হামিংবার্ড পর্ব ৫১
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
অরা আর আরিশ ধীরে ধীরে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটছে। বালডিচিয়ার ছোট্ট শহরটা যেন কোনো রূপকথার বই থেকে উঠে এসেছে। টালি ছাওয়া লাল ছাদের বাড়িগুলো সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে, দেয়াল জুড়ে আঁকা প্যাস্টেল রঙের ফুল আর পুরনো সময়ের ছোঁয়া মাখা জানালার গ্লাসগুলো রোদের আলোয় ঝিকমিক করছে।
রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট কাফে – সাদা রঙের কাঠের চেয়ার আর টেবিল পেতে রেখেছে বাইরে, যার উপর রোদ্দুর আর পাতার ছায়া একসাথে খেলা করছে। সেখানে বসতেই গেল তারা। এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা, চোখে রিমলেস চশমা আর গায়ে কোট, হাসিমুখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“Buongiorno! What would you like to have?”
আরিশ মেন্যুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“Two cappuccinos, two croissants with chocolate filling. That’s it for now.”
“Grazie! I’ll be right back.”
ভদ্রমহিলা চলে যেতেই অরা আস্তে করে বলল,
“ বুনাগিরিটিরি, না জানি কী বললেন উনি! ওটার অর্থ কী?”
অরার কথায় জোরে হেসে উঠল আরিশ। ভ্রু কুঁচকে ফেলল অরা। জানে না বলেই জিজ্ঞেস করলো, তাতে হাসার কী হয়েছে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ স্থানীয় ভাষায় ‘শুভ সকাল’ বলেছেন। “
“ ওহ আচ্ছা। আপনি ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলতে পারেন? “
“ একটু-আধটু। তবে পুরোপুরি না। কাজকর্মের সূত্রে ইতালিতে আসতে হয়, সেখান থেকেই একটু-আধটু শিখেছি। কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো। “
“ উমমম… বুঝলাম। “
আরিশ অরার কানের পাশে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
“ উমমম… এমন করছো কেন? এরকম তো কিস করলে করে। তুমি কি কিস করতে চাচ্ছো, হামিংবার্ড? “
ভড়কাল অরা। বিষম খেলো। আরিশ পানির বোতল থেকে পানি পান করতে দিলো অরাকে। ধীরেসুস্থে পানি পান করে ধাতস্থ হয়ে বসলো সে।
“ কী এমন বললাম যে, বিষম খেলে? “
“ আপনি বড্ড দুষ্ট। “
“ কিছু করার নেই। আমি এমনই ডার্লিং। “
আরিশের কথায় অরার মুখটা একটু লাল হয়ে উঠল। সে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, হালকা হাওয়ায় তার খোলা চুল উড়ছে।
ক্যাফের গুনগুন সুর, দূরের গির্জার ঘণ্টাধ্বনি আর পাহাড় থেকে নামা শীতল হাওয়া—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত শান্তির অনুভূতি তৈরি হচ্ছিল তাদের মাঝে। এরমধ্যে ভদ্রমহিলা খাবারগুলো দিয়ে গিয়েছেন। আরিশ কাপচিনোর কাপটা হাতে তুলে বলল,
“ ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যাই। শুধু তুমি আর আমি, সাথে পাহাড়ি নীরব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। “
“ তাহলে আমাকে ইচ্ছে মতো জ্বালাতন করতে পারতেন আরকি!”
অরা মৃদু হেসে কিছুটা নিচুস্তরে বলল কথাগুলো।
আরিশ হেসে তাকাল তার দিকে। কিন্তু সেই হাসি স্থায়ী হলোনা বেশিক্ষণ। আচমকাই অরার উরুতে শক্ত করে হাত রাখল আরিশ। কিছুটা ঘাবড়ে গেলো অরা।
“ আমি না জ্বালালে আর কে জ্বালাবে তোমায়?”
“ আবার! আপানকে ডাক্তার দেখিয়ে কী লাভ হয়েছে, শুনি? “
বিস্মিত হলো আরিশ। সত্যি তো! এমন আচরণ তো করার কথা নয় তার। হাত সরিয়ে ফেলল আরিশ ।
“ ডাক্তারের যা করার ছিলো করেছে। তোমার যদি মনে হয় আমি আর পাঁচটা ছেলের মতো শান্ত, ভদ্র টাইপ হয়ে গেছি তাহলে বলব– তুমি ভুল। ডাক্তার আমার মানসিক অস্থিরতা দূর করেছেন, আমার স্বভাব বদলাতে পারেননি। “
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরা। আরিশ সঠিক বলেছে।
“ হ্যাঁ ঠিক বলেছেন। খাওয়াদাওয়া শেষ করুন জলদি। নয়তো খেতে খেতেই সময় গড়িয়ে যাবে, ঘুরবো কখন?”
“ তুমিও খাও। “
“ খাচ্ছি তো। “
খাবার খেতে খেতে পাশের টেবিলে বসা এক বৃদ্ধ দম্পতির হাসির শব্দ তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
বৃদ্ধা হাতে এক কাপ কফি নিয়ে হাসতে হাসতে কিছু বলছিলেন, আর বৃদ্ধ তার হাত ধরে ছিলেন, তাদের চোখে ছিল বহু বছরের ভালোবাসা।
অরা চুপচাপ সে দৃশ্য দেখছিল। আরিশ জিজ্ঞেস করল,
“কী ভাবছো?”
“ভাবছি… উনাদের মতো বয়স হলে কেমন হবে? পঁচিশ বছর পরেও আমরা এমন করে একে অন্যকে ভালোবাসতে পারবো তো!.”
আরিশ মুচকি হেসে বলল,
“ তেজরিন খান আরিশের নিঃশ্বাস যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ এই ভালোবাসা চলতে থাকবে। তাই পঁচিশ কিংবা পঞ্চাশ এটা বলা যাচ্ছে না। বুঝলে? ”
অরা কোনো কথা বলল না। শুধু হাত বাড়িয়ে আরিশের হাতে হাত রাখল। ঠোঁটের কোণে তার মুচকি হাসির রেখা।
সকালের নাস্তা শেষে তারা দু’জন বেরিয়ে পড়লো টাসকানির বিভিন্ন জায়গা দেখতে। গাড়ি চালক মারিও ছিলো সাথে। প্রথমেই তারা গেলো Castello Vecchio বা পুরনো দূর্গে। সেখানকার পাথরের আঁকাবাঁকা গলি, ভাঙা প্রাচীর, আর ঘন নীরবতায় মোড়া শহরটা যেন নিঃশব্দে বলছিল শতাব্দী পেরোনো গল্প।
দেয়ালের ফাটলে গজিয়ে ওঠা লতাগুল্ম, কাঠের জানালায় মরচে ধরা বন্ধ শাটার, আর দূরে চোখে পড়া রঙিন ছাদের সারি সবকিছুই ছিল ছবির মতো নিখুঁত, অথচ ধুলোমাখা।
দূর্গের ওপর উঠে তারা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল – নিচের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে। নিচে সূর্যরঙা মাঠ, দূরে পাহাড়ের রেখা, আর মাথার ওপর থেমে থাকা আকাশ।
পুরনো দুর্গ শহর থেকে বেরিয়ে তারা চলে গেলো বাগনো ভিগনোনির ছোট্ট গ্রামে। সেখানে প্রাচীন গরম ঝর্ণার চারপাশে জল জমে ছোট ছোট পুকুর তৈরি, যেগুলোকে ঘিরে বেড়িয়েছে পাথরের বেঞ্চ আর কাঠের সেতু।
তারা ধীরে ধীরে পুকুরের ধারে হাঁটছিল , গরম জল থেকে উঠে আসা ধোঁয়ার মধ্যে মিশে থাকা সেই নরম আর্দ্রতা অনুভব করছিলো। কিছুক্ষণ বসে ছিল ঝর্ণার পাশের পাথরে, তারপর ফিরে আসলো, মনে রেখে এক নরম স্মৃতি
সূর্য তখন টালমাটাল করে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। হালকা সোনালি আলো বালডিচিয়ার গমক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ে সোনার চাদরের মতো ঢেকে রেখেছে গোটা উপত্যকা। সাইপ্রাস গাছগুলো নিঃশব্দ পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির জানালায় হাওয়ার ঝাপটা এসে অরার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল।
“ আজকের দিনটা কখনো ভুলবো না, রাগী ভূত। আমার জীবনের অন্যতম একটা দিন ছিলো। “
আরিশ মুচকি হাসল। অরা তার হাসির কারণটা ঠিক বুঝতে পারলোনা। হাসিতে দুষ্টমি লুকিয়ে ছিলো। আরিশ খুব আস্তে করে অরার শাড়ি ভেদ করে উন্মুক্ত কোমরে হাত রেখে, তাকে কোলের ওপর বসাল। অরা কিছু বলতেও পারছে না এখন। মারিও গাড়ি চালাচ্ছে। লজ্জায় গাড়ি থেকে লাফ দিতে পারলে শান্তি লাগতো অরার। আরিশ অরার কোমরে দু-হাত রেখে নাকের সাথে নাক ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ তোমার মুখে রাগী ভূত নামটা শুনলেই আমি সিডিউস হয়ে যাই, পাখি। কেমন আদুরে একটা ডাক! “
চোখ বড়ো করে ফেলল অরা। কী একটা অবস্থা, রাগী ভূত বলে ডাকলেও সমস্যা?
“ কীসব বলছেন! এমন নামেও কারো…..”
“ ডু ইউ লাভ মি?”
“ ইয়েস, আই লাভ ইউ। কোনো সন্দেহ আছে?”
“ নো। “
আরিশ অরার ঘাড়ে শক্ত করে হাত রাখল। একহাতে কোমড় আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে ঘাড় চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো সে। প্রথমে অস্বস্তি লাগলেও পরে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো অরা। মারিও এরমধ্যেই একটা রোমান্টিক গান বাজাতে শুরু করেছে। যদিও অরা ইতালিয়ান গানের আগামাথা বোঝেনা, তবে আরিশ তো বুঝতে পারছে। কিছুক্ষণ বাদে অরার ঘাড় ছেড়ে দিলো আরিশ। অরা নিচুস্তরে বলল,
“ মনে হচ্ছিল আরেকটু হলে ঘাড় মটকে দিবেন। “
শব্দ করে হেসে উঠল আরিশ। মারিও মুচকি মুচকি হাসছে।
“ মটকে দিলে, ব্যথা পেতে। “
“ এতো কেয়ার?”
“ কেন, আমি কি তোমার কেয়ার করি না?”
অরার ইচ্ছে করলো বলতে– হ্যাঁ মারাত্মক কেয়ারিং হাসবেন্ড আপনি। এতটাই কেয়ারিং যে শরীরে অজস্র দাগে ভরপুর হয়ে আছে, এতটাই কেয়ারিং যে ঠাস করে থাপ্পড় মারতেও সময় লাগে না।
কিন্তু অরা এসব কিছু বলল না। মুচকি হাসল কেবল।
“ কী হলো, বলো? ‘
“ হ্যাঁ অনেক কেয়ার করেন। “
খুশিতে গদগদ হয়ে বউয়ের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো সে। কোল থেকে নামিয়ে সিটে বসিয়ে নিজের, বুকে মাথা ঠেকিয়ে রাখল অরার।
“ বাসায় গিয়ে এ বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করবো। “
“ কোন বিষয়? “
“ আরো কেয়ার করার বিষয়, যাতে ভবিষ্যতে তুমি গর্ব করে বলতে পারো– তোমার হাসবেন্ড বেস্ট, কেয়ারি হাসবেন্ড। “
“ আচ্ছা। “
ঠোঁটের কোণের হাসি আরো প্রসস্থ হলো আরিশের। অরা চুপ করে রইলো। ক্লান্ত লাগছে শরীর। সারাদিন অনেক দৌড়ঝাঁপ গেছে। এখন এই পাগলের তালে তাল না মেলালে সমস্যা হতে পারে ভেবেই অরার এই নীরবতা।
“ চাচি! আপনি আসলেন কেন? আমাকে ডাক দিতেন, কিছু দরকার হলে দিয়ে আসতাম রুমে। “
দুপুরের রান্নাবান্না শেষ করে সবে হাতমুখ ধুয়ে দাঁড়াল তামান্না। এরমধ্যেই রান্নাঘরে তাসলিমা খাতুন এলেন। সাবিহার সাথে কথা বলেছিলেন তিনি৷ সবকিছু শুনে তালহার সাথে তামান্নার বিয়েটা মানার জন্য খুব করে বলল সে। সাবিহার জোড়াজুড়ি আর তালহার খুশির কথা ভেবে হলেও তাসলিমার মন গলেছে অবশেষে।
“ কিছু লাগবে না। এদিকে এসো, মেয়ে। “
তামান্না ধীরপায়ে তাসলিমার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এরমধ্যে কলিংবেলের শব্দ ভেসে এলো। তালহা ফিরেছে। দুপুরবেলা সে ছাড়া আর কেউ আসার কথা নয়। তামান্না তাসলিমার দিকে তাকিয়ে আছে, আগে দরজা খুলে দিয়ে আসবে কি-না সেজন্য।
“ যাও দরজা খুলে দিয়ে আসো। তারপর কথা শুনে যেও৷ “
“ ঠিক আছে, চাচি। “
তামান্না রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে একদৌড়ে ড্রইং রুমে উপস্থিত হলো। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ফেলল। দরজা খুলতেই তালহার হাতে কতগুলো বেলি ফুলের মালা দেখতে পেলো সে।
“ এই যে মিস তামান্না ভাটিয়া, এতো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন কেন? “
তালহা হাসিহাসি মুখে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো। তামান্না দরজা আঁটকে দিয়ে কণ্ঠ নিচু করে বলল,
“ চাচি এসেছেন রান্নাঘরে, আমার সাথে কথা বলতে। আপনি ঘরে যান এখন৷ এসব পরে দিবেন। “
“ মা এসেছেন, কথা বলতে! “
“ হ্যাঁ। “
“ ওকে, যাও৷ দেখো কী বলে। দেখো, আবার হবু শ্বাশুড়ির সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে বসো না৷ “
কিছুটা মজা করেই বলল তালহা। তামান্না ভেংচি কেটে রান্নাঘরের দিকে এগোল।
তাসলিমা খাতুন আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। তামান্নাকে দেখে সামনে এগিয়ে এলেন কিছুটা।
“ জি, বলুন। “
“ আরিশ দেশে ফিরলে তোমাদের বিয়ের বিষয় কথা বলবো। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? মানে এতো জলদি বিয়েতে কোনো সমস্যা? “
তামান্না যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। অস্ফুটে স্বরে শুধালো,
“ কী? “
“ যা শুনেছ সেটাই বলেছি। “
লজ্জায় কিছুটা মাথা নিচু করে ফেলল সে। বলল,
“ আপনারা যা বলবেন তাই হবে। আমার কোনো আপত্তি নেই, চাচি।”
“ বেশ। তাহলে লজ্জা পাওয়া বাদ দাও। গোসল সেরে আসছি, এখন থেকেই শ্বাশুড়িকে যত্ন করা শুরু করো। “
তাসলিমা খাতুন কথাগুলো বলেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তামান্না হাসবে না-কি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। এমন শ্বাশুড়ি পাওয়া সৌভাগ্যের না-কি দূর্ভাগের বলা মুশকিল ।
তাসলিমা খাতুন চলে যেতেই তালহা এসে ঢুকল রান্নাঘরে। তামান্না তখনও ভাবনার জগতে বিভোর ছিলো বলে তালহার আগমন টের পায়নি।
“ এই তামু, মা কী বললেন? “
“ বিয়ের কথা বললেন। ভাইয়া ফিরলে আপনার আর আমার বিয়ের কথা বলবেন, চাচি। “
“ কী?”
“ হ্যাঁ, যা শুনেছেন সেটাই। ‘
তালহা খুশিতে তামান্নাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরতে লাগলো। তামান্নার মাথা ঘুরছে।
“ মারহাবা! মা এভাবে রাজি হয়ে গেছে, ভাবতেই আনন্দ লাগছে। “
“ উঁহু আমার মাথা ঘুরছে। নামান, বলছি। “
“ আরে কিছু হবে না। “
“ তালহা ভাই! “
থেমে গেলো তালহা। তামান্নাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। ঠোঁট টিপে হাসছে তামান্না। তালহা গাল ফুলিয়ে বলল,
“ ভাই বললে কেন?”
“ থামানোর নিনজা টেকনিক!”
“ তবে রে এএ…..”
তালহা তামান্নাকে ধরতে চাইলো, কিন্তু তামান্না দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো । দু’জনেই মহাখুশি আজ। অবশেষে তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে চলেছে।
নয়নার মন এখন একটা নীরব সীমানার ভেতরে বন্দী। প্রতিদিন সকালে ইউনিফর্ম পরে আয়নায় নিজেকে দেখে, কিন্তু সেই চেনা মুখের ভেতরেও যেন কিছু হারিয়ে গেছে। স্কুলে যেতে যেতে প্রতিটি মোড়, প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি ক্লাসরুম – সবখানে পলাশের উপস্থিতি খুঁজে বেড়ায় সে।
ক্লাসে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। মনে পড়ে, ঠিক এই বেঞ্চেই একদিন পলাশ পাশের ক্লাস থেকে এসে বসেছিল একটু সময়ের জন্য। বারান্দায় দাঁড়ালেই মনে পড়ে, সেখানে দাঁড়িয়ে পলাশ একবার মুচকি হেসে বলেছিল,
“আজ খুব সুন্দর লাগছো।”
নয়না কিছু বলেনি সেদিন, শুধু হেসেছিল নরম করে।
এখন সেই শব্দহীন ভালোবাসা প্রতিদিন তাকে ভেতর থেকে একটু একটু করে খেয়ে ফেলছে। পলাশ চলে যাওয়ার পর, স্কুলের প্রতিটা দিন যেন শুধুই সময় গুনে যাওয়া। বন্ধুদের হাসির মধ্যে, পড়ার চাপে, টিফিনের ভিড়েও, নয়না একা হয়ে গেছে । ক্লাসরুমের জানালায় বসে আকাশ দেখে সে, ভাবে–
এই আকাশের নিচেই তো পলাশ আছে, কোথাও না কোথাও। আর দুই বছর পর সেই আকাশের তলায় আবার দেখা হবে।
কিন্তু ততদিন… প্রতিটি দিন যেন দীর্ঘশ্বাসে লেখা চিঠি হয়ে জমা হয় নয়নার মনের ডায়েরিতে। কথার অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলো তাকে নীরব করে দেয়, আর সেই নীরবতাই এখন তার সবচেয়ে বড় সঙ্গী।
“ কী রে নয়না? আজকাল এতো অন্যমনস্ক হয়ে থাকিস কেন?”
হাসিবের প্রশ্নে নড়েচড়ে বসে নয়না। সাথে যোগ দেয় উর্মি।
“ হ্যাঁ, রে! ইদানীং নয়না কেমন চুপচাপ হয়ে গেছিস। কী হয়েছে রে তোর?”
“ কই! আমার তো কিছু হয়নি। “
“ ইশ! বললেও হলো। “
উর্মি বলল। ইলমা পাশ থেকে বলে,
“ নয়না মনে হয় পলাশ ভাইকে মিস করে। “
চমকাল নয়না। যদিও পলাশ যে নয়নাকে পছন্দ করে এটা গোটা ক্লাসের সবাই জানে। কিন্তু ওদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, তবুও এমন মজা কেন করবে ইলমা?
“ এসব কী বলছিস ইলমা? আমি কেন উনাকে মিস করবো? “
কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল নয়না। সবাই চুপ করে গেলো। বিশেষ করে ইলমা। নয়নার মন মানসিকতা খারাপ না থাকলে সে কখনোই বন্ধুদের সাথে এমন আচরণ করে না।
“ আচ্ছা সরি, মজা করেছি। চল চল টিফিনের টাইম হয়ে গেছে। আজ সবাই একসাথে ঝালমুড়ি খাবো। “
ইলমা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল বাকিরাও উঠে দাঁড়িয়েছে, নয়না এখনো বসে। উর্মি নয়নার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল,
“ চল না, নয়না। একসাথে খাবো…..”
মুচকি হাসল নয়না। সাথে সাথে সবার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। চারজন একসাথে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে এগোল। মাঠের উত্তর দিকের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ঝালমুড়ি মামা বসেন প্রতিদিন।
“ ইউ আর লুকিং সো হট, হামিংবার্ড।”
আরিশের এমন মন্তব্যে নিজের দিকে একবার দেখে নিলো অরা। হট লাগার মতো কিছু দেখতে পেলো না সে। তার পরনে ছিল হালকা অফ-হোয়াইট লিনেন ম্যাক্সি ড্রেস, কোমরের কাছে একচেটিয়া বেল্ট দিয়ে বাঁধা। ভেতরে ধুসর রঙা ট্যাংক টপ আর হালকা গলার অলঙ্কার। চুলগুলো একপাশে নামিয়ে রেখেছে, একটু ভেজা এখনো। গোসল করে মাত্রই বের হয়েছে সে।
আয়নার সামনে থেকে উঠে গিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো অরা।
“ আপনার নজর ঠিক করুন। “
আরিশ সোজা হয়ে বসে আছে, দৃষ্টি তার অরার দিকে । তার পরনে কালো টিশার্ট, যার গলা একটু খোলা, আর হালকা বাদামি কর্ড প্যান্ট।
“ আমার নজর যথেষ্ট ঠিক আছে বলেই এখনও বলিনি, ট্যাংক টপ-এর নিচে যা দেখা যাচ্ছে, ওটা জানিয়ে দিচ্ছে তুমি কতটা ভয়ংকর সুন্দর।”
চমকাল অরা। লোকটা এতো পাজি কেন? কিছুটা লজ্জা পেলো অরা।
“ বলতে আর বাকি রেখেছেন কী?”
“ ওপস! সরি, হামিংবার্ড। কী করবো, বলো? চোখ থাকলে দেখা যাবে, স্বাভাবিক। “
আরিশ অরাকে জড়িয়ে ধরে, থুতনিতে চুমু খেলো। অরা আরিশের কোলে মাথা রাখলো।
“ এসব রাখুন, দেশে ফিরবো কবে? “
“ কবে যেতে চাও?”
“ আগামীকাল? “
“ শিওর?”
“ হুম। সবাইকে মিস করছি। “
হামিংবার্ড পর্ব ৫০
আরিশ অরার ঠোঁটে মৃদু কামড় বসাল। বিস্ময়ে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলো অরা। এই লোক কি ভ্যাম্পায়ারের বংশধর? এভাবে হুটহাট কামড় বসায় কেন সে?
“ ওকে। আগামীকাল সকালে ফ্লাইট। হ্যাপি?”
অরার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। জড়িয়ে ধরল আরিশকে।
“ হ্যাঁ। “