হামিংবার্ড পর্ব ৫৯

হামিংবার্ড পর্ব ৫৯
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

বেডের পাশে হাতে খোঁপা আর চিরুনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তালহা। অরা বসে আছে, আরিশ তার পেছনে বসে বউয়ের চুল, বিনুনি করার চেষ্টায় আছে। তবে বারবার বিনুনি করতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে ভদ্রলোক । ছোটো থেকে মা’কে চুল বাঁধতে দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি আরিশের আর না তো কোনো অন্য মেয়েকে। তার জীবনে নারীসঙ্গ ছিলো না বললেই চলে। তাই এসব চুল বাঁধার বিষয় একেবারেই অপটু সে। তবুও বউয়ের মন ভালো রাখার জন্য একঘন্টা ধরে বিনুনি বাঁধার চেষ্টায় অব্যাহত আছে সে। তালহা পড়েছে মহাবিপদে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার পা ব্যথা করছে এবার।

“ হলো, আপনার ?”
অরার প্রশ্নে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো আরিশ। তালহাও নড়েচড়ে উঠে, ভাইয়ের দিকে তাকাল। আরিশ আমতা আমতা করে বলল,
“ এইতো! আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ে যাবে। “
“ এক কথা তো, একঘন্টা ধরে শুনছি। “
জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নেয় আরিশ। তালহা মিটিমিটি হাসছে।
“ এক… এক ঘন্টা লেগেছে এটাই বলতে চাচ্ছো? কী এমন হয়েছে তাতে, হামিংবার্ড? তুমি একবার শুধু বলো, কী কী ডিজাইনে চুল বাঁধতে চাও তুমি। “
অরা বিষম খেলো আরিশের কথায়। যে মানু্ষটা একঘন্টা ধরে বিনুনি করতেই পারলোনা সে কি-না ডিজাইনের কথা জিজ্ঞেস করছে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ তালহা, পানি দে। কুইক!”
আরিশ তালহাকে বলা মাত্রই তালহা দ্রুত পানির গ্লাসটা তার দিকে এগিয়ে দিলো।
“ এই নাও। “
তালহার থেকে পানির গ্লাস নিয়ে তাড়াতাড়ি অরাকে দিলো। বেচারি এক নিঃশ্বাসে সবটুকু জল সাবাড় করে কিছুটা স্থির হয়ে বসলো।
“ ঠিক আছো, পাখি?”
“ এখনও পর্যন্ত ঠিক আছি। তবে আপনি দ্বিতীয় বার আর চুলের বিষয় কিছু বলবেন না প্লিজ। “
আরিশের ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসির রেখা ফুটল। তালহা বেচারা ঠোঁট টিপে হাসছে।
“ ঠিক আছে। তোমার যা ইচ্ছে ! বিনুনি অন্তত শেষ করি? “
“ নাহ…. আর বসে থাকতে পারবো না। আমার চুল, আমিই বেঁধে নিচ্ছি। “
অরা আরিশের হাত থেকে নিজের চুলগুলো সরিয়ে নিলো। চোখের পলকের মধ্যে ঝটপট বিনুনি করতে দেখে আরিশের চোখ তো ছানাবড়া।
এরমধ্যে কেবিনের দরজাটা একটু নড়েচড়ে ওঠে, খুলে যায়। সাবিহা ও তামান্না এসেছে। তাদেরকে দেখে অরার ঠোঁটে হাসি ফুটেছে। আরিশ সেই হাসিটুকু আড়চোখে তাকিয়ে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।

“ কেমন আছো, ভাবি?”
সাবিহা এসে অরার পাশের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলো। তামান্না, তালহার পাশে দাঁড়িয়েছে– হাতে খাবারের ব্যাগ।
“ আলহামদুলিল্লাহ আপু। আপনি কেমন আছেন? “
“ তুমি হসপিটালে আছো, আমরা কি ভালো থাকতে পারি? তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে চলো। সবাই তোমাকে মিস করছে। “

সাবিহার আচরণে অরা মুগ্ধ হচ্ছে। মানুষ কতটা বদলাতে পারে সেটা সাবিহাকে না দেখলে বুঝতে পারতো না সে। আরিশের ফোনে কল আসাতে ওদের কথাবার্তার মধ্যেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেছে সে। তালহা, তামান্না ইশারায় নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত। সাবিহার সাথে বেশ কিছুক্ষণ সময় কথা চলতে থাকলো অরার। আগামীকাল হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে দেবে তাকে।
রাত গভীর। চারদিকে শুনশান নীরবতা। বিছানায় বসে আছেন রোকসানা মল্লিক। চোখ দুটো লাল, পানশে। পাশের চেয়ারে বসে আছেন সুলাইমান মল্লিক, পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রাখা, মাথা নিচু।
একটা দীর্ঘ নীরবতা যেন দুজনের মাঝখানে শ্বাস নিচ্ছে।
রোকসানা হঠাৎ নিচু গলায় বলে উঠলেন,

“আমার মেয়ে… মা হতে যাচ্ছিলো… অথচ আমরা কিছুই জানতাম না, কিছুই না… সবকিছু জানার আগেই সে হারিয়ে গেছে। ”
সুলাইমান মাথা তোলে। চোখে কষ্ট জমাট, কিন্তু চোয়ালে শক্ত ভর।
“তকদীরে যা লেখা থাকে তাই হয়। …”
রোকসানার চোখ ছলছল করে উঠে।
“ মেয়েটাকে ছোটবেলা থেকেই জানি। দুঃখ লুকোতে পারে না সে। অথচ এখন দেখো, হাসছে, কথা বলছে, যেন সব ঠিক। কিন্তু আমি জানি, বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে ওর…”
সুলাইমান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।

“ওর দুচোখের শূন্যতা আমি দেখেছি, রোকসানা। আমার মেয়ে বড় হয়ে গেছে। কিন্তু একটা কষ্ট আছে যা বাবা-মা হলেও ভাগ করে নিতে পারি না…”
রোকসানা চুপ করে কাঁদতে শুরু করলেন।
“ আমার বুকের মধ্যে শুধু একটা প্রশ্ন – আমরা কী কিছু করতে পারতাম না?”
সুলাইমান উঠে এসে রোকসানার পাশে বসলেন। ধীরে ধীরে তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন।
“জীবনে কিছু কষ্ট আসে যেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা থাকে না। কিন্তু একটা জিনিস আমরা পারি– ওর পাশে থাকতে, ওকে জড়িয়ে রাখতে। ও যেন জানে, তার ব্যথা কেবল তার না… আমরাও সেই ব্যথা বহন করছি।”
রোকসানা মুখ তুলে স্বামীর চোখের দিকে তাকালেন।

“আমাদের মেয়েটা ভেঙে পড়ুক, সেটা আমি চাই না। সে আবার দাঁড়াবে। আমরা তাকে সেই শক্তিটুকু দেবো।”
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস দুজনেই একসাথে ছাড়লেন। রোকসানা ধীরে বললেন,
“কাল যখন ওকে বাড়ি নিয়ে যাব, তুমি থাকবে তো?”
সুলাইমান মল্লিক দৃঢ় গলায় বললেন,
“আমি তার বাবা, রোকসানা। যতটুকু ভেঙে পড়েছি, তার চেয়ে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ওর হাত ধরে ফিরব আমরা।”
রোকসানা কান্নাভেজা চোখে দোয়া করেছ
জানালার বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠছে – হালকা, ম্লান।
হাসপাতালের করিডোর জুড়ে সকালের আলো। জানালা দিয়ে ফুটে আসা নরম রোদের আভায় চারপাশে একটা শান্ত, নীরব পরিবেশ।

অরা ধীরে ধীরে হাঁটছে। তার পাশে আরিশ। ডান হাতে ছোট একটা ব্যাগ, বাম হাত দিয়ে অরাকে আগলে রেখেছে সে। একটু পেছনে রোকসানা আর সুলাইমান। সুলাইমানের হাতে ছাতা, রোকসানার চোখে চশমা। আরেকপাশে নয়না, হাতে ওষুধের ব্যাগ। কেউ খুব বেশি কথা বলছে না।
ডিসচার্জের প্রক্রিয়া আগেই শেষ হয়েছে। কেবিন থেকে বেরিয়ে সোজা লিফটের দিকে হাঁটছে ওরা।
আরিশ একবার নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে,
“কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে?”
অরা মাথা নাড়ে। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে একটা শান্ত অভিব্যক্তি।
“না।”
আরিশ কিছু বলল না আর। শুধু অরার হাতটা শক্ত করে ধরলো আরো।
লিফটের দরজা খুললে প্রথমেই সুলাইমান মল্লিক এগিয়ে এসে দাঁড়ান। ভেতরে ঢুকে অরার কাঁধে আলতোভাবে হাত রাখেন তিনি।

“চল মা। এবার তোর নিজের ঘরে ফিরবি।”
অরা তাকায় বাবার দিকে। বাবার চোখে জল নেই, কিন্তু সেই চিরচেনা নির্ভরতার ছাপ।
লিফট নিচে নামে। বাইরে এসে গাড়িতে ওঠে সবাই। খান পরিবারের কালো রঙের প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। ড্রাইভিং সিটে জলিল বসে, ইতোমধ্যে গিয়ার গুছিয়ে নিয়েছে।
আরিশ আর তালহা অরাকে মাঝখানে বসতে সাহায্য করে। ডানপাশে মা রোকসানা, বাঁপাশে আরিশ নিজে। নয়না সামনের সিটে, আর সুলাইমান বসেন ড্রাইভারের পেছনে।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। হাসপাতাল পেছনে পড়ে যায় ধীরে ধীরে। অরার চোখে হালকা পানি জমেছে, দৃষ্টি তার জানালার বাইরে। শুধু বাইরের দৃশ্য না, সে তাকিয়ে আছে জীবনের ভেতরের এক বিশাল ফাঁকা জায়গার দিকে – যেখানে কেউ এসেছিলো, থেকে যায়নি।
আরিশ খুব ধীরে অরার হাত ধরলো।

“পাখি…”
অরা মুখ ফেরায় না। চুপচাপ বলে,
“আমার বুকের এক কোণ আজীবনের জন্য খালি হয়ে গেলো।”
আরিশের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার নিজের সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই হারিয়ে গেছে। তা-ও তারই রাগের কারণে। এসব ভাবনা মাথায় আসে, রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না তার। চোখ বন্ধ করলেই একটা বাচ্চার অস্পষ্ট মুখ ভাসে।
“তুমি আবার পূর্ণ হবে। আমি আছি। আমরা একসাথেই এগোবো, হামিংবার্ড।”
অরা এবার চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিঃশব্দে অশ্রু ঝরে পড়ে। তার গালে পড়ে থাকা চুলের একপ্রান্ত, বাতাসে দুলে উঠছে। আরিশ অরাকে আগলে বসে আছে, বুকে মাথ ঠেকিয়ে।

গাড়ি খান বাড়ির দিকে এগিয়ে চলছে। রাস্তায় অনেক জ্যাম। থেমে থেমে চলছে গাড়ি। কিছুদূর যেতেই সিগনাল পড়লো, থেমে গেলো সব গাড়িগুলো। অরা চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। আরিশ একমুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। মুহুর্তের মধ্যে মাথায় রক্ত চড়ে বসল তার। এরমধ্যে অরাও জানালার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে। একটা ছেলে মোটরসাইকেলে বসে অরার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট দিয়ে সিটি বাজাচ্ছে। আরিশ যে ওই ছেলের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এটা নয়না দেখতেই আঁতকে উঠল। আসন্ন ঘটনা কী হতে পারে ভালো করেই আন্দাজ করতে পারছে সবাই।

আরিশ বিদ্যুৎ এর বেগে গাড়ি থেকে নেমেই ছেলেটার কলার চেপে ধরল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“তোর সাহস তো কম না, রে! আমার বউয়ের দিকে সিটি বাজাস! কিপ ইয়োর ফাকিং আইজ টু ইয়োরসেলফ! নইলে আজ তোর বাইকসহ রাস্তায় পুঁতে ফেলবো আমি!”
আরিশের চোখ লাল হয়ে উঠেছে, নিঃশ্বাস বেড়ে গেছে। ছেলেটা প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি, তারপর চিৎকারে লোকজন জড়ো হতে শুরু করল। চারপাশে ভিড় বাড়ছে। গাড়ির ভেতর অরা অস্থির হয়ে উঠল।
“ নয়না! বাবা, দেখো কী করছেন উনি! তালহা ভাই! “
অরার কথায় সবাই যেনো হুঁশে এলো। রোকসানা আর সুলাইমান একসাথে বলল,
“আরিশ! প্লিজ, ফিরে আসো!”

তালহা দ্রুত ড্রাইভারের পাশের দরজা খুলে নেমে গেল। গিয়ে আরিশের হাত ধরে টান দিল,
“ভাইয়া! রাগ করে সবসময় এইরকম করে বসো কেন! ভাবি ভালো নেই, এই অবস্থায় এসব ঠিক না!”
ছেলেটা এবার কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“ভাই, আমি জানতাম না উনি আপনার বউ… আমি তো মজা করছিলাম… ভাই প্লিজ!”
আরিশ গর্জে উঠল,
“মজা করছিলি? আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মজা করছিস? আজ তোর ওই ঠোঁট চেপে ধরি, না তারচে ভয়ংকর কিছু করি!”

তালহা তখন অনেক কষ্টে আরিশকে ধরে গাড়ির দিকে ঠেলে নেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ আঁটকে রাখা ওর পক্ষে সম্ভব না। অবস্থা খারাপ বুঝে নয়না গিয়ে বাইকের ছেলেটাকে চোখ রাঙিয়ে বলে,
“চলে যান এখান থেকে, আর কোনো মেয়ের দিকে সিটি বাজাতে সাহস করবেন না!”
ছেলেটা বাইকে উঠে দৌড়ে পালিয়ে যায়। চারপাশের লোকজন তখনও ফিসফাস করছে।
ছেলেটা চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পর কিছুটা শান্ত হয় আরিশ, গাড়িতে উঠে চুপচাপ বসে। অরার দিকে একবারও তাকায় না। তার চোখে তখনো আগুন। অরা ধীরে বলে,

“তুমি ঠিক করনি।”
আরিশ কাঁপা গলায় বলে,
“সে তোমাকে অপমান করেছে, টিজ করেছে পাখি… আমি কীভাবে সহ্য করতাম?”
“কিন্তু আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, হাঁটতেও পারিনি ঠিক করে। এখন একটু সুস্থ হয়ে বাড়ি যাচ্ছি… এভাবে আবার আপনি কারো গায়ে হাত তুললে, আমি কীভাবে স্বাভাবিক থাকবো বলুন?”
আরিশ এবার তার দিকে তাকায়। চোখে হতাশা, অনুশোচনা, কিন্তু রাগ নয়।

হামিংবার্ড পর্ব ৫৮

“আমি ঠিক করবো নিজেকে। শুধু তুমি পাশে থেকো…”
অরা চোখ সরিয়ে নেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জ্যাম কেটে গেলে গাড়ি আবার ধীরে ধীরে চলতে থাকে।
চুপচাপ… নিঃশব্দে… একটা সম্পর্ক তার ভারসাম্য খুঁজছে –ভালোবাসা আর সহনশীলতার মাঝপথে।

হামিংবার্ড পর্ব ৬০