হামিংবার্ড পর্ব ৩৯
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
রাত অনেকটাই নেমে এসেছে। চারদিক নিস্তব্ধ, বাতাসে একটা অলৌকিক শান্তি।
আরিশ কিছু বলছে না আর। তবু তার নীরব উপস্থিতিতে অরার ভিতরে একধরনের কাঁপুনি বয়ে চলেছে। ভালোবাসার এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো শব্দ ছাড়াও বলা যায়। আর অরা আজ ঠিক সেই মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে। তার ভেতরে একটা চাপা ইচ্ছা বহুদিনের মতো পা ফেলছিল – একবার, শুধু একবার, আরিশের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেবে সে। কিন্তু ইচ্ছেটা গভীর হলেও সাহসটা ছিল না। তবে আজ রাতে সবকিছু যেন নিজে থেকেই সহজ হয়ে উঠল। আরিশের একবার বলাতে সাহস পেলো সে।
চাঁদের আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরের ভিতর নেমে এসেছে। অরা আর দেরি করল না। ধীরে, নিঃশব্দে, শ্বাস ফেলে ফেলে কাছে এগিয়ে এসে –
সে ঠোঁট ছোঁয়াল আরিশের কপালে।
একটা দীর্ঘ, কোমল স্পর্শ। ভালোবাসার সবচেয়ে পবিত্র ভাষায় লেখা এক নিঃশব্দ কবিতা। চারপাশের রাত যেন আরও গভীর হলো, আর তাদের দুজনের মাঝখানে সময়টা থেমে রইল কিছু মুহূর্তের জন্য।
অরাকে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিল আরিশ।
নীরব, নিঃশব্দে অথচ এতটাই গভীর – যেন পুরো পৃথিবী থেমে গেছে কেবল এই আলিঙ্গনের ভেতর। তার শক্ত বাহুর মাঝে চাপা পড়ে থাকা অরা অনুভব করল, চারপাশের সমস্ত শব্দ, আলো, সমশ সব ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
শুধু একটা জিনিস টিকে আছে – তার নিজের হৃদয়ের শব্দ, যা আরিশের বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলছে।
আরিশ কিছুই বলল না। সে চাইলে আর একটু আঁকড়ে ধরতে পারত, কিছু বলেও দিতে পারত।
কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি সত্য ছিল এই নিরবতা – এই নিশ্চিন্ত আশ্রয়। ওভাবেই বুকের কাছে অরাকে আগলে রেখে,একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করল আরিশ।
মানুষ যখন প্রশান্তিতে থাকে, তখন শরীর নিজে থেকেই ঘুমিয়ে পড়ে। আরিশও তাই করল। বুকের মাঝে অরাকে জড়িয়ে রেখে, নিঃশ্বাসে মিশিয়ে, চোখ বন্ধ করে নিঃচঞ্চল ঘুমে তলিয়ে গেল সে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিন্তু অরা?তার চোখে ঘুম নেই।
শরীরটা নিরব, কিন্তু মনের ভেতর যেন ঝড়।
আরিশের বুকের ওপর মাথা রেখে সে অনুভব করছে সেই স্পন্দন। তার শরীর লেপ্টে আছে আরিশের গায়ে, গায়ের তাপ একরকম একাত্ম হয়ে আছে। তবু তার ভেতরে একটা অজানা কান্না, একটা টানাপোড়েন।
শরীরটা আরিশের শরীরের সঙ্গে মিশে আছে।
তবু যেন একদম একা অরা। শরীরে শরীরে ছুঁয়ে থাকা, মানেই কি মনের ছোঁয়া? না। আজকের এই গভীর রাতে, সেই প্রশ্নটাই বুকের ভেতর কুঁকড়ে কাঁদছে অরার।
ভালোবাসা শুধু স্পর্শে হয় না। ভালোবাসা হয় অনুভবে।আর অরা ঠিক সেই অনুভবটাই হারিয়ে ফেলেছে অথবা, খুঁজে পাচ্ছে না। সে নিজেকে বোঝাতে পারছে না কিছুই। কাকে বলবে? কে আছে যে তাকে বলবে, এই টানাপোড়েন থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসতে হয়? তার মাথায় যেন একেকটা ভারী চিন্তা ঠুকরে যাচ্ছে।
আগামীকাল ইউনিভার্সিটিতে যাবে। আরিশ নিজে বলেছে। সব ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করবে।
তবে… কে জানে, কাল আবার কী করে বসবে?
আশ্রয় চাইলেই কি পাওয়া যায়?একটা কপালে চুমু, একখানা আলিঙ্গন… এসবের বাইরেও কি কিছু লুকিয়ে থাকে? অরার চোখ খুলে যায় আবার। ঘুম আসে না। আরিশের বুকের উপর মাথা, গায়ের তাপে জড়ানো দেহ– তবু বুকের ভেতরটা বরফের মতো ঠান্ডা। সে যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে, আর সেই হারানোর ভয়টাই এখন গভীর রাতে তার একমাত্র সঙ্গী।
সকালের রোদ জানালার পর্দা পেরিয়ে ঘরের মেঝেতে উজিয়ে পড়েছে। হালকা গরম, বাতাসে যেন গা জ্বালানো একরকম ক্লান্তি। পাখির ডাক নেই বললেই চলে, রাস্তায় দূরের গাড়ির শব্দ কেবল নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে।
“গুড মর্নিং, ডার্লিং।”
পেছন ফিরে তাকাল তামান্না। তালহা দাঁড়িয়ে রান্নাঘরে। তামান্না সকালের নাস্তা তৈরি করছে, ডিম সিদ্ধ করে, খোসা ছাড়াচ্ছে।
“এত ইংরেজি বুঝি না আমি। ‘মর্নিং’ না বলে ‘শুভ সকাল’ বললেও তো হয়।”
হেসে বলে তামান্না। তালহা ঠোঁট বাঁকায় মজা করে। তামান্নার পাশে দাঁড়িয়ে সেও ডিমের খোসা ছাড়াতে সাহায্য করতে শুরু করে।
“আচ্ছা, ঠিক আছে। চলো না, একদিন বাইরে কোথাও ঘুরে আসি।”
বলে তালহা।
“আপনার মা শুনলে তো কেলেঙ্কারি বাঁধাবে।”
“আমার মা আমার বিষয়। তুমি শুধু বলো, যাবে কি না?”
তামান্না একটু ভেবে বলে,
“ঠিক আছে। কখন যাবেন?”
“আজ সন্ধ্যার পর। অফিস থেকে ফিরে বেরিয়ে পড়বো।”
মুচকি হাসে তামান্না। হঠাৎ তালহা একটু লাজুকভাবে বলে ওঠে,
“শুনো…”
“কী?”
“আমার বন্ধুরা তাদের গার্লফ্রেন্ডকে কত আদর করে – মানে কিস করে, জড়িয়ে ধরে, একসঙ্গে হাঁটে। ”
তামান্না ভ্রু কুঁচকে তাকায়, প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে বলে,
“ এসব আমাকে বলে কী বোঝাতে চান?”
তালহা গা বাঁচিয়ে বলে,
“না না, কিছু না। থাক, আমি যাচ্ছি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“নাস্তা করে যাবেন তো?”
ডাকে তামান্না।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে তালহা শুধু বলল,
“অফিসের ক্যান্টিনে খেয়ে নেবো।”
তামান্না আর কিছু বলার আগেই তালহা দরজা টেনে বেরিয়ে পড়ে।
আজকে আরিশ অফিসে যাবে না, সেজন্য তার ওপর বেশি দায়িত্ব পড়েছে। মাত্র মিনিট দুয়েক আগে ড্রইং রুমে এসে ঢুকেছেন তাসলিমা খাতুন।
ছেলেকে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে মনে মনে কিছু আন্দাজ করেই এগোলেন সেই দিকটায়।
রান্নাঘরে তখন তামান্না মুচকি হেসে নিজের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু তাসলিমা খাতুনকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেই হাসিটা যেন হঠাৎ থেমে গেল। মুখে একধরনের সতর্কতা এসে ভর করল।
তাসলিমা দাঁড়িয়ে থেকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে উপস্থিতি জানান দিলেন। যেন কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে ফেললেন।
“তালহা এসেছিল?”
“হ্যাঁ।”
“কেন? এমন কী জরুরি কথা ছিল তোমার সঙ্গে?”
“সেটা আপনি আপনার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন।”
তাসলিমা খাতুনের মুখ গোমড়া হয়ে উঠল। চোখেমুখে রাগের ছায়া স্পষ্ট।
তামান্নারও মেজাজ বিগড়ে গেল। সে তো আগেই জানত, তালহার মা ওর প্রতি কখনও মমতা দেখাবে না। তবুও নিজের অদ্ভুত আবেগ আর বেহায়া ভালোবাসার টানে তালহার সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে দ্বিধা করেনি সে।
তাসলিমা খাতুন কড়া গলায় বললেন,
“অফিস থেকে ফিরুক আজ, ওকেই জিজ্ঞেস করব সব। আর তুমিও তৈরি থেকো – এই বাড়িতে আর বেশিদিন থাকা হবে না তোমার।”
কঠিন সেই কথা ছুঁড়ে দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন রান্নাঘর থেকে। পেছনে দাঁড়িয়ে তামান্না শুধু পাথরের মতো চুপ। চোখে অস্থিরতা, মনে প্রশ্ন – সত্যিই কি আরিশ তাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দেবে?
নিশ্ছিদ্র সকালের আলো যেন শহরের ক্লান্তিকে মুছে নতুন কিছু শুরু করার সংকেত দিচ্ছে। গরমের মাঝে রোদটা বেশ রাগী হয়ে উঠেছে। বাতাস যেন ক্লান্ত, নিস্তেজ।
ইউনিভার্সিটির গেটের পাশে এসে দাঁড়াল একটি চকচকে কালো টোয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার জেড-এক্স। গাড়ির গায়ে রোদ ঝিলমিল করছে, গ্লাস এতটাই কালো যে ভিতরের কাউকে স্পষ্ট দেখা যায় না। অরা চুপচাপ বসে আছে, জানালার বাইরে তাকিয়ে। গেটের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর হাসি, কলরব সবকিছু যেন তার কাছে একেবারে নতুন।
“চলো, নামো।”
পাশে বসে থাকা আরিশ বলল।
ড্রাইভারের সিট থেকে নামল আরিশ। কালো শার্টের হাতা গুটানো, চোখে কালো সানগ্লাস, হাতে একটা ঘড়ি ঝলমল করছে। দরজা খুলে দিলো আরিশ, নামল অরা। আজ তার পরনে হালকা নীল সালোয়ার কামিজ, চোখে একটু চিন্তা, কিন্তু মুখে একটুকরো অনির্বচনীয় প্রশান্তি।
দুজন একসঙ্গে ইউনিভার্সিটির মূল গেটের দিকে এগিয়ে গেল। পাশ দিয়ে কিছু স্টুডেন্ট হেঁটে যাচ্ছে। তাদের চোখ বারবার ফিরে তাকাচ্ছে কালো গাড়ির দিকে, কিংবা আরিশের রুচিশীল ব্যক্তিত্বের দিকে।
গেট দিয়ে ঢোকার মুহূর্তে অরার পায়ের নিচে মৃদু কাঁপন। এত মানুষ… এত চোখ… অদ্ভুত এক অস্বস্তি কাজ করছিল ওর ভেতর।
আরিশ পাশে হাঁটছে, এক হাতে ব্যাগটা তুলে নিয়েছে অরার। ছায়ার মতো পাশে থেকেও যেন আড়াল করে রেখেছে তাকে। চারপাশে বিলবোর্ড, পোস্টার, বিভিন্ন বিভাগের নাম লেখা দালান, দূরে ছাত্রদের দল – সবকিছুতেই অরার চোখ আটকে যাচ্ছে।
“ভয় পাচ্ছো?”
হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল আরিশ।
অরা মাথা নাড়ল।
“না… তবে একটু অচেনা লাগছে।”
“সময় নাও। অভ্যস্ত হয়ে যাবে। ”
সামনে এগিয়ে চলল দুজন। প্রশাসনিক ভবনের দিকে। ইউনিভার্সিটির গেটটা ধীরে ধীরে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। আর অরার ভেতরে ভর করছে এক অনভিজ্ঞ উত্তেজনা, এক নতুন জীবনের স্পর্শ। সকাল থেকে আরিশের আচরণও স্বাভাবিক। এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। গতকাল রাতেই রনিকে কল করেছিল অরা। শান্তা, আকাশ, লিজা আরো অনেক বন্ধুদের জানিয়েছে ব্যাপারটা। সবাই বেশ খুশি। তারা সবাইও আজ ইউনিভার্সিটিতে আসবে বলেছে। কিন্তু আরিশ কি তাদের সাথে কথা বলতে দিবে অরাকে?
ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে আছে রনি, আকাশসহ আরো অনেকে। সবাই অরার ক্লাসমেট। একসাথে পড়ালেখা করেছে সবাই। অরার আকস্মিক বিয়েতে তাদের মধ্যে অনেকেই অখুশি হয়েছিল কিন্তু পরিস্থিতি কেমন ছিলো সেটা জানার পর থেকে আর কেউ অরার সাথে রাগ করে নেই।
“ কী রে! অরা তো এখন বের হলোনা। এতক্ষণ লাগে কাজ সারতে? “
লিজা বলল রনিকে উদ্দেশ্য করে । আকাশ বারবার অরার জন্য পথ চেয়ে তাকিয়ে আছে।
“ কী জানি! ওর পাগলাটে বর এসেছে সাথে। কখন কী করে বসে বলা যায় না। “
সবাই আকাশের দিকে তাকাল। আরিশ আকাশের সাথে কী কী করেছিল সেসব সবাই জানে। আর সে কারণেই সবাই ভয় পায় আরিশকে।
হামিংবার্ড পর্ব ৩৮
“ তা-ও কথা। অপেক্ষা করি আরকি!”
রনির কথামতো সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো কেবল।
কিছুক্ষণের মধ্যে দূর থেকে অরাকে দেখতে পেলো সবাই। নিজের স্বামীর হাত ধরে এগিয়ে আসছে সে। সবাই হাসতে লাগলো। ভার্সিটিতে এসেও হাত ধরে হাঁটছে তারা। আকাচ নিজেকে আড়াল করে দাঁড়াল। আরিশ দেখলে যদি আবারও গু*লি মারে! তারচে মুখোমুখি হওয়ার দরকার নেই।