হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬
Tahrim Muntahana

~ আমি তোমার ভাবী হতে রাজী, নাদিয়া!
কথাটি কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই নাদিয়া অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। মুখে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আফরা! সময় টা এখন সকাল। আজ একটু তাড়াতাড়িই ভার্সিটি এসেছে সে। সরাসরি নাদিয়ার আড্ডা স্থলে এসে কথাটি বলেই পাশে বসলো। নাদিয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো,
~ হঠাৎ মত পরিবর্তন?
~ কালকে তোমার ভাইয়ার কাছে গিয়েছিলাম। এটিটিউট মনে ধরেছে। ভাবলাম, সুযোগটা লুফে নিই!
চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে র‌ইলো নাদিয়া। আফরার মনোভাব বুঝার চেষ্টায় তাকিয়েই র‌ইলো। তবে কিছুতেই ধরতে পারলো না। মেয়েটা কেমন রহস্যময়! আফরা আবার বললো,

~ সন্দেহ করছো আমাকে?
ভড়কে গেল নাদিয়া, মেয়েটা বুঝলো কি করে? আমতা আমতা করে বললো,
~ সন্দেহ করার কথা না বলছো? হঠাৎ মেয়েটা রাজী হয়ে গেল, ব্যাপারটাই মাথায় ঢুকছে না!
শব্দ করে হাসলো আফরা। ভাবালেশ বললো,
~ হয়তো কারণ আছে নয়তো নেই! তবে তোমার ভাইয়ের ব‌উ কিন্তু আমিই হবো। দেখে নিও!
নিজের গন্তব্যের দিকে হাঁটা ধরে আফরা।‌পেছনে কয়েকজন মানুষ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় রহস্যময়ী মেয়েটির দিকে। নাদিয়াও ঠিক এভাবেই বলেছিল, মেয়েটা‌কি তার থেকে শোধ নিচ্ছে? তবে এত কিছু ভাবার সময় নাদিয়া পেল না, মনের মধ্যে এবার খুশিরা ঘুরছে। ভাইয়া এবার বাড়ি ফিরবে, বাড়িতে থাকবে! এর থেকে আনন্দের আর কি আছে? মেয়েটাকে সে যেভাবে ইচ্ছে ব্যবহার করবে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জ্ঞান ফিরেছে আরাফের। কিন্তু ভয়ে কথা বলছে না! চোখ বন্ধ করলেই সেই রক্তচক্ষু দৃষ্টি ভেসে উঠছে নেত্রপল্লবে। যা তাকে শান্তি দিচ্ছে না! আতিকুর সহ আরো ক’জন অফিসার বসে আছে কেবিনের বাইরে। ডক্টরের চেকাপ হয়ে গেলেই বয়ান নিবে তারা। ডক্টর বের হতেই একে একে কয়েকজন ঢুকে পড়লো কেবিনে। শক্ত বুটের পায়ের শব্দে কেঁপে উঠলো আরাফ। চিৎকার করতে গিয়েও ভাই কে দেখে থেমে গেল। আপন রক্ত দেখে যেন নিজেকে খোলা ব‌ইয়ের মতো মেলে ধরলো, কেঁদে উঠলো হাউমাউ করে। আতিকুরের মাঝে তেমন ভাবাবেগ দেখা‌ যায় না। দায়িত্বের চাপে যেন শুধু হাত আগলে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর যখন আরাফ স্বাভাবিক হয়, আতিকুর বলে উঠে,

~ কোথায় ঘটেছে ঘটনা টা?
~ আমি বন্ধুদের সাথে ছিলাম, হঠাৎ করে অচেনা নম্বরে ফোন আসায় একটু দূরে গিয়ে ফোনটা রিসিব করি। হেলো বলার আগেই কেউ নাকের উপর রুমাল চেপে ধরে। আর মনে নেই, জ্ঞান ফিরে দেখি আলো-অন্ধকার এক ঘরে আমি পড়ে আছি। সামনেই মুখোশধারী এক লোক। চাপাটি দিয়ে মারতে আসলেই ধস্তাধস্তি শুরু হয়।
চুপ হয়ে যায় আরাফ। বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়ে বলে উঠে,
~ আমার বাম হাতে চাপাটি চালিয়ে দেয়, আমি কোনো রকম ছাড়া পেয়েই দরজা ভেঙে দৌড়াতে শুরু করি। একসময় হাইওয়েতে এসে ট্রাকের সামনে অজ্ঞান হয়ে যাই।
আতিকুর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ভাই কে পরখ করে। আর কেউ বুঝতে না পারলেও সে ঠিক পেরেছে। তার ভাই যে মুখস্ত মিথ্যে বলে যাচ্ছে সে জানে। তবে এই বিষয়ে কিছু বললো না। আরেকজন অফিসার প্রশ্ন করলো,

~ মুখোশধারী ছেলে না মেয়ে বুঝতে পেরেছিলেন?
~ না! অন্ধকার ছিল।
~ সে কোনো কথাই বলেনি?
~ না বলেনি, আমার হাতটা কেটে ফেলেছে ভাইয়া? আমার বাম হাত আর নেই।
আবার কান্না করে দেয় আরাফ। প্রশ্ন থেকে বাঁচার জন্য‌ই যে এমন নাকে কান্না তাও বুঝতে পারে। অফিসার রা আর প্রশ্ন না করেই বাইরে চলে যায়। থেকে যায় আতিকুর। নিরবতায় ছেয়ে যায় কিছু মুহূর্ত। হুট করে আতিকুর বললো,
~এই বাম হাত দিয়েই তো আমার ব‌উয়ের শাড়ির আঁচল টেনে ধরেছিলি? তাইনা ভাই?
ভীষণ ভাবে চমকায় আরাফ। আতিকুর হেসে উঠে দাঁড়ায়। আরাফের কাটা বাম হাতটাই টোকা মেরে কেবিনের বাইরে বের হয়ে আসে। ব্যাথায় চোখ মুখ অসম্ভব রকমের কুঁচকায় আরাফ। মনের মধ্যে অজস্র ভয়, প্রশ্ন। তবে ভাইয়া কি এসবের সাথে জড়িত? নাকি সেই করেছে তার অবস্থা? নাকি অন্য কেও?

~ আপনার বোনের প্রস্তাবে রাজি হয়েছি মি. আদিল! আপনি প্রস্তুত তো?
আবারো সেই বিকেল, সেই মুহূর্ত, সেই কেবিন! আফরা আবার এসেছে আদিলের অফিসে। আজ তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি, বরং আসার সাথে সাথেই বসের কেবিনে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে। কারণ টা যে কালকের খোলা চুলের রহস্য সে বুঝতে পেরেছে। সবাই তাকে বসের বিশেষ কেউ ভেবে নিয়েছে। নিজের কাজে নিজেই গর্ববোধ করছে আফরা। আদিল মাহমুদ কে তো টেক্কা দিতে হবে!

আফরার গলার স্বর শুনে আদিল বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই রাগে পুরো শরীর তার জ্বলে যাচ্ছে। মেয়েটা তার সাথে ওপেন গেইম খেলছে‌। অথচ মেয়েটি জানেই না, গেইমের রাজা সে! কাঁচের গ্লাস টা শব্দ করে সরিয়ে আফরার সামনে দাঁড়ায় আদিল। আফরা দু পা পিছিয়ে যায়, অবাক হয়ে দেখে আদিল কে। বাহ বেশ হ্যান্ডসাম তো! আফরা পিছিয়ে যাওয়াতে আদিল বাঁকা হাসে, তবে বেশী ক্ষণ সেই হাসি স্থায়ী হয় না। আফরা কে এগিয়ে আসতে দেখে ঠোঁটের কোণেই মিলিয়ে যায়, চোখে ফুটে উঠে অবাকতা। আফরা মিষ্টি হেসে বললো,
~ ওরে বাপস! দেখুন তো দুজন কে বেশ মানাবে না? আপনার বোনের পছন্দ আছে বলতে হবে!
চোখ বুজে আবার খুলে আদিল। শান্ত সুরে বললো,
~আপনাকে আবার সাবধান করছি মিস আফরা ইবনাত। আমাকে রাগাবেন না, এই অফিসে পা দেওয়ায় দুঃসাহস‌ও আর করবেন না। প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারবেন না!
~ কালকে লাঞ্চ টাইমে আসবো, ওকে? নিজের হাতে আপনার জন্য ভালোবেসে রান্না করবো। আপনি চাইলে খাইয়ে দিতেও সমস্যা নেই!

হাতের মুঠো শক্ত হয়, কপালের রগ গুলো কেমন ফুলে উঠেছে, রাগের তোপে ঘামছে আদিল। সামনে মেয়েটিকে এখন‌ই শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে, গুনে গুনে কয়েকটা ঘা বসিয়ে দিতে পারলে হয়তো এই রাগ টা কমে যেত! তবে এখন সে অপারগ! এই অফিস টা তো তার কষাই খানা নয়!
~ ভয় পাচ্ছেন মি. আদিল মাহমুদ! বিয়ে করতে আদিল মাহমুদ ভয় পাচ্ছে নাকি? ইশশ, বড্ড আফসোস হচ্ছে!
হেসে উঠে আদিল। মেয়েটা তার জেদ তুলতে চায়ছে! অথচ এই মুহূর্তে তার রাগ ছাড়া কিচ্ছু হচ্ছে না! আফরার ধারণা কে ভুল প্রমাণ করে আদিল হেসেই বলে,
~ আমি বিয়ে তাকেই করবো, যার জীবনে নায়ক হবো, খেলার গুটি নয়! সো মিস আফরা ইবনাত! ইউর প্ল্যান ফ্লপ!
~ আমি নাহয় আপনার জীবনে খলনায়িকা হয়েই ঢুকে যাবো! খলনায়িকা কিন্তু পারমিশন নেয় না! প্রয়োজন‌ই পড়ে না!

আদিলের এবার বেশ ভালো লাগছে! মেয়েটি গভীর জলের মাছ! অনেক দিন পর ঠিকঠাক খেলোয়াড় পেল! খেলাটা জমে যাচ্ছে মনে হচ্ছে! নিজেও ভাবালেশ বলে উঠে,
~ আমার জীবন, একমাত্র চাবিকাঠি আমার হাতেই! তো মিস খলনায়িকা, অল‌ দা বেস্ট! এবার যাবেন তো?
~ আপনি চাইলে আমি থেকে যাবো! আমার তো কোনো সমস্যা নেই!
~ আমার বিরাট সমস্যা রয়েছে! আমার জীবন, আর আমি নামক মানুষ টা কারোর জন্য‌ই থেমে থাকে না! আর আপনি থাকলে, পুরোটাই টাইম ওয়েস্ট! সো প্লিজ, দরজা খোলা আছে!
আফরা কিছুটা শব্দ করে হাসতে হাসতেই বের হয় কেবিন থেকে। আবার দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বলে উঠে,
~ আমি আপনার সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছি মি. আদিল মাহমুদ! আপনার হার খুব তাড়াতাড়িই দেখবেন! শুধু সময়ের অপেক্ষা!

আদিল শান্ত দৃষ্টি ফেলে একপলক দেখে নেয় আফরা কে! তারপর দুর্বোধ্য হেসে নিজের সিক্রেট কেবিনে ঢুকে পড়ে। আফরা আগের দিনের মতোই বাঁধা খোঁপা টা খুলে দেয়। আজ মনটা বেশ‌ ফুরফুরে লাগছে! কিছুটা হেলতে দুলতেই অফিস থেকে বের হয়! হাঁটতে হাঁটতেই আবার খোঁপা বেঁধে রিকশা ডেকে বসে পড়ে। উদ্দেশ্য হসপিটাল! এবার একটু আরেকজনের ভেতর টা নাড়িয়ে দেওয়া যাক!
ধরণীতে সবে সন্ধ্যা নেমেছে। সূর্যটা রক্তিম রঙে রাঙা হয়ে বিদায় নিয়েছে কিছুক্ষণ হলো। তবে ঘুটঘুটে অন্ধকার এখনো রাজ করতে পারে নি। রিকশাওয়ালা টা একটু পর পর পেছনে ঘুরছে। আফরার সেদিকে দৃষ্টি নেই, সে প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত। হুট করেই রিকশাওয়ালা বললো,

~ আপা হাসপাতালে কেন যাইতাছেন?
~ হসপিটালে মানুষ কেন যায় মামা?
রিকশাওয়ালা ইতস্তত ভঙ্গিমায় হাসলো। আফরা হাসিটা দেখলো তাকিয়ে, কি স্বচ্ছ হাসি। নেই কোনো জটিলতা, কুটিলতা। নেই কোনো আর্ট! পান খাওয়া লাল দাঁত গুলো কেমন অবলীলায় বের করে হাসছে, তাকে কেমন দেখা যাচ্ছে সেটা ফেক্ট না! হাসিতে যে আনন্দ ঝরে পড়ছে সেটাই মুখ্য। রিকশাওয়ালা আমতা আমতা করে বললো,
~ না মানে হাসপাতালে মানুষ সাইজা যায় নাহি?
আফরা হেসে উঠলো! সে সেজেছে? নিজেকে একটু দেখে নিলো। সাদা থ্রিপিস, গলায় ছোট স্কার্ফ, কানে দুল, ঠোঁটে একটু লিপস্টিক! এইতো! তাকে কি একটু বেশীই সুন্দর লাগছে নাকি? হেসেই বললো,
~ কেন মামা? হসপিটালে মানুষ সেজে যেতে পারে না?
~ হাসপাতালে গেলে তো কান্দন আহে আপা, কত মাইনষের আহাজারি।

~ আমি তো মামা, অন্যদের কান্না দেখতেই যাচ্ছি। মাঝে মাঝে মনের‌ মধ্যে কেমন আনন্দের ঢোল বাজে অন্যের কান্না দেখে! আর এই রূপ দিয়ে কি হবে মামা? যদি না মানুষ তা দেখে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যায়!
রিকশা থেমে যায়, আফরা হেসে নেমে পড়ে, পাঁচ টাকা ভাড়া বেশী দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। রিকশাওয়ালা মামা অবাক চোখে মেয়েটির হাঁটা দেখে। এ কেমন মেয়ে? মানুষের কান্না দেখে যার হাসি পায়, আনন্দ পায়! বহুত মানুষ সে জীবনে দেখেছে, এই মেয়ের মতো আর দেখে নি! কত বিচিত্র মানুষ, কত বিচিত্র তার ভাবনা! রিকশাওয়ালা আবার ছুটে চলে নতুন যাত্রীর খুঁজে। রাত যতক্ষণ না গভীর হয় ততক্ষণ ছুটেই চলবে যাত্রীর খুঁজে!
হসপিটালের ভেতর ঢুকে আফরা ফোন বের করে। মেসেজ অপশনে ঢুকে কেবিন নম্বর দেখে নেয়! হাতের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে পা চালিয়ে হাঁটা ধরে। নিজ চোখে না দেখা পর্যন্ত শান্তি লাগবে না। মন জুড়াবে কেমন করে?
নিজের কেবিনে শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে আরাফ। বাম হাত গেছে তো কি হয়েছে, ডান হাত আছে, দিব্যি ফোন ধরে রাখা যায়! কেবিনের দরজা খুলার শব্দ শুনে তাড়াহুড়ো করে ফোনটা রেখে দেয়! আফরা কে দেখে বিস্মিত হয়ে যায়! আফরা মুচকি হেসে টুল টেনে বসে। হাসি ধরে রেখেই বলে,

~ বেশ অবাক হয়েছেন দেখছি!
~ তুমি এখানে?
~ দেখতে এলাম। পরিচিত তো, সে যেভাবেই হোক। খারাপ কিংবা ভালো! তো এক্সপেরিয়েন্স কেমন?
~ এমন ভাবে বলছো, যেন বেশ মজা পেয়েছো! আর আমি কোনো এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়েছিলাম! মজা নিচ্ছ?
~ কি যে বলেন, মজা নিবো কেন? তবে আপনার এই অবস্থা দেখে আমার একটা কথা খুব মনে পড়ছে!
~ কি কথা?
~ পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে!
রক্তিম চোখে তাকায় আরাফ। যেন চোখ দিয়েই ধ্বংস করে দিবে সব। আফরা গা জ্বালানো হাসি ফেরত দিয়ে বলে উঠে,

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫

~ এই হাত টা দিয়েই তো কোনো মেয়ের সম্ভ্রমে থাবা বসিয়েছিলেন! কিন্তু আফসোস, দেখুন পরিণতি!
হেসে কেবিন থেকে বের হয়ে যায় আফরা। আরাফ চোখ বুজে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। রহস্য গুলো কেমন গুহা থেকে বের হচ্ছে! মেয়েটার এসব বলার কারণ কি? কেন বললো? মেয়েটা কি জানে? জড়িত রয়েছে? নাকি তাকে তার পাপের দৃশ্য মনে করিয়ে দিল শুধু!

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৭