হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬১+৬২
Tahrim Muntahana
বেলা গড়িয়েছে। অপরাহ্ন আজ থমকে গেছে। থমকে গেছে বান্দরবানের প্রকৃতির আকাশ, বাতাস, পাহাড়, পর্বত। থমকে গেছে বান্দরবানে বসবাস রত প্রত্যেকটা মানবজীবন। খা খা করছে পথঘাট, বড় বড় দালানকোঠা, নেই কোন শব্দ, ঝঞ্ঝাট! প্রকৃতি আজ বড়ই শান্ত। সেই সাথে শান্ত গোটা বান্দরবান। রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে, জায়গায় জায়গায় পুঁটলির মতো কয়েকদল পুলিশ টহল দিচ্ছে অদ্ভুত শান্ত ভঙ্গিমায়। রৌদ্রদীপ্ত কংক্রিটের রাস্তা আজ পরম সুখে ঘুমাচ্ছে, কয়েকদল স্বার্থপর মানুষের পায়ের নিচে তাদের আজ পিষতে হচ্ছে না।
সকালে সব ঠিক ছিল। কর্মজীবনের উদ্দেশ্যে যখন মানুষেরা ছুটোছুটি করতে নিজেকে তৈরি করছে ঠিক তখনই বোলতার মতো ছুটে এলো কয়েকটা খবর। সরকার আজ সকল অফিস, আদালত, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছেন, সেই সাথে রেড এলার্ট জারি করে প্রত্যেক মানুষ কে নিজ গৃহে অবস্থান করার নির্দেশ দিয়েছেন। শুধুমাত্র অসুস্থ রোগী, রোগীর একান্ত নিজের লোক, রোগী বা লাশ বহনকারী গাড়ি কে উপযুক্ত দলিল দেখিয়ে বাইরে বেরোনোর নির্দেশ দিয়েছেন। এমতাবস্থায় কেউ যদি আইন লঙ্ঘন করে গৃহ ত্যাগ করে তাহলে তাকে সরাসরি খানায় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে, রয়েছে বিরাট অঙ্কের জরিমানা। কোনো শিশু যদি ভুলবশত বেরিয়ে পড়ে, তার দায়ভার শুধু মাত্র তার অভিভাবকের। তার সাথে যা খুশি হতে পারে, সরকার বা সরকারি কর্মকর্তা এর জবাবদিহিতা করবে না। কিন্তু একটিমাত্র পেশা রয়েছে, যাদের জটিল প্রশ্নের নিকট হয়তো সরকারও ভয় পায়। সাংবাদিক! তাদের অনুমতি না দিলেও তারা ঠিক অনুমতি নিয়ে দুর্যোগের মধ্যেও বেরিয়ে পড়বে। খবরটা এতটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে শুধু মাত্র বান্দরবান শহর নয় বাংলাদেশের প্রত্যেক টা শহর যেন উন্মুখ হয়ে বসে আছে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কারণ জানার জন্য। পুরো বাংলাদেশ আজ চঞ্চলা হয়ে উঠেছে। কি হতে চলেছে আজ? কেনই বা এমন কঠোরতা? কেনই বা এমন নির্দেশনা?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিছু সময়ের ব্যবধানে বান্দরবানের শান্ত ভঙ্গি হুট করেই কেটে গেল। কয়েকশ গাড়ির বিকট আওয়াজ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই জড়সড় হয়ে গেল নিজ গৃহে অবস্থান করা মানুষ গুলো। উত্তেজনায় ছটফট করে জানালার কিঞ্চিৎ ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে লাগলো গাড়ির বাহার কে। সাইরেন বাজিয়ে ছুটতে লাগলো গাড়ি। গন্তব্যে পৌঁছেছে। ধুলোবালি উড়িয়ে বিকট শব্দে থেমে গেল গাড়ি গুলো। নেমে পড়লো ইউনিফর্ম পরা শক্তপোক্ত দেহের অধিকারী অফিসার গণ। নির্দেশনা মোতাবেক সৈন্যরা ঘিরে ধরলো শহরের বড় তিন হসপিটাল, মাহমুদ বাড়ি, মাহমুদ অফিস। শ শ সরকারি টুপিওয়ালা অফিসার গণ বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে পড়লো। আজ যেন মুক্তির নিশানা উড়ানোর জেদ চেপেছে তাদের। মনোরম প্রকৃতির এই বান্দরবান শহর কে কুলষিত মুক্ত করতে অবিরাম তারা যুদ্ধের মনস্থির করেই এসেছে। যাই হয়ে যাক, আজ তারা পিছু হটছে না। সেনাপ্রধান জেনারেল অতিব ইসলাম এই মিশনের সব ভার তুলে দিয়েছেন বিগ্রেডিয়ার অনিমেষ মির্জার হাতে। অনিমেষ মির্জা নিজ ইচ্ছায় এবং কর্নেল নুরুল আলম সিদ্দিকী’র সহমর্মিতায় ভার থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছেন। সকল দায়িত্ব আজ নুরুল আলম সিদ্দিকী’র। তার নেতৃত্বে সূচনা হয়েছে এই যুদ্ধের।
হাতে মাইক নিয়ে নুরুল আলম সিদ্দিকী দাঁড়িয়ে আছেন মাহমুদ হসপিটালের সামনে। গোপন সূত্রে জানতে পেরেছেন অনল মাহমুদ এই হসপিটালেই অবস্থান করছেন। মাথা কে আগে নিজেদের আয়ত্বে আনতে পারলে পুরো শরীর চলে আসবে। ছেলের দিকে একনজর তাকিয়ে নুরুল আলম সিদ্দিকী মুখ বরাবর মাইক ধরলেন। স্পষ্ট, দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলেন,
~ মি. অনল মাহমুদ আপনাকে নিচে নামার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। শুনতে পাচ্ছেন আপনি? কোনো রকম চালাকি করবেন না। আমাদের টিম আপনাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। আপনার চালাকি প্রমাণ হলে ওপেন শুটের নির্দেশ আমাদের হাতে রয়েছে। আত্মসমর্পণ করুন। মি. অনল মাহমুদ শুনতে পাচ্ছেন? আমাদের টিম হসপিটাল ঢুকে রোগীদের অসুবিধায় ফেলতে চাচ্ছে না; আপনি এই সহমর্মিতার সুযোগ নেওয়ার কথা ভাবলে আমরা সেই সহমর্মিতা শীঘ্রই ত্যাগ করবো। আবারো বলছি আত্মসমর্পণ করুন।
সাড়া শব্দ নেই। হসপিটালের গেইট বন্ধ নেই তবুও সৈন্যদের ঢুকার অনুমতি দেওয়া হয়নি। রোগীর নিকটস্থ রা বিভ্রান্ত হয়ে ছুটোছুটি করলে ভুল হওয়ার সম্ভবনা একশো ভাগ। সময় চলে গেল আরো কয়েক মিনিট। আফীফ এগিয়ে এসে দাঁড়ালো নুরুল আলম সিদ্দিকী’র নিকট। দু হাত পেছনে রেখে বুক খানিক শক্ত করে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
~ স্যার, মাইক টি আমাকে দিন। আমি কিছু বলবো!
নুরুল আলম সিদ্দিকী ভাবনা বিহীন মাইক তুলে দিলেন আফীফের হাতে। আফীফ হসপিটালের দিক তাকিয়ে মাইকে বললো,
~ হসপিটালে অবস্থান রত রোগী, রোগীর নিকটস্থ, ডক্টর, নার্স ও স্টাফ প্রত্যেকগণ মনোযোগ দিয়ে শুনুন। ক্যাপ্টেন আফীফ মুনতাসির বলছি, আপনারা যে যেখানেই আছেন সেখানেই অবস্থান করুন। যারা কেবিন ছেড়ে বাইরে অবস্থান করছেন তারা দ্রুত কেবিনে অবস্থান করুন। আমি আবারো বলছি দ্রুত’ই কেবিনে অবস্থান করুন। আপনাদের বড়জোর পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হবে। আমাদের সৈন্যরা দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করবে; এমতাবস্থায় আপনাদের খামখেয়ালি পনায় কোনো ক্ষতি হলে আমাদের টিম জবাবদিহিতা করবে না। মি. অনল মাহমুদ আপনার নিকট সময় রয়েছে পাঁচ মিনিট। নিজেকে পূর্ণাঙ্গ রূপে সুস্থ দেখতে চাইলে আত্মসমর্পণ করুন নতুবা আমাদের সৈন্যরা আপনার সাথে সর্বোচ্চ কঠোরতা প্রকাশ করবে।
মাইক নামিয়ে পাশে তাকালো আফীফ। হাত দিয়ে ইশারা করতেই আরেকজন ক্যাপ্টেন ঘড়ির দিক দৃষ্টি রাখলেন। সময় যেন আজ বাঁধ মানছে না। খুব দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট শেষ হতে কয়েক সেকেন্ড অবশিষ্ট। অনল মাহমুদের চিহ্ন মাত্র নেই। নুরুল আলম সিদ্দিকী আফীফের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় জানাতেই আফীফ বন্দুক তুলে নিলো হাতে। ইশারা করতেই আফীফের পেছন দাঁড়িয়ে গেল কয়েকজন সৈন্য। সম্মুখ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই কয়েক পা এগিয়ে গেল আফীফ। দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকার নির্দেশ দেওয়ার পূর্বেই খুলে গেল দরজা। এক জোড়া স্লিপার পরিহিত পা দেখা গেল। আফীফ পা জোড়া অনুসরণ করে সম্মুখে তাকাতেই ঝটকা গেল একটু খানি। অনল মাহমুদ দাঁড়িয়ে আছেন, সাদা পাঞ্জাবিতে লোকটাকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। আফীফ অনিমেষ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। লোকটার মাঝে নেই ভয়, নেই জড়তা, নেই দুঃখ, নেই রাগ; আফীফ খুব করে লক্ষ্য করছে লোকটা তার দিকেই তাকিয়ে আছেন অপলক। যেন আজ খুব করে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন। আফীফ খানিক নড়ে উঠলো। মুখ ফুটে কিছু বলবে পূর্বেই অনল মাহমুদ এগিয়ে এসে নিচে নেমে দাঁড়ালেন। দু হাত উপরে তুলে মুচকি হেসে বলে উঠলেন,
~ আমি আমার সকল দোষ, অন্যায়, পাপ কাজের কথা স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করছি।
কর্নেল নুরুল আলম সিদ্দিকী কিছুক্ষণ স্তব্দ ভুমিকা পালন করলেন। আফীফের দিকে শান্ত নজরে তাকিয়ে বড় বড় পা ফেলে অনল মাহমুদের সম্মুখে দাঁড়ালেন। উচ্চস্বরে বললেন,
~ আপনার সকল লোকদের বলুন আত্মসমর্পণ করে আমাদের নিকট ধরা দিতে।
কথাটি শোনা মাত্র অনল মাহমুদ হাত আরো খানিক উপরে তুললেন। তৎক্ষণাৎ কালো পোশাকধারী লোকগুলো মাটিতে হাঁটু ঠেকিয়ে মাথা নত করে বসে পড়লো। আত্মসমর্পণ মঞ্জুর করে নিয়েছে সকলে। আফীফ সৈন্যদের ইশারা করতেই একে একে লোকগুলো কে জিপে তোলা হলো। ব্যস্ত এই সময়ের মধ্যেই অনল মাহমুদ বড্ড শান্ত। নুরুল আলম সিদ্দিকী কে উদ্দেশ্য করে অত্যন্ত নিম্ন কন্ঠে বললেন,
~ যাকে আমি পেয়েও ধরে রাখতে পারিনি আপনি মশাই দুই যুগ ধরে আগলে রেখেছেন! যাকে জন্ম দিয়ে আগলে রাখতে পারিনি আপনি মশাই দুই যুগ ধরে তাকে বুকে বহন করছেন। আপনি মশাই পরম সৌভাগ্যবান!
কর্নেল নুরুল আলম সিদ্দিকী শান্ত চোখে চোখ রাখলেন অনল মাহমুদের চোখে। চাপা এক শ্বাস বেরিয়ে এলো। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন তিনি। আফীফ এগিয়ে আসছে। অনল মাহমুদ পরক্ষণেই বাঁকা হেসে বললেন,
~ এখন যদি তাকে সবটা বলে দিই? কি করবেন কর্নেল?
~ যা আমার তা আমারই থাকবে! একটি মাত্র সত্য আমার পিতৃত্ব কে ভুল প্রমাণ করতে পারে না। আমি আমার ছেলে কে বীরসেনা মেহরাব মুনতাসিরের মতোই কঠোর, প্রতিবাদী, আদর্শ ব্যক্তিত্ববান করে গড়ে তুলেছি। আশা রাখছি আমার এত দিনের শিক্ষা কে ভুল প্রমাণ করে মুখ ফিরিয়ে নিবে না!
কর্নেল নুরুল আলম সিদ্দিকী চুপ করে গেলেন। আফীফ কাছাকাছি এসে পড়েছে। ফিসফিস কন্ঠে আবার বললেন,
~ বর্তমানে পিতা নুরুল আলম সিদ্দিকী নয় কর্নেল নুরুল আলম সিদ্দিকী আপনার সামনে রয়েছে। আর ওই ছেলে টা এখন ক্যাপ্টেন আফীফ মুনতাসির, নয় আফীফ মুনতাসির! সবার পূর্বে আমাদের ডিউটি! চলুন!
অনল মাহমুদ চওড়া হাসলেন। নুরুল আলম সিদ্দিকী’র পাশে হাঁটা ধরলেন। তবে বেশী পথ যাওয়া হয়ে উঠলো না। কেউ তীব্র বেগে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। থমকে গেলেন অনল মাহমুদ সহ অফিসার গুলো। অনল মাহমুদ স্তব্দ হয়ে জড়িয়ে ধরা মানুষটিকে অনুভব করছেন। এমন টা কখনো হয়নি। ছোট্ট আদিলের মাথায় যখন অন্যকিছু ঢুকে গেল তাদের সম্পর্ক থেকেও চলে গেল সরলতা। দুজন জটিল মানুষ জটিল ভাবেই দুজন দুজন কে ভালোবেসে গেছে। আদিলের শরীর মৃদু কাঁপছে। এই ভঙ্গুর আদিল কে অনল মাহমুদ জাপটে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। নুরুল আলম সিদ্দিকী আফীফ কে নির্দেশনা দিয়ে বলে উঠলেন,
~ এরেস্ট হিম, বাবার সাথে তিনিও যুক্ত আছেন।
অনল মাহমুদ আদিল কে ছেড়ে দেন। পূর্বে ফিসফিসয়ে বলে উঠেন,
~ কথা দিয়েছো আদি, রাখবে কিন্তু!
তারপরেই উচ্চ রাগান্বিত কন্ঠে নুরুল আলম সিদ্দিকী কে বললেন,
~ আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে? আমার ছেলের অফিস রেট করে অবৈধ কিছু পেয়েছেন? তাহলে কোনো যুক্তিতে আপনি আদিল কে এরেস্ট করার হুকুম দিচ্ছেন? আমি অনল মাহমুদ নিজের সব দোষ স্বীকার করেছি। আমি একা করেছি সব, আমার সাথে কেউ ছিল না। আদিল কেউ যুক্ত করতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে রাজী নয় বলেই আমার থেকে পৃথক থাকে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন আদিলের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না। ঠিক এই কারণেই। খারাপ হলেও আমি তো বাবা? তাই থাকতে পারেনি ছুটে এসেছে। এর দ্বারা প্রমাণ হয়ে যায় না আদিল মাহমুদ দোষী। আইন নিশ্চয়ই নির্দোষ কে শাস্তি দিবে না?
নুরুল আলম সিদ্দিকী চুপ রইলেন। তাদের নিকট আদিলের বিরুদ্ধে সত্যিই কোনো প্রমাণ নেই। তবে তিনি জানেন আদিল ঠিক তার বাবার মতোই। অনল মাহমুদ আবার চিৎকার করে উঠলেন,
~ এই আমি আপনাদেরই এক অফিসার জিয়াউল কে নিজের হাতে মেরেছি। আজ ভোরে নিজের স্ত্রী কে গুলি করে মেরেছি। অস্ত্র প্রা*চার, অঙ্গ প্রা*চার, নারী ও শিশু প্রা*চার, খু*ন সবকিছুর সাথে জড়িত আমি। একমাত্র আমি। আমার ছেলেকে এর মধ্যে জড়ালে অনল মাহমুদ কিন্তু এই আত্মসমর্পণের পাঠ চুকিয়ে দিবে!
আদিল নিস্ফলক দেখে গেল, বাবার কথার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু বলার স্পর্ধা তার হলো না। সে এখন এগিয়ে গেলে অনল মাহমুদ সত্যিই বদলে যাবে, রক্তাক্ত হয়ে পড়ে রবে কিছু দেহ। কিন্তু আদিলের মনের ইচ্ছে টা কেউ পূরণ করেই দিলো। ভেসে এলো মেয়েলি কঠোর কন্ঠস্বর,
~ আমার কাছে প্রমাণ রয়েছে! আদিল মাহমুদের বিরুদ্ধে সকল প্রমাণ আমি দিবো।
কন্ঠস্বর অত্যন্ত পরিচিত। চমকাল না আদিল। অনল মাহমুদ রুক্ষ দৃষ্টি তে তাকালেন মিরা’র দিকে। মিরা বাঁকা হেসে আফীফের দিকে এগিয়ে দিল একটা ফাইল। আফীফ ফাইল না দেখেই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
~ আপনি এখানে আসলেন কি করে মিস মিরা?
~ বিগ্রেডিয়ার অনিমেষ মির্জার অনুমতি নিয়েই এসেছি।
আফীফ আর কথা না বাড়িয়ে ফাইল খুলে দেখলো। মিরা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। একপলক মিরা’র দিক তাকিয়ে একজন সৈন্য কে উদ্দেশ্য করে বললো,
~ এরেস্ট হিম ফাস্ট!
অনল মাহমুদ কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন, হাত ধরে আটকে দিল আদিল। অনল মাহমুদ কে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল। আদিল চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। এটাই চাইছিল সে। শাস্তি প্রয়োজন তার। যে মানুষ টা তার জন্য এতবড় শাস্তি বরণ করে নিলো; তাকে অন্ধকারে রেখে এই আলোতে সে থাকবে কি করে? এতগুলো সৈন্য দুটো বন্দী কে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলো গাড়ির দিক। কর্নেল নুরুল আলম সিদ্দিকী মুখশ্রী আজ ঝলমলে। এই অর্জন তাকে এত বছরের উৎকণ্ঠা কে দূরে ছুড়ে দিল। এতবছর যে আফসোস টা বুকে নিয়ে দগ্ধ হচ্ছিলো, আজ সেই আফসোসের অর্ধেকংশা হাতের মুঠোয়। আর অর্ধেকাংশ যে কখনোই ফুরাবার নয়।
কামিনী বেগম দেখছিলেন দুটো বন্দী কে। করিডরে দাঁড়িয়ে হাঁসফাঁস করছিলেন তিনি। ছুটে যেতে মন কেমন করছে তার। একবছরের ছোট্ট আদিল আজ তাগড়া যুবক। দৌড়ে বুকে জড়িয়ে নেওয়ার বড় স্বাদ জেগেছে। অপারগতা তার অশ্রু হয়ে ঝরছে। যখন বুঝলেন এরপর আর দুজন কে তিনি দেখতে পাবেন না; স্থান, কাল, পরিস্থিতি ভুলে কামিনী বেগম ছুটতে লাগলেন। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে দাঁড়ালেন দরজা ধরে। এই বয়সে অসুস্থ শরীরে দৌড়ানো হয়তো উচিত হয়নি। ক্রমশ শ্বাসকষ্ট তার বেড়ে যাচ্ছিল। তারা গাড়ির খুব নিকটে, কামিনী বেগমের ভেতর টা হুহু করে উঠলো। এগোতে না পেরে তিনি ভেতরে ভেতরে দাপাতে থাকলেন। উপর ওয়ালা হয়তো তার সহায় ছিলেন, হাঁটার শক্তি পেলেন তিনি। শক্তির অপব্যবহার করে তিনি আবার ছুটতে লাগলেন। এবার আর ভুল করলেন না। অর্ধেক পথ পেরিয়ে যতটা সম্ভব গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠলেন,
~ নুরুল!
নিস্তব্ধ পরিবেশে শব্দ টা ছড়িয়ে যেতে সময় লাগলো না। নুরুল আলম সিদ্দিকী হাঁটা থামিয়ে দিলেন। অতি পরিচিত কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। কিন্তু অনল মাহমুদ ফিরে তাকালেন না। ভালোবাসার মানুষটার মুখে অন্য একটি নাম শোভা পাচ্ছে। বুকটা হয়তো অসংখ্য ছিদ্র হলো, হৃদপিন্ড হয়তো স্পন্দন নেওয়া বন্ধ করে দিলো, দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। আফীফ দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। কামিনী বেগম বুকে হাত দিয়ে হাপাচ্ছেন ছেলের বুকে। নুরুল আলম সিদ্দিকী একপলক অনল মাহমুদের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নিজের মাঝেই লুকিয়ে রইলেন। চোখ কখনোই মিথ্যে বলে না। এই যে তিনি দেখছেন অনল মাহমুদ নামক কঠোর মানব দগ্ধ হচ্ছেন; মন সায় দিচ্ছিলো না। নুরুল আলম সিদ্দিকী নিজ অবস্থানে থেকেই বলে উঠলেন,
~ মিসেস কামিনী আপনার এখানে আসা একদম উচিত হয়নি। ক্যাপ্টেন আফীফ মুনতাসির আপনি নিজ অবস্থানে আসুন। ডিউটিরত নিয়ম ভঙ্গ করবেন না।
আফীফ চাপা শ্বাস ফেলে কামিনী বেগম কে ছেড়ে দিলো। ঠিকঠাক ভাবে দাঁড় করিয়ে পূর্বের অবস্থান নিতেই অনল মাহমুদ হুট করে বলে উঠলেন,
~ আমি একটু উনার সাথে কথা বলতে পারি? দু মিনিট সময় দিন!
কামিনী বেগম সে কথার তোয়াক্কা না করে ছুটে গেলেন আদিলের কাছে। কাঁপা কাঁপা হাত তুলে দিলেন আদিলের গালে। একটু বেশীই হয়তো আবেগী হয়ে গেছেন। দু গাল চেপে আদিল কে নিচু করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতেই আফীফের মুখশ্রী কঠোর থেকে কঠোর হয়ে গেল। আদিল নিশ্চুপ, শান্ত। কামিনী বেগম খানিক আপ্লুত কন্ঠে বললেন,
~ আমার সেই ছোট্ট আদি তুমি? এই দুটো হাত দিয়ে তোমাকে সর্বপ্রথম ছুঁয়ে ছিলাম।
সেই আদি আজ এতবড় হয়ে গেছে? আমাকে চিনো? আমি , আমি তোমার…
থেমে গেলেন কামিনী বেগম। মুখে হাত চেপে দূরে সরে গেলেন। কি বলতে যাচ্ছিলো সে? ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামী, ছেলের দিকে তাকালেন; বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দুজন। ভ্রু কুঁচকে গেল তাঁর। আফীফ অবাক মিশ্রিত অস্পষ্ট স্বরে বললো,
~ তুমি কথা বলতে পারছো আম্মা?
এবার যেন চমকালো কামিনী বেগম, আদিল। নিজ গলায় হাত দিয়ে ব্যাপারটা ধরতে পেরেই উল্লাসিত ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ালেন কামিনী বেগম। কালকে রাতের মিনি স্ট্রোক তার গলার স্বর ফিরিয়ে দিয়েছে। অথচ এত কথা বললো ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি!
আদিল অবাক হয়েছে আফীফের মুখে আম্মা ডাক শুনে। এক ছুটে তার চতুর মস্তিষ্ক বুঝে গেল হুট করে এই আত্মসমর্পণের কারণ। আদিল খানিক মায়া মায়া চোখে আফীফ কে দেখলো। তবে বেশীক্ষণ স্থির রইলো না। অনল মাহমুদ আকস্মিক কামিনী বেগমের হাত ধরে কাছে টেনে নিলেন। পাঞ্জাবির পকেটে ছোট্ট রিভলবার টি থাকতে পারে কেউ ধারণা করতে পারে নি। বেশ কিছুটা দূরে সরে গেলেন অনল মাহমুদ। নূরুল আলম সিদ্দিকী শুকনো ঢোক গিললেন। কন্ঠ খানিক খাদে নেমে এসেছে তার,
~ মি. মাহমুদ আপনি এমন কিছু করবেন না, আমরা ওপেন শুট করতে বাধ্য হবো। মিসেস কে ছেড়ে দিন। ছেড়ে দিন উনাকে। মি. মাহমুদ আবারো বলছি ছেড়ে দিন।
আফীফের চোখ ক্রমশ রক্তিম হয়ে উঠছে। নিজের মা’য়ের এমন পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে পারছেন না তিনি। বন্দুক উঠিয়ে অনল মাহমুদের দিকে তাক করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
~ ভালো ভাবে বলছি আমার আম্মা কে ছাড়ুন। লিভ হার ফাস্ট! আদারওয়াইজ আই উইল শুট ইউ। মি. মাহমুদ এক থেকে পাঁচ গুনবো।
অনল মাহমুদ আফীফের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। একপলক কামিনী বেগমের ভয়হীন মুখশ্রী দেখে অদ্ভুত গাম্ভীর্য নিয়ে বলে উঠলেন,
~ অনল মাহমুদের জীবনে একজনই নারী ছিল, যে ক্ষমতা রাখতো অনল মাহমুদের না কে হ্যাঁ তে পরিনত করার। সেই নারীর বিরহেই অনল মাহমুদ প্রতি রাতে পড়ে থাকতো মদের গ্লাস নিয়ে, একেরপর এক খারাপ কাজে লিপ্ত হতো। সেই নারী তুমি! তুমি নারী ভয়ংকর কামিনী ফুল!
থামলেন অনল মাহমুদ। কামিনী বেগমের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রকণা, বুকটা খা খা করছে। অনল মাহমুদ রক্তিম চোখ মেলে আফীফের ট্রিগার চেপে ধরা হাত দেখলো। পরক্ষণেই বাঁকা হেসে রিভলবারে চাপ দেওয়ার ভঙ্গিমা করতেই পর পর ছটা বুলেট বুকে এসে বিধলো! সাদা পাঞ্জাবি ছেয়ে গেল লাল রক্তে। তখনও অনল মাহমুদের ঠোঁটের ভাঁজে হাসি। জমিনে লুটিয়ে পড়লেন অনল মাহমুদ মাহমুদ। কামিনী বেগমের বিস্মিত, স্তব্দ , ব্যাথা মিশ্রিত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলেন,
~ এতদিন মনের মাঝে বিশ্বাস ছিল আমার কামিনী ফুল কারো বুকে মুখ গুঁজতে পারে না। পারে না কারো সাথে সংসার গড়তে। সম্পূর্ণ ভুল আমি! অনল মাহমুদ এতটা বছর বুকের ভেতর যে ভালোবাসা টাকে আঁকড়ে ছিল তার মুখে অন্য কারো নাম সেই বুকেই জ্বলন ধরায়। অন্ধকার কারাগার বা ফাঁসির দড়ি কখনোই অনল মাহমুদের যোগ্য শাস্তি হতে পারে না। সন্তানের ছুড়ে দেওয়া বুলেট পিতার বুক ঝাঁঝরা করলো কামিনী ফুল। কিন্তু ছেলেটা মস্ত বড় ভুল করেছে। এই বুকে তো তুমি থাকো, সেই বুকটাই কেন?
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। আকাশ বাতাস যেন এবার সত্যিই থেমে গেছে। অস্পষ্ট স্বরে অনল মাহমুদ আবার বলে উঠলেন,
~ নারী তুমি বলিষ্ঠ পুরুষকে ভাঙতে সক্ষম! নারী তুমি শখের পুরুষের প্রাণ নিতে সফল! তবুও নারী তুমি পুরুষের বুকেই থাকো! বিদায়!
নিঃশ্বাসের ধমকে বুক আর উঠানামা করলো না। জড়ানো কন্ঠের বানী আর শোনা গেল না। দেহটা জমিনের বুকে পড়ে রইলো কয়েক’শ লোকের উন্মুখ দৃষ্টির সম্মুখে। ঠিক তখনই একটি শব্দ, ছুটে চলা পাখপাখালির ঝাঁক ভয় যেন বেড়ে গেল! প্রকৃতি এক দলা বাতাস ছুটিয়ে নিষ্ঠুর প্রেমিকের ছন্দপতনের সাক্ষী হয়ে হাসতে লাগলো! আহা জীবন! আজ আছি কাল নেই! তবুও কত ছুটে চলা!
রক্তাক্ত অনল মাহমুদের মাথাটা কারো কোলে! স্তব্দ প্রকৃতি এখনো পাল্টায় নি। বাবার মাথা টা নিজ উরুর উপর রেখে অনিমেষ তাকিয়ে আছে আদিল। শান্ত রক্তিম চোখে কতশত অভিযোগ, অভিমান, অনুরাগ! এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা পড়ে রইলো সে! ভালোবেসে আগলে রাখার কেউ রইলো না। কেউ না! আদিল চোখ তুলে একপলক আফীফের দিকে তাকালো। আফীফের মনে হলো ওই দৃষ্টি তাকে এফোড়ওফোড় করে দিবে। কেন মনে হলো সে বুঝলো না। রাতের শেষ ভাগে সেই সমঝোতা টা তার মনে আদিল মাহমুদের প্রতি কিছুটা হলেও অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। মনে হয়েছে কোথাও একটা কিন্তু রয়েছে। সেই অনুভূতি থেকেই হয়তো আজ ভঙ্গুর আদিল তার হৃদয়ে দোলা দিতে পেরেছে। তবুও আফীফ স্ট্যাট বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে রইলো। আদিলের পাশে নিস্তেজ বসে আছে মিরা। তার এই আদিল কে দেখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কিসব অদ্ভুত ভাবনা মাথায় আসছে। একবার ইচ্ছে করছে আফীফ কে মেরে দিতে, আবার ইচ্ছে করছে আদিল কে মেরে নিজে মরতে। নিজের মনের খোঁজ সে আদৌ পেল না, ঠিক কি চায় মন!
স্বামীর বুকে লেপ্টে আছেন কামিনী বেগম। থরথর করে কাঁপছেন তিনি। বড় বড় চোখ রক্তাক্ত অনল মাহমুদের উপর। বন্ধ চোখের পাতা ভেজা, মুখশ্রী তে অদ্ভুত মিশ্র স্নিগ্ধতা ও ব্যাথার ছাপ, শান্ত ভঙ্গিমায় ঘুমিয়ে আছে লোকটি! কামিনী বেগমের মনে হচ্ছে তার বুকে কেউ অনবরত ছু*রি চালাচ্ছে। তাকে দগ্ধ করছে প্রতি সেকেন্ডে। নুরুল আলম সিদ্দিকী শক্ত , কঠোর মুখশ্রী তে স্ত্রী কে আগলে রেখেছেন। কোথাও একটা তার বুকেও চিনচিন করছে। নিজ অর্ধাঙ্গিনীর চোখের কাতরতায় অন্যকেউ; এ ব্যাথা সহ্য হওয়ার নয়! নিজ ভালোবাসার মন কাঁদছে অন্য কারো যাতনায়, এ দুঃখ কোথায় লুকাবেন তিনি? তবুও দাঁতে দাঁত কামড়ে আগলে রেখেছেন। প্রথম ভালোবাসা টা হয়তো কেউই ভুলতে পারে না! চাপা শ্বাস ফেলে তিনি আফীফ কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
~ ক্যাপ্টেন আফীফ মুনতাসির, লাশ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে মি. আদিল মাহমুদ কে নিয়ে আসুন। জলদি!
তিনি আর দাঁড়াতে চাইলেন না। মিসেস কামিনী বেগম কে নিয়ে সরে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করতেই বাঁধা দিলেন কামিনী বেগম। করুণ চোখে তাকালেন স্বামীর দিকে। নুরুল আলম সিদ্দিকী দাঁড়িয়ে পড়লেন, চোখ বুজে চাপা শ্বাস ফেলে মত দিলেন স্ত্রীর ইচ্ছেই। অর্ধাঙ্গিনী যদি পোড়াতে চায়, পোড়াক! মিরা উঠে দাঁড়ালো, আফীফের পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কিছু বলেই উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,
~ নিয়ে যান উনাকে, এরা বিপজ্জনক। এদের আলো সহ্য হয়না, অন্ধকারেই মানায়। নিয়ে যান এদের। মনের জ্বালা মিটুক।
একপলক মিরার দিকে তাকিয়ে আদিল বাবার মাথাটা আস্তে করে নিচে রাখলো। উবু হয়ে কপালে পর পর তিনবার ঠোঁট ছোঁয়ালো। হাত বাড়িয়ে অনল মাহমুদের হাত থেকে রিভলবার নিজের হাতে তুলে নিতেই আফীফ শক্ত কন্ঠে বললো,
~ বাড়াবাড়ি করবেন না মি. আদিল। রিভল*বার নিচে রাখুন। নতুবা শুট করতে বাধ্য হবো।
আদিল কথা শুনলো না, রিভল*বার টি খুলে আফীফের দিকে বাড়িয়ে দিতেই চমকালো আফীফ। ভেতরে বুলেট নেই! নুরুল আলম সিদ্দিকী স্ত্রীকে আরেক টু শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরলেন। ভালোবাসা কি নিষ্ঠুর খেলা খেললো! আফীফ অদ্ভুত নজরে বাবা-মা কে দেখলো, আরেকবার জমিনে লুটিয়ে থাকা অনল মাহমুদ কে। চতুর মস্তিষ্ক ইঙ্গিত পেয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন করার মুহুর্ত সঠিক নয়। লাশ কে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে আফীফ আদিল কে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। ঠিক তখনি খুব করে কারো অনুপস্থিতি টের পেল। আজ তার পাশে কেউ নেই! কেউ এই জয় নিয়ে বাচ্চাদের মতো একটু পর পর উল্লাসের বানী ছড়াচ্ছে না। স্থান ভুলে কেউ তার বুকে ঝাঁপিয়েও পড়ছে না। আফীফের বুকের ব্যাথা হু হু করে কয়েকশো গুন বেড়ে গেল। পাশে বসা আদিলের দিকে তাকিয়ে বললো,
~ আপনার আর আমার মধ্যে এই মুহুর্তের পার্থক্য কি জানেন? আপনি কষ্ট পাচ্ছেন একজন খু*নির জন্য, আর আমি কষ্ট পাচ্ছি একজন বীর সৈনিকের জন্য! যে আপনার বাবার হিংস্রতার স্বীকার।
আদিল ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো আফীফের কথায়। প্রাণহীন সেই হাসি আফীফের নজরে এলো না। গাড়ি এখনো ছাড়েনি। বিশাল জ্যাম গাড়ির। খানিক দেরীই হবে। এরমধ্যে ভেসে এলো পরিচিত এক মেয়েলি ভৎসর্না,
~ জন্মদাতার বুক ঝাঁঝরা করে অনুভূতি কেমন মি. আফীফ মুনতাসির!
কন্ঠটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আদিলের হাসি চওড়া হলো। এই কন্ঠস্বর টা তার এই মুহুর্তে খুব ইচ্ছে করছিল শুনতে। যে কথা মুখ ফুটে সে বলতে পারছিল না, খুব করে চাচ্ছিলো কেউ এসে বলুক। আফরা ইবনাত মেয়েটা ইচ্ছে পূরণ করেই দিল। আফরা’র কথা ঠিক হজম হলো না আফীফের। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
~ আপনি এখানে? কি বললেন এটি?
আফরা অনুমতি না নিয়েই আফীফের সম্মুখে বসে পড়লো। পায়ের উপর পা তুলে দু হাত একত্রে মুঠো করে মুচকি হাসলো। বললো,
~ জন্মদাতার বুক ঝাঁঝরা করে সহসৈনিকের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিলেন! জয়ের জন্য শুভকামনা!
পরপর নিজ ভাবনা গুলো সাজালো আফীফ। মায়ের আচরণ, বাবার নির্লিপ্ততা, অনল মাহমুদের উপচে পড়া বেদনাদায়ক চাহনি, আত্মসমর্পণ, বুলেট হীন বন্দুক, আদিলের তাচ্ছিল্য, আফরার উক্তি; ক্যাপ্টেন আফীফ মুনতাসির এক নিমিষেই একত্রে মিশিয়ে উত্তর পেয়ে গেল। বড়সড় এক ধাক্কা খেল সে। থমথমে হয়ে গেল তার মুখশ্রী। অদ্ভুত এক পীড়া টের পেল বুকে। জন্মদাতা! শব্দটা কি সহজেই বলে দিল মেয়েটি, তাহলে সে কেন সহজ ভাবে নিতে পারছে না? নেত্র পল্লবে ভেসে উঠলো অনল মাহমুদের রক্তাক্ত মুখশ্রী। আফীফ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো। পরক্ষণেই যখন জিয়াউলের সেই কাপড়ে ঠাসা পেটের উপর অবহেলিত সেলাইয়ের দৃশ্যটা চোখে ভাসলো; এতক্ষণের যন্রণাটা এক ছুটে পালিয়ে গেল। সামনের মেয়েটির তাচ্ছিল্যের জবাব দিতে বলে উঠলো,
~ আপনাকে একবার বলেছিলাম, দোষী জন্মদাতা হলেও আফীফ মুনতাসিরের নিশানা ভুল হবে না। ক্যাপ্টেন আফীফ মুনতাসির কখনোই অন্যায়ের সাথে আপোষ করেনি, করবেও না! সে নিজের বুক ঝাঁঝরা করে হোক বা আপনার বুক! ওই বুকে কিন্তু এক আফীফ মুনতাসির কেই চাই!
আফীফ মুচকি হাসলো। আফরা ঠোঁট বেঁকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। মনের ভেতর প্রশান্তি দোল খাচ্ছে। আফীফের এই শক্ত খোলস দেখতে ভালো লাগে। আফীফের চোখে চোখ রাখলো আফরা। শ্বাস ফেলে নিম্ন কন্ঠে বলে উঠলো,
~ আমার কাছে আপনি খুবই নগন্য। তবে কেন মনে হয় এই নগন্যের মাঝে লুকিয়ে আছে আমার না পাওয়া হাহাকার, নির্ঘুম কালো রাত, সহস্র ফোঁটা রক্তিম অশ্রু?
নির্লিপ্ত চাহনিতে আফরার হেঁটে যাওয়া দেখলো আফীফ। নিঃশব্দে ছুটে চললো গাড়ি। ক্রমশ দুরত্ব বাড়ছিল, আফীফ অনুভূতিহীন চোখ রাখছিল প্রকৃতির মাঝে। প্রকৃতি আজ সত্যিই নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছে!
পরপর কলিংবেলটা বেজেই চলেছে। আগুন্তক থামার নাম নিচ্ছে না। ঘর থেকে দৌড়ে এলো অথৈ। এই সময় টাতে স্বামীর সাথে গল্পগুজবে কেটে যায়। হঠাৎ কে এলো ধরতে পারলো না। মাথায় উড়না চাপিয়ে দরজা খুলে দিল অথৈ। কে এসেছে না দেখেই আন্তরিক গলায় বলে উঠলো,
~ এতক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য দুঃখিত আ…
বলা হয়ে উঠলো না। সম্মুখের মানুষ টিকে দেখে কন্ঠস্বর রোধ হয়ে আসে। বুকের ভেতর আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। এতদিন পর বোন কে দেখে আফরা’র মাঝে কোনো পরিবর্তন ই দেখা গেল না। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
~ কিরে বোন, ভেতরে যেতে দিবি না নাকি? বোনের সংসার দেখতে এলাম!
অথৈ কে সরিয়ে নিজেই ঢুকে পড়লো আফরা। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখলো। বাসাটা বেশ সুন্দর, সাজানো গুছানো! উৎফুল্ল হয়ে বললো,
~ বাহ আমার বোন তো বেশ গোছানো? বর কই?
এতক্ষণ অপরাধীর ন্যায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে ছিল অথৈ। এবার আর থাকতে পারলো না। দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আফরা’র বুকে। আফরা আগলে নিলো না। দাঁড়িয়ে রইলো কাট হয়ে। অথৈ কান্না ভেজা কন্ঠে বললো,
~ আমাকে ক্ষমা করে দাও আপু। আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি। তোমাকে না জানিয়ে এতবড় সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওই মানুষ টার অবস্থা এতটা খারাপ ছিল আমি দ্বিতীয় কিছু ভাবতে পারিনি। শুধু মাত্র আমার জন্য লোকটা এতটা বছর ঘর বন্দী থেকে এতটা কষ্ট ভোগ করেছে। পাগল হয়ে দাপিয়েছে। সুযোগ আর হাত ছাড়া করিনি। তুমি তখন আমার থেকে দূরে। সুযোগ হয়ে উঠেনি বলার। ভয় পেয়েছিলাম খুব, তুমি যদি না মেনে নাও! খুব স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম আপু। ভালোবাসার জন্য তোমার কথাও ভাবিনি। আমাকে ক্ষমা করবে তো আপু?
আফরা এবার ধীর গতিতে হাত রাখলো অথৈ’র পিঠে। হাসি ফুটলো অথৈ’র ঠোঁটের ভাঁজে। আফরা সেই হাসি দেখলো। এত গুলো খু”ন কিভাবে করলো প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না আফরা। যে আড়ালে থাকতে চায় তাকে থাকতে দেওয়া উচিত। সে জেনেছে জানুক, বলার প্রয়োজন তো নেই। এতে হয়তো সম্পর্কে জটিলতা চলে আসবে। আফরা বেশীক্ষণ দাঁড়ালো না। একটু খানি আলাপচারিতা করেই বেরিয়ে এলো। আফরা চলে যাওয়া মাত্রই অথৈ দৌড়ে জড়িয়ে ধরলো অনিক কে। ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে উঠলো। আফরা’র ক্ষমার মাঝেও অভিমান টের পেয়েছে অথৈ। যা তাকে কষ্ট দিচ্ছে। অনিক সহধর্মিণী কে আগলে নেয় বুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে, কপালে ঠোঁটের পরশ দিয়ে ভালোবাসা জানান দেয়। ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয়। আর কি লাগে?
আজ ঢাকা ফিরে যাবে আফরা! এই বান্দরবানে আর ফিরে আসবে না! সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলো আফরা। বান্দরবানের মাটির ঘ্রাণ শুষে নিচ্ছে। খুব দ্রুত তাকে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। ভেবে রিকশা ডেকে উঠে পড়লো আফরা। মৃদু বাতাসে রিকশায় চেপে বেশ লাগছে আফরার। সেই ভালো লাগা টাকে বাড়িয়ে দিয়ে ফোন এলো। ‘পাপা’ নাম দেখে ঝটপট রিসিভ করলো আফরা। অপর পাশ থেকে ভেসে এলো,
~ আম্মু, তোমার এত বছরের পরিশ্রমের ফল আজ পেয়েছো। অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
অনিমেষ মির্জা উৎফুল্ল কন্ঠে কথা টা বলতেই আফরা হাসলো। হেসে জবাব দিল,
~ তুমি ছাড়া সম্ভব হতো না পাপা!
~ কে বলেছে, তোমরা যেভাবে এগোচ্ছিলে ঠিক পারতে। আমি শুধু সময়টা এগিয়ে নিয়ে এসেছি। আমার মায়ের জয় হয়েছে, আজ আমার গর্বের দিন!
~ আই লাভ ইউ পাপা!
~ হয়েছে আহ্লাদ দেখাতে হবে না। অনেক হয়েছে দূরে থাকা। এতটা বছর তো থাকলে। এবার পাপার কাছে ফিরে এসো। তুমি ছাড়া আমার যে কেউ নেই!
~ খুব শীঘ্রই ফিরছি পাপা, তুমি ছাড়া আমারও তো কেউ নেই। লাগবে ও না আর। আমার তুমি থাকলেই হবে।
মেয়ের কথায় অনিমেষ মির্জার চোখ চকচক করে উঠলো। দ্বিগুণ উল্লাসিত কন্ঠে বললেন,
~ সর্বপ্রথম আমার সাথে দেখা করবে আম্মু। আমি নিবাসে থাকবো! সাবধানে আসবে, আমাদের গাড়ি করেই আসবে। এখন আর লুকোচুরি করে কি হবে?
অনিমেষ মির্জার কথায় আফরার হাসি চওড়া হয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয় পাপার ছবির দিকে। একমাত্র এই মানুষটিই তাকে সরল ভাবে ভালোবাসে, আহ্লাদ করে।
সময় চলে গেলে ঘন্টাখানেক। গোধূলি বিকেলের শুরু। আফরা সরাসরি কলিংবেল না চেপে দরজায় টোকা দিল। হয়তো কাছেই ছিল, দরজা খুলে দিল নুরুল আলম সিদ্দিকী। এখনো সেই ইউনিফর্ম পরিহিত। নুরুল আলম সিদ্দিকী ‘র পেছনে আফীফ এসে দাঁড়িয়েছে। তারাও এখন ঢাকার দিক রওনা হবে। আফরা নিজের হাতব্যাগ থেকে সাদা দুটো কাগজ বের করে নুরুল আলম সিদ্দিকী ‘র দিকে বাড়িয়ে দেয়। নুরুল আলম সিদ্দিকী ভ্রু কুঁচকে রয়, আফরা একপলক আফীফ কে দেখে বলে উঠে,
~ মি. জিয়াউলের চিঠি। একটা আপনার, আরেকটা তার বাবা-মায়ের জন্য!
নুরুল আলম সিদ্দিকী হাতে তুলে নেন। অপলক তাকিয়ে থাকেন কাগজ দুটোর দিকে। আফীফ ভরসা যুক্ত হাত রাখে বাবার কাঁধে। নুরুল আলম সিদ্দিকী মুচকি হেসে হাঁটা ধরেন ভেতরের দিকে। তা দেখে আফরা কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠে,
~ কেউ একজন উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের উক্তি শুনিয়ে বলেছিল,
Sweet are the uses of adversity- দুঃখের প্রয়োজনীয়তাও মধুর!
সেই প্রয়োজনীয়তা এতটাই মধুর যে সে আমাকে এতটা বছর দুঃখেই ভাসিয়ে রাখলো!
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬৯+৬০
নুরুল আলম সিদ্দিকী চমকে পিছু ফিরলেন। পড়ে যেতে নিয়েও দেয়াল ঠেসে নিয়ন্ত্রণ করলেন নিজেকে। আফরা মুচকি হেসে হাঁটা ধরলো। কয়েকপা যেতেই গাড়ি এসে সামনে দাঁড়ালো। আফরা ঘুরে নুরুল আলম সিদ্দিকী’র হতভম্ব মুখশ্রী দেখে উঠে বসলো গাড়িতে। তৎক্ষণাৎ ছুটতে শুরু করলো গাড়ি। নুরুল আলম সিদ্দিকী গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারলেন না। পারলেন না নাম ধরে ডাকতে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে একবার কাগজ দুটো দেখে, আরেকবার বুকে হাত চেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আফীফ ফ্যালফ্যাল করে ঘটনা দেখতে লাগলো। এগিয়ে যাওয়ার সাধ্য তার হলো না। কি হলো এমন?