হামিংবার্ড পর্ব ১৬

হামিংবার্ড পর্ব ১৬
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

“তুই কী করেছিস, মকবুল? কী করেছিস তুই আমার মেয়ের সঙ্গে?”
রোকসানার গলা থরথর করে কাঁপছে রাগে। চোখে যেন আগুন। তিনি তেড়েমেড়ে এগিয়ে এলেন মকবুলের দিকে, যেন ছিঁড়ে ফেলবেন তাকে।
মকবুল কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু মুখ খুললেই আরিশের লাথি। ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে তার। বারবার আরিশের কাছে কাকুতিমিনতি করে যাচ্ছে সে। আরিশের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। আর ঠিক তখনই নয়না অরার কোল থেকে ধপ করে পড়ে যায়। অজ্ঞান।
রোকসানার মনোযোগ এক ঝটকায় মেয়ের দিকে ঘুরে যায়।

“নয়না!”
ছুটে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন তিনি।
“মা, নয়নাকে ঘরে নিয়ে চলো।”
রোকসানার কণ্ঠে কান্না আর ভয় মিলেমিশে এক অসহায়তা। অরা কাঁপতে কাঁপতে নয়নাকে সামলানোর চেষ্টা করে।
“আমি পারছি না একা ধরে রাখতে মা।”
“চল, আমি ধরছি।”
রোকসানা মেয়ে আর অরার ভর নিয়ে নয়নাকে টেনে তোলেন। তার চোখে শুধু একটাই প্রশ্ন—
এ মেয়েটা ঠিক হবে তো?
“চল মা, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু হয়নি।”
অরার কণ্ঠে সান্ত্বনার ছোঁয়া, কিন্তু গলায় একরাশ শঙ্কা।
“আপনারা নয়নাকে রুমে নিয়ে যান।”
আরিশ ঠান্ডা গলায় বলে। চোখে তখনো আগুন।
“এই জানোয়ারটার বিচার আমি করছি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরা একবার তাকায় মকবুলের দিকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নয়নাকে বুকে আগলে রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
মকবুল আরিশের পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
মকবুল আরিশের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদে, ভিজিয়ে ফেলে মেঝে।
“বাবা গো! একটা ভুল হয়ে গেছে। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমি পাপ করেছি, তবু মাফ করো। এই বয়সে শরীর সইছে না আর। এত মার খেতে পারছি না বাবা!”
আরিশ থমকে যায় এক মুহূর্ত। চোখ নামিয়ে দেখে— এই লোকটাই নয়নার সর্বনাশ করতে চেয়েছিল।
গর্জে ওঠে তার বুকের ভেতর থেকে এক পশুর ডাক।
“তুই মানুষ না, মকবুল। তুই একটা ঘৃণ্য কীট!”
সে সজোরে ঘুষি বসিয়ে দেয় মকবুলের মুখে। আবার রক্ত। মকবুল ছিটকে পড়ে যায়, মুখে গোঙানি। আরিশ দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে, কিন্তু তার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
“বিশ্বাস কর, শয়তান যদি সত্যিই কথা বলতে পারত, তবে সেও তোকে দেখে বলত— ‘আমি না, এই জানোয়ারটা করেছে সব!’ তুই নিজের পাপ শয়তানের ঘাড়ে চাপাতে চাইছিস? ছি… তোর মতো ঘৃণ্য কিছু আর হয় না।”
আরিশ থমকে দাঁড়াল এক মুহূর্ত, চোখে তীব্র ঘৃণা।

জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“এই বয়সে নাকি মারধর সইছে না! অথচ এতটুকু একটা মেয়ের ওপর হাত ঝাঁপিয়ে পড়তে তোর কোনো কষ্ট হয়নি, তাই না?”
চোখদুটো লাল, কণ্ঠে বিদ্যুৎ আরিশের।
“বাস্টার্ড!”
আরেকটা ঘুষি মেরে আরিশ মকবুলকে প্রায় অচেতন করে ফেলল। মকবুল ফ্লোরে পড়ে রইল নিঃশ্বাস নিচ্ছিল কষ্টে। নিজে উঠে দাঁড়ানোরও শক্তি নেই তার। আরিশ কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলল। সংক্ষিপ্ত কথায় জানিয়ে দিল— ‘তুলে নিয়ে যেতে হবে’।
মকবুলকে আপাতত ঘরের পেছনের খোলা মাঠে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হলো। আগামীকাল থানায় যোগাযোগ করা হবে।

বিছানায় অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে নয়না। অরা বসে আছে তার পাশে। ডাক্তার এসেছে, আরিশই কল করে আনিয়েছে। ঘরের এককোনায় মাথা নিচু করে গম্ভীর মুখে বসে আছেন সোলাইমান মল্লিক। নিজের মেয়ের এই অবস্থার জন্য কোথাও না কোথাও নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে তার। কারণ দিনশেষে মকবুল তো সোলাইমানেরই বন্ধু ছিলো! রোকসানাও খুব ভেঙে পড়েছে। মেয়েটার সাথে ছোটো থেকে এরকম হয়ে এসেছে অথচ আজ! আজ সর্বনাশ ঘটতে ঘটতে, বেঁচে যাওয়ার পর সবকিছু জানতে পারলেন তিনি৷ আরিশ মকবুলের মুখ থেকেই স্বীকারোক্তি নিয়েছে, রেকর্ড করে রেখেছে সব। আপাতত আজকের রাতের জন্য নয়নাদের বাড়ির পেছনে খোলা মাঠে হাতপা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে তাকে। আগামীকাল সকালে আরিশ থানায় কল করবে।

নয়না বিছানায় নিস্তেজ পড়ে আছে। চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাস খুব ধীরে চলছে। মাথার পাশে একটা ছোট্ট টেবিলে স্যালাইন ঝুলছে। আরিশ ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে, হাত মুষ্টিবদ্ধ, মুখে তীব্র রাগ তার। বাবামায়ের উচিত সন্তানদের দিকে খেয়াল রাখা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েরা তাদের পরিচিত কিংবা আত্মীয়য়ের মাধ্যমেই যৌন হয়রানির স্বীকার হয়৷ আর এসব নির্যাতনের কথা গোপন রাখার ফলেই একদিন বড়সড় বিপদ ঘটে।
ডাক্তার স্টেথোস্কোপ সরিয়ে বললেন,
” প্রেশার খুব লো। ও এখন শকে আছে। ভালো হয়েছে সময়মতো ওকে বাঁচানো গেছে। নাহলে পরিস্থিতি অন্যরকমও হতে পারতো।”

সোলাইমান বসা থেকে উঠে মেয়ের বিছানার দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে গলা ধরে আসা স্বরে বললেন,
” ঠিক হয়ে যাবে তো? এসব কিছু মনে রাখবে না তো? মানে ও স্বাভাবিক থাকবে তো?”
” এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। ওর মানসিক অবস্থা খুব ভেঙে পড়েছে। ট্রমা কিভাবে মোকাবিলা করবে সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু সাবধানে থাকতে হবে। কাউন্সেলিং লাগতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে। চিন্তার কিছু নেই আপাতত। ”
নয়নার মা কান্না চেপে বসে আছেন বিছানার পাশে।
চোখে অশ্রু, মুখে স্তব্ধতার ছাপ। ডাক্তার ঔষধ কিছু ঔষধ লিখে বেরিয়ে যান। আপাতত নয়না মানসিকভাবে যেমন বিধস্ত তেমনই শারীরিকভাবে দূর্বল।
সোলায়মান ফ্লোরে বসে পড়ে নয়নার হাত ধরে ফিসফিস করে,

” আমার ভুলের জন্যই আজ এত বড় সর্বনাশ হতে চলেছিল নয়না। আজ থেকে যদি দরকার হয়, আমি তোর ছায়া হবো। কেউ আর তোর দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারবে না। কেউ না। ”
সোলাইমান নিঃশব্দে কাঁদছেন। আরিশ হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলো একবার, রাত ন’টা পেরিয়ে গেছে। অরা বসে আছে চুপচাপ, মুখে কথা নেই। তাদের দুই বোনের জীবনটায় কেনো এমন হচ্ছে?
” আপনারা শক্ত থাকুন। বিপদ ঘটেনি, নয়না ঠিক আছে। মানসিক যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে সেটা আপনাদের সাপোর্ট পেলেই সেড়ে যাবে। কিছুদিন বাসার ভিতরে রাখবেন নয়নাকে। লোকজনের কথা শুনলে মানসিকতা খারাপ হয়ে যেতে পারে। ”

এতকিছুর মধ্যে আরিশের এমন মনোভাব দেখে অবাক হয়েছে অরা। লোকটার মনে মায়া দয়াও আছে তাহলে! রোকসানা আরিশের দিকে এগিয়ে গেলেন। জড়িয়ে ধরলেন বুকে। আরিশ একটু কেঁপে উঠল, যেন মায়ের ছোঁয়া! কথায় বলে না? মাসির শরীর থেকে মায়ের গন্ধ আসে? আরিশের বেলায়ও তেমন হয়। এজন্যই আরিশ রোকসানার থেকে আরো দূরে সরে থাকে সবসময়। কিন্তু এই মুহুর্তে আরিশ দূরে সরতে পারলো না। আজ তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন অসহায় মা। যার মেয়ে তারই সামনে জ্ঞান হারিয়ে, বিধস্ত অবস্থায় শুয়ে আছে।
” তুই না এলে নয়নার কী হতো জানি না আরিশ। তোকে কী বলব জানি না আমি। শুধু বলব, অরাকে ভালো রাখিস বাবা। অতীতে যা হয়েছে ভুলে যা। পৃথিবীর সব নারী একরকম হয় না বাবা। ”
আরিশ কিছু বলল না। বলার ইচ্ছেও করছে না। কিন্তু নয়নার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো তার।
” কিছু হতোনা নয়নার। মকবুলের শাস্তির বিষয়টা আমি দেখব। ”
রোকসানা আরিশকে ছেড়ে দিয়ে, সোলাইমান মল্লিকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।

” দেখো তুমি এরকম করে থেকো না। মেয়েটা জ্ঞান ফেরার পর তোমাকে এমন দেখলে আরো কষ্ট পাবে। ”
সোলাইমান চোখের জল মুছে, নয়নার দিকে তাকায়। আরিশ অরার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করল, কিন্তু অরা মাথা নেড়ে ‘না ‘ বলল। আরিশ চোখ পাকাল। অরা মাথা নিচু করে ফেলল শুধু।
” আচ্ছা তামান্না তোমার বাড়িতে কেউ নেই? ”
বসার ঘরে সোফায় বসে আছে তালহা, তামান্না ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার সাজিয়ে রাখতে ব্যস্ত। তামান্না ও তাসলিমা নিজেদের ঘরে আছেন। কাজ করতে করতে উত্তর দিল তামান্না,

” না ভাইজান। থাকার মধ্যে ছিলো, একটা ভাই আর মা। বাবা তো সেই কবেই মারা গিয়েছিলেন, তখন আমি খুব ছোটো। ভাই আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়ো। একটা মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বাড়ি ছেড়েছে সে। শুনেছি তার শ্বশুর অনেক বড়লোক। এতটাই বড়লোক যে, আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেনি ভাই। ওর আত্মসম্মানে লাগত সেজন্য। এমনিতেই নানান রোগশোকে আক্রান্ত ছিলেন মা। তার ওপর ভাইয়ের এমন সিন্ধান্তে অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। তারপর একদিন হঠাৎ তিনিও…….”
তামান্নার গলা ভারী হয়ে এসেছে। দু-চোখ জল গড়িয়ে পড়ছে গালে। তালহা বিষয়টা বুঝতে পেরে তামান্নার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

” আমি দুঃখিত। প্লিজ তুমি কেঁদো না! আমরা কেউই চিরস্থায়ী নই। সবাই একদিন মা*রা যাবো। ”
” হুম। ”
গাড়ির হর্নের আওয়াজে নড়েচড়ে উঠল তামান্না। হাতের কাজ ফেলে রেখে দরজার দিকে এগোল সে। তালহা ওর পেছন পেছন যাচ্ছে।
” ভাইয়া, ভাবি এসেছে , শিওর। ”
” ভাবি?”
তামান্নার কথায় হেসে উঠল তালহা। মাথা চুলকে বলল,

” ভাবি মা এসেছে। ভাইয়া বরাবর ওভার পজসিভ ছিলো, ভাবি মা’র ক্ষেত্রে সেটা আরে বেশি। ”
তামান্না কিছু বলল না। আর কেউ না জানলেও অরার প্রতি আরিশের আচরণ কেমন সেটা তামান্না ভালো করে জানে।
খোলা আকাশের নিচে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে মকবুল। আশেপাশে কিছু নেড়ি কুকুর বসে আছে। কেনো যে নয়নার সাথে আজ এমন করতে গেলো সেই ভেবেই আফসোস হচ্ছে তার। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেছে। শরীর দূর্বল। আরিশের অত মার খেয়ে শরীরের প্রতিটি গাঁটে গাঁটে ব্যথায় ছেয়ে গেছে।
” আপনাকে এভাবে বেঁধে রেখেছে কে! ”
আচমকা কারো কণ্ঠস্বর শুনে চমকাল মকবুল। সেই সাথে খুশিও হলো বটে। সামনে তাকাল, অন্ধকারে অস্পষ্ট সব। মকবুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আটাশ/ উনত্রিশ বছর বয়সী একজন যুবক। হাতে ফোন, ফ্লাশলাইট জ্বলছে। পরনে তার কালো রঙের টি-শার্ট, সাথে জিন্স। তবে মুখে মাস্ক! আপাতত ফোনের ফ্লাশলাইটের আলোতে এতটুকুই দেখতে পেলো মকবুল।

” আ..মা..কে বাঁচাও, বা..বা। আমি ভুল করে..ছি।”
কথা জড়িয়ে যাচ্ছে মকবুলের। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল এতটুকুই। যুবক মকবুলের দিকে এগোল। ফোন মাটিতে রেখে দ্রুত মকবুলকে মুক্ত করতে লাগলো সে।
বিছানার মাঝখানে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে অরা। পরনে গোলাপি রঙের থ্রিপিস, খোঁপা করা চুল, কানে গলায় কোনো গয়না নেই এখন। সামনের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল সে। আরিশ দাঁড়িয়ে আছে, হাতে দড়ি। আজকে যা করেছে তাতে শাস্তি কতটা ভয়ানক হবে সেসব ভেবেই চোখে জল এসে যাচ্ছে অরার। ওভাবে পালিয়ে গিয়ে নিজ বাড়িতে যাওয়ার মতো ভুল কীভাবে করল সে, সেসব ভেবেই খারাপ লাগছে অরার। অবশ্য বাড়িতে গিয়েছিল বলেই আজ নয়না বেঁচে গেলো। নয়নার কথা মনে পড়তেই বুকটা খা খা করে উঠল অরার। বোনটাকে রেখেই চলে আসতে হলো। আরিশ কিছুতেই তাকে রেখে এলোনা।

” কী দেখছ হামিংবার্ড? ভয় লাগছে? ”
অরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
” দড়ি দিয়ে কী করবেন?”
আরিশের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি। সে এগিয়ে এলো অরার দিকে, অরা একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছে কেবল। কিন্তু পিছিয়ে আর যাবে কোথায়!
” দড়ি দিয়ে কী করে, বলো তো? ”
অরা চমকায়, থমকায়। আরিশ কি তাকে বেঁধে কিছু করতে চলেছে! অরা আতংকে এদিকওদিক তাকিয়ে বিছানা থেকে উঠে দৌড় দিতে চাইলে আরিশ ক্ষিপ্ত গতিতে ধরে ফেলল তাকে। অরা ঠুকরে কেঁদে উঠে বলল,
” আমি একটা মানুষ। দয়া করুন। প্লিজ এরকম করবেন না! ”

আরিশ অরাকে কোলে তুলে নিয়ে কিছুটা ঝুঁকে বিছানায় ছেড়ে দিল। ভাগ্যিস বিছানাটা বেশ নরম। নয়তো অরার কোমর আস্ত থাকত না।
” আই নিড দিস, হামিংবার্ড। ভালোবাসা চাই না, যা চাই সেটা জোর করেই আদায় করে নেবো। ”
অরা কিছু করতে পারছে না। আরিশ তার হাতদুটো খাটের মাথার ওপরে তুলে বেঁধে ফেলেছে।
” প্লিজ! প্লিজ!”
বড্ড করুণ শোনাচ্ছে অরার গলা। আরিশ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের মতো এগোলো। অরার শরীর থেকে ওড়না সরিয়ে ফেলল। তারপর নিজের টি-শার্ট খুলে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে বলল,
” আর ইউ রেডি ফর দিস?”
অরা কেঁদে বলে,
” না।”
আরিশ হাসে। অরার বুকে মাথা রেখে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
” এখানে ঘুমাব আজ। সারারাত আমাকে এভাবেই সহ্য করতে হবে তোমাকে। নড়তেও পারবে না৷ ”
অরা কিছুটা অবাক হলো। শুধু বুকে মাথা রাখার জন্য এতকিছু করলল আরিশ?

” শুধু এটুকুই? ”
” আরো কিছু চাও? তুমি বললেই সবকিছু….. ”
” না, না,না। তা বলিনি। ”
” উফ! কী ধুম তানানানা করছ? ”
অরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আরিশ অরার পেটে হাত রেখে শুয়ে আছে বুকে। ক্লান্ত লাগছে বেশ। মনে হচ্ছে অরার বুক কোনো শান্তির স্থান। যেখানে মাথা রাখতেই কেমন শান্তি শান্তি লাগছে।
” কিছু না। ঘুমান। ”
” গুড নাইট, ছোট্ট পাখি। ”
আরিশ অরার বুকের মাঝখানে একটা কিস করে। নাক দিয়ে দুষ্টমি করে কিছুক্ষণ। একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে, ওভাবেই দু’জন।
রাত তিনটা। শহরের একেবারে প্রান্তে পুরনো জাহাজঘাটের পাশে পরিত্যক্ত কারখানা। ছায়া আর শীত মিশে আছে বাতাসে। যেখানে মানুষের পা পড়েনি বহুবছর!
চেয়ারে বসে আছে মকবুল—তবে স্বেচ্ছায় নয়।

তার শরীরটা রশিতে এমনভাবে বাঁধা যেন পেশিগুলো চিৎকার করে উঠছে। মুখে গোঁজা জমাট কাপড়, চোখ দুটো ফুঁসে উঠছে ভয়ে। জ্ঞান হারিয়ে ছিলো এতক্ষণ। মকবুল কিছু বুঝতে পারছে না। যতদূর মনে পড়ে অচেনা যুবক তাকে খোলা মাঠ থেকে মুক্ত করার পর ধরে ধরে একটা গাড়িতে উঠে বসেছিল। কিন্তু তারপর?
হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। শুধু তার নিঃশ্বাসটা কুয়াশার ভেতর থেকেও শোনা যাচ্ছে। এটাই সেই যুবক! কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন? আর তাকেই বা বেঁধে রেখেছে কেনো?
“জানিস, মকবুল ধর্ষণের বিচার আদালতে হয় না এখন, এজন্য আমি নিজেই একেকটা ধর্ষককে নিজের আদালতে শাস্তি দেই।”
মকবুল আঁতকে উঠল যুবকের কথায়৷ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা কি তার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করবে? মকবুল কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,

” কে তুমি? আর আমাকে এখন কেনো নিয়ে এসেছ?”
কোনো উত্তর পেলো না মকবুল। যুবকটি ঠোঁটে হালকা একটা নির্মম হাসি নিয়ে ধীরে ধীরে ঘরের এক কোণায় এগিয়ে গেল। সেখান থেকে তুলে আনল একটা পুরনো ধাতব হুক। তার চোখে মুখে কোনো রাগ নেই, বরং অদ্ভুত এক প্রশান্তি।
চেয়ারে বসা মকবুলের হাত-পা শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। নড়ারও উপায় নেই। চোখে-মুখে আতঙ্ক জমে উঠেছে। সে জানে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, কিন্তু ঠিক কী, তা আন্দাজ করতে পারছে না।

যুবক নিঃশব্দে তার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় মকবুলের পায়ের নখের নিচে হুকটা ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে উল্টো করে তুলতে শুরু করল। মকবুল দম নিয়ে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তার শিরাগুলো ফুলে উঠল, মুখ বেগুনি ছায়া নিলো যন্ত্রণায়। সে যেন হাওয়ায় ঝুলে থাকা এক মৃতপ্রায় দেহ—নড়তে পারছে না, কাঁদতে পারছে না, শুধুই অসহায়।

হামিংবার্ড পর্ব ১৫

হুকটা একটানে উল্টো করে তুলে নিতেই কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। যুবক তাকিয়ে রইল—শান্ত, স্তব্ধ। যেন এটাই প্রাপ্য ছিল মকবুলের।
” তোর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি মকবুল। অপেক্ষা কর, সবে তো শুরু! ”

হামিংবার্ড পর্ব ১৭