হলুদ বসন্ত পর্ব ২৯

হলুদ বসন্ত পর্ব ২৯
জাওয়াদ জামী জামী

দীর্ঘ রজনী, ঘুমহীন দু জোড়া চোখ। একজন সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করছে৷ অপরজন কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত, তার অভিযোগের খাতাও পূর্ণ হয়েছে। অভিমানও ফিঁকে হয়ে এসেছে অনেকটাই৷ তবুও সুক্ষ্ম একটা অস্বস্তি এখনো দুজনের মাঝে রয়েই গেছে। ইশরাক একটু নড়ল। হয়তো সে কিছু বলছে চাইছে, হয়তো দীর্ঘশ্বাস চাপার চেষ্টা করছে। শব্দ আসেনা, শুধু গভীর রাতের নিস্তব্ধতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
বাতাসে জানালার পর্দা সামান্য দুলে ওঠে। তবে কি দুজনের মধ্যকার নিরবতার দেয়াল ভাঙ্গবে? নাকি নতুন কোন সকাল আসার আগেই তারা নিজেদের মত করে মুখ ফিরিয়ে নেবে?
প্রতিটা ক্ষন অসহ্য ঠেকছে ইশরাকের কাছে। নিঃশ্বাসও ওর সাথে বেইমানী করছে। তারা ধীর গতিতে চলাচল করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি প্রানটা বেরিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে উঠে বসল ইশরাক। এক ঝলক তাকাল অবনীর দিকে। বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইল।

অবনী কপাল কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করল কি হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে ওরা এক বিছানায় আছে। অথচ একদিনও ইশরাককে এমন অস্থির হতে দেখেনি। কি হয়েছে তার? একবার পাশ ফিরে দেখবে নাকি? একই বিছানায় দুজন মানুষ শুয়ে আছে। একজন ছটফট করছে অথচ অপরজন চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকবে এটা কি আদৌও সম্ভব?
” কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে? ”
অবনীর প্রশ্নে চোখ খুলল ইশরাক। তার ঠোঁটে কি অস্পষ্ট হাসির রেখা ফুটে নিমেষেই মিলিয়ে গেল?
” কিছুই হয়নি। রাত জাগিসনা, ঘুমিয়ে পর। কালকেও বাড়িতে মেহমান থাকবে। মায়ের সাথে তোকে অনেক কাজ করতে হবে। তাই তোর ঘুমানো দরকার। ”
” হুঁ। আপনি ঘুমাবেননা? ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আগে আমাকে ‘ তুমি ‘ বলতিস। এখন ‘ আপনি ‘ কেন? ”
ইশরাকের এমন প্রশ্নে থতমত খায় অবনী। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়।
” আগের আমি আর এখনকার আমির মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। তাছাড়া আগেরকার মত স্বাভাবিক সম্পর্কও নেই দুজনের মধ্যে। দুজনের ক্ষেত্রে মধুর সম্ভাষণের জন্য সুসম্পর্ক থাকতে হয়। যেটা আমাদের মধ্যে নেই। ”
” এখন নেই বলে কি ভবিষ্যতে হতে পারেনা? আমরা চাইলেই সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। ”
” না পারেনা। ” ইশরাকের দিকে তাকালনা অবনী। পাশ ফিরে শুয়ে পরল। এই মুহূর্তে ইশরাকের দিকে তাকানো মানেই, ইশরাকের চোখে নিজের দুর্বলতাকে প্রকাশ করা যেটা চায়না অবনী। ও চায় মানুষটা আরও একটু পুড়ুক। বিচ্ছেদের অনলে পুড়ে খাঁটি হোক তার ভালোবাসা।
অবনীর সরাসরি উত্তর শুনে ইশরাক বিষাদের হাসি হাসল। ওর মনে হল, অবনীর মন পাওয়া এ জীবনেও হয়ে উঠবেনা।

” এ তুই কি বলছিস, বাপ? এখনই চলে যাবি? কিন্তু কেন? তোর তো রাতে যাওয়ার কথা ছিল? যাসনা, বাপ। বাড়ি ভর্তি মেহমান, এখন যদি তুই চলে যাস, কেমন হবে বল? ”
” জিদ করোনা, মা। মেহমানদের তোমরাই আপ্যায়ন করতে পারবে। আমার এখনই যেতে হবে। ইমারজেন্সী না হলে আমি যেতামনা। একটু বোঝার চেষ্টা কর, মা। ” ইশরাক মিথ্যা বলল। কোন ইমারজেন্সী কাজ নেই তার। সে শুধু অবনীর ওপর অভিমান করেই যেতে চাইছে। অবশ্য অভিমান বললে ভুল হবে, সে অবনীর মাথা ব্যথার কারন হতে চাইছেনা। ওকে দেখলেই অবনীর কুঁকড়ে যাওয়া, আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া কিংবা বিরক্ত হওয়া ইশরাকের চোখ এড়ায়নি। তাই সে অবনীকে দুদণ্ড শান্তি দিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

” তোর যখন কাজ পরে গেছে, তাহলে যা। কিন্তু না খেয়ে তোকে যেতে দেবো না। রান্না শেষ, তুই খাবি চল। ”
” এখন খেতে বসলে বাস মিস করব, মা। আমি রাস্তায় খেয়ে নেব। তুমি এত উতলা হয়োনা। ”
ছেলে না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে এটা মানতে পারছেননা নাজমা আক্তার। কিন্তু তার জেদি ছেলের সাথে পেরে ওঠার সাধ্য কারো নেই। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল ইশরাক। চোখের জলে ছেলেকে বিদায় দিলেন নাজমা আক্তার।
অবনী দূর থেকে ইশরাকের চলে যাওয়া দেখল। ও খুব করে আশা করেছিল ইশরাক পেছন ফিরে তাকাবে। কিন্তু ওকে নিরাশ করে ইশরাক দৃঢ় পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। অভিমানের মেঘ জমল মনের গহীনে। অভিমানে কেঁদে ফেলল অবনী। বিরবির করে বলছে, সে কেন এত কষ্ট দেয় আমাকে? কেন এতটা কাঁদায়?

” এই যে মেয়ে, তোমার স্বামী চলে গেল আর তুমি খিলখিলিয়ে হাসছ! আশ্চর্য মেয়ে তুমি! তোমার জায়গায় আমি থাকলে কেঁদে বুক ভাসাতাম।তোমরা এখনকার মেয়েদের ভেতর ভালোবাসা তো নেই, সেই সাথে লাজলজ্জা বলতে কিছুই নেই। তোমাকেও আমার নির্লজ্জই মনে হচ্ছে। ” রিজিয়া বেগম যেন অবনীকে অপমান করতেই কথাগুলো বলল। উঠান ভর্তি মানুষজনে৷ সামনে সে অবনীকে কথার বানে জর্জরিত করল।
এমনিতেই অবনীর মন খারাপ, তারওপর রিজিয়া বেগমের কটুবাক্য শুনে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেল। একদিন হয় সে এই বাড়িতে এসেছে, এরইমধ্যে সে এই বাড়ির লোকজনের বিষয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে!

” আপনি কিভাবে বুঝলেন আমার লজ্জা নেই? আমি কি আপনার মাথায় কাঁঠাল ভেঙেছি? স্বামী চলে গেছে বলে কি এখন আমাকে উঠানে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে হবে? আমি নির্লজ্জ হলে আপনি কি? আপনি তো আস্ত একটা ডাইনী। একটা এতিম মেয়ের সাথে কি ব্যবহার আপনি করেছেন সেটা সবাই জানে। কি পরিমান নির্লজ্জ হলে একটা মা হারা মেয়ের কাছ থেকে তার বাবাকে ছিনিয়ে নেয় সেটা সবাই জানে। আটাশ বছর ধরে যে মানুষটা শ্বশুর বাড়িতে পরে রয়েছে, একবারও তার খোঁজ নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি আপনারা। আজ তারই বাড়িতে এসে আসন গেড়েছেন, লজ্জা করছেনা আপনার? স্বামীর সব সম্পত্তি মা হারা মেয়েটাকে ফাঁকি দিয়ে নিজের সন্তানদের নামে লিখে নিয়েছেন, লজ্জা করেনি আপনার? যার নিজেরই লজ্জা নেই, সে আবার এসেছে অন্যের লাজলজ্জার বিচার করতে! কি ভেবেছেন, এত বছর পর এসে এই সংসারের রাশ নিজের হাতে নিবেন? আপনি নিতে চাইলেই সেটা আমরা হতে দেব? বড়মা আপনাদের দাওয়াত দিতেই চায়নি। কিন্তু আমরা বড়মাকে রাজি করিয়েছি। বিশেষ করে আমি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম বেইমান দেখতে কেমন হয়। দেখেও নিয়েছি। বেইমান দেখার জন্মের সাধ মিটেছে আমার। ” অবনী আরও কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু মিনারা খাতুন দৌড়ে এসে অবনীকে নিয়ে তার বাড়িতে গেলেন।

নাজমা আক্তার এতক্ষণ উঠানেই ছিলেন। রিজিয়া বেগমের কথা শুনে তার রাগ হয়েছিল। তিনিই রিজিয়া বেগমের কথার প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন, তবে তার আগেই অবনীকে ফুঁসে উঠতে দেখে তিনি থেমে যান। তার সৎমাকে এতগুলো কথা শোনানোর পরও তিনি অবনীর ওপর একটুও রাগ করেননি। অবনী ভুল কিছু বলেনি। তিনিও যদি অবনীর মত প্রতিবাদী হতে পারতেন, তবে বছরে একবার হলেও বাপের ভিটায় তার পা পড়ত। আব্বার অন্তরে তার জন্য ভালোবাসা থাকত। কিন্তু আফসোস সৎমায়ের অত্যাচারে তিনি ভুলেই গেছিলেন প্রতিবাদ কাকে বলে।
” নাজমা, তোর সামনে এমনকি পুরো বাড়ির মানুষের সামনে তোরই ছেলের বউ তোর মাকে অপমান করল, আর তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস? এটা আমি তোর কাছ আশা করিনি। আর তুই কি সত্যিই আমাদের দাওয়াত করতে চাসনি? কেমন মেয়ে তুই! ” নাজমা আক্তারের আব্বা আফসোস করে বললেন।

” শুরুটা কিন্তু আমার তথাকথিত মা-ই করেছিল। তার কি দরকার ছিল আমার পুত্রবধূকে অপমানজনক কথা বলার? আমার ছেলে চলে গেছে জন্যই কি অবনীকে লোক দেখানো কান্না কাঁদতে হবে? ওর মনের মধ্যে কি চলছে সেটা কাউকে দেখানোর দরকার নেই। আর আমি কেমন মেয়ে সেটা নিশ্চয়ই আপনি জানেন? আবার আমাদের পরিচিত অধিকাংশ মানুষই আপনি কেমন বাবা। আপনি আপনার স্ত্রীর কথা শুনে আমার সাথে কেমন আচরণ করেছেন সেটা অনেকেই জানে। আমাকে ঠকিয়েছেন সেটাও জানে। হ্যাঁ, এটা সত্যি আমি অবনী আর ইশুর বাবার জন্যই আপনাদের দাওয়াত করতে বাধ্য হয়েছিলাম। নয়তো যে বাবা আমাকে অনেক বছর আগেই পর করে দিয়েছে, তাকে দাওয়াত করার কোন প্রয়োজন ছিলনা। ”

নাজমা আক্তারের কথা শুনে লজ্জায়-অপমানে চেয়ার ছাড়লেন নাজিমুদ্দিন। তিনি স্ত্রী-সন্তানদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিলেন। রাগে তার চেহারা লাল হয়ে গেছে।
” তুই আমার মেয়ে, সেটা ভাবতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। নিজের বাবা-মাকে অপমান করতে তোর একটুও খারাপ লাগলনা? তুই আসলে কারও মেয়ে হবার যোগ্য নয়, না কারো মা হওয়ার যোগ্য। ” আবারও নাজমা আক্তারকে অপমান করলেন তার আব্বা।

” ব্যস, অনেক বলেছেন। এবার থামুন। আমার মা কেমন সেটা ছেলে হিসেবে আমরা ভালোই জানি। সে যে একজন যোগ্য মা, যোগ্য স্ত্রী, যোগ্য পুত্রবধু এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনি যে বাবা হিসেবে অযোগ্য এটা একশোভাগ সত্যি। কিভাবে পারলেন, নিজের ঔরসজাত সন্তানকে পর করে দিতে? তার বিয়ে দিয়ে বাবার কর্তব্য পালন করেছেন ভেবেছেন? কিন্তু বিয়ের পর একবারও তার খোঁজ নিয়েছেন? শ্বশুর বাড়িতে মা হারা মেয়েটা কিভাবে দিনাতিপাত করছে সেই খবর রেখেছেন? সেই মেয়ে যে দুই সন্তানের মা হয়েছে, সেই খবর জানতেন? দুই নাতীকে দেখতে এসেছেন কখনো? আজ আটাশ বছর পর এসে গলায় এত জোর থাকে কিভাবে? দ্বিতীয় স্ত্রী আর তার সন্তানরা আপনার কাছে সবকিছু এটা জানতাম, কিন্তু এটা বুঝতে পারিনি আমার মা আপনার কাছে এতটা ঘৃণার পাত্রী। আরে আপনি আমার মাকে ঘৃণা করবেন কি? আমরাই আপনাদের ঘৃণার চোখে দেখব আজকের পর থেকে। নিজেদের জাত চিনিয়ে গেলেন আপনারা। ” শান্তশিষ্ট সাদাফ মায়ের অপমানে রেগে গেল।

হলুদ বসন্ত পর্ব ২৮

এরপর আর এই বাড়িতে তাদের থাকা চলেনা। নাজিমুদ্দিন তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নিলেন। ঠিক তখনই নাজমা আক্তার এসে তাদের নিয়ে আসা মিষ্টির প্যাকেটগুলো নাজিমুদ্দিনের হাতে ধরিয়ে দিলেন।
” এগুলো নিয়ে যান। মিষ্টি আমার কোনকালেই পছন্দের ছিলনা এটা হয়তো আপনার জানা নেই। ” কথাটা বলেই বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন নাজমা আক্তার। হতভম্ব নাজিমুদ্দিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। এরপর সবাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

হলুদ বসন্ত পর্ব ৩০