হামিংবার্ড পর্ব ৪১
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা বালিশের পাশে রেখে দিল মেহরাব। মানুষ কখন কার প্রেমে পড়ে, তা কেউ আগে থেকে জানে না। মেহরাবও জানত না। কখন যে সাবিহার প্রেমে পড়ে গেছে, বুঝতেও পারেনি। এমন এক মেয়েকে তার ভালো লেগে গেছে– এই ভাবনাতেই বিরক্ত হতো সে। নিজেকে কতবার কড়া করে শাসন করেছে! কিন্তু মন তো কারো শাসন মানে না। মেহরাবের মনও মানেনি। শেষমেশ সে সাবিহার প্রেমে পড়েই গেল।
রাত গভীর। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মেহরাব, কিন্তু মাথায় ঘুরছে শুধুই সাবিহার কথা। তার পরিবার বলতে মা, বাবা আর এক বোন– যদিও বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, এখন থাকে শ্বশুরবাড়িতে। বহু চেষ্টা করেও ছেলের বিয়ে দিতে পারেননি মা-বাবা। একসময় হালই ছেড়ে দিয়েছেন তারা। মেহরাবের মা ছেলে অন্ত প্রাণ। মেহরাব ছাড়া তার একদিনও চলে না। শুধু মায়ের জন্যই বিদেশে ভালো চাকরির সুযোগ পেয়েও বহুবার হাতছাড়া করেছে সে। মেহরাব ভাবছিল – যদি কানাডা চলে যেত, কেমন হতো জীবনটা? কিন্তু মা? মা’কে কি আদৌ বোঝানো যাবে?
ভাবনার অতলে ডুবে ডুবে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো মেহরাব।
ভার্সিটির প্রথম দিন আজ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে কাজল দিচ্ছে অরা। ঘরে নিঃশব্দ একটা উত্তেজনা। চেয়ারে বসে আরিশ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে, চুপচাপ, মনোযোগী। বরাবরের মতোই ভদ্রলোক কালো রঙের পোশাকে সুসজ্জিত, যেন এক নিখুঁত অভ্যস্ততা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তোমার সাজগোছ নষ্ট হয়ে যাবে এখন।”
নরম কণ্ঠে বলে উঠল আরিশ।
চেয়ার থেকে উঠে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল অরার দিকে।
অরা কিছুটা অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকাল। তার পরনে হালকা মিষ্টি রঙের থ্রিপিস, ঠোঁটে মেরুন লিপস্টিক, কানে কুন্দনের ছোট দুল, চোখে গাঢ় কাজল– সব মিলিয়ে সে যেন সকালবেলার এক স্নিগ্ধ অনুভূতির মতো। খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে কিছুটা। তবে অরা চুলগুলোও আঁচড়ে নিতে লাগলো এবার।
আরিশ থেমে দাঁড়াল অরার কাছাকাছি, চোখে একরাশ প্রশ্রয়।
“ কেন?”
“কারণ, আজ তোমাকে অসহ্য রকম হট লাগছে।”
অরার কোমর ধরে তাকে এক ঝটকায় কাছে টেনে নিলো আরিশ।
“প্লিজ, এখন না। সাজগোছ নষ্ট হয়ে গেলে বের হবো কীভাবে?”
“হোক না। এমন সেজেগুজে যাচ্ছো কেন? আমি ছাড়া আর কেউ তোমার এই রূপ দেখবে না।”
আরিশের কণ্ঠে ছিল একধরনের দাবি।
“কই সাজলাম? কেবল লিপস্টিক আর কাজল দিয়েছি।”
“কাজলের দরকার নেই। মুছে ফেলো। রাতে দিও – আমি দেখবো।”
অরা বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। সবসময় এমন হুকুম, এমন দখলদারি–ভালো লাগে না তার। কিন্তু কীই বা করবে? আরিশের কথা না শুনলে পরে বাড়বে ঝামেলা। একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল অরা, ঠোঁটের কোণে জমে থাকা অভিমান চেপে রাখার চেষ্টা করল।
“ঠিক আছে।”
নরম কণ্ঠে বলল অরা, চোখের কাজল মুছে ফেলতে শুরু করল। সময়ও লাগল কিছুটা। এ ফাঁকে আরিশ যেন একেকটা দৃশ্য গিলছে চোখে– অরাকে ভালো করে দেখে নিচ্ছে সে, একটানা।
“আজ রাতে আর তোমার নিস্তার নেই, পাখি।”
চোখ আধবোজা করে ফিসফিসিয়ে বলল আরিশ।
“আমি আর নিজেকে সামলাতে পারছি না।”
লাজুক মুখে মাথা নিচু করে রইল অরা। ন’টা বাজছে– দেয়ালঘড়ির কাঁটা যেন তাগাদা দিচ্ছে, ভার্সিটিতে যেতে হবে।
“সেটা রাতে দেখা যাবে। এখন চলুন।”
অরা চোখ তুলে বলল, ঠোঁটে অল্প হাসি। আরিশ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।
“তুমি বুঝবে না।”
“কী বুঝবো না?”
“চোখের সামনে এমন সুন্দরী বউ থাকার পরও আদর করতে না পারার যন্ত্রণাটা।”
“কেন বুঝবো না?”
“কারণ, তুমি পুরুষ নও।”
অরা হেসে উঠল – প্রাণখোলা, ঝরঝরে সেই হাসিতে যেন সকাল নামে ঘরে। আরিশ এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকল, মুগ্ধ হয়ে।
“বুঝলাম। এখন চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
যাওয়ার আগে হঠাৎ করেই আরিশ অরার ঠোঁটে একটা আলতো চুমু এঁকে দিল, তারপর ভালোবাসায় মেশানো এক মৃদু কামড় বসাল। অরা একটু চমকে উঠল, কিন্তু কিছু বলল না।
যেন বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি অফার চলছে।
“ চলো। “
হাতে হাত ধরে ঘর থেকে বেরোল দু’জন। ড্রইং রুমে যেতেই তাসলিমা খাতুনের মুখোমুখি হলো তারা।
“ তোমার সাথে কথা ছিলো আরিশ। গুরুত্বপূর্ণ। “
তাসলিমা খাতুন বেশ থমথমে গলায় বললেন কথাগুলো।
“ সন্ধ্যায় কথা হবে। এখন লেট হচ্ছে চাচি। “
“ ঠিক আছে। “
আরিশ আর না দাঁড়িয়ে অরাকে নিয়ে বাসা বেরিয়ে গেলো। তাসলিমা খাতুন একা একা দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছেন । কথা বলার সময় নেই কিন্তু বউকে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে দেওয়ার মতো ঠিকই সময় আছে!
গাড়ি চলছে। অরা চুপচাপ জানালার কাচে চোখ রাখল– বাইরের দৃশ্যগুলো একটার পর একটা সরে যাচ্ছে, ঠিক যেন তার ভেতরের অনুভূতির মতোই নিরব, অনিঃশেষ। যেতে যেতে কোনো কথা হলোনা দুজনের মধ্যে। শুধু নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে গাড়ির টায়ারের শব্দ। ভার্সিটির গেটের সামনে থামলো গাড়ি। অরার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। আরিশ এক নজর তাকাল সেদিকে তারপর লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল কয়েকবার। অরা অন্য কোনো বিষয় খুশি হয়ে হাসলেও হিংসা হয় আরিশের। মনে হয় অরা একমাত্র তার জন্য হাসবে, অন্য কিছুর জন্য নয়। অদ্ভুত ভাবনা!
“ চলো, ক্লাসে পৌঁছে দিয়ে আসবো। “
“ দরকার নেই। আপনার লেট হচ্ছে না? আপনি যান, আমি চলে যাবো। কারো সাথে অপ্রয়োজনীয় কথা বলবো না। “
ভ্রু নাচিয়ে বলল আরিশ,
“ শিওর? “
“ হ্যাঁ। শুধু বন্ধুদের সাথে কথা বলবো তবে সীমিত। “
“ গুড গার্ল। তাহলে ঠিক আছে। আমারও লেট হচ্ছে, মিটিং আছে জরুরী। “
হাতঘড়ির দিকে এক নজর তাকিয়ে ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে বলল আরিশ। তারপর গাড়ির দরজা খুলে দিলো। অরা গাড়ি থেকে নামতেই যাবে এমন সময় হাত টেনে ধরলো আরিশ।
“ কী?”
অরার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তার কপালে চুমু খেলো আরিশ।
“ এখন যাও৷ সোজা ক্লাসে যাবে। আর হ্যাঁ ক্লাস শেষে কল করবে। “
“ আচ্ছা। সাবধানে যাবেন। “
“ ওকে। “
গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিলো আরিশ। অরা এখনও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এক অদৃশ্য টানে আরিশের গাড়ি দৃষ্টির আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। ভার্সিটির গেটের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। এরমধ্যেই আকাশের সাথে দেখা হলো তার। এদিকেই আসছে সে। অরা দ্বিধায় পড়ে গেলো, আকাশের সাথে কথা বলবে কি-না ভেবে। বলা তো উচিত! আরিশ যা করেছে তাতে অরারও ক্ষমা চাওয়া দরকার।
“ এসেছ তুমি! “
আকাশ নিজে থেকেই কথা বলল।
“ হ্যাঁ। কেমন আছো?”
“ এইতো, ভালোই। তুমি? “
“ হ্যাঁ, ভালো আছি। চলো ক্লাসে যাই। “
“ আরে দাঁড়াও! তোমার বর তো নেই এখানে, চলো না দোকানে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দেই একটু? ক্লাস শুরু হতে তো এখনও দেরি আছে। “
আকাশের প্রস্তাবটা মন্দ না। তবে অরা তো আরিশকে কথা দিয়েছে, সোজা ক্লাসে যাবে। কিন্তু আকাশকেও কীভাবে না বলবে? অরাকে অন্যমনস্ক হয়ে থাকতে দেখে আকাশ আবারও বলল,
“আরে এত ভাবছো কেন? চলো তো!”
আকাশ হেসে হাত ধরল তার। অরা খানিকটা অন্যমনস্ক ছিল, সুতরাং আপত্তি করল না।
তবে কিছুদূর গিয়ে নিজে থেকেই হাতটা ছাড়িয়ে নিলো, তারপর পাশাপাশি হাঁটতে লাগল দু’জন।
রাস্তার ওপাশে একটা ছোট চায়ের দোকানের দিকে এগোল তারা। আকাশ অরাকে সেখানে বসতে বলল। অরা বেঞ্চিতে বসে চারপাশে তাকাল।
এদিকে আকাশ একটু দূরে গিয়ে ফোনটা বের করল পকেট থেকে। কোনো একটা নাম খুঁজে নিয়ে একবার চারপাশে নজর বুলিয়ে
চুপিচুপি কল করল কাউকে।
“ এখন আসুন। চায়ের দোকানে আছে অরা। “
ওপাশ থেকে কিছু একটা বলে কল কাটা হলো। আকাশের ঠোঁটের কোণে রহস্যময়ী হাসি!
মিনিট পাঁচেক হলো আকাশ গেলো কিন্তু এখনও ফিরছে না। দোকানদার অরাকে চা দিয়েছে। একা একাই চা খাচ্ছে সে। আকাশের চায়ের কাপটা পাশেই রাখা আছে। এরমধ্যে আকাশ চলে এলো।
“ কোথায় গিয়েছিলে আকাশ?”
“ আরে ইমার্জেন্সি! বুঝতে পেরেছ?”
হাতের ইশারায় কিছু একটা বোঝাল আকাশ। অরা ইতস্ততভাবে মাথা নাড়ল।
“ না-ও চা খাও, আমার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। “
“ আমাকে রেখে একাই খেলে! ইট’স বেরি ব্যাড অরা। “
আকাশ মজার ছলে বলল।
“ মামা অরাকে আরেককাপ চা দিন তো, বেশি করে লিগার দিবেন৷ “
শেষের কথাগুলো দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে বলল আকাশ।
অরা বিপাকে পড়েছে। চা পছন্দের হলেও এই মুহুর্তে আর খেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু না-ও বলতে পারছে না। কেনো যে আগে আগে একা খেতে গেলো সেই ভেবেই বিরক্ত লাগছে এখন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দোকানদার চা দিলো।
“ লেট হচ্ছে আকাশ। চা শেষ হলেই, চলে যাবো। ওকে?”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ, পাক্কা। “
আকাশ হেসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা বলছে। অরাও খুব এনজয় করছে সবকিছু। কতগুলো দিন পর এভাবে প্রানখুলে বাঁচতে পারছে!
“ অরা ম্যাম!”
আচমকা কারো ডাকে পেছন ফিরি তাকাল অরা। আকাশও তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দু’জন ভদ্রলোক, ফর্মাল পোশাক পরে আছে তারা। অরা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। কৌতূহলী হয়ে শুধালো অরা,
“ আপনারা কারা? “
“ আরিশ স্যার এক্সিডেন্ট করেছে ম্যাম। আমরা উনার পরিচিত। অজ্ঞান অবস্থায় উনি শুধু বারবার আপনার নাম নিচ্ছেন, প্লিজ আমাদের সাথে চলুন। “
বুকটা কেমন ধক করে উঠলো অরার। আরিশের এক্সিডেন্ট হয়েছে! অরা কিছু বিচারবিবেচনা না করেই বলল,
“ আমি যাবো। উনার কাছে নিয়ে যান আমাকে। “
আকাশ বলল,
“ আমিও যাচ্ছি সাথে, চলো। “
দুই ভদ্রলোক আকাশ ও অরাকে গাড়িতে তুলে নিলো। গাড়ি চলতে লাগলো তার আপন গতিতে। অরা সমানে কেঁদে যাচ্ছে। মাথা কাজ করছে না তার। আরিশের যদি কিছু হয় তাহলে!
“ আর কতদূর? কোথায় আছে আরিশ?”
আকাশ ও দুই ভদ্রলোক একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একবার। তারপর আচমকাই একজন অরার মুখে একটা রুমাল চেপে ধরল। মুহুর্তেই চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো তার। জ্ঞান হারালো অরা।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। ফরেনারের সঙ্গে মিটিং শেষ করে মাত্রই কেবিনে প্রবেশ করলো আরিশ। চেয়ারে বসে অস্থিরতায় নড়ে উঠে ফোন হাতে নিলো। না, অরা এখনও কল করেনি।অদ্ভুত লাগল আরিশের, প্রথম দিন তো এতটা দীর্ঘ সময় ক্লাস হওয়ার কথা নয়। তৎক্ষণাৎ অরার নম্বর ডায়াল করল সে। বেজে বেজে কল কেটে গেলো, কিন্তু অন্যপাশ থেকে রিসিভ হল না।মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো আরিশের। আবারও কল দিলো। এবার ফোন বন্ধ বলছে।হঠাৎ মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।
সব কিছু রেখে ইউনিভার্সিটির দিকে ছুটে গেলো সে।
দুপুরের তীব্র রোদ মাথার ওপর পোহালেও অরা চেয়ারে বসে রয়েছে, হাত-পা বাঁধা, অচেতন নয়, একটু ঝিমিয়ে আছে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে চারপাশে তাকাতে লাগল।
পুরনো, ঝকঝকে ছাদের ছায়াযুক্ত একটি বাড়ির উঠোনে সে রয়েছে– চারপাশে ঘিরে বাড়ি, আর মাঝখানে উঠোন, শহরের মধ্যে এমন জায়গা থাকা মুশকিল, অর্থাৎ শহর থেকে অনেক দূরে কোনো এক নিস্তব্ধ স্থানে বন্দি রয়েছে সে।হঠাৎ মনে এলো আরিশের কথা – তার দুর্ঘটনার খবরে অরার বুক টেনে উঠল, চেঁচিয়ে উঠল সে।
“ কেউ আছেন? কে আছেন! আমাকে এভাবে আঁটকে রেখেছেন কেন! আরিশ কোথায়?”
বেশ কয়েকবার চেঁচাল অরা। তারপর সেই লোক দু’জন একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
“ এখানে চেঁচামিচি করে কোনো লাভ নেই মামুনি। তোমার আরিশ তো ঢাকায় আছে, সুস্থ আছে। কিন্তু তুমি সুস্থ থাকবেনা আর। “
কথাটা বলেই দু’জনে বিশ্রীভাবে হেসে উঠল। এদের নাম কালু ও কালাম। চৌধুরীদের পোষা গুন্ডা। রহমান চৌধুরী ও ফারুক চৌধুরীর আদেশেই অরাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আকাশের সাহায্যেই কাজটা সহজ হয়েছিল। বিনিময়ে ফারুক চৌধুরী আকাশকে অনেক টাকাপয়সা দিয়েছে। যদিও এসবকিছুই জানে না অরা। কালু ও কালামের কথায় অরার কাছে এটা স্পষ্ট যে, তারা খারাপ মানুষ। তার রাগ হচ্ছে ভীষণ। কেন যে বোকার মতো এদের সাথে এলো!
“ আকাশ! আকাশ কোথায়? কী করেছিস ওর সাথে তোরা?”
হাসতে লাগলো ওরা দু’জন। অরা নড়েচড়ে নিজেকে চেয়ার থেকে ছাড়াতে চাইলো কিছুক্ষণ। কিন্তু কোনো লাভ হলোনা।
“ আমরা কিছু করিনি তার সাথে। উল্টো সেই আকাশই তোকে এখান পর্যন্ত নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে, বোকা মেয়ে। বন্ধু নির্বাচনে সচেতন হতে হয়৷ “
অবাক হলো অরা। আকাশ এমনকিছু করতে পারে বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। কিন্তু বাস্তবতা তো এটাই যে, আকাশের জন্যই ক্লাসে না গিয়ে চায়ের দোকানে গিয়েছিল সে। অরা কাঁদছে। আরিশের কথা শুনলে আজ তাকে এমন বিপদে পড়তে হতোনা।
“ আমাকে আটকে রেখে কার কী লাভ হবে? প্লিজ আমাকে যেতে দাও!”
কালু এগিয়ে এলো অরার দিকে। অরার খোলা চুলে নাক ডুবিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। ঘৃনায় শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো অরার।
“ আমাদের লাভ হলো টাকা। তোকে ঠিকানা লাগাতে হবে আমাদের, মানে কবরে পাঠাবো। তবে ওপর থেকে অর্ডার আসার পর। কিন্তু….. “
দাঁড়ি চুলকে হাসতে লাগলো কালাম। কালু অরার চুলগুলো নেড়েচেড়ে দিতে দিতে বলল,
“ কিন্তু মরার আগে অনেক আদর পাবি তুই। মাত্র যৌবনে পা রাখলি, একটু এনজয় করেই মরবি না হয়। আমরা দু’জন তোকে অনেক সুখ দেবো। কী বলিস কালাম?”
তারা দু’জন একসাথে হেসে উঠল। অরার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবে সে। চোখ বন্ধ হয়ে আসার আগ পর্যন্ত আরিশের মুখটা মনে পড়তে লাগলো তার।
ইউনিভার্সিটির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। একটু আগেই ভার্সিটির মূল ফটকে প্রবেশ করলো আরিশ। কিন্তু সেখানে গিয়ে যা শুনলো তাতে মাথায় রক্ত চড়ে গেছে তার। অরা আজকে ভার্সিটিতে আসেনি। ভয়, রাগে পাগল পাগল লাগছে তার। হঠাৎ শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে তার, হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে । মাথার ভেতর হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু কোনো উত্তর পাচ্ছে না সে।
অবিশ্বাস আর উৎকণ্ঠায় দ্রুত ভার্সিটির বাইরে বেরিয়ে এলো আরিশ। হাঁটু চাটাচ্ছে, হৃদয় ব্যথায় ভারাক্রান্ত। ফোন তুলে অরার বাবার বাড়ি ডায়াল করলো। নয়না ফোন রিসিভ করলো। আরিশের কণ্ঠে আঁটসাঁট কাঁপন।
“ হ্যালো! কে?”
“ অরা গেছে তোমাদের কাছে? “
“ আপু! কই না তো! ওর না আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার কথা ছিলো, ভাইয়া? গতকাল রাতে এজন্য খুশিতে কল করেছিল। মায়ের সাথে কথাও বলল। “
আরিশ আরকিছুই শুনতে পারলোনা। অরা ও বাড়িতেও যায়নি মানে কিছু ঠিক নেই। নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে মেয়েটার। মনের ভিতর একটা অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে গেলো। চিৎকার করে উঠলো আরিশ। আশপাশের সবাই অবাক হয়ে আরিশকে দেখতে লাগলো। ভাবলো, ভদ্রলোক উন্মাদ হয়ে গেছে। পরপর তিনবার কোথায় কোথায় যেন কল করলো আরিশ। কথা হলো তাদের সাথে। তারপর আশপাশের সবগুলো দোকানে অরার ছবি দেখাতে লাগলো। চায়ের দোকানে অরার ছবি দেখাতেই চিনতে পারল দোকানদার। আরিশ উত্তেজিত হয়ে ভদ্রলোকের কলার চেপে ধরে রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলো,
“ কখন এসেছিল, অরা? আর কার সাথে? একা?”
“ একটা ছেলের সাথে এসেছিল, সকালে। আকাশ না আয়ুশ তার নাম। দু’জনে চা খেলো তারপর একটা বড়ো গাড়িতে চড়ে বসলো। এরচেয়ে বেশি কিছু আমি জানিনা। “
দোকানদার ভয়ে ভয়ে বলল কথাগুলো। আরিশের চোখে যেনো কোনো মৃত্যুপুরীর ছায়া নেমে এসেছে, যেকেউ দেখলে ভয় পাবে। এরমধ্যে তালহা এসে উপস্থিত হলো সেখানে। আরিশকে দোকান থেকে বের করে আনলো। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে আরিশ।
“ ভাইয়া প্লিজ শান্ত হও। ভাবিকে ঠিক পেয়ে যাবো। হয়তো বন্ধুর সাথে কোথাও গিয়েছে। “
“ নাহ তালহা। অরা কখনো এমন কাজ করবে না। আকাশের মধ্যে ঘাপলা আছে, ওকে আগেরবারই জানে মেরে ফেলা দরকার ছিল। ভুল হয়ে গেছে আমার। আগে আমার অরাকে পাই তারপর ওকে এতো ভাগ করে কাটবো যে ওর লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাবে না কেউ। “
আরিশ কথা শেষ হতেই গাড়িতে উঠে বসল। তালহা কী বলবে বুঝতে পারছে না। আরিশকে এরকম ভয়ংকর রূপে কখনো দেখেনি সে। কথা বলতেও ভয় লাগছে ওর। আজকে নিশ্চিত খুনোখুনি লেগে যাবে। কিন্তু অরা ভাবি কোথায়? চিন্তায় মাথা ধরে গেছে তালহার। আরিশ গাড়ি চালাচ্ছে। চোখ থেকে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ছে তার। রক্তবর্ণ চোখে জল যেন আগ্নেয়গিরির লাভা!
“ ভাইয়া আমরা কোথায় যাচ্ছি? “
“ আকাশের বাড়ি। ও সবকিছু জানে। “
তালহা চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা কল এলো আরিশের ফোনে। অবস্থা বেগতিক দেখে তালহা ড্রাইভ করতে লাগলো। কল রিসিভ করলো আরিশ।
“ স্যার চৌধুরীরা করেছে সব। তারাই ম্যাডামকে কিডন্যাপ করিয়েছে। “
কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে আরিশের।
হামিংবার্ড পর্ব ৪০
“ খবর লাগা কোথায় রেখেছে অরাকে। আমার খবর চাই! নইলে সব শেষ করে ফেলবো আমি। “
ওপাশ থেকে কল কেটে দিলো। আরিশের পাগল পাগল লাগছে, ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। কেনো যে সকালবেলা অরাকে ক্লাসে পৌঁছে দিয়ে এলোনা সেই আফসোসে কলিজা পুড়ে যাচ্ছে তার। চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রির কথা মনে পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আরিশের, হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। ফারুক চৌধুরী ও রহমান চৌধুরী ব্যবসায় না পেরে এরকম কিছু করবে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি আরিশ। এবার আরিশও তাই করবে, যা চৌধুরীরা করলো। সম্মানের বিনিময়ে সম্মান!