হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬৩+৬৪

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬৩+৬৪
Tahrim Muntahana

দুটো খাটিয়া পাশাপাশি অবস্থান করছে। সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশ দুটোর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। চট করে কেউ চিহ্নিত করতে পারবে না দেহ খানা কার। শত শত সেনা দাঁড়িয়ে আছে। জেনারেল আকা’র নেতৃত্বে সম্মাননা পর্ব শেষ হলেই জানাযা পড়ানো হবে, লাশ নিয়ে যাওয়া হবে তাদের গন্তব্যে‌‌। এখনের অপেক্ষা শুধু দুটো মানুষের। তাদের উপস্থিতি বিহীন কার্য সম্পাদন সম্ভব নয়।

রাতের প্রহর কাটছে বিবস হয়ে। চাঁদনী রাতের জ্বলজ্বল করা চাঁদ খানা অন্ধকার দূরীভূত করতে ব্যস্ত। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে সাদা কাপড়ে। এতে করে কাপড় খানা যেন একটু বেশীই জ্যোতি ছড়াচ্ছে। জানান দিচ্ছে তারা না থেকেও রয়েছে সবার মাঝে। এত এত সেনা, নিহত’র আত্মীয় মাঠটিকে পরিপূর্ণতা দান করেছে, তবুও প্রগাঢ় এক নিস্তব্ধতা। সৈনিকের ত্যাগের স্মরণেই হয়তো এই নিরবতা, মৌনতা। যুদ্ধটা মনের মধ্যে এখনো চলছে। কঠিন সৈনিকের চোখ ফেটে অশ্রু গড়ানোর বদল মুখে ফুটে উঠছে কঠোরতা, চোখে ফুটে উঠছে হারানোর এক অমলিন ব্যাথা। সেনানিবাসের অতি পরিচিত ‘ফানি ম্যান’ নামক হাসিখুশি সৈন্য টা আর তাদের মাঝে নেই। এই কথাটা শুনতেও তারা নারাজ। তাই তো দৃষ্টিতে রুক্ষতা! নেই তবুও আছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাতের বিবস প্রহর কাটছে ধীর গতিতে। সময়ের আজ যেন তাড়া নেই। ঘড়ির কাঁটায় নয়টা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। জেনারেল আকা একজন সৈনিক কে নির্দেশ দিলেন কর্নেল নুরুল আলম সিদ্দিকী’র সাথে যোগাযোগ করতে। লাশ আর ফেলে রাখা যাবে না।‌ কেমিক্যাল আর কতক্ষণ লাশকে পচা থেকে রক্ষা করবে! তবে সৈনিকের আর কষ্ট করে কথা খরচ করতে হলো না, কর্নেল নুরুল আলম সিদ্দিকী ও ক্যাপ্টেন আফীফ মুনতাসির এসে উপস্থিত হয়েছেন। আজ কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই, আফীফ এগিয়ে যায় লাশের দিকে। দুটো খাটিয়া পাশাপাশি দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় তার। কন্ঠকে নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রশ্ন করে,

~ দুটো খাটিয়া কেন এখানে?
জেনারেল আকা এগিয়ে এসে আফীফের পাশে দাঁড়ান। কাঁধে হাত রেখে বলেন,
~ ইয়াং ম্যান, অনল মাহমুদের লাশ‌ও এখানে রয়েছে।
বড় সড় এক ধাক্কা খায় আফীফ। ঠিক বুঝতে পারে না কারণ। একজন বীর সৈনিকের পাশে একজন খুনী কে রাখার মতো নির্দেশ কি করে জেনারেল দিয়েছেন আফীফ সেটাই ভেবে পায় না। গমগম কন্ঠে বলে উঠে,
~ একজন বীর সৈনিকের পাশে একজন অপরাধী’র লাশ রাখার নির্দেশ আপনি দিয়েছেন স্যার? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।

আপনার মনে হচ্ছে না এতে আমাদের বীর সৈনিক কে অপমান করা হচ্ছে?
জেনারেল আকা থতমত খেয়ে গেলেন। আফীফ একপলক জিয়াউলের বাবা-মা’র দিকে তাকালো; তারা যে কেউ ই এই কাজ টি সমর্থন করছে না আফীফ স্পষ্ট বুঝতে পারছে। ছেলের লাশের পাশে তার‌ই খুনীর লাশ কোন বাবা-মা সহ্য করতে পারবে? জিয়াউলের মা এখন পর্যন্ত অনবরত কেঁদে যাচ্ছেন। এক মায়ের কোল খালি হয়েছে আর এখানে তামাশা হচ্ছে দেখে নুরুল আলম সিদ্দিকী খানিক রেগে গেলেন। তবে সম্পূর্ণ টাই আফীফের উপর ছেড়ে দিয়ে তিনি চুপ র‌ইলেন। জেনারেল আকা প্রশ্নের উত্তরে নতুন করে কিছু সাজাতে পারলেন না। মিনমিনে কন্ঠে বললেন,

~ অনল মাহমুদ তোমার জন্মদাতা আফীফ!
সবটা ক্লিয়ার আফীফের কাছে, সবটা। নুরুল আলম সিদ্দিকী’র কানে পৌঁছানো মাত্র তিনি চমকালেন। আফীফের দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন একদম স্বাভাবিক আফীফ। চাপা শ্বাস ফেলে নুরুল আলম সিদ্দিকী বুকে হাত রাখলেন, চিনচিনে ব্যাথা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছেলে হারানোর শোক বুঝি তাকেও পেতে হবে? তার ভাবনা সমাপ্তিতে পৌঁছাতে পারলো না তার পূর্বেই আফীফের শান্ত কন্ঠ ভেসে এলো,
~ তো? একজন সৈনিকের জন্মদাতা বলে তার অপরাধ মাফ করে দিবেন? ক্যাপ্টের আফীফ মুনতাসির কে জন্ম দিয়েছে বলে সে একজন অপরাধী হয়েও বীর সৈনিকের পাশে থাকার সুযোগ পাবে? আপনার নিয়ম যে উল্টো সুর করছে স্যার!

জেনারেল আকা মাথা নত করে নিলেন। ভুল তার, সে স্বীকার করে নিয়েছে। নিজ হাতে জন্মদাতা কে ওপেন শুট করায় তিনি ভেবেছিলেন তার একজন সৈনিকের জন্য এতটুকু করতেই পারেন। তবে এতে করে যে তিনি আরেকজন সৈনিকের সাথে অবিচার করছেন সে ভাবার সুযোগ হয়নি। তবে একজন সৈনিকের নিকট জবাবদিহিতা দিতে নারাজ সে। নিজের অবস্থান ধরে রাখতে বললেন,
~ নিজের অবস্থান ভুলে যেও না আফীফ। লাশ ওপেন শুটে হয়েছে, দায়িত্ব আমাদের‌ই, তার নিকটস্থ আদিল মাহমুদ ছাড়া কেউ নেই। সে এখন বন্দি। আর আছো তুমি, তাই এ ব্যবস্থা করা হয়েছে।
~ বীরসেনা মেহরাব মুনতাসির কেন সেই সুযোগ পেল না? উত্তর আছে আপনার কাছে? শুধু মাত্র কয়েকটা ছবি দেখে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসি কাঠে ঝুলানো হয়েছে; এর কৈফিয়ত যদি আমি সরকারের কাছে চাই? সরকার আমাকে সে কৈফিয়ত দিবে তো? একজন সৈনিকের মতো শ্রদ্ধা তো তাকে দেওয়া হয়নি। লাশ টাকে অত্যন্ত হেলায় ফেলে রাখা হতো যদি না কর্নেল নুরুল আলম সিদ্দিকী সময় মতো না পৌঁছাতো। আপনি কোন দায়িত্বের কথা বলছেন স্যার?

পরিবেশ গমগম করে উঠলো। জেনারেল আকা জবাব দিতে হিমশিম খেলেন। সেও একজন সরকারের লোক, তাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয় সে তাই করে। স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
~ তুমি যেমন সরকারি লোক, আমিও সরকারি লোক। আমাদের একটি নিয়মের মধ্যে থাকতে হয়। তখন প্রমাণ এতটাই শক্ত ছিল যে নিশ্চিত করে দোষী ছিলেন শেখ মেহরাব মুনতাসির। কিন্তু এতবছর পর সত্যি সামনে এলো, সবটাই অনল মাহমুদের সাজানো ছিল। আমরা হেল্পলেস ছিলাম আফীফ। আর তুমি একজন সৈনিক, সরকারের সিদ্ধান্তে প্রশ্ন তুললে তোমার ক্যারিয়ারে আঁচ আসবে। কথা বাড়িয়ো না আফীফ, জানাযার ব্যবস্থা করো!
আফীফ চুপচাপ হয়ে গেল। তার আর কিছুই করার নেই বীরসেনার জন্য। প্রমাণ স্বরূপ তাঁকে দোষী করা হয়েছে, কারোর হাত ছিল না। তবে সে কিছুতেই জিয়াউলের পাশে অনল মাহমুদের লাশ‌ রাখতে দিবে না। মুখ ফুটে কিছু বলবে, পূর্বেই মেয়েলি প্রশ্নাত্মক গমগমে কন্ঠ ভেসে আসে,

~ শেখ মেহরাব মুনতাসিরের একমাত্র উত্তরাধিকারী শেখ আফরা মুনতাসির যদি আপনাদের যোগ্যতার উপর প্রশ্ন তুলে? সরকারের অপরাগতা’র দিকে আঙুল তুলে? তাকেও কি ফাঁসিকাঠে ঝুলাবেন? নাকি ওপেন শুটের নির্দেশ দিবেন? আপনাদের সরকারের তো অ’প’রা’ধীর রক্ত সহ্য হয় না, সহ্য হয় সৎ মানুষের রক্ত।
ছোট খাটো এক বিস্ফোরণ বয়ে গেল। নুরুল আলম সিদ্দিকী ব্যতিত কাছেপিঠের অফিসার গণ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে র‌ইলেন আগন্তুক মেয়েটির দিকে। আফীফ স্তব্দ! আফরা দাঁত বের করে হাসছে। হাসিটা ঠিক তাচ্ছিল্য নাকি চঞ্চলতা’র বুঝা যাচ্ছে না। বড় বড় পা ফেলে জেনারেল আকা’র সামনে দাঁড়ায় আফরা। জেনারেল আকা নিজের বিস্ময় লুকিয়ে প্রশ্ন করে,

~ আপনি শেখ মেহরাব মুনতাসিরের মেয়ে? প্রমাণ আছে আপনার কাছে?
~ প্রমাণ লাগবে কেন?
আফরা’র ভাবালেল প্রশ্ন। জেনারেল আকা বিরক্ত হোন। শক্ত গলায় বলেন,
~ অবশ্যই প্রমাণ লাগবে। একজন বীর সৈনিকের মেয়ে হিসেবে আমরা যাকে তাকে ধরতে পারি না। শেখ মেহরাব মুনতাসিরের স্ত্রী ও আট বছরের মেয়ে সেদিন অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যবরণ করেছিল। তাহলে আপনি?
~ আপনারা আদৌ নিজেদের প্রফেশনে যোগ্য তো? নিয়েছিলেন কোনো খোঁজ? পোড়া বাড়ির ছাই দেখে ভেবেনিলেন নূন সিদ্দিকী, শেখ আফরা মুনতাসির মরে গেছে? আপনাদের ভাবনা এতটা স্ট্রং কেন? ভাবতে পারেননি ছোট মেয়েটি তো বাইরে যেতে পারে, ভাবতে পারেননি বাড়িতে হয়তো কেউ ছিল না, ভাবতে পারেন নি বাড়িটায় কেউ ইচ্ছে করে আগুন লাগিয়েছে। আপনারা শুধু ভেবেছেন একজন সৈনিককে কি করে তার পদমর্যাদা থেকে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামানো যায়, কয়েকটা ছবি দেখে ফাঁসি কাঠে ঝুলানো যায়। এই যোগ্যতা নিয়ে কথা বলেন?
জেনারেল আকা অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলেন। তবে স্থান বা সময় সঠিক নয় বলেই তিনি চুপ থাকলেন। সমঝোতা করতে বললেন,

~ মিথ্যে প্রমাণ, আপনাদের প্রতিবেশীদের স্ট্যাটমেন্ট, সময় আমাদের চোখে পর্দা টানিয়ে রেখেছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিজেদের অপারগতা স্বীকার করছে, ভুল স্বীকার করছে। এত দিনের ভুল ধারণা থেকে মানুষ কে বের করতে খুব শীঘ্রই একটি আয়োজন করা হবে। বর্তমানের কাজটি শেষ করতে দিন!
আফরা কথা বাড়ালো না। নুরুল আলম সিদ্দিকীর দিকে একপলক তাকিয়ে অনিমেষ মির্জার কাছে চলে গেল। অনিমেষ মির্জা মেয়ের অপেক্ষায় করছিলেন। আফরা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো অনিমেষ মির্জার বুকে। আগলে নিলেন তিনি। ললাটে অধর স্পর্শ করে বললেন,
~ বাড়ি যাও আম্মু, আমি কাজ গুলো শেষ করে আসছি। জমিয়ে আড্ডা হবে।
আফরা হেসে ফিরে গেল নিজের স্থানে। জেনারেল আকা সবাই কে এই মুহুর্ত টা ভুলতে সাহায্য করলেন। মাইক উঠিয়ে নিজের মতো বলে উঠলেন,

~ আজ আমাদের জন্য একটি শোকের দিন। এত বছরের যে ভুল ধারণা আমরা নিজেদের মধ্যে ঠেসে রেখেছিলাম, যাকে আমরা দেশদ্রোহী বলে অবজ্ঞা করতাম; আজ তার‌ই অপরাগতা প্রকাশ করছি। শেখ মেহরাব মুনতাসির নিজের পরিবার বিসর্জন দিয়ে , নিজেকে বিসর্জন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন দেশপ্রেমিকের হৃদয়ে দেশ বীনা অন্য কিছু নেই। অফিসার জিয়াউলের ত্যাগ আবারো প্রমাণ করে দিল সৈনিক লড়ে যাবে কিন্তু আপোষ করবে না। তার এই ত্যাগের স্মরণে ফুলের মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আহ্বান করছি কর্নেল নুরুল আলম সিদ্দিকী ও ক্যাপ্টেন আফীফ মুনতাসির কে! আপনারা এগিয়ে আসুন।‌

প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছে আফীফ। তবুও সম্মান জানিয়ে এগিয়ে গেল সে। একে একে সম্মাননা পর্ব শেষ করে জানাযা পড়ানো হলো। জিয়াউলের লাশ বাড়ির লোকের নিকট হস্তান্তর করে সরকারী নিয়মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হলো আফীফ। আশেপাশে নজর ঘুরিয়ে কাউকে খুঁজলো। না পেয়ে চাপা শ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে বসলো। মাটি দিয়ে ফিরে যাবে নিজ বাড়িতে। নুরুল আলম সিদ্দিকী নিজের জিপে উঠে সিটে মাথা এলিয়ে দিলেন। আজকের দিন টা তাকে প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির বেড়াজালে বন্দী করে রাখলো। জিয়াউলের চিঠি টা পড়া হয়নি। গাড়ি চালানোর নির্দেশ দিয়ে তিনি পকেট থেকে কাগজ টি বের করলেন। ধীর গতিতে ভাঁজ খুলে ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। হয়তো প্রস্তুত করছেন আবেগে ভেসে বেড়ানোর জন্য,

~ “বস,
প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিবো। কঠোর , শক্তপোক্ত কর্নেল নুরুল আলম সিদ্দিকী’র সাথে অনেক বেয়াদবি করেছি। আপনি মেনেও নিয়েছেন তা। কিন্তু কখনো আপনাকে অসম্মান করিনি। প্রচন্ড ভয়, অস্বস্তি নিয়ে সেনানিবাসে পা দিয়েছিলাম। কত‌ই না অবুঝ ছিলাম। সেই অবুঝ যুবকটিকে ছোট্ট শিশুর মতো হাতে ধরে শিখিয়েছেন স্যার; মা যেমন প্রথম কথা বলা শেখায়, বাবা যেমন প্রথম হাত ধরে হাঁটতে শেখায় ঠিক তেমন করেই গড়ে তুলেছেন।‌ আজকের জিয়াউল নাহলে কখনোই হতে পারতাম না। ভয়ে হয়তো পালিয়ে আসতাম। নাহলে অসুস্থ হয়ে বাদ পড়ে যেতাম। এরপর থেকে আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করায় যেন আমার ধর্ম হয়ে উঠেছিল।
এই সময় টাই আপনার কথা খুব মনে পড়ছে স্যার। আমার বোকা বোকা কথা আর শুনতে হবে না। আমার আবদার ও আর রাখতে হবে না। আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম স্যার, কিন্তু ওরা বাঁচতে দিল না। তবে মরতে একটুও ভয় পাইনি। কর্নেল নুরুল আলম সিদ্দিকী’র ভরসার মান রেখেছি আমি।

অনেক কথা লিখে ফেললাম। এখন একটা অনুরোধ করবো‌। অনান মেয়েটা খুব একা স্যার, মেয়েটা হয়তো আমাকে নিয়ে স্বপ্ন সাজাতে চেয়েছিল। আর হয়ে উঠলো না, আপনি ওকে নিজের কাছে রাখবেন? একটু ভালোবাসা দিবেন, আমার ভাগের থেকেই দিয়েন। জীবিত থাকতে হিংসা করলেও এখন তো মৃত তাই হিংসা করছি না।
আর হ্যাঁ স্যার, আপনার কাঠখোট্টা টাইপের ছেলে কিন্তু প্রেমে পড়েছে। সরাসরি বলতে ভয় লাগতো, এখন লাগছে না। আফরা ম্যামের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, সুযোগ মতো দুজন কে এক করে দিয়েন তো। আমার মা-বাবা কে একটু সাহস দিয়েন স্যার। বিদায় নিচ্ছি এখন, তার আগে একটি কথা। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি স্যার!

নুরুল আলম সিদ্দিকী আস্তে করে কাগজ টি আবার ভাঁজ করলেন, বুক পকেটে রেখে দিয়ে; কয়েকবার হাত বুলালেন বুকে। কি এক অসহ্য যাতনা হচ্ছে, মনে হচ্ছে এই মুহুর্তের থেকে মরণ ভালো ছিল। ছেলেটাকে কখনো বলা হয়নি আফীফের মতোই ভালোবাসতেন। তার নিকট যেমন আফীফের খোঁজ নিতেন, আফীফের নিকট তেমন তার খোঁজ নিতেন। এই মুহুর্তে নিজেকে রোবট মনে হচ্ছে নুরুল আলম সিদ্দিকীর। কেন তিনি এত কঠোর হলেন? তাহলে সরাসরি বলতে না পারার আফসোস টা তো সারাজীবন বয়ে নিতে হতো না! ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে, ভেতরের আর্তনাদ বাইরে বেরিয়ে আসার আন্দোলন করছে, ঘাড়ের পাশে এক ছটা ব্যাথা কেমন পিঠ বেয়ে নিচে নেমে গেল। বার কয়েক বড় সড় ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত রাখার প্রয়াস চালালেন তিনি। হয়তো আজ উপর ওয়ালা সহায় হয়েছেন। গাড়ি থেমে গেল, গন্তব্যে চলে এসেছে। টুপিটা গাড়িতে রেখেই নেমে পড়লেন নুরুল আলম সিদ্দিকী। কিছুক্ষণ পূর্বেই আফীফ এসে উপস্থিত হয়েছে। আর দেরী করলো না কেউ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাটি দেওয়ার ব্যবস্থা করলো।‌

কমে এসেছে ভিড়। নিকটস্থ আত্মীয় ছাড়া কেউ নেই। আফীফ চুপিচুপি কবরের পাশে এসে দাঁড়ায়। চারপাশ নজর বুলিয়ে দেখে, কারোর উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। উবু হয়ে বসে সে। হাত বাড়িয়ে কবরটা ছুঁয়ে দেয়, অশ্রুকণা ভিড় করতে চায় তবে কঠোর পুরুষ ভেঙে পড়ে না। ঠোঁট কামড়ে কান্নাটা নিয়ন্ত্রণ করে আফীফ। ফিসফিস করে বলে উঠে,

~ জিয়া, আমার ভাই! তোমার কথা রাখো নি জিয়া। পাতালে যেতে চেয়েছিলে, থেকে গেলে না। একাই চলে গেলে! আমার জীবনের বড় আফসোস তোমাকে ভালোবাসা জিয়া। যে আফসোস আজ থেকে আমাকে আমৃত্যু বয়ে নিয়ে যেতে হবে। কাঠখোট্টা আফীফ মুনতাসির তোমাকে খুব ভালোবাসে জিয়া!
আরেকটু এগিয়ে যায় আফীফ। মুখ এগিয়ে নিয়ে অস্পষ্ট ফিসফিস কন্ঠে বলে,
~ “ভালোবাসি!”

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে যে হাঁটা ধরে আর পিছু ফিরে তাকানোর সাহস করে না। মনে হয় কলিজা কেউ কে’টে রেখে দিয়েছে, সে অনুভূতি হীন পা চালাচ্ছে। আফীফ আবার কি মনে করে‌ মাঠটিতে ফিরে আসে জানে না, তবে তার ধারণায় সঠিক হয়। অনল মাহমুদের খাটিয়া টা এখনো সেভাবেই পড়ে আছে। দু তিন জন সেনা ঘুরাফিরা করছে, তবে বড় মাপের কাউকে দেখতে পেল না। কিছুটা দূরে চোখ যেতেই আফীফের দৃষ্টি খাদে নেমে এলো। হাত কড়া পরা অবস্থায় বসে আছে আদিল, দৃষ্টি খাটিয়ার দিকে। আফীফের বুকের চিনচিনে ব্যাথা টা বাড়লো বৈ কমলো না। ভাবনা বিহীন বড় সড় এক সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে গেল আফীফ। সৈনিক দের নির্দেশ দিয়ে বললো,
~ মি. মাহমুদ কে ছাড়ুন, লাশের ব্যবস্থা করতে হবে।

আদিল বেশ অবাক হয় তবে প্রশ্ন করে না। চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। হাত কড়া খুলে দেওয়া হয়। দশ বারো জন সৈনিক পিছু লেগে থাকে।‌ আফীফ সরাসরি খাটিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে হাতল ধরে, আদিল চরম ভাবে থমকায়। ঘোরের মধ্যেই পাশের হাতল চেপে ধরে। দুজন সৈনিক এগিয়ে আসতেই কাঁধে তুলে নেয় খাটিয়া। আফীফের শরীর টা কেমন ঝিমঝিম করে উঠে। দাঁড়িয়ে রয় কয়েক মুহূর্ত। এলোমেলো পায়ে হাঁটতে থাকে সরকারী গোরস্থানের দিকে। কবর খোঁড়া ছিল, পাশে রেখে জানাযা পড়া হয়। আফীফ-আদিল দুজন মিলে দেহ খানা শুয়িয়ে দেয় মাটিতে। শক্ত নিষ্ঠুর পুরুষ দুজন নিঃশব্দে নিজেদের কার্য শেষ করে। মনের মধ্যে কি চলছে তা লুকাতে যেন বড়‌ই পারদর্শী। আফীফের নির্দেশে কবরের সম্মুখে সিমেন্টের খাম স্থাপন করা হয়। আদিল সবটাই নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় দেখে যায়, শব্দ বিনিময় করতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় মুখ থেকে একেকটা শব্দ ভেতরের আ’র্ত’না’দ কে প্রকাশ করে দিবে। ইশারায় একজন কে নির্দেশ দিয়ে আফীফ খানিক দূরে সরে আসে। আদিল দেখে খামে কিছু খুদায় করা হচ্ছে। লোকটি কাজ শেষ করে চলে যায়‌। আদিল চোখ মেলে দেখে, বিড়বিড় করে বলে উঠে,

~ “Adil Mahmoud
He is a notorious terrorist But he is also a good husband and a best father.”
আদিল তাকায় আফীফের দিকে। ভাবালেশ দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে টা তার ভাই। খালাতো, সৎ দুইয়ের মিশ্রণে অধিক আপন মনে হয়। তবে যে সে প্রকাশ করতে নারাজ। নিষ্ঠুর আদিল মাহমুদ নিষ্ঠুরতা ছেড়ে বের হতে পারে নি, পারবেও না! আফীফ স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
~ আমার সাথে আসুন মি. মাহমুদ!
আর কোনো শব্দ ব্যয় হয় না। হাঁটতে শুরু করে আফীফ। গাড়িতে গিয়ে বসতেই আদিল এসে পাশে বসে। ছুটতে শুরু করে গাড়ি। লুকিং গ্লাসে চোখ বুলিয়ে আফীফ নিজের মতোই আওড়াতে থাকে,
~ আপনি আমার ভালোবাসা ও ঘৃণার মাঝে একখন্ড চাপা শ্বাস হয়ে রয়ে যাবেন। সম্মান, অসম্মানের মাঝে দুর্বোধ্য এক রহস্য হয়ে থেকে যাবেন। আফীফ মুনতাসির অনল মাহমুদ কে অস্বীকার করলেও তার রক্ত কে বরণ করে নিচ্ছে। আপনার এই অসীম ত্যাগ আমি সারাজীবন বয়ে নিয়ে যাবো! ইউ আর এ বেস্ট ফাদার অলসো এ গুড হাজবেন্ড!

গাড়ি থামে ছোট এক বাড়ির সামনে। গেইট নেই, চারপাশ দেয়াল নেই শুধু এক ঘর। আদিল কে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ দেয় না আফীফ। নিজ থেকে বলে উঠে,
~ ভেতরে যান, বুঝতে পারবেন।
আদিল কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে, একপলক আফীফের দিকে তাকিয়ে বড় বড় পা ফেলে ঘরের দরজার কাছে চলে যায়। আফীফ আর অপেক্ষা করে না, চলে যায় নিজ গন্তব্যে। আদিল ভ্রু কুঁচকে টোকা দেয় দরজায়, পরপর দুবার টোকা দেওয়ার পর‌ই খুলে যায় দরজা। হাস্যজ্জ্বল মেয়েটির মুখশ্রী দেখে থমকায় আদিল। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
~ রাজনন্দিনী!

সময় ছুটে চলছে নিজস্ব গতিতে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ, নিঃশব্দে দৃষ্টি বিনিময় করে চলছে‌। যেন কতদিনের পিপাসিত হৃদয়ের তেষ্টা মেটাচ্ছে। হয়তো বা মনমাঝারে কিলবিল করছে নানান স্মৃতি, অমলিন কিছু স্বপ্ন, অধরা কিছু অপ্রাপ্তি। অপ্রাপ্তিরাও অধরা হয়; প্রাপ্তির আশারাও যে দূরে ছুটে পালায়। মৃদু শব্দে গলা ঝেড়ে নিলো আদিল। মিরা চোখের পলক ফেলে আবার দৃষ্টি রাখলো আদিলের উপর। আদিল মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসলো। পায়ের উপর পা তুলে বসে কিছুটা সময় ভাবলো। হুট করেই বললো,

~ এমন নাটকের মানে?
মিরা বসলো আদিলের পাশে। গালে হাত রেখে ফের আদিলের মুখশ্রী অবলোকন করতে করতে বললো,
~ সব নাটকের মানে হয়?
~ আমি তো জানি মিরা শিকদার অকারণে নিঃশ্বাস ‌ও নেয় না।
মিরা কিছুটা শব্দ করে হাসলো‌। চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেল এক কোণে থাকা টেবিলের সামনে। কয়েকটা শুকনো খাবারের বয়াম। প্লেটে কিছু বিস্কুট, ফ্লাক্স থেকে চা নিয়ে আদিলের সামনে রাখলো। কিছু বললো না আদিল। ভূমিকা বিহীন একটি বিস্কুট হাতে তুলে নিয়ে সময় ব্যয় করলো না। মুখে পুরে হাতে চায়ের কাপ তুলে নিল। সারাটা দিন পেটে কিছু পড়ে নি। মিরা আবার বসতে বসতে বললো,

~ আপনার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই! তাই ছেড়ে দিয়েছে, এখানে আমি কি করতে পারি?
~ মামার বাড়ির গল্প মায়ের কাছে করাও একটা আর্ট! এদিক দিয়ে আপনি মস্ত বড় আর্টিস্ট!
~ আপনি একদিকে খু*নী, স্মাগ*লার, কু*খ্যাত সন্ত্রা*সী; অন্যদিকে আমার ভালোবাসা! বলে না ভালোবাসা জানে না বাঁধা! আপনাকে আমি ভালোবাসতে চাই না, আপনাকে নিয়ে আমি ভাবতে চাই না, আপনাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতে চাই না! কিন্তু এই চাই না’র মাঝে বৃহৎ আকারের এক চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। না শব্দ টার মাঝেও এক প্রকান্ড অধিকারবোধ আছে। আমি বার বার হেরে যাই সেই অধিকারবোধের কাছে, আমি বার বার পরাজিত হচ্ছি এই আকাঙ্ক্ষার কাছে! তবুও কেমন সুখ সুখ লাগে!

মেয়েটা বড় বড় চোখ মেলে অনর্গল বলে যাচ্ছে। আদিল শান্ত দৃষ্টিতে মিরা কে দেখে যায়। মিরা বলতে থাকে,
~ যে মেয়ে পরোক্ষ অপরাধের জন্য নিজের জন্মদাতার বুক ঝাঁঝরা করে, সেই মেয়েই সেই অপরাধের অপরাধী কে বাঁচানোর জন্য ছুটে যায়। শত শত মিথ্যে বলে যায়, পাক্কা অভিনেত্রী’র মতো অভিনয় করে যায়‌। আপনার ভালোবাসা শুধু আমাকে পুড়িয়েই গেল ডাক্তার। আমি তো সুখের আশায় বুকে স্বপ্ন বুনেছিলাম। সেই বুকে পাথর চাপা দিয়ে স্বপ্ন গুলোকে কেন ভেঙে চুরে ফেললেন ডাক্তার?
স্পষ্ট ব্যাথার ছাপ। আদিল অনুভূতি হীন মনের কথা ব্যক্ত করার কাজে নিয়োজিত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রয়। মিরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবে। আবার বলে,

~ আমার জন্মের তিন বছর পর মা যখন মারা গেল, আমি তেমন কিছুই বুঝি না। ফিল করতে পারিনি। দিব্যি হেসে খেলে থেকেছি। আমার থেকে চার বছরের আপাই আমার মা হলো। একজন মা যেমন সন্তান কে সবটা দিয়ে আগলে রাখে ওই মেয়েটা আমাকে তার সবটা দিয়ে আগলে রাখতো। আমার সুখ দুঃখের একমাত্র সাথী সে। কেন যেন ভাইয়া আর বাবা কে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারতাম‌ না। মনে হতো ওরা তো পুরুষ মানুষ মেয়ে মানুষের সমস্যা বুঝার ক্ষমতা ওদের নেই। একপাক্ষিক দুরত্ব ছিল। বাবাও তখন মা কে হারিয়ে দিশেহারা, শুনেছি প্রেম করে বিয়ে করেছিল। সেসব কথা বাদ দিই। কয়েকটা বছর কেটে গেল। একদিন আপাই কাউকে না বলে আমাকে পাঠিয়ে দিল সেই বরিশালে। আপাইয়ের বুকে গুঁজে থাকা মিরা তখন কিশোরী। অপরিচিত জায়গা, অপরিচিত মানুষ ইন্টোভার্ট মিরা কে একাকীত্বের সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে ফেলে রাখলো। অন্যদের কাছে আমি হয়ে উঠলাম আজব প্রাণী, যার দুঃখ নেই, কথা শোনালে মন খারাপ হয় না, গাঁয়ে হাত তুললে ব্যাথা লাগে না।

যে যেভাবে পারতো ব্যবহার করে যেত, আমি ঠিক প্রতিবাদ শিখি নি। আপাইয়ের স্বপ্ন ছিল মেডিকেল চান্স পেতেই হবে। তোড়জোড় চলছিল কিন্তু শেষমেষ পেরে উঠিনি। তখনো আপাই ঠিক মায়ের মতোই পাশে থেকেছে। সাহস দিয়েছে, দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দেওয়ায় জোড় করেছে‌‌। কিন্তু কেন যেন একটা জিনিস আমাকে দুই বার টানে না। ভার্সিটি ভর্তি হলাম। একদিন শুনি আমার আপাই হসপিটালে ভর্তি। ইন্টোভার্ট মিরা তখন হাউমাউ করে কেঁদেছিল, সিনিয়র একজন মজা করায় হাতটা এমন ভাবে মঁচকে দিয়েছিল ছয়মাস লেগেছে ভালো হতে! এক সন্ধ্যায়, সাদা এপ্রোন পড়া এক সুদর্শন যুবক রোগীদের সাথে কথা বলছিল। এমন ভাবে কথা বলছিল সে এখানে ডাক্তারি নয় মাষ্টারি করতে এসেছে। আশ্চর্যজনক ভাবে মিরা প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে গেল। ইন্টোভার্ট মিরা হাসতে শিখলো। সে আর বেশি দিন টিকলো না। আপাই কড়া করে বলে দিল অনল মাহমুদের হিংস্রতার কথা, আদিল মাহমুদের কঠোরতার কথা। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এগিয়ে ছিলাম। কৌশলে চিঠি লিখতাম, আমার জীবনে সবচেয়ে সেরা দিন ছিল ওই দিন যেদিন চিঠির উত্তর আদিল মাহমুদ দিয়েছিল। সুখে মরে যাচ্ছিলাম। চলতে থাকলো, আবার ঘনিয়ে এলো সেই কষ্টের মুহূর্ত। আপাই আর নেই! আপন কেউ ছিল না, ভাইয়া ছিল ট্রেনিংয়ে। দিশেহারা আমি তলিয়ে গেলাম আবারো অন্ধকারে।

হাঁপাতে থাকে মিরা। বুক ঢলে নিয়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দেয়। গলা শুকিয়ে গেছে। বার কয়েক শুকনো ঢোক গিলে, কাজ হয় না। কেশে উঠে সে। আদিল পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়, এক চুমুকে পানি টুকু শেষ করে হাসে মিরা। চেয়ারে পা তুলে বসে আবার বলে,
~ ডিপ্রেশনে ভোগছিলাম। ভালো লাগতো না কিছু, নিজেকেই নিজের কাছে উচ্ছিষ্ট মনে হতো। মনের জোরের অভাব ছিল,

হঠাৎ হঠাৎ কান্না পেত, অনর্গল চোখে জল আসতো। রাতে ঘুম হতো না, একটু চোখ লেগে আসলেও পরপর‌ই ভয় পেয়ে ধড়ফড় করে জেগে উঠতাম। মনে হতো এই বুঝি আঁধারে কেউ এসে আমার গলা চিপে ধরবে, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। ঘুম না হ‌ওয়ার ফলে শরীরে শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। ঠোঁটের ফাঁকফোকর দিয়ে কিছু বের করতেও বিরক্ত লাগতো, হাঁটতে বিরক্ত লাগতো। খেতে বিরক্ত লাগতো। ঘুমের প্রয়োজন ছিল খুব। শান্তি তে একটু ঘুমাতে চেয়েছি। প্রতিনিয়ত ঘুমের বডি খেতে থাকলাম, একসময় এটাও শরীরে সহন হয়ে গেল; ঘুম এলো না। মাদকাসক্ত হয়ে গেলাম। ফেন*সিডিল, হেরো*ইন খেতে থাকলাম বিপুল হারে। শরীর মন দুটোই চাঙ্গা হয়ে উঠতো; বিষাদ আর আমাকে ছুঁতে পারতো না। ঘুম হতো, তন্দ্রার মতো, একটা জায়গায় বসে ঝিমুতে থাকতাম; দুঃখ আমাকে স্পর্শ করতো না। সিগারেটের পর সিগারেট, চায়ের পর চা শেষ করেছি ঝিমুতে ঝিমুতে। কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করতাম আপনাকে নিয়ে।

সংসার হবে, বাচ্চা হবে, আমাকে মা মা করে ডাকবে, আপনাকে বাবা; আবার স্বপ্ন গুলো কোথায় হারিয়ে যেত খোঁজ ই পেতাম না। তখন ঘুমানোর জন্য ইয়া*বা সেবন শুরু করলাম! ঘুম হতো না, ঝিমাতাম। আবার যখন ঘুম হতো দুই তিন দিন একটানা ঘুমাতাম। এই জগত কি টের পেতাম না। খেতে হতো না, খিদে কেটে যেত। অনেকটা দিন পর। মেঝেতে ঝিমুচ্ছিলাম; একটা মেয়ে আসে। নিয়ে যায় কোথায় টের পাই না। তিন দিন পর জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হসপিটাল আবিষ্কার করি। পাগলামি করছিলাম প্রচুর, চিকিৎসা করাবো না; এমন ভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম, একবেলা ড্রাগস না পেলে আমি কাঁপতাম, খু*নের জোঁক উঠে যেত। কতবার যে আফরা কে আঘাত করেছি, মেয়েটি সহ্য করে নিতো।ডক্টর রাগান্বিত হয়ে কিছু বললেও ধমকাধমকিতে ডক্টরের জান বের করে নিতো। আমি তখন অন্য দুনিয়ায় ছিলাম। আফরা নিয়ে গেল আমাকে সত্যের মুখোমুখি। আপাই কে ধ*র্ষণ করার সত্যটা যখন আমার সামনে এলো, ঠিক থাকতে পারিনি। নিজের বাবা কেই মেরে দিয়েছি। আফরার মোটিভেশনে নিজেকে সুস্থ করার চেষ্টা করি। হ‌ই, আমি সুস্থ! কিন্তু অসুস্থ মন আর সুস্থ হলো না। ওই এক ডাক্তারের কাছেই পড়ে র‌ইলো!
উঠে দাঁড়ায় মিরা‌। হাত ব্যাগ হাতে নিয়ে চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল টা মুছে নেয়। দরজার নিকট দাঁড়িয়ে বলে উঠে,

~ একদিন বের হবেন না ঘর থেকে, আমি চাই না আমার শিকার কে অন্যকেও নিজের শিকার করে নিক!
মিরা বাইরে বের হয়। বাঁকা হেসে দরজা বন্ধ করে দিতেই আদিল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এক লাফে দরজার নিকট চলে যায়। ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলে উঠে,
~ ওপেন দা ডোর মিরা‌। এমন কিছু তুমি করবে না, মিরা দরজা খোল‌।
মিরা হাসে, কিছুটা শব্দ করেই। দরজায় তালা লাগিয়ে রসিকতা করে বলে উঠে,
~ সরি ডাক্তার! আই লাভ ইউ!
হাসতে হাসতে মিরা ছুটে চলে রাস্তা ধরে। হাসির শব্দ টা যখন অনেক দূরে শুনতে পায়, রাগে দরজায় লাথি বসায় আদিল। দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠে,
~ এর শোধ আমি নিবো রাজনন্দিনী! তোমার ভালোবাসা ভয়াবহ হলে, আমার ভালোবাসা ভয়ংকর!

রাতের নিস্তব্ধতায় গাড়িটা থামলো শব্দ করে। পিচের রাস্তায় ঘর্ষণের শব্দ টা কানে বাজার মতো। এত গভীর রাতে কে এলো ধরতে পারলো না নুরুল আলম সিদ্দিকী। বাবা-ছেলে কিছুটা একান্তে সময় কাটাচ্ছিল। কয়েকদিনের ঝড় ঝাপটা মনের উপর যে ব্যাথার আস্তরণ ফেলে দিয়েছিল; তা আজ অনেকটাই কেটে গেছে‌। কিন্তু বাবা-ছেলের মাঝে অনল মাহমুদ কে নিয়ে কোনো কথায় হয়নি। না আফীফ প্রশ্ন করেছে, না নুরুল আলম সিদ্দিকী নিজ থেকে কোনো জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পিতা-পূত্রের মাঝে কী এক সুনিপুণ ভালোবাসার দৃঢ়তা! গাড়ির শব্দে দুজন‌ই বাগান থেকে পার্কিংয়ের দিক আসে। আফরা কে দেখে অবাক হয়। অবাকতা কে বাড়িয়ে দিয়ে আফরা মিষ্টি হাসে। এগিয়ে গিয়ে বাচ্চা দের মতো নুরুল আলম সিদ্দিকী’র হাত ধরে বলে উঠে,
~ অন্যের গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ানোয় আরাম মামাই!

নুরুল আলম সিদ্দিকী’র চোখ ছলছল করে উঠে। তিনি অপলক তাকিয়ে থাকেন আফরা’র দিকে। কাঁপা হাত বাড়িয়ে গাল ছুঁয়ে দেন। এই মেয়েটা তার ছোট্ট আফরা! তার বোনের নাড়ি ছেঁড়া ধন! আফরা কোটর ভর্তি জল নিয়ে নুরুল আলম সিদ্দিকী’র হাতের উপর হাত রাখে‌। কেটে যায় কয়েক মুহূর্ত‌। নুরুল আলম সিদ্দিকী নরম কন্ঠে শুধান,
~ তুমি কি করে জানলে তোমার নাম আমি আফরা রেখেছিলাম? কাউকে তো বলি নি! গোপন ছিল!
~ কেন গোপন রেখেছিলে? আমি কি তোমার ডায়েরি পড়তে পারি না? ছোট বেলায় একটু চুরির স্বভাব ছিল, তা তো তুমি জানতেই। তাহলে কি করে ভাবলে, একটা ডায়েরি দেখেও আমি পড়বো না? যদিও কঠিন শব্দ গুলো পড়তে কষ্ট হয়েছে, তবে কিছুমিছু তো বুঝতে পেরেছি। তাইনা?

মেয়েটা যেন আজ বাচ্চা হয়ে গেছে। অবলীলায় কথাগুলো বলে যাচ্ছে। আফীফ মুগ্ধ অবাক চোখে পরখ করছে মামা-ভাগ্নীকে। আফরার কথা শুনে নুরুল আলম সিদ্দিকী হেসে ফেললেন। নিজেও তাল মিলিয়ে বললেন,
~ আমার পাজী মা! কিন্তু আমাকে এটা বলো, জেনারেল স্যারের সামনে এই নাম ব্যবহার করলে কেন? তোমার নাম তো…

~ শেখ মাহনূর মুনতাসির! আব্বা রেখেছিল! আচ্ছা চলো কোথাও বসি!
নুরুল আলম সিদ্দিকী আফরা’র হাত ধরেই গোল টেবিল টাই বসালেন। মাথা নেড়ে ইশারা করে ছেলেকে বললেন পাশে বসতে। আফীফ বসলো। কিছু বললো না।আফরা নিজের মতো বলতে থাকলো,

~ হাওয়ায় মিঠাই নিয়ে এসেছে এক লোক, আম্মার ব্যাগ থেকে দশ টাকা চুরি করে লুকিয়ে বের হয়েছিলাম। আম্মা বাইরের খাবার খেতেই দেয় না। ভেবেছিলাম কিনেই চলে আসবো, আম্মাকে বললে আর বকা দিবে না। কিন্তু বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে কখন সময় চলে গেছে টের‌ই পাই নি। দুপুরের পর বাড়ি গিয়ে দেখি ওটা আর আমাদের বাড়ি নেই, ছাই‌ হয়ে গেছে। চিৎকার করে ডাকলাম, কান্না করলাম কাউকে পেলাম না, একজন প্রতিবেশীও বের হয়ে বললো না। আট বছরের ছোট্ট মেয়েটার কান্না তাদের কানে পৌঁছালেও মনে পৌঁছায়নি। কেউ এলো না, অপেক্ষা করলাম। রোদে দাঁড়িয়ে অতিরিক্ত কান্নার ফলে অজ্ঞান হয়ে যাই‌। জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করি সুন্দর নরম তুলতুলে বিছানায়। তারপর থেকে ওই বিছানা টাই আমার বাসস্থান ছিল। গম্ভীর মেয়েটাকে পাপা নিজের মতো তৈরি করেছিল। বলেছিল সকল অতিত, ছোট্ট মাহনূর নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করেছিল যার কবলে ধ্বংস অনিবার্য!

পাপা চায় নি আগেই কেউ আমাকে চিনে ফেলুক, হয়তো আমাকেও মেরে ফেলতো। নতুন নাম দিতে চেয়েছিল, আমার মনে হলো তোমার দেওয়া গোপন নামে এক জোর আছে। শেখ মাহনূর মুনতাসির হয়ে উঠলো আফরা ইবনাত। সকল প্রকার অস্ত্র চালানো শিখিয়েছে পাপা, সকল প্রকার কৌশল অবলম্বন করতে শিখিয়েছে পাপা! তুমি যে আমার মামাই, পাপা জানতো না। পরিচয় গোপন রেখেছিলে, আমিও আর বলিনি। আমার মনে হয়েছিল তোমার সাথে আমার নাম জড়িয়ে গেলে আমি যে যুদ্ধের জন্য নিজেকে তৈরি করছি সে আর হবে না। প্রতিশোধের নেশা মন কে এতটা আসক্ত রেখেছিল, আমি আর কিছুই ভাবার সুযোগ পাই নি। একটু বুঝতে শেখার পর চলে গেলাম সেই বান্দরবান। আমার শৈশবের কাছে‌। একা থাকতে শুরু করলাম, নিজেকে এতিম দেখালাম। গোপনে মাহমুদ বংশের প্রত্যেকের খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম। এতটা সহজ ছিল না। কেউ মূল বিষয়, মূল পরিচয় জানতো না। কাঠখড় পুড়িয়ে আমার সকল তথ্য বের করতে হয়েছে। পরিচয় হয় অথৈ’র সাথে।

মেয়ে এতিম খানায় থাকতো, ভালো এক সম্পর্ক গড়ে উঠে। অনিক মাহমুদের সাথে সম্পর্ক। মেয়েটা ঝোঁকের বশে বিয়ে করে ফেলে না জানিয়ে। আমি দেখেশুনে রাখছিলাম। কিন্তু কিছু দিন পরেই খবর পাই মেরে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। ঘাড় সাইড শক্ত রড় দিয়ে আঘাত করায় প্যারালাইজড হয়ে পড়ে। গুরত্বর অবস্থায় ভর্তি করি হসপিটালে। রিস্ক ছিল, নির্জন বাড়ি খুঁজে বাড়িতেই চিকিৎসা চালাচ্ছিলাম। এভাবেই চলছিল। প্রমাণ জোগাড়ের মধ্যেই দুর্দান্ত এক খবর আসে। মিরা আদিলের সম্পর্ক! আমি চেয়েছিলাম মিরা কে ব্যবহার করতে। কিন্তু পরিকল্পনার পূর্বেই মেয়েটা বড় একটা আঘাতের সম্মুখীন হয়। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে থাকতো, চিকিৎসা করায়।

সত্যের মুখোমুখি করি। এরপর থেকেই শুরু আমাদের একেকটা প্রমাণ জোগাড়। কিন্তু প্রমাণের শক্তি ছিল না, অনল মাহমুদ এক ছুটে প্রমাণ টা উল্টে দিতে পারতো। তোমাদের ব্যবহার করি, চিঠি পাঠায়, বান্দরবান নিয়ে আসি, বর্ডারে চোরাচালানের দৃশ্য দেখায়। এরপর কি হয়েছে জানোই! আমি অনল মাহমুদ কে মাত দিতে চেয়েছিলাম! এমন ভাবে তার সমাপ্তি টানতে চেয়েছিলাম তিনি যেন আফসোস করেন। আমার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। নিজ ছেলের হাতে মৃত্য বরণ করেছেন তিনি, ব্যাথামিশ্রিত মুখটা আমার আজ‌ও চোখের সামনে ভাসে। শান্তি পাই আমি! যে লোকটা আমার মায়ের শরীর চিতায় তুলেছে, যে লোকটা একজন বীর সেনা কে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছে, একটা মেয়ের শৈশব কেড়ে নিয়েছে, এতিম করে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল একা; তার মৃত্যু আমাকে আনন্দ দিয়েছে।
ঠোঁট বেঁকিয়ে শব্দ করে হাসলো আফরা। নুরুল আলম সিদ্দিকী ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছাড়লেন‌। আফীফ শান্ত হয়ে তাকিয়ে আছে অন্ধকারে। আফরা আর বসলো না। উঠে পড়লো। বললো,

~ শুনেছি কাল কি সব অনুষ্ঠান আছে!
~ হ্যাঁ। শেখ মেহরাব মুনতাসির, জিয়াউল কে কে সম্মান জানিয়ে; আফীফ কে নতুন পদবী দিবে! মিশন সাকসেসফুলের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
আফরা আবারো ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো। তারপর কিছু না বলেই হারিয়ে গেল অন্ধকারে। গাড়ির শব্দ টা দূরে যেতেই উঠে দাঁড়ালো নুরুল আলম সিদ্দিকী। ধীরে ধীরে পা ফেলে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লেন। ঘুমিয়ে আছেন কামিনী বেগম। পাশে বসে হাত চেপে ধরলেন নুরুল আলম সিদ্দিকী। কামিনী বেগম খানিক কেঁপে উঠলেন। তবুও দুজন নিশ্চুপ ভরসায় সেভাবেই রয়ে গেলেন। এভাবেও ভালোবাসা যায়!
অন্ধকার বিলাস আফীফ বাগানে বসেই করে গেল‌। মনের ভেতর চলছে ভিন্ন কিছুর উদ্যোগ। মন বারংবার ছুটে যেতে চায়, নিষিদ্ধ নারীর নিকট। তবুও কোথাও একটা বাঁধা! মনের খচখচানি! মেয়েটার হাসি যে অদ্ভুত। কি ইঙ্গিত দিয়ে গেল? কাল সব ঠিকঠাক হবে তো? নাকি আবারো কোনো ঝড়! লন্ডভন্ড সব!

রাত তখন দুটো বেজে ছত্রিশ মিনিট। নিজ উদ্যোগে ফোন টা বেজে চলছে। বাসের সিটে গাঁ এলিয়ে ঘুমিয়ে ছিল আহিশ। ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে ভেসে আসে কান্নার শব্দ। আহিশ চোখ বুজে শ্বাস নেয়। নরম কন্ঠে বলে উঠে,
~ আম্মা কাঁদছো কেন? আমি দুদিন পরেই চলে আসবো।
অপরপাশ থেকে মিহি কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
~ আম্মু বলছে তুমি আর আমাদের সাথে থাকবে না! কেন থাকবে না আব্বু?
~ সাথে না থেকেও পাশে থাকা যায় আম্মা। রাখছি এখন, ঘুমিয়ে পড়ো। আব্বু চলে আসবে!
মিহির কথা আর শুনে না আহিশ। যেখানে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই, সেখানে অযথা মায়া বাড়ায় না সে। আহিশ ফোন কাটতেই মিহি মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদে উঠে। মনিরা বুঝে পায় না কি করে সান্ত্বনা দিবে ছোট্ট মিহিকে। আগলে নেয় বুকের মাঝে। ফিসফিস করে বলে,

~ কিছু কিছু মেয়ের অভিভাবক হীন বেড়ে উঠতে হয়। তুই আমার আমানত, আমার অংশ। কথা দিচ্ছি তোকে আমি এমন ভাবে তৈরি করবো, মাঝরাতে বসে কারো জন্য কাঁদতে হবে না। যে সুখ থেকে আমি বঞ্চিত সে সুখে তোকে আমি ভাসাবো।
মিহি কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যায়। মনিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আসে না, সে বহুদূর। আনমনে ফিসফিস করে বলে উঠে,
~ সে তোর আব্বু মিহি, ঠিক তোর কাছে আসবে। কিন্তু তোর মায়ের কেউ না! কেউ না!
আহিশ বিষাদ চোখে ফোনের ওয়ালপেপারে তাকিয়ে থাকে। প্রেমপিয়াসী এখন আর কল্পনায় আসেনা। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ছলছল চোখে ওয়ালপেপারে ঠোঁট ছোয়াবে আবার বেজে উঠে ফোন। রিসিভ করে কানে তুলতেই অপরপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,

~ পৌঁছেছি!
~ আংকেল ডাকা যায় না? এখন তো রাগ করি না!
আসমানী ঠোঁট চেপে কান্না নিয়ন্ত্রণ করে। সে এখন বহুদূর। সদূর নিউজিল্যান্ডে বসে প্রিয়জনের সাথে কথা বলছে। যেতে চায় নি, থাকতে চেয়েছিল মাতৃভূমিতেই। ফিরে যেতে চেয়েছিল আবার গ্রামে। আহিশ দেয়নি, মেয়েটির উজ্জ্বল ভবিষ্যত; গ্রামে গিয়ে নষ্ট হোক সে চায় নি। তাই তো জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে। আহিশ আবার বলে,
~ দেশে এমন ভাবে ফিরবি তোর জন্য যেন এয়ারপোর্টে হাজারহাজার লোক দাঁড়িয়ে থাকে‌। আংকেলের মৃত্যুর খবর‌ও যেন তোকে টলাতে না পারে। এনজয় কর, জীবন অনেক সুন্দর।
টুট টুট শব্দে ফোন কেটে যায়। বন্ধ ঘরে ছোট্ট মেয়েটি আর্তনাদ করতে থাকে। এই অচেনা শহরে আজ সে একা। আহিশ বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপে হাসে। কষ্ট গুলো আগের মতো ছুঁতে পারে না। এখন শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা!

সোফায় বসে ঝিমুচ্ছেন অনিমেষ মির্জা। মেয়েটা এখনো বাড়ি ফিরে নি। কলিংবেলের শব্দে তিনি ধড়ফড়িয়ে উঠেন। চোখ ঢলে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বসে থাকেন। পণ করেন আজ খুব করে বকে দিবেন। গম্ভীর মুখে দরজার কাছে ছুটে যান। দরজা খুলে কড়া করে কিছু বলবেন আফরা মিষ্টি হেসে ভেতরে ঢুকে। অনিমেষ মির্জা আর কিছুই বলতে পারেন না। এই হাসিটা তাকে কাবু করে রাখে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন শক্ত করে। আফরা অবাক হয়। ভ্রু কুঁচকে তাকায়, অনিমেষ মির্জা কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠেন,

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬১+৬২

~ পাপা কে ভ্রু কুঁচকানো দেখাচ্ছো? সাহস তো মন্দ না!
আফরা খিলখিল করে হেসে উঠে। অনিমেষ মির্জা তাকিয়ে থাকেন অপলক। মেয়েটা তার ভালো থাকার মাধ্যম। আফরা অনিমেষ মির্জার পেটের কাছে হাত নিয়ে সুরসুরি দিতেই তিনিও হাসতে থাকেন। বাবা-মেয়ের খুনসুটিময় মুহুর্ত কেটে যায়। ভোরের আলো ফুটে। নতুন দিনের সূচনা হয়!

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬৫+৬৬