হামিংবার্ড পর্ব ৫
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
সোলাইমান মল্লিক সকাল সকাল অফিসে চলে গেছে, নয়নাও স্কুলে গিয়েছে। সংসারের যাবতীয় কাজ শেষ করে, বাইরে বের হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন রোকসানা মল্লিক। অরাকে একনজর দেখার জন্য হাসফাস লাগছে উনার। হঠাৎ ফোনের রিংটোনে নড়েচড়ে উঠলেন রোকসানা। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে তাকাতেই চমকালেন। অরা কল করেছে! রোকসানা কালক্ষেপণ না করলে কল রিসিভ করলেন।
” অরা! অরা তুই ঠিক আছিস? ”
” আমি ভালো আছি মা। তোমরা কেমন আছো? ”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন রোকসানা।
” তোর কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না, কীভাবে ভালো থাকি বল? ”
” আমার ফোনে চার্জ ছিলো না মা। আর একটু জ্বর এসেছিল…..”
” জ্বর! কখন এলো? আর এখন কমেছে? ”
উতলা হয়ে উঠলেন অরার মা।
” শান্ত হও মা। জ্বর কমেছে। ডাক্তার এসেছিল, ঔষধ দিয়েছে। এখন একদম ফিট হয়ে গেছি। ”
” যাক আলহামদুলিল্লাহ। মা তুই আমার সাথে রাগ করিসনি তো?”
” কী বলছ মা! রাগ কেনো করব? কিন্তু মা, আরিশ ভাই… মানে আরিশের সাথে কেনো বিয়ে দিলে? শুধুমাত্র তোমার বোনের ছেলে বলে? ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেয়ের প্রশ্নের উত্তরে রোকসানা কী বলবেন বুঝতে পারছেন না।
” কেনো অরা? আরিশ কি ভালো ছেলে নয়? তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে? ”
অরার চোখ ছলছল করছে। নয়নার চোখেও পানি। কিন্তু ফোনের অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রোকসানা মল্লিক সেটা দেখতে পাচ্ছেন না।
” না, ভালো ছেলে। ”
” তাহলে! আমি জানি, তোদের বয়সের পার্থক্যটা বেশি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আরিশ তোকে খুব ভালো রাখবে। ”
” তাই যেন হয়। ”
” আমি তোর কাছে আসার জন্য বের হচ্ছিলাম, এরমধ্যে তুই কল দিলি। ”
” আমি সুস্থ হলে, দু’দিন পর তোমার কাছে যাবোই তো। বিয়ের তিনদিন পর বাবার বাড়ি যেতে হয় না?”
রোকসানা মল্লিক হাসলেন মেয়ের কথায়। বললেন,
” আসলে আমাদের মুরুব্বীরা এমনই করে এসেছেন। সেজন্য আমরাও বলি এটা নিয়ম। যাইহোক, আরিশকে বলিস আমি কল দিলে যেন রিসিভ করে। ছেলেটা কেমন জানি! কখনো কল দিলে পাই না। ”
” আচ্ছা মা। ভালো থেকো। ”
” তুইও ভালো থাকিস,দেখা হবে শীঘ্রই। ”
” ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ হাফেজ। ”
” আল্লাহ হাফেজ। ”
কল কাটতেই নয়না বলল,
” আপু দুদিন পর, ভাইয়া তোমাকে নিয়ে যাবে তো?”
নয়নার প্রশ্নে আনমনা হয়ে গেলো অরা। সত্যি তো! আরিশ কি আদৌও যাবে? মায়ের কাছে নিজের কষ্টের কথা বলতে চায় না অরা। তাহলে মা নিজেকে অপরাধী ভাববে। অরা যে মা’কে ভীষণ ভালোবাসে।
সকাল বেলা, শহরের রাস্তাগুলোতে ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। বড় বড় গাড়ি চলতে শুরু করেছে, আর মানুষজনও ছুটছে তাদের কর্মস্থলে। ট্রাফিক সিগনালগুলোতে গাঢ় লাল আলো জ্বলছে, গাড়িগুলোর হর্নের শব্দ মিশে যাচ্ছে শহরের শব্দে। রাস্তায় দোকানের ঝাঁকজমক, বাজারের গলির ভীড়, সব কিছু যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
আরিশ আজকে অফিসে পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। তেজরিন খান আরিশ, খান ইন্ড্রাস্টির একমাত্র উত্তরাধিকারী। বাবার পর চাচা আর চাচার পর আরিশই ব্যবসার হাল ধরে রেখেছে । আরিশের অফিস বিল্ডিংটা শহরের অন্যতম বড়ো ও প্রভাবশালী অফিস ভবনগুলোর মধ্যে একটি। পনেরো তলা দালানের উপরের দিকে বিশাল একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে, যেখানে ‘খান ইন্ড্রাস্টি’ লেখা, এবং তার আশেপাশে গ্লাসের কাচের দেয়ালে সুর্যের আলোর প্রতিবিম্ব। আরিশ নিজে তার কর্মজীবনে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এসে এখানে পৌঁছেছে। অফিসের প্রতিটি কোণায় কাজের তাগিদ, দায়িত্ব আর প্রভাব যেন দৃশ্যমান। ব্যক্তিজীবনে আরিশ যেমনটা রাগী, কর্মক্ষেত্রে ততটাই ঠান্ডা মাথার অধিকারী। সব কাজ মাথা ঠান্ডা রেখে করে।
আরিশের অফিসে, লবি থেকে শুরু করে প্রতিটি কোণায় আভিজাত্যের ছোঁয়া! লবি এবং করিডরগুলো উজ্জ্বল সাদা ও সোনালী রঙের শেডে সাজানো, যেখানে বড় বড় কাচের জানালা দিয়ে বাইরে শহরের দৃশ্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়। আরিশের কেবিনটা পুরো অফিস ভবনের উপরতলায়, তার নিজের পরিসরের মতো বিশাল। কেবিনের দেয়ালে রয়েছে শীতল রঙের প্রিন্ট, আর মেঝে লেদারের টাইলস দিয়ে ঢাকা। কেবিনের মাঝখানে একটি বিশাল কাঠের টেবিল, যার ওপরে সাজানো কিছু ব্যবসায়িক রিপোর্ট এবং কাগজপত্র। টেবিলের এক কোণে রাখা আছে সোনালী রঙের একটি দামী পেন, আর পাশে রয়েছে একটি আধুনিক ডিজাইনের ফোন। পুরো কেবিনের এক কোণে বিশাল চামড়ার চেয়ার, যেখানে আরিশ বসে।
” মে আই কাম ইন স্যার? ”
ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে ছিলো আরিশ। নবনীতা ইসলামের কণ্ঠস্বর শুনে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলেও আরিশ এক মুহূর্তের জন্যও তার ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলল না।।
” ইয়েস, কাম ইন। ”
নবনীতা মুচকি হেসে রুমে প্রবেশ করল। আরিশ ইশারায় বসতে বলল তাকে। নবনীতা চেয়ার টেনে বসলেন।
” স্যার, আমাদের নতুন প্রজেক্টের জন্য কিছু আপডেট রয়েছে।”
নবনীতা কথা শুরু করল, কিন্তু তার কণ্ঠে কিছুটা উদ্বেগ ছিল।
“কিছু ডেটা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, কিছু রিপোর্ট মিসিং। আমি ভাবছিলাম, হয়তো আপনি যদি একটু সময় দেন, তবে আমি বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে পারি।”
আরিশ একটু থেমে রইল, তারপর ধীরে ধীরে সামনে থাকা একটা ফাইলের ওপর চোখ বুলাল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি সোজা হয়ে বসে বলল,
“আপনি কি নিশ্চিত যে, পুরো টিম মিটিংয়ের সময় সব ডেটা সঠিকভাবে হ্যান্ডেল করেছে?”
“হ্যাঁ স্যার, তবে কিছু ভুল ধারণা ছিল। আমার মনে হচ্ছে, কিছু রিপোর্টের ফরম্যাট ঠিক হয়নি এবং তাই এগুলো সঠিকভাবে সিস্টেমে ইন্টারপ্রেট হচ্ছে না।”
নবনীতা উত্তরে বলল, তার কণ্ঠে সতর্কতা স্পষ্ট।
“ঠিক আছে। আপনি টিমের সাথে বসে সেগুলো ঠিক করার ব্যবস্থা নিন। আমি কিছুদিন পর রিপোর্টটি আবার দেখে নেব। আর হ্যাঁ, যেকোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।”
নবনীতা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“ধন্যবাদ স্যার। আমি দ্রুত সমাধান করতে চেষ্টা করব।”
আরিশ আবার ল্যাপটপে দৃষ্টিপাত করল, কিন্তু তার মনোযোগ এখনো নবনীতার দিকে ।
“এছাড়া, আমি শুনেছি আপনার একটি নতুন আইডিয়া ছিল, আমাদের বিপণন কৌশল নিয়ে। সেটার বিষয় বলুন। ”
নবনীতা একটু হাসি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, স্যার। আমি মনে করি যদি আমরা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে আরও ইন্টারঅ্যাক্টিভ ক্যাম্পেইন চালাতে পারি, তবে আমাদের কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু অনেকটা বৃদ্ধি পাবে। আমি কিছু নতুন আইডিয়া নিয়ে এসেছি।”
আরিশ চুপচাপ শুনল। কিয়ৎক্ষণ বাদে বলল, “গুড আইডিয়া। আগামীকাল এটা নিয়ে কথা বলব। এখন আপনি আসুন। আর হ্যাঁ কাজগুলো মন দিয়ে করবেন। ”
” ওকে স্যার।”
নবনীতা আর কথা বাড়ালো না। আরিশ অতিরিক্ত কথা অপছন্দ করে, এটা অফিসের সবাই জানেন। নবনীতা রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আরিশ অনলাইনে মিটিং এ জয়েন হলো।
সারাদিন একা একা থাকতে ভালো লাগছে না অরার। তামান্না নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে । তাছাড়া তার সাথে ভালো জমেও না অরার। রুম থেকে বেরিয়ে করিডোরে হাঁটছে সে। পরনে কালো রঙের গাউন, খোলা চুল। আরিশ আগেই অরার জন্য পোশাক আনিয়ে রেখেছিল। সেগুলোই পরছে এখন। করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে পুরো বাড়িটার দিকে ভালো করে নজর বুলাতে লাগলো অরা। বাড়ি তো নয় যেন রাজপ্রাসাদ! অরা অবাক চোখে সবকিছু দেখছে। এরমধ্যেই কলিংবেলের আওয়াজ পাওয়া গেলো। তামান্না রাতের খাবার রান্না করছিল। কলিংবেলের শব্দে দৌড়ে দরজা খুলে দিতে এলো সে। অরা করিডোরে দাঁড়িয়েই সবকিছু দেখছে। আরিশ বাসায় ফিরেছে। আরিশকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখেই দৌড়ে রুমে চলে গেলো মেয়েটা।
” অরার জ্বর কমেছে, তামান্না?”
বসার ঘর পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে প্রশ্ন করলো আরিশ। তামান্না বলল,
” জি ভাইয়া। ভাবি….”
” আরকিছু জানতে চাইনি৷ ”
তামান্না চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে এগোল। নিজেকে গালি দিলো কয়েকটা। কেনো যে আগবাড়ানো কথা বলে সেই নিয়ে নিজের ওপর বিরক্ত সে।
” এভাবে শুয়ে আছ কেনো? ”
আচমকা আরিশের কথায় শোয়া থেকে উঠে বসল অরা। শোয়া নিয়েও কি রাগারাগি করবে না-কি? মানুষ তো নয়, যেন আজাজিল খন্নাস। অরা নিজেকে ধমক দিলো। এসব কথা তো অরার দাদি বলে, অরা কেন বলবে?
” এমনি৷ ”
আরিশ জামাকাপড় খুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলল সব। পরনে কেবল প্যান্ট। আরিশকে এভাবে অর্ধনগ্ন অবস্থায় দেখে চোখ সরিয়ে ফেলল অরা। বিষয়টা খেয়াল করলো আরিশ। নিজের স্বামীর দিক থেকে চোখ সরাল কেনো সে? মুহুর্তেই আরিশের মাথার পোকাটা নড়েচড়ে উঠল। কিছু না বলেই অরার একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অরা চমকাল, ভয় পেলো কিছুটা।
” চোখ সরিয়ে নিলে কেনো? ”
” না মানে, আসলে…..”
আরিশ অরার দু-হাত ধরে নিজের উন্মুক্ত বুকে ছোঁয়াল। মৃদু কেঁপে উঠল ছোট্ট অরা। এতবড় একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সামনে অরাকে নেহাৎ এতটুকুই লাগে। তার ওপর বয়সের পার্থক্য চৌদ্দ বছরের!
” আমার দিকে তাকাও হামিংবার্ড। ”
অরা ভয়ে ভয়ে তাকাল আরিশের দিকে। আরিশের চোখে আবারও সেই পাগলামি দেখতে পাচ্ছে অরা৷
” আমার দিক থেকে কখনো নজর সরাবে না। আমাকে দেখবে, যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ। মনে রেখো, আমি ছাড়া গোটা পৃথিবীর সকল পুরুষ তোমার জন্য হারাম, নিষিদ্ধ। ”
অরা চুপ করে শুনছে সব।
” কথা বলছ না কেন? ”
ধমকে উঠল আরিশ৷ অরা ভয়ে বলল,
” আচ্ছা। ”
আরিশের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কেনো তা সে জানে না। মনে হচ্ছে তার স্ত্রী তার প্রতি আগ্রহী নয়৷ অরাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো আরিশ। অরা ভয় পাচ্ছে। আবারও হয়তো জোর করে ইন্টিমেট হবে লোকটা! অরার চোখ ছলছল করছে। এই লোকের অত্যাচার সে সইতে পারে না,সেই ক্ষমতা নেই তার। আরিশ কোমরের বেল্ট খুলে ফেলল। তারপর অরার শরীরের ওপর ঝুঁকে, হাতদুটো ওর মাথার ওপরের দিকে একত্র করে বেল্ট দিয়ে বাঁধতে লাগলো। অরা ভয় পাচ্ছে খুব। থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। যদিও বেল্ট দিয়ে বাঁধতে গেলে হাতে কোনো চাপ পড়বে না, উল্টো বাঁধন শিথিল হয়ে যাবে।
” প্লিজ এরকম করবেন না। আমি আর কখনো আপনার দিক থেকে চোখ সরাবো না। ”
আরিশ কোনো উত্তর দিলো না। হাত বাঁধা শেষে অরার শরীরে ওপর নিজের শরীর ছাড়ল, ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। অরা চুপচাপ শুয়ে আছে কেবল। আরিশ গভীরভাবে কিস করছে তাকে। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পরেও অরার থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে উঠে বসলো আরিশ। রেগেমেগে বলল,
” তরতাজা পুরুষের ঠোঁটের স্পর্শ পেয়েও কোনো রেসপন্স করলে না কেন? বয়স তো একেবারে কম না, সতেরো / আঠারো হবে। চাহিদা নিশ্চয়ই আছে? তাহলে? ”
অরা ভয়ে, লজ্জায় কী বলবে বুঝতে পারছে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কেবল। আরিশ অরার হালচাল বুঝতে পারছে না।
হামিংবার্ড পর্ব ৪
” কথা বলো ছোট্ট পাখি। ”
” আমার সময় লাগবে। ”
” গুড। ”
অরার হাত খুলে দিতে লাগলো আরিশ। মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মেয়েটা। অরা ছাড়া পেয়ে উঠে বসল। আরিশ ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে। মায়ের বলা কথাগুলো কি এখন বলবে? দোটানায় আছে অরা। কী বললে আবার কী করতে শুরু করবে বলা যায় না!