হামিংবার্ড পর্ব ৩৮

হামিংবার্ড পর্ব ৩৮
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

“ সাবিহা কথা বলবে বলেছিল, কী বলবে সেটুকু শুনতে গিয়েছিলাম শুধু। তুমি তো জানোই, সকালে চলে যাবে ও। “
“ তাই বলে আপনাকে ভালোবাসি বলবে?”
“ তুমি নিজেও ভালোবাসবে না, ভালোবাসার কথা বলবে না– আর কেউ বললেও সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু কেনো বলো তো? “
চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো আরিশ। অরা ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে কেবল। সত্যি তো, এরকম কথাবার্তা কেন বলছে সে? থতমত খেয়ে গেল বেচারি। তার মনের মধ্যে যে কী অশান্তি লাগছে সেটা তো আরিশকে বোঝাতে পারছে না।

“ কিছু না। ঘুমাবো আমি। ছাড়ুন। “
অরা ধীরে ধীরে আরিশের বুক থেকে সরে এসে পাশের বালিশে মাথা রাখলো।সে মুখ ঘুরিয়ে আরিশের বিপরীত দিকে শুয়ে পড়লো।
আরিশ একটুও দেরি করলো না, পেছন থেকে ওর কোমরে আলতো করে হাত রাখলো, তারপর এক টানে তাকে নিজের দিকে টেনে নিলো।
এক নিমিষেই অরা আবার আরিশের উষ্ণ বুকের সাথে মিশে গেলো। জানেনি, চেয়েও যেন না চাওয়ার মতোই কাছে আসা যায়। বুকের স্পর্শে তার অভিমানগুলো ধীরে ধীরে গলে যেতে লাগলো।
“ প্রতিদিন তো এভাবে বুকের ভেতরই ঘুমাও। আজ আবার ছাড়তে বলছ কেন? ভাবখানা এমন তুমি বললেই যেন, কথা শুনবো আমি।”
কথাগুলো শুনে শুকনো ঢোক গিলল অরা। কিছুদিন ধরে লোকটা একেবারে ভদ্রলোক হয়ে গেছে, জোরাজোরি করতে আসে না। কিন্তু এখন যদি কিছু করে? এই লোককে একটুও বিশ্বাস নেই। কখন কী করে বসে বলা যায় না। অরা দোটানায় পড়ে গেছে। মনটাও আগের মতো নেই মনে হচ্ছে। কেমন একটা উড়ুউড়ু ভাব! কেন এমন হচ্ছে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ আপনি… আপ…”
“ হ্যাঁ, আমি?”
“ আ…পনি দূরে সরুন। আজকে আমি নিজে নিজেই ঘুমাবো, বুকের ভেতর জড়িয়ে না। “
কথা শেষ হতে না হতেই আরিশ অরাকে জাপটে ধরে বিছানায় চেপে ধরলো। অরা কিছুটা ধাক্কা দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো – পুরোটা দৃশ্য যেন কোনো এক বুনো হুলো বেড়ালের সঙ্গে কসরত। কিন্তু ওই যে, যতই চেষ্টা করুক না কেন, আরিশের বাঁধন ভাঙা গেল না। বরং প্রতিটা ছটফটানিতে যেন আরও বেশি করে জড়িয়ে গেল সে… একরকম হার মেনে নিঃশ্বাস ফেললো অরা।
“স্টে স্টিল… হামিংবার্ড!”
আরিশ একটু থামল। জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আবার বলতে লাগলো,

“যতদিন আমি বেঁচে আছি, আমার বুকেই মাথা রেখেই তোমাকে ঘুমাতে হবে। সেটা তুমি চাও না চাও– তাতে কোনো তফাৎ হয় না। কারণ আমার ভালোবাসা শর্ত মানে না, অরা। আমি তোমায় ভালোবাসি একটুখানি উন্মাদ হয়ে… এতটাই, চাইলে তোমায় নিজের করে রাখতে শাস্তিও দিতে পারি।”
অরা একদম বোঝে না, এই ছেলেটা কী বলছে! চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। তার এমন ভ্যাবাচেকা মুখ দেখে, আরিশ হেসে আলতো করে তার নাকটা টিপে দেয়। যেন চোখ দিয়ে বলে,
“বোকার মতো তাকিয়ে আছো কেন? শেষের বাক্যটা মনে হচ্ছে তোমার মাথার ওপর দিয়ে গেলো। “
“ হ্যাঁ… মানে না। “

মুচকি হাসল আরিশ। অরার কপালে চুমু খেলো একটা। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল অরা।
“ যদি কখনো পরিস্থিতি এমন হয় তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছ তখন আমি তোমাকে কখনোই যেতে দেবো না, পাখি৷ তোমার জন্য দরকার পড়লে তোমাকেই শাস্তি দেবো। আমার জিনিস কেবলই আমার। “
“ আপনি ভালোবাসেন আমাকে? “

লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে শুধালো অরা। আরিশের হৃদয়ে অদ্ভুত তোলপাড় চলছে। ভালোবাসা! সে কি ভালোবাসে অরাকে? এই যে বুক ধুকপুক করা, তার সংস্পর্শে এলে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হওয়া, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠা, তার একটু অনুপস্থিতিতে হৃদয়ে যন্ত্রণা হওয়া – এসবই কি ভালোবাসা? নিজের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে গেলো আরিশ। তাকে তো অরার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। অরা আগ্রহী হয়ে তাকিয়ে আছে, আরিশের উত্তর শুনতে হবে তাকে। আরিশ যদি এই ভয়ংকর কথাটা বলে, সে তাকে সত্যি ভালোবাসে– তখন অরা কী করবে? এই মানুষটা ভালোবাসার পথে হাঁটলে তাকে কীভাবে বলবে, অরা এখনও সংশয়ে আছে? সে জানে না আরিশের সাথে সত্যি থাকতে পারবে কি-না। মাঝে মধ্যে মনে হয়, এই জেলখানায় আর থাকা সম্ভব না। কিন্তু পরক্ষণেই আরিশের পাগলামি, কেয়ার, যন্ত্রণা দেওয়া ছোঁয়াগুলো অরাকে তার প্রতি দূর্বল করে তোলে।
“ ভালোবাসা কী জানি না, হামিংবার্ড। আমি শুধু জানি, তোমাকে চাই, আজীবন চাই। আমার জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট তোমার সাথে কাটাতে চাই আমি। এতটুকু একটা মেয়ে, কী এমন করলে বলো তো? আমি তো এমন ছিলাম না, পাখি। “

“ আমি এতটুকু একটা মেয়ে? “
আরিশের সব কথা রেখে নিজের প্রতি অপমানজনক কথাটাই ভালোমতো কানে ঢুকলো তার। আরিশ না হেসে পারলোনা আর। এই প্রথম আরিশকে প্রাণ খুলে, শব্দ করে হাসতে দেখলো অরা।
“ নিজের দিকে তাকাও, তারপর আমার দিকে দেখো একবার। “
অরা অবাক হয়ে তাকালো। নিজের দিকে চোখ গেল, তারপর ধীরে ধীরে আরিশের দিকে।
কিন্তু ওমা! আরিশ তো তার ওপর এভাবে চেপে আছে যে, সে তো ওকে ঠিকমতো দেখতেই পাচ্ছে না!
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলো—
‘আরেকটু লম্বা হলে… আরেকটু মোটা হলে… আজই এর অপমানের উপযুক্ত জবাব দিয়ে দিতাম।’
“ থাক এসব। ঘুমাতে হবে। সকালে এয়ারপোর্টে যেতে হবে আবার। সকাল সকাল ফ্লাইট সাবিহার। “
“ আপনি যাবেন?”
“ যাবো না?”

অরা সরাসরি কিছু বলতে পারলোনা। চুপ করে রইলো। আরিশ তাকে নিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে বলল,
“ জানো অরা মাঝে মধ্যে ভাবি, তুমি যদি আমাকে আমার মতো করে ভালোবাসতে! পরক্ষণেই মনে হয়, তাহলে আমি খুশিতে মরে যেতাম। “
“ এসব বলতে নেই। “
“ ওহ ভালো কথা, ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম আজ। বললেন আমি মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছি। ঠিকমতো চললে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবো। আমি কি সত্যি অসুস্থ? “
অরা কী বলবে বুঝতে পারছে না। যদি বলে সে অসুস্থ এবং তারপর যদি আরিশ রেগে যায় তখন?
“ আপনি ঠিক আছেন। এত ভাববেন না, ঘুমান। “
মৃদু হাসল আরিশ। অরার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। কয়েক মিনিট ওভাবেই চলল সব। তারপর দু’হাতে আগলে ধরল অরাকে।

গ্রীষ্মের শহরের দুপুরে রোদের তাপে রাস্তা পুড়ে যাচ্ছে। গাড়ির হর্ন, ক্লান্ত মানুষ আর দূরে শুয়ে থাকা রিকশাওয়ালা, সবাই যেন এক অস্থির নীরবতায় তীব্র গরমে ডুবে আছে। আকাশ রুক্ষ, আর শহর ঘাম ও ধুলোর মধ্যে বেঁচে থাকে।
মেয়ের দেশছাড়ার পর থেকে তাসলিমা খুব ভেঙে পড়েছেন। ছোটো থেকে কখনো কাছ ছাড়া করেনি সাবিহাকে, অথচ আজ এতো দূর গেলো মেয়েটা। তা-ও একা! এসব ভেবে ভেবে ভদ্রমহিলার শরীরটাও একটু খারাপ হয়ে গেছে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেননা। তালহা অবশ্য মায়ের সাথে কথা বলে, তার মন ভালো করার চেষ্টা করে। তবে একজনের শূন্যতা কখনো আরেকজনকে দিয়ে পূর্ণ হয় না। একজন মায়ের কাছে তার প্রতিটি সন্তান আলাদা আলাদা জায়গায় অবস্থান করে।

“ কাকি? “
আনমনে বসে ছিলেন তাসলিমা। তামান্নার ডাকে নড়েচড়ে উঠলেন। দুপুরের সময় এখন। সবাই খেয়ে নিলেও তিনি কিচ্ছু খাননি। সেজন্য বেডরুমেই খাবার নিয়ে এসেছে তামান্না।
“ কী হয়েছে? “
তামান্না খাবার হাতে ঘরে প্রবেশ করলো। খাটের একপাশে দাঁড়িয়ে খাবারগুলো একে একে বিছানার ওপর রাখতে লাগলো সে।
“ খেয়ে নিন। আপনি এভাবে না খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তালহা ভাই, সাবিহা আপু সবাই কষ্ট পাবেন। “
“ এতো দরদ দেখাতে হবে না। নিজের কাজে যাও তুমি। “
অন্য সময় হলে তামান্না কিছু একটা বলতো নিশ্চিত। কিন্তু এখন বলার পরিস্থিতি নেই। তাসলিমা যেমনই হোক এখন তাদের মন খারাপ। আর খারাপ সময় কারো সাথে এমনভাবে কথা বলা উচিত না যাতে করে সে আরও কষ্ট পায়।
“ খাবার রেখে গেলাম। “

তামান্না ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তাসলিমা খাতুন দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তালহার সাথে কথা বলতে হবে। দিনদিন এই কাজের মেয়েটার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে তার। এসব ভাবতে ভাবতে খাবার খেতে শুরু করলেন তিনি।
সন্ধ্যা বেলা, রহমান চৌধুরীর বাড়ির ড্রয়িং রুমে দুটি সোফায় বসে আছেন দুই ভাই, ফারুক চৌধুরী ও রহমান চৌধুরী। রুমের জানালা দিয়ে শীতল সন্ধ্যার আলো প্রবাহিত হচ্ছে, আর বাইরে কিছুটা অন্ধকার পড়তে শুরু করেছে। ঘরের কোণে একটি টেবিল, যেখানে কিছু বই রাখা, আর রান্নাঘর থেকে চায়ের হালকা গন্ধ ভেসে আসছে।
“ কোনোভাবে যদি একবার মেয়েটা বাড়ির বাইরে বের হতো তবেই খেলা জমে যেতো ভাই। “

ফারুক চৌধুরী কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই বললেন কথাটা। রহমান চৌধুরী ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখলেন।
“ শান্ত হও। কতক্ষণ বাড়ির বাইরে না বেরিয়ে পারবে? এক সময় না একসময় আরিশের স্ত্রী’কে বাড়ির বাইরে বের হতেই হবে। আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগাবো আমরা। লোকজন গুম করে দেওয়া আমাদের বা হাতের খেল ফারুক। আর একবার বিবি গায়েব হয়ে গেলে মিয়া সাহেব এমনি শেষ হয়ে যাবে।”
বড়ো ভাইয়ের কথায় বেশ আনন্দিত হলেন ফারুক। এরমধ্যে চা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন আয়েশা চৌধুরী, রহমান চৌধুরীর স্ত্রী তিনি।
“ দুই ভাইয়ের অনেক প্ল্যান-প্রোগ্রাম হলো এখন চা খেয়ে নাও, সাথে পকোড়া। “
ভাবির কথায় মুচকি হাসল ফারুক। রহমান বললেন,
“ ঠিক আছে। ভেতরে যাও এখন। “

আয়শা কেবল মাথা নেড়ে, রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। এই বাড়িতে মেয়েদের কোনো কদর নেই, তারা যেন সবসময় পর্দার আড়ালে, অনিশ্চিত এক জীবনে বন্দি। রান্নাবান্না করা, সন্তানদের যত্ন নেওয়া– এটাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব, আর সেই কাজগুলো করতে করতে জীবন চলে যায়। স্বামীর কাছে কোনোরকম সম্মান বা ভালোবাসা তাদের ভাগ্যে নেই। যেন তারা শুধুই দাসী, যাদের কাজ শুধু আদেশ পালন করা, আর কিছু নয়।
অফিস থেকে ফিরেই তামান্নাকে খুঁজছে তালহা। প্রথমে রান্নাঘর তারপর আশপাশে উঁকিঝুঁকি দিয়েও যখন পেলো না তাকে তখন তামান্নার ঘরের দিকে এগোল। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো তার রুমে। দরজা খোলাই ছিলো। কিন্তু রুমেও দেখা যাচ্ছে না মেয়েটাকে। আশপাশে তাকাতে তাকাতে ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলো তালহা। ঘরে এসে তালহাকে দেখে বেশ অবাকই হলো তামান্না।

“ আপনি! “
“ হ্যাঁ। এদিকে এসো। “
“ কেন?”
তালহা নিজেই এগিয়ে গেলো তামান্নার দিকে। তামান্না শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তালহার দিকে। ছেলেটা পকেট থেকে একটা বেকি ফুলের গাজরা বের করে তামান্নার হাতে ধরিয়ে দিলো।
“ দাঁড়াও।”
তালহা তামান্নার আধখোলা চুলগুলো পুরোপুরি খুলে খোঁপা করতে শুরু করেছে দেখে বিস্ময়ে কথা বলতেও যেন ভুলে গেছে তামান্না। খোঁপা করা শেষে চুলে গাজরাটা ভালো করে পেঁচিয়ে নিলো তালহা।
“ এবার ঠিক আছে। “
“ এসব কী ছিল? “

“ সেদিন না বললে, খোঁপায় বেলীফুলের গাজরা দেওয়ার খুব ইচ্ছে তোমার। তো ইচ্ছে পূর্ণ করলাম। “
“ হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু এটাও বলেছিলাম, নিজের প্রিয় মানুষের হাতে খোঁপায় বেলীফুলের গাজরা পড়তে চাই। “
তামান্নাকে অবাক করে দিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসলো তালহা। তার চোখেমুখে দৃঢ়তা। তামান্না পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, তার চোখে কিছুটা অবিশ্বাসও ছিল। পরনে সাদা শার্ট, কালো স্যুট আর ফরমাল প্যান্ট – একেবারে পরিপাটি, সজ্জিত। ঠোঁটের কোণে একটা প্রসস্থ হাসির রেখা । কোটের পকেট থেকে একটা গোলাপি রঙের গোলাপ ফুল বের করে সামনে বাড়িয়ে দিলো তালহা। গোলাপি রঙের গোলাপ পছন্দ তামান্নার। মেয়েটার সবকিছু যেনো এখানেই থমকে গেছে। বিশ্বাস করতে পারছে না কী হচ্ছে বা হতে চলেছে।
“ মিস তামান্না ভাটিয়া, ডু ইউ ম্যারি মি? আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?”

নিঃশ্বাস যেন আঁটকে এসেছে তামান্নার। চোখ ছলছল করছে। তালহা হেসে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তামান্না কী বলবে বুঝতে পারছে না। যা হচ্ছে তা অবিশ্বাস্য লাগছে ওর কাছে।
“ সমস্যা নেই, বসেই আছি আমি। আপনি সময় নিন। তামান্না ভাটিয়া বলে কথা। “
তামান্নার ঠোঁট কাপছে, গলা শুকিয়ে আসছে। কী করবে বুঝতে না পেরে তালহার মুখোমুখি বসে পড়লো সে। হু হু করে কেঁদে উঠল। ভড়কাল তালহা। কোনোকিছু না ভেবে বুকে জড়িয়ে ধরল তামান্নাকে।
“ এই তামু, আমি কি তোমাকে ভুল কিছু বললাম? বিশ্বাস করো তোমাকে কষ্ট দেওয়ার মতো কিছু করতে চাইনি আমি। নিজের সাথে বোঝাপড়া করে তবেই এই সিন্ধান্তে উপনীত হয়েছি আমি। তুমি না চাইলে কোনো সমস্যা নেই। আমরা আগের মতোই থাকবো। প্লিজ কান্না করো না। তোমাকে এভাবে দেখতে একটুও ভালো লাগছে না আমার। “
তামান্না তালহাকে ছাড়িয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ওড়না দিয়ে চোখমুখ মুছল। তালহা কিছু বুঝতে পারছে না, এখনও ওভাবেই বসে আছে।

“ আবার প্রপোজ করুন তালহা ভাই। ‘
মুচকি হেসে বলল তামান্না। তালহা জোরে হেসে উঠল।
“ ডু ইউ ম্যারি মি, মাই কুইন?”
“ হুম। “
তামান্না তালহার হাত থেকে গোলাপটা নিলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল তালহা। তামান্নাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে দূরে সরে গিয়ে বলল তামান্না,
“ বিয়ে করবো বলেছি, জড়াজড়ি করবো বলিনি। “
“ উপস! ভুল হয়ে গেছে আমার। ক্ষমা করে দিন মহারাণী। “
“ হুম ভুল তো করেছেনই। “
“ তো শাস্তি দিতে চাচ্ছো?”
“ না। মানে আপাতত না। পরে ইচ্ছে হলে বলবো। “
“ ওখে। আপাতত চলো, খিদে পেয়েছে খুব। “
দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাল তামান্না। রাত দশটা বাজলো বলে!
“ হ্যাঁ, হ্যাঁ চলুন। ডিনারের সময় হয়ে গেছে। ভাইয়া, ভাবিও খেতে চলে আসবে।”
“ হুম চলো। “

দু’জনে একসাথে ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগোতে লাগলো। বিষয়টা দূর থেকে খেয়াল করেছে অরা। হঠাৎ ওদের একসাথে ঘর থেকে বের হতে দেখেই কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসল মেয়েটা।
“ শরীর কেমন এখন?”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ। স্ক্রিনকেয়ার নিয়ে খুব সচেতন সে। রাতেও তার স্ক্রিন কেয়ার বাদ যায় না। অরা চেয়ারে বসে আছে, চুপচাপ।
“ ভালো। “
“ ভার্সিটি কবে যাবে?”
নড়েচড়ে উঠল অরা।
“ আপনি যেদিন সময় পাবেন। “
“ বেশ, কাল চলো তাহলে। সব ফর্মালিটিস কমপ্লিট করে আসবো। “
ভীষণ খুশি লাগছে অরার। সে কখনো ভাবেনি এ বাড়িতে থেকে তার লেখাপড়া হবে। যদিও লেখাপড়া অপছন্দ ছিলো অরার। কিন্তু সেদিন রনির বলা কথাগুলো শোনার পর থেকে অরা এটা অনুভব করেছে, লেখাপড়া আসলেই দরকার।
“ আচ্ছা। “
গায়ের টি-শার্ট খুলে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল আরিশ। অরা আঁড়চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
“ আচ্ছা হামিংবার্ড, এমনিতে তো খুব বকবক করো তুমি। কিন্তু আমার সাথে এতো কম কথা বলো কেন?”
চমকাল অরা। এই লোক কীভাবে জানলো সে বকবক করে? কারণ এ বাড়িতে আসার পর থেকে তো আরিশের সাথে কিংবা বাকি কারো সাথেই তেমন কথা বলে না সে।

“ কই!”
ক্রুর হাসল আরিশ। এগিয়ে গেলো অরার দিকে। আচমকা অরার হাতদুটো চেয়ারের পিছনে চেপে ধরে, অন্য হাতে থুতনিতে শক্ত করে হাত রাখল সে। কিছুটা ভয় পেলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখল না অরা। এই দুই মাসে আরিশের পাগলামির সাথে পরিচিত হয়ে গেছে সে।
“ বলবো?”
“ হ্যাঁ। “
আরিশ অরার কানের লতিতে চুমু খেলো কয়েকটা। তারপর বসাল মৃদু কামড়। মুচড়ে উঠল অরার শরীর। আরিশের উষ্ণ নিঃশ্বাসের শব্দে কিছু একটা হচ্ছে তার। অরাকে হুট করেই কোলে তুলে নিলো সে। তারপর বিছানায় নিয়ে বসাল। মুখোমুখি বসলো দু’জন।
“ গতকাল বিকেলে একা একা কী বলছিলে?
‘ আরিশের দিকে তাকালে কেমন কেমন লাগে আমার, কেন লাগে? আধপাগল লোকটাকে বিয়ে করে আমিও মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি।’
মনে পড়ে, হামিংবার্ড?”
আরিশের কথায় বিষম খেলো অরা। আরিশ মুচকি হেসে পাশের টি-টেবিলের ওপর রাখা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো তার দিকে। অরা পানি পান করে কিছুটা শান্ত হলো বটে। তবে আরিশ কীভাবে তার গতিবিধি জানলো সেটাই ভাবার বিষয় এখন।

“ আপ..আপনি কী করে জানলেন?”
“ ওইদিকে তাকাও। “
রুমের এককোনায় তাকাল অরা। এটা তো সিসিটিভি ক্যামেরা! তারমানে ঘরে বসে যা বলে, যা করে সবকিছুই দেখতে পায় আরিশ! কী লজ্জা!
“ আপনি এটা ঠিক করেননি, আরিশ। “
“ আমি এমনিতেই বেঠিক মানুষ, পাখি। এখন বলো আমার দিকে তাকালে কেমন লাগে? “
“ কেমন লাগবে আবার! অস্বস্তি লাগে, আপনি যেভাবে রাগ করেন, ভয় লাগে। এ…এটাই। “
আরিশ অরার গালে দু-হাত রাখল। কপালে কপাল ঠেকাল। ফিসফিস করে বলল,
“ আরকিছু?”
অরা মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেছে যেন। আরিশের এই মোহনীয় কথা তাকে ভীষণ টানে।
“ হামিংবার্ড!”
“ জি। “
“আই থিংক… আই লাভ ইউ।”

অরার হৃদস্পন্দন যেন এক লাফে অনেকটা বেড়ে গেল। শরীরটা হঠাৎ করেই হালকা লাগতে শুরু করলো, যেন কোনো অদৃশ্য ভেলায় চড়ে সে মহাশূন্যে ভাসছে। সময়টা থেমে গেছে, শব্দহীন এক শূন্যতায় কেবল ওদের দুইজনের নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গোটা পৃথিবীটা গলে গিয়ে ছোটো হয়ে গেছে –তাতে শুধু আরিশ আর অরা, আর কিছুই নেই।
“ ডু ইউ?”
“ আমি জানি না। “
“ জানতে পারলে বলবে?”
“ হুম। “
“ একটা কিস করবে, পাখি? “

হামিংবার্ড পর্ব ৩৭

আরিশ না বললেও অরা খুব করে চাচ্ছিল, একবার আরিশের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেবে সে। কিন্তু নিজে থেকে পারছিল না। এখন কাজটা সহজ হলো। অরা আর সময় নিলো না, আবেশে আরিশের কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো আরিশ। এভাবে জড়িয়ে থাকলে মনে হয়, পৃথিবীর সবকিছু থমকে গেছে। কেবল অরার হৃৎস্পন্দন চলছে।

হামিংবার্ড পর্ব ৩৯