! ঘাস খামচে ধরে আফীফ। ঘাসের সাথে লড়াই করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। স্মৃতি গুলো তাজা হয়ে হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে। ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে। গড়িয়ে পড়ে অশ্রু কণা, ঘাসের উপর শিশিরবিন্দুর মতো রয়ে যায়। ‘

মৃত্যু’ শব্দ টা কতটা তুচ্ছ! সৃষ্টিকর্তার দেওয়া প্রাণ এদের কাছে তুচ্ছ, চাইলেই মেরে ফেলা যায়। মানুষ মরে কেন? হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকলে কি হতো? এই নিয়ম পাল্টে যেত, হারানোর শোক থাকতো না, হৃদয়ের আর্তনাদ থাকতো না, ভালোবাসি বলতে না পারার আফসোস থাকতো না, না পাওয়ার বেদনা থাকতো না, একসাথে হাজার মাইল পথ চলতে পারতো, তাল মিলিয়ে সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতে পারতো। আফীফ পা দাপটায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে যায় বারংবার। হুট করেই মনে পড়ে, এই ছেলেটাকে সে বলতে পারেনি সে কতটা প্রিয় তার, বলতে পারেনি তার হৃদয়ের ক্যানভাসে ছেলেটা বিশাল জায়গা করে আছে, বলা হয়নি ছেলেটাকে সে আপন ভাইয়ের মতো আগলে রাখতো আড়ালে! আফসোস হচ্ছে! কেন বললো না? কেন একটা বার বললো না ভালোবাসি?
মাথায় কারো হাতের স্পর্শে চোখ খুলে আফীফ। আফরা’র মুখশ্রী দেখে আবার চোখ বুজে। শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫৫+৫৬

~ একটু বিলি কেটে দিবেন কাটামুকুট?
ছোট্ট একটি আবদার। চট করে নাকচ করতে পারে না আফরা। ঘাসের উপর পা মেলে বসে বিলি কেটে দেয়। ক্ষণে ক্ষণে হাত তার কেঁপে উঠে। আফীফ চোখ খুলে আবার। আফরার দিকে নয়, জ্বলজ্বল করা চাঁদ টার দিকে তাকায়। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়েই থাকে। তারপর আনমনে বিড়বিড় করে বলে উঠে,
“কবিতা তোমায় আজ দিলাম ছুটি
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি!”

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫৯+৬০