হামিংবার্ড পর্ব ৫৪
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
অরার মাথার ওপরে তার হাতদুটো দেয়ালের সাথে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ। ভদ্রলোক মারাত্মক রেগে আছে। চোখমুখ ভীষণ ভয়ংকর দেখাচ্ছে। অরা ঠিক বুঝতে পারছে না কীভাবে আরিশকে শান্ত করবে। হঠাৎ করেই মনের ভেতর একটা ভাবনা এলো তার। পুরুষ মানুষ তার শখের নারীর সংস্পর্শে গেলে আগ্নেয়গিরির মতো উত্তপ্ত মেজাজে থাকলেও শান্ত দীঘির জলের মতো হয়ে যায়। অরা ধীরে ধীরে আরিশের কপালে কপাল ঠেকাল। ফিসফিস করে বলল,
“ শান্ত হও, আরিশ৷ শান্ত হও রাগী ভূত। রাস্তায় চলাচল করতে গেলে লোকজন দেখবেই! এটাই স্বাভাবিক। “
অরার মুখে তুমি সম্বোধন শুনে মেজাজ বদলে গেলো আরিশের। প্রিয়তম স্ত্রী’র এমন মোহনীয় আচরণে একেবারে শান্ত হয়ে গেলো সে।
“ তুমি আমাকে ‘তুমি ‘ বলে সম্বোধন করলে?”
“ হ্যাঁ, করলাম। সমস্যা আছে? “
আরিশ অরার হাতদুটো ছেড়ে দিলো। মুখোমুখি, একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
“ হ্যাঁ, অনেক সমস্যা হচ্ছে পাখি৷ তোমার এতো ভালোবাসায় আমি যেন সুখে মরে যাচ্ছি। কী করবো বুঝতে পারছি না। আমি যদি নাচতে শুরু করি তুমি কি হাসবে?”
বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলল আরিশ। অরা আরিশের ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বলল,
“ সুখে বেঁচে থাকুন, মরার কথা বলবেন না। “
আরিশ আঁড়চোখে নিজের ঠোঁটের দিকে, অরার আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা বুঝতে পেরে ঝটপট আঙুল সরিয়ে ফেলল অরা। আরিশ তার কোমরে হাত রেখে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে নিচু স্বরে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ বলবো না। একটা কথা বলো….”
“ হু…?”
“ তোমার কি কখনো নিজে থেকে আমাকে পেতে ইচ্ছে করে না? “
অরা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো আরিশ। অরা একটু দূরে সরে ওয়ারড্রব থেকে থ্রি-পিস বের করতে করতে বলল,
“ আপনার নাকের ডগায় যতদিন রাগ বসে থাকবে ততদিন এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন না।”
আরিশ নিজের নাকের দিকে চোখ টেরা করে তাকাল। আবছা আবছা কেবল নিজের নাকটা ছাড়া আরকিছুই দেখতে পেলো না। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে অরার ঘাড়ে থুতনি রাখল সে।
“ কই, আমার নাকের ডগায় তো কিচ্ছু নেই! “
“ খবরদার! ভ্যাম্পায়ারের উত্তরসূরী হওয়ার মতোন আচরণ করবেন না। “
থতমত খেয়ে থুতনি সরিয়ে ফেলল আরিশ। অরার কথার আগামাথা কিছুই সে বুঝতে পারেনি।
“ কী বললে এগুলো! “
“ ভ্যাম্পায়ারের নাম শোনেননি? “
“ হ্যাঁ, মুভিতে দেখেছিলাম একবার। তো? তার সাথে আমার….. “
“ তাহলে নিশ্চয়ই মুভিতে এটাও দেখেছেন বদের হাড্ডিগুলো সুযোগ পেলেই মেয়েদের কামড় বসিয়ে দেয়। “
ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল আরিশের। এবার সবকিছু ক্লিয়ার। অরার ঘাড়ের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে, একপাশে রাখল আরিশ। তারপর মৃদু করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো সেখানে। অরা চোখ বন্ধ করে ফেলল আবেশে। কিন্তু বেশিক্ষণ সেই আবেশ স্থায়ী হলোনা। তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হতে লাগলো।
“ যখন তুমি আমাকে ভ্যাম্পায়ারের উত্তরসূরী বললে, তখন যোগ্য উত্তরসূরী হওয়ার চেষ্টা করবো আমি। “
অরা আরিশকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে ফেলল। আজকে সত্যি অনেক ব্যথা পেয়েছে সে।
“ আপনি একটা…. ধুর ভাল্লাগে না। “
অরা দ্রুত পা চালিয়ে জামাকাপড় বদলে নেওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। আরিশ মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে কেবল। বলতে গেলে সেভাবে অরাকে কখনো রাগ করতে দেখেনি । আজকে তাই অরাকে রাগানোর সুযোগটা হাতছাড়া করলো না আরিশ।
গত দু’দিন ধরে খান বাড়িতে শুধু বিয়ের কেনাকাটাই চলছে। চারদিকে ব্যস্ততা, হাসি-আনন্দে মুখর পরিবেশ। তাসলিমা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়েছে সাবিহার – আগামী সপ্তাহেই দেশে ফিরবে সে। আর ঠিক তাতেই চূড়ান্ত হয়েছে তামান্না আর তালহার বিয়ের দিনক্ষণ।
সবাই উৎসবে মেতে উঠলেও নয়নার মনটা যেন কোথায় হারিয়ে থাকে। চারপাশের রঙিন আলো, সেজেগুজে ঘোরাঘুরি, খুশির হইচই – সবই ঠিকঠাক, তবুও তার ভেতরে যেন একটা অদৃশ্য শূন্যতা বসে আছে। কেউ টের পায় না, কিন্তু নয়নার দৃষ্টিতে মাঝে মাঝেই এক রকমের বিষণ্ণতা ভেসে ওঠে।
ব্যাগপত্র গোছগাছ শেষে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়েছে সাবিহা। মনটা আজ দারুণ ফুরফুরে লাগছে তার। কতগুলো মাস পর সবার সাথে দেখা হবে! ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা সাবিহার৷ হঠাৎ মেহরাবের কথা মনে পড়লো। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই তার দেশে ফেরার খবর শুনে আনন্দিত হবে – এসব ভাবতে ভাবতে ফোন হাতে নিয়ে মেহরাবের নম্বরে কল করলো সাবিহা। পরপর দুটো রিং হতেই কল রিসিভ হলো। একনজরে সময় দেখে নিলো সাবিহা। বাংলাদেশে এখন গভীর রাত। নিশ্চত মেহরাবের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে ভেবে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সাবিহা।
“ হু, বলো। “
মেহরাবের এমন কথায় ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছে না সাবিহা। কিয়ৎক্ষণ চুপচাপ রইলো সে, তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ আসলে আমি খেয়াল করিনি…. এখন অনেক রাত… মানে বাংলাদেশে এতো রাত হয়েছে খেয়াল করিনি । “
“ খেয়াল করলে কী আমাকে কল করতে না, সুন্দরী? সো ব্যাড!”
মেহরাব ঘুমের ঘোরে-ই ফোনে কথা বলছে। সেজন্য কথাগুলো কেমন জড়িয়ে যাবার পাশাপাশি অদ্ভুত লাগছে সাবিহার। সচারাচর মেহরাব এমন গলায় কথা বলে না।
“ আপনার ঘুম কাটেনি। এখন রাখছি, পরে কথা হবে। আমি আগামীকাল সকালে ফ্লাইটে ওঠাার প্রস্তুতি নিচ্ছি। দোয়া করবেন। “
“ দোয়া! তুমহারে লিয়ে অল টাইম দোয়া…….. মানে দোয়া করি সাবিহা….”
মে হরাব ভুলভাল বকছে শুনে খিলখিল করে হাসতে লাগলো সাবিহা।
“ ওকে। বায়।”
“ হুহ হু।”
কল কেটে নিজে থেকেই হাসতে লাগলো সাবিহা। কতদিন পর এমন প্রাণখোলা হাসি এলো জীবনে! বাড়ি থেকে দূরে সরে সাবিহা একটা বিষয় বুঝতে পেরেছে, ভালোবাসা মানুষ কাছে থাকুক কিংবা দূরে তারা সব সময় আমাদের হৃদয়ে থাকে। এই যে এতদূর এসে থাকছে সাবিহা তবুও তো মা, ভাইকে প্রতি সেকেন্ড মিস করে যাচ্ছে সে।
অরার আর ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছে না। আরিশ কিছুতেই অরাকে চোখের আড়াল করতে পারবে না। সেজন্য অনলাইনে ক্লাসসহ, বাড়িতে বসে পড়াশোনা করতে যা যা দরকার তাই করতে রাজি আছে আরিশ। এতো ঝামেলা পুহিয়ে পড়ার থেকে ঘরসংসার সামলানোই ভালো বলে ভাবছে অরা। কিন্তু আরিশ বরাবরই খামখেয়ালি, জেদি প্রকৃতির মানুষ। তাই তার ইচ্ছেতে বাড়ি থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে অরা।
“ তোমার কি মনে আছে, ভাইজান কী বলেছিলেন? “
বিছানা গোছানো শেষে স্বামীর সামনে মুখোমুখি বসলেন রোকসানা মল্লিক। সোলাইমান ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছেন।
“ হ্যাঁ, গো। সব মনে আছে। কিন্তু ও বাড়িতে তালহার বিয়ে লাগলো বলে, তারমধ্য তো অরা বাড়ি থেকে থেকে হতে পারবে না। দেখি ভাইজান ঠিক কবে বিয়ের তারিখ ঠিক করেন। “
“ ঠিক আছে। আমি এমনি মনে করিয়ে দিলাম। অনেক রাত হয়ে গেছে, ঘুমাও। “
“ হু…..”
গ্রীষ্মের তাপদাহ শেষে যখন বর্ষা আসে, প্রকৃতির মধ্যে একধরনের প্রশান্তি নেমে আসে। । ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ে ছাদের ওপর, জানালার কাঁচে, মাটির গায়ে- সবখানে। গাছপালার ধুলো ধুয়ে গিয়ে তারা হয়ে ওঠে টাটকা সবুজ। পথঘাটে জমে ওঠে কাদামাটি, কোথাও বা ছোট ছোট জলাধার।
রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময় চটাস চটাস শব্দ তুলে ভিজে পড়ে থাকা পাতাগুলোর ওপর দিয়ে হেঁটে যায় পথচারীরা। গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ,ভিজে মাটির গন্ধ, যেন হৃদয়ের গভীরে গেঁথে বসে।
সন্ধ্যার পর বাতাসটা আরও শীতল হয়ে আসে, বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁয়ে দেয় জানালার পাশে বসে থাকা কোনো ভাবুক মনকে।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে অরা। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। রাত কম হয়নি, দশটা ছুঁইছুঁই । তবে আজকে আরিশের অফিসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ আছে। সেজন্যই দেরি হচ্ছে ফিরতে। আজকে হুট করে অরার শরীরটা কেমন খারাপ লাগছে। আরিশকে জানালে অতিরিক্ত চিন্তা করবে ভেবে কিছু বলেনি। দু’দিন পর তামান্নার সাথে তালহার বিয়ে। কতো কাজকর্ম! নিজের হাতে সব কাজ না করলেও বাড়ির বউ হিসেবে কিছু দায়িত্ব তো থাকেই! তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল অরা। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসলো।
“ ভাবি? আসবো?”
আকস্মিক তামান্নার গলার স্বরে চমকে উঠলো অরা। তবে পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে প্রত্যুত্তরে বলল সে,
“ হ্যাঁ এসো, আপু। “
তামান্না ধীরপায়ে রুমে ঢুকে দাঁড়াল। অরা ইশারায় বসতে বললো।
“ আপনার কি শরীর খারাপ ভাবি? আজকে কেমন দূর্বল লাগছিল আপানাকে। মনে হয় রক্তশূন্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে আপনার। “
অরা এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক্লাস টেন থেকেই এই সমস্যা—অ্যানেমিয়া! খাওয়াদাওয়ার প্রতি কখনোই আগ্রহ ছিল না তার। মায়ের বকুনি খেয়ে জোর করে খেতে হতো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বকুনিও কমেছে, আর অরার খাওয়ার অভ্যাসও রয়ে গেছে আগের মতোই অবহেলায় গড়া।
“ হয়তো। তুমি কিছু বলবে? না-কি এমনি এসেছ?”
তামান্না মুচকি হাসে। বলে,
হামিংবার্ড পর্ব ৫৩
“ ভাবি আমি চাই আমার বিয়েতে আপনি আমাকে বউ সাজিয়ে দিবেন – আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?”
অরা হেসে বলল,
“ কীসের আপত্তি! অবশ্যই সাজিয়ে দেবো। তবে আমি সাজগোজের বিষয় খুব পটু নই। “
“ আপনি যেভাবে পারেন তাতেই চলবে, ভাবি। “
“ বেশ,দেবো। “
“ ঠিক আছে, ভাবি। আমি এখন আসছি। ভাইয়া ফিরলে খাবার গরম করে দেবো। “
“ দরকার নেই, আমি করে নেবো সব। তুমি যাও।”
“ আচ্ছা। “
তামান্না হাসি হাসি মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। অরা বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে, চোখ বন্ধ করে ফেলল। ভীষণ দূর্বল লাগছে তার।