হামিংবার্ড পর্ব ৪
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
আরিশের ধমকে ভয়ে চুপসে গেছে তামান্না। কী বলবে বুঝতে পারছে না। যেহেতু অরার ঘাম ছাড়েনি সেজন্য পোশাক বদলানোর কথা মাথায় আসেনি। আর তামান্না এতটাই ভয় পেয়ে গেছিল জলপট্টির কথাও খেয়াল ছিলো না ওর।
” ভাইয়া এরকম ভুল আর কখনো হবে না। এবারের মতো মাফ করে দিন!”
আরিশ তামান্নার দিকে খেয়াল না করে অরার দিকে মনোযোগ দিলো। বালিশের পাশে গিয়ে বসল আরিশ। তারপর অরার মাথ তুলে নিজের উরুতে রাখল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” বকবক না করে পানি আর রুমাল নিয়ে আয়৷ ”
” জি ভাইয়া। ”
তামান্না দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আরিশের ভীষণ অপরাধবোধ হচ্ছে। অরার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ঠোঁটে ঘা, চোখের নিচে কালো দাগ, গলায় কামড়ের দাগ! উফ এভাবে কেউ টাচ করে? নিজেকে জানোয়ার মনে হচ্ছে ওর। কিন্তু আরিশ রাগ করে আদর করতে গেলে কতটা জংলী হয়ে ওঠে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারেনা।
” এই যে পানি আর রুমাল, ভাইয়া। ”
” এখানে রাখ। ডাক্তার আসবে, দরজার কাছে গিয়ে অপেক্ষা কর। উনি নক করলেই দরজা খুলে দিবি। ”
” ঠিক আছে ভাইয়া। ”
আরিশের সামনে খুব সাবধানে পানির বাটি আর রুমাল রেখে, আবারও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো তামান্না। অরাকে আবারও বালিশে শুইয়ে দিলো আরিশ। কপালে জলপট্টি দিয়ে, ফাস্ট এইড বক্স খুঁজতে লাগলো। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারেই রাখা ছিলো। অরার ক্ষত জায়গাগুলো পরিষ্কার করে ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছে আরিশ। মেয়েটা ঘোরের মধ্যেও ব্যথা অনুভব করতে পারছে। ঔষধ লাগানোর সময় ছটফট করছিল খুব। আরিশ নিজের ওপর বিরক্ত। শাস্তি দিতে গিয়ে বিয়ে করে, শেষে এতটুকু বউ নিয়ে বিপদে পড়ল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ডাক্তার এসে অরাকে দেখে কিছু ঔষধ দিয়ে গেছে। শরীরের ব্যথার জন্যই জ্বর এসেছে। তামান্না আরিশের জন্য, রাতের খাবার ঘরে দিয়ে গেছে। আরিশের এই রূপ আগে দেখেনি সে। শক্তপোক্ত মানুষটারও যে কারো জন্য এতটা ভাবনাচিন্তা হয় তামান্না সেটা আন্দাজও করতে পারেনি। আরিশ তাকে সাহায্য করলেও কখনো ভালো আচরণ করেনি আর না তো খারাপ। সব সময় এমনভাবে কথা বলেছে, মেয়েরা যেনো ঘৃনার পাত্রী। আরিশ সকল নারীকেই কমবেশি ঘৃণা করে। কিন্তু কেনো সেটা জানে না তামান্না।
গভীর রাত। সোফায় বসে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে আছে আরিশ। পরনে তার টি-শার্ট ও হাফপ্যান্ট। অরা ঘুমোচ্ছে। মাঝখানে একবার চোখ মেলে তাকিয়েছিল, তামান্না ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে তখন। আরিশ অরার আশেপাশেও ছিলো না তখন। তামান্না বুঝতে পারে না, ভাইয়া ভাবির সামনে কেনো এতটা কঠিন হয়ে থাকে? পেছনে তো কতটা কেয়ার করলো, অস্থির হয়ে ছিলো।
গরমে হাসফাস লাগছে আরিশের। অরার জন্য এসি বন্ধ করে রাখা হয়েছে । এভাবে গরমে কাজ করাও যাচ্ছে না। তারচে বেলকনিতে গিয়ে বসে কাজ করা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ! আরিশ ল্যাপটপ নিয়ে সোজা বেলকনিতে চলে গেলো। আরিশের রুমের বেলকনিটা অনেক বড়ো। এখানে নানান ফুল গাছ আছে। বেলি, গোলাপ, অর্কিডসহ আরো অনেক ফুল! সাথে মাঝে মধ্যে দক্ষিণা বাতাস তো আছেই। গভীর রাতে কোনো কোলাহলও থাকে না শহরে। এখানে এসে বসলেই মন ভালো হয়ে যায় আরিশের।
বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছেন রোকসানা। মেয়ের চিন্তায় ঘুম আসছে না৷ যতই নিজেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাখতে চাচ্ছেন, ততই অস্থির লাগছে উনার। অরাকে আরিশের সাথে বিয়ে দিয়ে কি ভুল করলেন? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রোকসানা মল্লিক। আগামীকাল সকালে খান বাড়িতে যাবেন তিনি। আরিশকে জবাবদিহি করতে হবে।
বিছানায় বসে আছে ছয় বছরের আরিশ। হাতে তার পারফিউমের বোতল। পারফিউম শেষ হয়ে গেলেও তার বোতলগুলো আরিশের মা রেখে দেন। ছোট্ট আরিশ সেগুলো নিয়েই খেলছে। হঠাৎ আরিশের মা এলেন সেখানে। আরিশকে ওগুলো নিয়ে খেলতে দেখে ভীষণ রেগে গেলেন। মুহুর্তেই বাচ্চাটার চুলগুলো ধরে গালে থাপ্পড় মারতে লাগলেন তিনি।
” তোকে কতবার না বলেছি, আমার গোছানো জিনিস নষ্ট করবি না? কেনো এলোমেলো করেছিস?”
আরিশ ভয়ে কান্নাও করছে না। চুপচাপ মার খাচ্ছে। কিন্তু ভেতর ভেতর শেষ হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। সুমনা আরো কিছুক্ষণ মারধর শেষে আরিশকে ছেড়ে দিয়ে ফোন হাতে বেলকনিতে চলে গেলেন। ছোট্ট আরিশ বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। দুই গালে আঙুলের দাগ বসে গেছে সব। আরিশ তবুও শব্দ করে কাঁদে না। [ কেবল গল্পের স্বার্থে এগুলো লিখলাম। বাস্তবে বাচ্চাদের সাথে এ ধরণের আচরণ অপরাধ, এবং অনুচিত। এগুলো আমি সমর্থন করি না।]
রাতে আরিশের বাবা বাসায় ফিরতেই সুমনার সাথে ঝামেলা হলো। ছেলেকে এভাবে কেনো মেরেছে জিজ্ঞেস করতেই ঝামেলার শুরু! আফজাল খান নিতান্তই ভালো মানুষ। এতটুকু ছেলের সাথে এমন আচরণ তো সৎ মা-ও করে না। সেখানে সুমনার এমন আচরণে অবাক হোন আফজাল। অবশ্য সুমনা এরকমই। অদ্ভুত! নিজের রাখা কোনো জিনিসপত্র কেউ ধরলেও বাজেভাবে রিয়াক্ট করেন। সব সময় নিজের পছন্দমত পোশাকআশাক পরান, আরিশকে। উনার পছন্দের বাইরে গেলেই শুরু হয় অত্যাচার। আফজাল ঠিকমতো কিছু বলতেও পারে না। সুমনা ছেলের সামনেই শারীরিক বিষয় নিয়ে ঝামেলা করে। সুমনার মতে আফজাল তার চাহিদা মেটাতে অক্ষম। আর অক্ষম পুরুষদের এত হাঁকডাক মানায় না। আফজাল দমে যায়। কোনো পুরুষ যদি বুঝতে পারে সে তার স্ত্রী’কে তৃপ্তি দিতে পারছে না, তবে তারচে গ্লানি আর কিছুতেই নেই।
কোনো মেয়েলি কণ্ঠে কান্নার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেছে আরিশের। অবশ্য ভালোই হয়েছে। দুঃস্বপ্ন দেখেছে। ওই ভদ্রমহিলা স্বপ্নে এসেও টর্চার করলো আজ! আরিশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল সে, গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, শহরের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। কান্নার শব্দটা আরো তীব্র হতেই নড়েচড়ে উঠল আরিশ। ল্যাপটপ হাতে রুমের দিকে এগোল সে।
” আপু তোমার কী হাল হয়েছে! আমি মা’কে বললাম, তুই হয়তো ঠিক নেই। মা বিশ্বাস করেনি৷ সবকিছু মায়ের জন্য হয়েছে। উনি কেনো তোমাকে ওই লোকটার সাথে বিয়ে দিলেন আপু! ”
নয়নার কান্না থামে না। অরা বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে। ওড়না দিয়ে গলা ঢেকে রেখেছে। যেন গলার দাগগুলো নয়নার চোখে না পড়ে সেজন্য । অরার জ্বর কমেছে এখন, তবে শরীর দূর্বল। তামান্না খাবার খাইয়ে, ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে। আরিশ গতকাল রাতেই এ বিষয় সবকিছু বলে দিয়েছিল মেয়েটাকে। অরার সব দেখাশোনা যেন ঠিকমতো হয়। অরার কাছাকাছি থাকলে কেমন অস্থির লাগে আরিশের। তাছাড়া আরিশ চায় না, তার ছোট্ট পাখিটা বুঝুক, তার স্বামী তাকে নিয়ে ভাবে।
” নয়না প্লিজ শান্ত হ। উনি এসে শুনে ফেললে কী মনে করবেন, বল? আমার জ্বর এসেছে একটু। আরকিছুই তো হয়নি। ”
নয়না চোখের পানি মুছে বলল,
” তাহলে ঠোঁটে কী হয়েছে তোমার? ”
তামান্না হালকা কেশে উঠল নয়নার কথায়। অরা ভাবল এসব নিয়ে কথা বলায় তামান্না লজ্জা পেয়ে এমন করছে। নয়না কিছু বুঝতে পারছে না। অরা বলল,
” এসব তুই বুঝবি না। বড়ো হ, তারপর বুঝবি পাগলি। ”
তামান্না ইশারা করলো অরাকে। নয়না এরমধ্যে সামনে তাকাল, আরিশ দাঁড়িয়ে আছে। বেলকনি থেকে রুমে এসেছে। অরাও এতক্ষণে বিষয়টা বুঝতে পেরে চুপ করে বসলো।
” গুড মর্নিং হামিংবার্ড। ”
” গুড মর্নিং। ”
আজকে উত্তর দিতে দেরি করলো না অরা। নয়না একবার আরিশের দিকে তাকাচ্ছে আবার অরার দিকে তাকাচ্ছে। অরার চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু নয়না সেটা বুঝতে পারছে না। তবে কিছু একটা যে হয়েছে এটুকু বেশ বুঝতে পারছে। অরা নয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,
হামিংবার্ড পর্ব ৩
” আমার ছোটো বোন….”
” নয়না! আমি জানি। কেমন আছো নয়না? ”
অরা ভয়ে কথা কম বলছে। নয়না অল্প কথায় উত্তর দিলো–
” ভালো।”
আরিশ ল্যাপটপটা রেখে, ওয়ারড্রব থেকে তোয়ালে হাতে নিলো। অফিসে লেট হয়ে যাচ্ছে, ওয়াশরুমের দিকে এগোল আরিশ। দুই বোনের কথোপকথনে কোনো আগ্রহ নেই তার।