হলুদ বসন্ত পর্ব ৩২

হলুদ বসন্ত পর্ব ৩২
জাওয়াদ জামী জামী

” স্যার, আপনি আগে বলবেননা আপনি এএসপি স্যারের বন্ধু? এইমাত্র ডিএমপি কমিশনার স্যার আমাকে ফোন দিয়েছেন। এএসপি স্যার কমিশনার স্যারকে ফোন দিয়েছেন আপনার কেস আমলে নেয়ার জন্য। কিন্তু স্যার, আমি বুঝতে পারছিনা, এএসপি মৃদুল স্যার থানায় ফোন না দিয়ে কমিশনার স্যারকে ফোন দিল কেন? ” ডিউটি অফিসার বিগলিত গলায় জিজ্ঞেস করল।
” কমিশনার স্যার মৃদুলের চাচা। আর কিছু জানার আছে আপনার? ” ইশরাক শান্ত স্বরে বলল।
” কিছু মনে করবেননা স্যার, লোকটাকে আপনি মারতে মারতে আধমরা করে ফেলেছেন। তার বাঁচার চান্স ফিফটি ফিফটি। তার পরিবার থেকে নিশ্চয়ই আপনার বিরুদ্ধে কেস করবে। তখন কি করবেন, স্যার? ”

” আমরা প্রমান দেখিয়ে দেব, মাহি অবনীকে মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বিরক্ত করত। আজও সে আগেই অবনীকে এ্যাটাক করেছিল। এবং ওকে হ্যারাজ করেছে। আমি নিজে স্বাক্ষী দেব এবং হোস্টেলের কয়েকজনও অবশ্যই অবনীর পক্ষেই কথা বলবে। আপনাকে অভিযোগ লিখতে বলা হয়েছে, আপনি অভিযোগ লিখুন। আর হ্যাঁ, ভবিষ্যতে অবশ্যই নিজেকে একজন দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে প্রমান করতে সত্যের পক্ষে লড়ার চেষ্টা করবেন। ” অবনীর সাথে থানায় ওর বন্ধু মিশমি এসেছে। সে তীক্ষ্ণ গলায় ডিউটি অফিসারকে উপহাস করল।
ডিউটি অফিসার মুখ কালো করে মিশমির ভাষন শুনল।
” আপনার পরিচয়? ভিক্টিমের সাথে আপনার সম্পর্ক কি? ” ডিউটি অফিসার চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
” আমি মিশমি রেজা। অবনীর বন্ধু আমি। একসাথেই হোস্টেলে থাকি আমরা। আমার বাবা ব্যারিষ্টার শহীদ রেজা, মা প্রফেসর সালমা রেজা। ও হ্যাঁ, আমার মামা সাদিক আমীন যিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ে সচিব হিসেবে কাজ করছেন। আর কিছু জানতে চান? ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” ন…না ম্যাম, যা বলেছেন এটাই যথেষ্ট। আমি অভিযোগ নিচ্ছি। শুরু থেকে বর্ননা করুন সকালে কি ঘটেছিল। ”
মিশমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু বর্ননা করল।
” মাহি জানতনা ম্যাম বিবাহিতা? ”
” অবনী তাকে ভর্তি হওয়ার পরপরই বলেছিল, ও ম্যারিড। কিন্তু মাহি ওর কথা বিশ্বাস করেনি। যেহেতু অবনী কারও সাথেই তেমন একটা কথা বলতনা, মিশতনা তাই ও মাহিকে বিশ্বাস করাতে যায়নি। ইভেন আমরাও বিশ্বাস করিনি ও বিবাহিতা। আমরা ভেবেছিলাম, অবনী আমাদের সাথে মজা করেছে। ”
” কেন বিশ্বাস করেননি? স্পেসিফিক কোন কারন? ”
” আমরা ভেবেছিলাম, ও ছেলেদের থেকে দূরে থাকতে নিজেকে বিবাহিতা পরিচয় দিয়েছে। মাহিও সেটাই ভেবেছিল। এটা সে নিজে বলেছে। আচ্ছা, আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন? আপনি কি কোনভাবে মাহির পক্ষ নিতে চাচ্ছেন? ”
” তদন্তের স্বার্থে জানতে চাচ্ছি, ম্যাম। ” এরপর আর কোন কথা হলোনা। ডিউটি অফিসার অভিযোগ নিলে ইশরাক সবাইকে নিয়ে থানা থেকে বেড়োনোর উদ্যোগ নিল।

” চলুন আপনাকে পৌঁছে দেই। আপনাকে হোস্টেলে নামিয়ে দিয়ে আমরা বাসায় যাব। ” সাদাফ মিশমিকে বলল।
” নো থ্যাংকস। আপনারা চলে যান। অবনীর শরীরটা বোধহয় ঠিক নেই। আমি রিক্সা নিয়ে চলে যাব। ”
” না করবেননা। আমরা হোস্টেলের পাশ দিয়েই যাব। সাদাফ, গাড়ি দেখ। ”
” ভাইয়া, আমার কথা শুনুন, আপনি অবনীকে নিয়ে বাসায় যান। আমার জন্য চিন্তা করবেননা। আমার একটু কাজ আছে। আমি কাজ সেড়ে হোস্টেলে যাব। ”
” ওকে। সময় করে একদিন বাসায় আসবেন। ভালো লাগবে আপনি আসলে। ”
” শিওর। ”

ইশরাক সাদাফ দুই ভাইকেই পছন্দ হল মিশমির। স্বল্পভাষী দু’জনের মধ্যে ব্যাক্তিত্বের ছটা দেখে অবাক হয় মিশমি। সেই সাথে বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। বাবা-মার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। যাকে মিশমির পছন্দ নয়। যার অবস্থান কিনা মিশমির বিপরীত মেরুতে।
চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়েই অবনীর মাথা ঘুরে গেল। তাল হারিয়ে পরে যেতে লাগলে ইশরাক ওকে ধরে ফেলল।
” অবনী, ঠিক আছিস তুই? কোথায় খারাপ লাগছে আমাকে বল? ” ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল ইশরাক।
অবনী কিছু না বলে ইশরাকের দিকে তাকাল। ওর চেহারা দেখে ইশরাক বুঝে গেল মেয়েটা ঠিক নেই। প্রায় সাথে সাথেই ইশরাক অবনীকে কোলে তুলে নিল। ইশরাকের এমন কাজে অবনী প্রথমে ভয় পেলেও পরক্ষণেই দু হাত দিয়ে ইশরাকের গলা পেঁচিয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখল। মিশে রইল ইশরাকের বুকের সাথে।

মিশমির মন নিমেষেই ভালো হয়ে গেল দৃশ্যটা দেখে। সায়েমও এমন। সে-ও মিশমির সামান্য মন খারাপেই উদগ্রীব হয়ে পরে। ওর মন ভালো করতে তৎপর হয়ে যায়। মনে মনে মিশমি ভাবল, চাইলেও মানুষ সবকিছু পায়না। কোন মানুষই পরিপূর্ণ নয়। মাঝেমধ্যে কিছু অপরিপূর্ণতাকেও সাথী করে মানুষকে সুখী হতে হয়।
সাদাফ গাড়ি নিয়ে আসলে ওরা রওনা দেয়। ইশরাকের কোলে মাথা রেখে গাড়ির সিটেই শুয়েছে অবনী। অবশ্য ইশরাকই ওকে শুইয়ে দিয়েছে।
বিল্ডিংয়ের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামল সাদাফ। গাড়ি থেকে নেমে আবারও অবনীকে কোলে নেয় ইশরাক। আশেপাশের সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ইশরাক কোনদিকে না তাকিয়ে অবনীকে নিয়ে লিফ্টে উঠল।

” ওয়েলকাম ঠু ইওর রেলম। ” অবনীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলল ইশরাক।
অবনী রুমের ভেতরে চোখ বুলাল। মোটামুটি গোছানো হয়েছে রুমটাকে।
” পছন্দ হয়েছে? ” আবারও জিজ্ঞেস করল ইশরাক।
মাথা নাড়ল অবনী। কথা বলার শক্তি পাচ্ছেনা।
” কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা? ” অবনীকে নিরব থাকতে দেখে ইশরাক ওর গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল।
” ক্ষুধা লেগেছে। গতকাল সকালের পর কিছু খাওয়া হয়নি। ” দুর্বল গলায় বলল অবনী।
” কেন? খাওয়া হয়নি কেন? ” অবাক হয়েছে ইশরাক।
” সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। রাতে মাথা ব্যথা করছিল। খেতে ইচ্ছে করেনি। ”
ইশরাক দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সাদাফকে পাঠাল খাবার আনতে। এরপর রান্নাঘরে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে রুমে গেল।
” তুই এমন কেন বলতো? চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে তুই না খেয়ে আছিস। শরীর তো এমনিতেই খারাপ হবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর সাদাফকে পাঠিয়েছি খাবার আনতে। ”

অবনী মাথা নেড়ে সায় জানায়। চোখ বন্ধ করে পরে রইল বিছানায়। ইশরাক ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ইশরাকের ছোঁয়া একটুও খারাপ লাগছেনা অবনীর। ওর প্রতিটা ছোঁয়ায় শিউরে উঠছে মেয়েটা।
পনের মিনিট পরই সাদাফ বাসায় আসল। ও খাবারের প্যাকেট পানি অবনীর রুমে দিয়ে বেরিয়ে গেল অবনীর হোস্টেলের উদ্দেশ্যে। অবনীর জিনিসপত্রগুলো এখনো হোস্টেলেই রয়ে গেছে। সেগুলো আনতে হবে।
ইশরাক অবনীকে খাইয়ে দিল। খাওয়ার পরপরই ঘুমিয়ে গেল সে। মাথা ব্যথার কারনে রাতে ঘুমাতে পারেনি। ক্ষুধায়, মাথা ব্যথায় শরীরটা দুর্বল ছিল। খাওয়ার পরই শরীরটা নেতিয়ে পরল। আর ঘুমিয়ে পরল সাথে সাথেই।
ঘুম ভাঙ্গলে রুমে ইশরাককে মেঝেতে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকতে দেখল অবনী। সে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে। শরীরটা ঝরঝরে লাগছে। হাই তুলে দরজার দিকে তাকাতেই দেখল ওর ব্যাগগুলো রাখা আছে।

” এসে গেছে আমার জিনিসপত্র? ”
” উঠে গেছিস? শরীর ভালো লাগছে এখন? ”
” হুঁ। ” অবনী আর কিছু না বলে সোজা বেলকনিতে গেল।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। সামনের একটা বিল্ডিংয়ের ছাদে চোখ গেল। নানান রঙের ফুলের মেলা বসেছে সেখানে। মুগ্ধ নয়নে সেদিকে তাকিয়ে থাকে অবনী। হঠাৎই উপলব্ধি করল ওর পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। অবনী গ্রীলে কপাল ঠেকিয়ে তাকিয়ে ছিল সামনের ছাদের দিকে। ওর দু হাত দু’দিকের গ্রীল আঁকড়ে ধরেছে। সে অবস্থাতেই ওর হাত দু’টোকে আঁকড়ে ধরল কেউ। থুঁতনি রাখল অবনীর খোলা কাঁধে। অবনীর বুঝতে বাকি রইলনা সে কে। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল মেয়েটার। শরীরের ভার ছেড়ে দিল ইশরাকের ওপর। ইশরাক বুঝতে পারল ওর রমনীর মনোভাব।

” কিছুক্ষণের জন্য বাহিরে যেতে হবে আমাকে। সাদাফ বাসায় নেই। একা থাকতে পারবি? ”
” পারব। ”
” ভয় করবেনা তো? ”
” উঁহু। ”
” কিছু লাগবে তোর? ”
” হুঁ। ” একটু ভেবে উত্তর দিল অবনী।
” কি? ”
” একটা লাল শাড়ী। ”
” আর? ”
” একমুঠো কাঁচের চুরি। ”
” তারপর? ”
” বেলি ফুলের মালা। ”
” আর কিছু? ”
” আলতা। ”
” এখনো আলতা পরিস? ”
” চার বছর ধরে আলতায় পা রাঙাইনা। ”
” সরি। ”
” কেন? ”
” সবকিছুর জন্য। ”
অবনী নিরব থাকল।
” আর কিছু লাগবে? ”
মাথা নাড়ল অবনী।
” কি? ”
” একটা লাল পাঞ্জাবি। ”
হাসি ফুটল ইশরাকের ঠোঁটের কোনে।
” তোর জন্য আর কি আনব সেটা বল? ”
” বলেছি তো। ”
” ভয় লাগলে আমাকে ফোন দিস। আমি যাচ্ছি। ”

হলুদ বসন্ত পর্ব ৩১

হঠাৎই অবনী ওর কাঁধে ভেজা অথচ নরম ছোঁয়া অনুভব করল। কয়েক সেকেন্ড ছিল সেই ছোঁয়ার স্থায়িত্ব। অবনী ঠোঁট কামড়ে হাসল। পেছন ফিরে তাকালনা।
ইশরাক হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অনুমতি পেয়ে গেছে। আজকের পর থেকে অবনীর সুখের কারন হবে সে। সুখের জোয়ারে ভাসাবে তার নারীকে।
বিঃদ্রঃ আগামী তিনদিন গল্প আসবেনা। বাসায় মেহমান আসবে। লিখার সময় পাবোনা। আপনারা ভুল বুঝবেননা।

হলুদ বসন্ত পর্ব ৩৩