হামিংবার্ড পর্ব ৪৮

হামিংবার্ড পর্ব ৪৮
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

হ্যাঁ এটাই সত্যি! আরিশ কখনোই অরাকে নিজের থেকে আলাদা হতে দেবে না।
“ একদম ঠিক বুঝতে পেরেছো। আমার মৃত্যুর আগপর্যন্ত, তোমাকে ছাড়ছি না আমি। যদি জান্নাতের নিয়ামত হই আমরা, সেখানেও আমি শুধু তোমাকেই চাই, হামিংবার্ড।”
কথা শেষে অরার দিকে গভীর ভালোবাসা মাখা দৃষ্টিত তাকাল আরিশ। অরা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আরিশের বুকের ওপর মাথা রাখলো। আরিশ তাকে শক্তভাবে জড়িয়ে নিলো বুকে।
“ আমিও আপনার সাথে থাকতে চাই। কিন্তু মাঝে মধ্যে আপনার টক্সিক আচরণ খারাপ লাগে খুব। “
আরিশ গভীর নিশ্বাস ছাড়ল। চোখ নামিয়ে বলল,
“কী করবো বলো? আমি চাইলেও নিজেকে পরিবর্তন করতে পারছি না…”
তার কণ্ঠে হতাশা, কিন্তু চোখে ভালোবাসার অপরাধবোধ।

অরা মুচকি হাসল, মাথাটা একটু কাত করে আরিশের চোখে চোখ রাখল। সে হাসি অভিমানী, কিন্তু ভালোবাসায় পূর্ণ।
দু’জন এখন সামনাসামনি দাঁড়িয়ে। আরিশের কাঁধে অরার হাত, আর অরার কোমরে আরিশের শক্ত বাহু জড়িয়ে। চারপাশে ফেয়ারি লাইটের আলো ঝলমল করছে, দূর থেকে আত্মীয়স্বজনের হাসি, কোলাহল ভেসে আসছে। তবু ওদের মাঝখানে যেন এক টুকরো নির্জন জগত — কেবল তারা দু’জন, একে অন্যের অস্তিত্বে ডুবে।
“পরিবর্তন কেন করবেন? কারো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কখনো নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন না। কারণ যে আপনাকে ভালোবাসবে, আপনি যেমন তেমনটা জেনেশুনেই ভালোবাসবে। তার সামনে নিজেকে অন্য রকম দেখানোর প্রয়োজন পড়বে না। তবে হ্যাঁ, যদি নিজের মধ্যে কোনো খারাপ গুণ থাকে সেটা অবশ্যই বর্জন করা দরকার।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরা আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল, চোখে-মুখে বুদ্ধিদীপ্ত একটা প্রশান্তি খেলা করছিল।
“ওয়াও! আমার ছোট্ট পাখিটা এতো সুন্দর করে কথা বলা শিখলো কবে!”
আরিশ অবাক হয়ে তাকালো অরার দিকে, ঠোঁটের কোণে প্রশ্রয়মাখা হাসি।
“আমি মোটেও ছোটো নেই এখন। বিশ বছরে পা রেখেছি। এই বয়সে আমার কত বান্ধবীরা তো মা-ও হয়ে গেছে।”
অরা চোখ গোল করে বলল, গাল ফুলিয়ে একটুখানি রাগ দেখানোর চেষ্টা করলো।
“তুমি চাইলে আমরাও বাবা-মা হতে পারি। শুধু একবার বলো তুমি, রাজি!”
আরিশ কপট কণ্ঠে বললো, চোখে মুখে দুষ্টু হাসির ঝিলিক।
“ধ্যাৎ! আমি তা বলিনি।”
লজ্জায় মাথা নিচু করে হাসি চেপে বলল অরা।
“তা বললেও হবে না কিছু। সমস্যা আছে একটা।”
এবার একটু গম্ভীর হলো আরিশ। ভ্রু কুঁচকে তাকালো সামনের দিকে।
“কী সমস্যা?”
অরা ভ্রু তুলে কৌতূহল নিয়ে তাকালো আরিশের চোখে।
“আমি বাবা হতে চাই না।”
“কী!”
চমকে উঠে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো অরা।

“হ্যাঁ, আমি তোমার সন্তানের বাবা হতে চাই না। কারণ তুমি আমার থেকে বেশি বাচ্চার পেছনে সময় ব্যয় করবে। আমার সেসব সহ্য হবে না।”
আরিশ গম্ভীর চোখে তাকিয়ে বলল, যেন মনের গভীর থেকে কথাগুলো বেরিয়ে আসছে।
“আপনি আসলেই পাগল! বাচ্চার সাথেও হিংসা করবেন?”
বিরক্ত কণ্ঠে বলে চোখ বড় বড় করলো অরা, মুখে একটা অবিশ্বাসের ছাপ। চুপ করে রইলো আরিশ। কিছু একটা ভাবছে সে। ভ্রু কুঁচকে চোখ নামিয়ে ফেলল।
তারপর হালকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তবে বেবি যদি তোমার মতো কিউট একটা পাখি হয় তবে, মানাতে চেষ্টা করবো।”
একটু হেসে গাল চুলকে বললো আরিশ, যেন নিজের কথায় নিজেই মজা পাচ্ছে। অরা মুচকি হাসল। তারপর আলতো করে আরিশের চুলের মধ্যে হাত দিয়ে হালকা নেড়ে দিলো একবার।
আরিশ খানিকটা চমকে তাকালো অরার দিকে।

মুহূর্তেই নরম হয়ে গেলো তার মুখের ভাব।
মায়ের মতো স্পর্শটায় যেন মনটা কেঁপে উঠলো তার।
হঠাৎ করেই মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো।
চোখে ভেসে উঠলো অতীতের কোনো স্মৃতি।
চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে স্থান ত্যাগ করলো আরিশ, একটাও শব্দ না করে।
অরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার পেছনে।
সে কিছুই বুঝতে পারলো না। কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো হতবিহ্বল হয়ে।
ঘড়িতে সময়, রাত এগারোটা। অতিথিরা সবাই নির্দিষ্ট সময় খাওয়াদাওয়া সেড়ে যে যার বাড়ি চলে গিয়েছেন। অরার বাবা-মা, তাসলিমা খাতুন উনারাও খেয়েদেয়ে শুতে চলে গেছেন৷ বাকি আছে কেবল তামান্না, তালহা ও অরা, আরিশ। তামান্না রান্নাঘরে, নিজেদের জন্য খাবার গরম করছে, তালহা ড্রইং রুমে বসে ফোন নিয়ে ব্যস্ত। আরিশ, অরা নিজেদের ঘরে আছে।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ, দৃষ্টি তার দূর আকাশে। অরা সাহস করে আরিশের সাথে কথা বলতেও পারছে না। আয়নার সামনে বসে গয়নাগাটি খুলে রাখছে সে। আর মাঝে মধ্যে আরিশকে দেখছে। আচমকা ভদ্রলোকের কী হলো সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না অরার। এই ক’মাসে আরিশকে কখনো এরকম চুপচাপ থাকতে দেখেনি। বরং রাগ করে চিৎকার-চেঁচামেচি করাতেই আরিশ ঠিকঠাক লাগে। কিন্তু আজ হঠাৎ আরিশের এই নিস্তব্ধতা অরাকে ভাবাচ্ছে।
সেই রাতে আরিশের সাথে আর কথা বলা হলোনা তার। সবাই যে যার মতো খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়লো। আরিশ খেয়েছিল, তবে অল্প। অরাও বিশেষ কিছু খায়নি। বিছানায় শুতেই দু-চোখ জুড়ে ঘুম ভর করেছে তার। বিয়ের পর আজ প্রথম আরিশের হাতের ওপর না শুয়ে বালিশে শুয়েছে সে। মনটা অস্থির লাগছে। আরিশের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল টেরও পায়নি অরা।
মাঝরাতে আচমকা হাত-পায়ে একরকম নরম চাপ অনুভব করে অরার ঘুম ভেঙে গেল। চোখের পাতা ভারী, কিন্তু শরীরের অস্বাভাবিক অবস্থান যেন তাকে সচেতন করে তুলল।

ঘুম ঘুম চোখে পাশে তাকিয়ে দেখল, আরিশ নেই।
হঠাৎ করেই বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। পুরো ঘুম কেটে গেল তার। বসে উঠতে গিয়েও থমকে গেল অরা। হাত-পা যেন নড়ছে না ঠিকঠাক! ঘাড় কাত করে তাকিয়ে চমকে উঠল সে।
পায়ের গোড়ালি দুটো শক্ত দড়িতে বাঁধা, হাত দুটো বিছানার মাথায় লাগানো কাঠের ফ্রেমে রুমাল দিয়ে বাঁধা – যতটা মজবুত, ঠিক ততটাই নরমভাবে যেন কষ্ট না হয়। স্তম্ভিত অরা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল নিজের অচল শরীরের দিকে।
হালকা ঘাবড়ে গেলেও তার মনে হচ্ছিল– এই কাজ আরিশ ছাড়া কেউ করতে পারে না। তার ভাবনায় ছেদ পড়ল একটা কাঁপা গোঙানির শব্দে।
মাথা কাত করে ফ্লোরে তাকাতেই অরার চোখ আটকে গেল।
মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে আরিশ। মুখ গুঁজে রেখেছে নিজের হাঁটুতে। এলোমেলো চুলে ঢাকা মুখটা আবছা আলোয় অস্বস্তিকরভাবে অচেনা লাগছে।
এক মুহূর্তের জন্য গলার স্বর আটকে গেল অরার। তবুও সাহস করে ডাকল সে।

“আরিশ? কী হয়েছে আপনার?”
গলায় কাঁপুনি, চোখে মিশ্র ভয় আর উদ্বেগ।
ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকাল আরিশ। চোখ লাল, মুখ শুকিয়ে গেছে। যেন বহুক্ষণ কেঁদেছে সে।
কোনো কথা না বলে সেখানেই কিছুক্ষণ স্থিরভাবে বসে রইল।
“আপনি ঠিক আছেন?”
অরার কণ্ঠে এবার গভীর উদ্বেগ। নিজের অবস্থার কথা ভুলে গিয়ে শুধু আরিশকে নিয়েই ভাবছে সে।
আরিশ যেন এই প্রশ্নেই একটু চমকাল। চোখে-মুখে মেঘের মতো আবেগ খেলা করল।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে। নিঃশব্দে বিছানার দিকে এগিয়ে এল।
অরা অবচেতনেই দম ছাড়ল। তাহলে ঠিক আছে ও।
বিছানায় বসে অরার চোখে চোখ রাখল আরিশ। এবার আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল– তার গাল বেয়ে কাঁচা নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে এখনো।
অরার কপাল ভাঁজ পড়ে গেল। অবিশ্বাস আর বিস্ময়ে ভরে উঠল তার চোখ। আরিশ কাঁদছে? সে তো কখনো কাঁদে না!
ভাঙা গলায় আরিশ বলল,

“তোমার ভয় করছে, হামিংবার্ড? আমাকে ভয় পাও তুমি?”
কণ্ঠটা যেন শিশুর মতো ভাঙা, আর চোখজোড়া বৃষ্টিভেজা বিকেলের আকাশ। অরা মাথা নাড়ল ধীরে। চোখে স্থির বিশ্বাস।
“না। আপনাকে ভয় পাবো কেন? যে মানুষটা আমাকে এতো ভালোবাসায় মুড়ে রেখেছে, তার কাছে কীসের ভয়?”
ঠোঁটের কোণে একটুখানি মায়ামাখা হাসি, চোখে নিখাদ স্নেহ।
আরিশ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। চোখ দুটো আরও ছলছল করে উঠল।
চুপচাপ, নিঃশব্দে সে অরার হাতের বাঁধন খুলে দিতে লাগল – খুব যত্নে, খুব ধীরে।
অরা বুঝতে পারছে, আরিশ ভেতরে একদম ভেঙে পড়েছে। কিছু একটা হয়েছে, যা তাকে তছনছ করে দিয়েছে।
হাত খুলে দেবার পর অরা ধীরে ধীরে উঠে বসল। দুজনের চোখে চোখ আটকে রইল এক মুহূর্ত।
আচমকা, কোনো কিছু না বলে, আরিশ অরাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। যেন কোনো বাঁধ ভেঙে গেল তার ভেতরে।

অরা প্রথমে থমকে গেল। পুরো মুহূর্তটা থেমে গেল চারপাশে। তারপর ধীরে ধীরে সে নিজের দুই হাত দিয়ে আরিশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কান্নারত কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল আরিশ,
“শোনো হামিংবার্ড… তুমিও কি একদিন আমায় ছেড়ে চলে যাবে? তুমি তো জোর করে আছো এখানে, তাই না? আমি বেঁধে রেখেছি, না হলে অনেক আগেই উড়ে যেতে। তুমি উড়েই যেতে চাও, তাই না, পাখি?”
অরার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। এমন অসহায়, ভাঙা কণ্ঠ শুনে ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল সে। প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয় একজন মানুষকে কীভাবে এতটা তছনছ করে দিতে পারে – সেটাই যেন এবার স্পষ্টভাবে অনুভব করল অরা।
ধীরে হাত বাড়িয়ে আরিশের মুখের কাছে আনল নিজের কপাল। অরার কপাল ঠেকল আরিশের কপালে। চোখে চোখ রেখে সে ধীরে বলল,

“আমি কোথাও যাবো না, রাগী ভূত। আমি আপনাকে ভালোবাসি, ঠিক যেমন আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আছি, থাকবো… প্লিজ, শান্ত হোন।”
আরিশ যেন কিছু বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিল। কেবল অরার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল নিঃশব্দে। পরম মুহূর্তে তার চোখজোড়া জলে ভরে উঠল। মাথা নিচু করে কপালে চুমু খেল, তারপর এলোমেলোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল চোখে, নাকে, গালে। আর অরাও দুই হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরল তাকে, ভালোবাসা ছড়িয়ে দিল স্পর্শে, চোখে, প্রশ্বাসে।

“আমার না, সব সময় মনে হয় এই বুঝি তোমাকে হারিয়ে ফেললাম…”
আরিশ একটু থেমে আবারও ফিসফিস করে বলল,
“ঘুমাতে পারি না আজকাল, দুঃস্বপ্ন দেখি… তুমিই নেই কোথাও।”
“না আরিশ,দুঃস্বপ্ন শুধু মনের ধোঁয়াশা। ওগুলো কখনও সত্যি হয় না।”
আরিশ এবার অরার পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে কোলে তুলে বসাল।
“আমি একটা কাজ করবো।”
“কী কাজ?”
অরার চোখে খেলা করে কৌতূহল।
“একটা চুক্তিপত্র বানাবো। সেখানে লেখা থাকবে – তুমি আজীবন আমার সঙ্গে থাকবে।”
অরার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে হালকা চুমু খেল আরিশের ঠোঁটে। মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
“আপনি যা খুশি করতে পারেন। কিন্তু আগে তো আপনি নিজের মতো হয়ে আসুন। এভাবে ভাঙাচোরা লাগছে, আর… আপনি আনরোমান্টিক হয়ে গেছেন।”

শেষ কথাটা একটু নিচুস্বরে বলল অরা, যেন মজা করেই।
আরিশ থমকে গিয়ে তাকাল, তারপর চোখ বড় বড় করে বলল,
“আমি, আরিশ খান, আনরোমান্টিক? শুনুন মহারাণী, আপনাকে স্পেশাল ফিল করানোর জন্য কতটা কষ্ট করে নিজেকে কন্ট্রোল করছি, তা আপনি বুঝবেন না।”
“কেন বুঝবো না?”
“কারণ, তুমি পুরুষ মানুষ নও।”
অরা হেসে ফেলল। আরিশ অরার কপালের কাছে ঝুঁকে এসে বলল,
“মানুষ আসলে কী চায় সে নিজেই জানে না, পাখি। যখন অস্বাভাবিক আচরণ করতাম, জোর করে কাছে টানতাম তখন বলতে– স্বাভাবিক হোন। এখন ভদ্রলোক হয়ে গেলাম, এখন বলতেছ– আগের মতো হোন।”
অরা থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
“না মানে…”
“মানে আমি বুঝে গেছি। তুমি জোর করে আদরে অভ্যস্ত হয়ে গেছো।”
চোখে এক চিলতে দুষ্টুমির ঝলক। তারপর হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বলল,
“ওয়েট! সকালে ফ্লাইট। রাতে মনমেজাজ খারাপ ছিলো বলে, বলা হয়নি। আগামীকাল ইতালি যাচ্ছি আমরা। তোমার পছন্দের পাহাড়ি এলাকা, ইতালির টাসকানিতে যাচ্ছি। “
“সত্যি? কিন্তু কিছুই তো গুছানো হয়নি!”
“এখনই গুছিয়ে নিই। কেবল দরকারি জিনিস নেবে। বাকিটা শপিং করে নেবো।”
“ওকে!”
“চলো তাহলে, হামিংবার্ড।”

আরিশ অরাকে নামিয়ে, রুমের বাতি জ্বালাল। আলোর নিচে ওরা দু’জনে ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটা ছোট রাতের কান্না পেরিয়ে, এক নতুন সকালকে স্বাগত জানাতে।
সকালের শুরুটাই খারাপ খবর দিয়ে হয়েছে রহমান চৌধুরীর জন্য। কোম্পানির বড় রকমের ক্ষতির খবর পেয়ে তার মনমেজাজ একেবারে বিগড়ে গেছে। আরিশের সঙ্গে সেই ঘটনার পর থেকেই চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিজ ধীরে ধীরে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
রহমানের এখন আর বুঝতে বাকি নেই এই সব কিছুই তেজরিন খান আর আরিশের কাজ। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিজও আজ নুয়ে পড়েছে, সেটা ভেবেই নিজের ওপর বিরক্তি চেপে বসেছে।
যদি অরার সঙ্গে সেদিন ওরকম কিছু না করত, তাহলে আরিশও হয়তো এভাবে তাদের পেছনে লাগত না।
রান্নাঘরে সকালের নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত রোকসানা মল্লিক। নয়নার আজ ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। সকাল দশটায় পরীক্ষা শুরু, তাই সে উঠে কিছুটা রিভিশন নিচ্ছে এখন।
সোলাইমান মল্লিক বসে আছেন টিভির সামনে। আগের মতো আর পত্রিকা পড়া হয়ে ওঠে না, তাই খবর জানার একমাত্র ভরসা এখন নিউজ চ্যানেলগুলো।

হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই চমকে উঠলেন তিনি। ফোন হাতে নিয়ে মুচকি হাসলেন,গ্রামের বাড়ি থেকে বড় ভাই আজমাইন মল্লিক ফোন দিয়েছেন।
সোলাইমানদের পরিবারে দুই ভাই, তিন বোন। তাদের মা, আনজুম মল্লিক, থাকেন আজমাইনের সঙ্গেই গ্রামে। বাবা মারা গেছেন বহু বছর আগে। ছোট বোন রিনা থাকেন একই গ্রামে, তাঁর একমাত্র ছেলে নিশান। বাকি দুই বোন থাকেন অন্য শহরে – তাদের সঙ্গে সোলাইমান বা আজমাইনের কোনো যোগাযোগ নেই।
সোলাইমানের স্ত্রী রোকসানাকে বিয়ে করার কারণে তারা সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। প্রথম দিকে পুরো পরিবারই রোকসানাকে গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অরা ও রোকসানার সরলতা, আন্তরিকতা আর ভালোবাসায় গলে যায় সবাই – আজমাইন, রিনা এমনকি আনজুম মল্লিকও।
“ আসসালামু আলাইকুম, ভাইজান। কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, তোরা কেমন আছিস?”
আজমাইন ভাইয়ের কণ্ঠে ভরপুর আন্তরিকতা।
“আলহামদুলিল্লাহ। মা কেমন আছেন?”

সোলাইমানের কণ্ঠে কৌতূহল আর মায়া।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। তোরা তো এমনি গ্রামে আসবি না, তাই দরকারে কল দিলাম।”
ভাইয়ের কথায় এক ধরনের অভিমান লুকানো।
ভাইয়ের এমন কথায় খানিকটা সংকোচে পড়ে গেলেন সোলাইমান। দীর্ঘদিন গ্রামে না যাওয়া, মা’র সঙ্গে দেখা না হওয়া—সব মিলিয়ে একটা অস্বস্তি বুকে চেপে বসল।
“আসলে জানেনই তো, কাজের…”
“হ্যাঁ জানি বাপু, তোমার অফিস আছে। মেয়েটাকে নিজেরা নিজেরাই বিয়ে করিয়ে দিলি! মা অরার জন্য খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। মেয়েটার কী অবস্থা এখন? জামাই কি এখনও…”
আজমাইন মল্লিকের গলায় চিন্তার ছায়া।
“এখন সবকিছু ঠিক আছে, ভাইজান। অরা সুখেই আছে, আলহামদুলিল্লাহ।”
সোলাইমান আশ্বাস দিলেন আত্মবিশ্বাসী গলায়।

“যাক আলহামদুলিল্লাহ। সুখে থাকলেই ভালো।”
আজমাইন মল্লিক যেন নিজের ছোট ভাইয়ের মুখে শান্তির খবর শুনে স্বস্তি পেলেন।
“আচ্ছা শোন, উর্মির জন্য ছেলে পক্ষ এসেছিল গতকাল। দেখাশোনার পর একেবারে হাতে আংটি পরিয়ে গেছে। আগামী শুক্রবার বিয়ের তারিখ ঠিক হবে ইনশাআল্লাহ। বুঝতেই পারছিস, মেয়ের বিয়ে। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে চলে আসা চাই।”
উর্মি আজমাইনের বড় মেয়ে, সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে। আজমাইনের তিন সন্তান—দুই মেয়ে, এক ছেলে।
“আলহামদুলিল্লাহ! এটা তো অনেক আনন্দের খবর। তবে ভাইজান, এক সপ্তাহ আগে যেতে পারবো কি না নিশ্চিত না। অন্যের কোম্পানিতে কাজ করি, ছুটি পাওয়া কঠিন। তবে ইনশাআল্লাহ বিয়ের তিন-চার দিন আগেই চলে যাবো, রাগ করবেন না!”
সোলাইমান গলায় অনুশোচনা মেশানো বিনয়ের সুর।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আজমাইন মল্লিক।

“বেশ। তবে সবাইকে নিয়ে আসা চাই, অরাদেরও নিয়ে আসবি।”
“ঠিক আছে, ভাইজান।”
সোলাইমান সম্মতির মাথা নাড়লেন ফোনের এপাশ থেকে।
“বেশ। তাহলে ভালো থাক। আশা করি, শীঘ্রই দেখা হবে আমাদের।”
“জি ভাইজান। আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
ফোন রেখে মনটা হালকা লাগলো সোলাইমানের। ভাইয়ের কণ্ঠে একধরনের কাছের টান ছিল, যা তার ভিতরে জমে থাকা অপরাধবোধটুকু একটু হলেও লঘু করে দিল।
রোকসানা রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এলেন ডাইনিং টেবিলে। ফোনালাপের কিছুটা শুনে ফেলেছে নয়না, তাই ড্রইং রুম থেকে ছুটে এলো।
“বড় আব্বু কল করেছিলেন, বাবা?”
নয়নার চোখে উচ্ছ্বাস।

সোলাইমান মুচকি হাসলেন। মেয়ের কাঁধে হাত রেখে ডাইনিং রুমের দিকে এগোলেন।
“হ্যাঁ। উর্মির বিয়ে সামনে।”
“ইয়াহু! উর্মি আপুর বিয়ে! কিন্তু কতদিন পর, বাবা?”
নয়নার গলায় খুশি ও কৌতূহলের ঝাঁপটা।
চেয়ার টেনে বসলেন সোলাইমান। রোকসানা চুপচাপ খাবার পরিবেশন করছেন। বাবা-মেয়ের কথা শুনে এমনিতেই সবকিছু বুঝতে পারবেন ভেবেই কিছু জিজ্ঞেস করছেন না।
“তা কম হলেও পনেরো দিন পর।”
সোলাইমান হিসেব করে বললেন।
“যাক বাঁচা গেলো। আমার পরীক্ষা চলবে বারো দিন পর্যন্ত। পরীক্ষার মধ্যে বিয়ে হলে তো, গেলো!”
নয়না হেসে বলল, যেন চিন্তার পাহাড় নেমে গেছে।
রোকসানা মেয়ের প্লেটে পরোটা দিতে দিতে হাসিমুখে বললেন,
“তোর পরীক্ষার কথা শুনলে ভাইজান হয়তো বিয়েই পিছিয়ে দিতেন।”

“একদম ঠিক!”
সোলাইমান হেসে সায় দিলেন।
সবাইকে খাবার দিয়ে রোকসানাও টেবিলে বসলেন। খাবার মুখে তোলার আগে একবার চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকালেন। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
সারাটা জীবন বহু ঝড়ঝাপটা গেছে তাঁর ওপর দিয়ে। প্রথম স্বামীর মৃত্যু, সমাজের অবজ্ঞা—সব পেরিয়ে আজ সোলাইমান মল্লিকের মতো একজন দায়িত্বশীল, ভরসাযোগ্য মানুষ তাঁর পাশে। এটাই হয়তো জীবনের পুরস্কার।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সকালে সূর্য ওঠার আগেই বিমানবন্দরের পথে রওনা দিয়েছিল অরা আর আরিশ। সকাল আটটার ফ্লাইটে মিলানের উদ্দেশ্যে উড়ে যায় তারা। আকাশে ভেসে থাকা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে জানালার কাচে ভেসে আসে সূর্যের সোনালি আলো। অরার চোখে তখনও খানিক বিস্ময়, খানিক স্বপ্ন। আরিশ তার পাশে বসে, অরার হাতে হাত রেখেছিল।
দীর্ঘ এগারো ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে সন্ধ্যার ক্লান্তি মাথায় নিয়ে তারা ইতালির মাটিতে পা রাখে স্থানীয় সময় বিকেল তিনটায়। বাংলাদেশে তখন সন্ধ্যা। কফির মতো ঘন রোদ, আর অপরিচিত ভাষার শব্দে যেন চারপাশের পরিবেশটাই নতুন লাগে।

হামিংবার্ড পর্ব ৪৭

মিলানে নিজেদের এপার্টমেন্টে ছোট্ট বিরতি, কফির কাপ, আর এক চিলতে বিশ্রামের পর ব্যাগপত্র গুছিয়ে তারা রওনা দেয় দক্ষিণ টাসকানির সেই নির্জন, পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকার দিকে – বালডিচিয়া। নামের মধ্যেই যেন একটা সুর বাজে– বালডিচিয়া, যেন পাহাড় আর কুয়াশার গল্প।
গাড়ির জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। পাহাড়, আঙুরের খেত, কল্পনার মতো গ্রাম আর দূরে হারিয়ে যাওয়া সোনালি বিকেল। প্রথমবার অজানা দেশের পথে, সাথে আরিশ– সবকিছুই যেনো স্বপ্নের মতো লাগছে অরার।

হামিংবার্ড পর্ব ৪৯