হামিংবার্ড পর্ব ৬২
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
অরা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই দৌড়ে চলে গেল বসার ঘরের দিকে। বেগুনি রঙের শাড়ির আঁচল দুলে উঠলো পেছনে, খোলা চুল উড়ল মুখের দুই পাশে। পা দুটো যেন মাটিতে টেকেই না, একরকম ভেসে ভেসে চলে গেল সে ড্রইং রুমে। চকলেট তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার।
ড্রইং রুমে পৌঁছাতেই চোখ ছানাবড়া করে থমকে দাঁড়াল অরা। ঘরের মাঝখানে তিনজন ডেলিভারি বয়, একটার পর একটা চকোলেটের বক্স নামাচ্ছে। সোফার একপাশে, টেবিলের ওপর, এমনকি নিচে পর্যন্ত জায়গা নেই প্রায়। বক্সের গায়ে রঙিন ফিতা বাঁধা, কোনোটা গোলাপি, কোনোটা নীল। কোথাও লেখা – For Hummingbird.
অরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। একটা চকলেট চেয়েছিল সে শুধু। আরিশ জানে, অরা হাজারটা কখনোই চাইবে না, বললেও হয়তো খাবে না। তাই বলেনি কিছু, সারপ্রাইজ দিয়েছে। কিন্তু অরার একটুকু চাওয়া যেন আরিশের কাছে ছিল একটা মহাকাব্য।
আরিশ ঠিক এমনই—অরার চাওয়া কখনও ছোটো হয়ে যায় না তার কাছে। সে জানে, বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর থেকে অরা যতই মুখে রাগারাগি করুক হয়ে, তার ভেতরে একটা কোমল পাখি বসে থাকে। সেই পাখিটার জন্য একটুখানি আনন্দ মানে আরিশের কাছে শতগুণ বেশি আনন্দ দেওয়া।
অরা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল টেবিলের কাছে। একটা বক্স তুলে নিল হাতে। খুলে দেখল ভেতরে হ্যান্ডমেড চকলেট, তার প্রিয় কফি ফ্লেভারের গন্ধ উঠে এল। হঠাৎ খেয়াল হলো অরার, আরিশ তাকে ডেলিভারি বয়দের কাছাকাছি যেতে মানা করেছিল। অরা ধীরপায়ে হাতের চকলেট বক্সটা রেখে সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকেই সবকিছু দেখছে। এরমধ্যে আরিশ বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। অরাকে ওভাবে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে দেখে মুচকি হাসল। যাক আগের অরাকে খুঁজে পাচ্ছে সে। পেছন থেকে হেঁটে এসে আরিশ বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” চলো, চকলেট দেখবে। ”
অরা মুচকি হাসল। আরিশ তার হাত ধরে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। যে মানুষটার মনে অরার জন্য এতটা ভালোবাসা তার একটু-আধটু পাগলামি সহ্য করা যায় বলেই আজ অরা বাধ্য মেয়ের মতো সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলো।
আরিশ অরাকে নিয়ে এগিয়ে এসে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিল পুরো ঘরে ছড়িয়ে থাকা চকলেটের বক্সগুলোর দিকে। তারপর ঠোঁটে একটা প্রশান্ত হাসি নিয়ে ডেলিভারি বয়দের দিকে তাকিয়ে বলল,
“টেবিলের ওপর রাখুন, আর যেগুলো জায়গা পাচ্ছেন না সেগুলো সোফার সামনে মেঝেতে সাজিয়ে দিন। সাবধানে… এগুলো কিন্তু আমার স্ত্রীর জন্য।”
একটু থেমে আবার বলল,
“আরেকটা কথা—একটা বক্সও যেন উল্টে না পড়ে। ”
ডেলিভারি বয়েরা হেসে ফেলল,
“ঠিক আছে স্যার!”
আর অরা তখন দাঁড়িয়ে—চোখে অবিশ্বাস, মনে একরাশ ধরা না পড়া ভালোবাসা।
“এখনও বুঝলে না, আমি কেমন বর?”
অরা চোখ নামিয়ে হেসে ফেলল।
“আপনি বর না, আপনি একটা পাগল।”
“তোমার পাগল, এইটুকু মনে রাখলেই হবে।”
অরা কিছু বলল না। শুধু গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আরিশের গায়ের সঙ্গে হেলান দিয়ে। চকোলেটের ঘ্রাণে মিশে থাকল ভালোবাসার অদৃশ্য সুবাস।
আরিশ অরার মুখে একটুকরো চকলেট তুলে দিলো। অরা ইশারায় বোঝালো, ঘরে গিয়ে খাবে। আরিশ কথা শুনলো না। অরার গালে চকলেট লাগিয়ে দিলো। ঠোঁটে দিতে গেলেই অরা খপ করে চকলেটটুকু খেয়ে ফেলল। এরমধ্যে ডেলিভারি ম্যানরা চলে গেছে। পুরো ড্রইং রুমে শুধু অরা, আরিশ আর চকলেট!
” ঠোঁটে, গালে চকলেট লেগে গেছে। মুছে দিন….”
অরার কথার মানে বুঝতে পারলোনা আরিশ। কারণ অরা নিজেই তো মুছে নিতে পারতো, আরিশকে বলল কেন? অরা মিটিমিটি হাসছে। আরিশের ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটল।
” বড্ড দুষ্ট হয়ে গেছো, হামিংবার্ড। বাট আমার থেকে বেশি না!”
অরা কিছু না বলেই ধীরে মুখটা এগিয়ে দিলো আরিশের দিকে। তার ঠোঁটে লেগে থাকা হালকা চকলেটের ছোপ চোখে পড়তেই আরিশ নিঃশব্দে সামান্য ঝুঁকে এলো। আরিশ ধীরে, খুবই ধীরে, তার মুখ নামিয়ে আনলো অরার ঠোঁটের কাছে। কোনো শব্দ হয়নি, কেবল নিঃশ্বাসে হালকা কাঁপুনি ছিল। সে এমনভাবে সেই মিষ্টি চিহ্নটুকু সরিয়ে দিলো, যেন তার স্পর্শের বদলে অনুভবটাই বলছিল সব কথা। ঠোঁট ছুঁয়ে যায়নি পুরোটাই, কিন্তু অরার হৃদয়টা ধুকধুক করে উঠলো, তাকে ছুঁয়ে যাওয়া এই মুহূর্তের গোপন ইশারায়। অরার গালটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো, কিন্তু সে চোখ সরালো না। ভালোবাসা কখনও কখনও শব্দের চেয়ে স্পর্শহীন ইঙ্গিতেই বেশি বলে ফেলে সব।
কিয়ৎক্ষণ বাদে অরা ইশারায় বোঝালো– ‘গালেও চকলেট লেগে আছে, একইভাবে সেগুলোও…. ’
আরিশ তার কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” তুমি হয়তো ভুলে গেছো, ছোট্ট পাখি– তোমার বর কতটা রোমান্টিক। এসব বিষয় আমাকে কিছু বলার দরকার পড়বে না তোমার। ”
” মোটেও না, জনাব খান। ”
অরার দুষ্টমিগুলো ভীষণ উপভোগ করছে আরিশ।
ডেলিভারি বয়রা চকলেটের বক্স সাজিয়ে বেরিয়ে যেতে না যেতেই ড্রইংরুমের দিকে এল তালহা। ওর হাতে একটা কাপ ছিল, সম্ভবত চা খেতে নিচে নেমেছিল। ঘরে ঢুকে চকলেটের পাহাড় দেখে থমকে গেল সে। আরিশ তখন অরার গালের চকলেটগুলো সরাতেই যাচ্ছিল, আচমকা তালহার আগমনে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো তারা। তালহা অবশ্য কিছু বুঝতে না পারার ভান করে বলল,
“আরে এত চকলেট! এখানে কি বিয়ের গিফট-প্যাকিং হচ্ছে নাকি?”
একটু থেমে গলা চড়িয়ে উঠল তালহা,
“ ভাইয়া, এতগুলো চকলেট কি শুধু ভাবি মায়ের জন্য?
আরিশ হেসে বলল,
” অরা যদি তোমাদেরকেও দেয় তাহলে ভাগ পেতে পারো। ”
অরাও মিটিমিটি হাসছে। আরিশ যে মজাও করতে পারে তা আজ প্রথম দেখলো সে।
পেছন থেকে সাবিহা এল সালোয়ার-কামিজ পরনে, ঘুমঘুম চোখে। তার চোখ চকলেটের দিকে যেতেই কপালে হাত রেখে বলল,
“ওয়াও! বউকে খুশি করতে গিয়ে একেবারে চকোলেট কোম্পানির সাপ্লাই কিনে এনেছো, ভাইয়া!”
তামান্না আসতেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মুখে হালকা ঈর্ষার ছাপ, চোখে মুগ্ধতা। তারপর হেসে বলল,
“এই বাড়িতে বউ হলে চকলেটের খেত জুটবে বুঝি?”
সাবিহা ফিসফিস করে বলল,
“তুমি তো তালহা ভাইয়ার বউ হচ্ছো। ও তো তোমাকে বললেই বলে—‘মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খাও, মোটা হবে।’ চকলেট কি আর দেবে!”
তালহা ভুরু কুঁচকে বলল,
“আরে তুই চুপ কর তো সাবিহা!”
আরিশ তখন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, অরার মুখে আরেক টুকরো চকলেট পুরে দিয়ে, একটু খোশ মেজাজে দাঁত বের করে বলল,
“বুঝলে না তো, অরা আমার হামিংবার্ড। ও একটা চাইলে, আমি হাজারটা দেবো—এইটাই তো প্রেমের ইনভেস্টমেন্ট। ”
সাবিহা হেসে ফেলল,
“এত ইনভেস্ট করে লাভ কী?”
আরিশ কপট গম্ভীর গলায় বলল,
“হুম, লাভ একটাই– অরা আমার দিকে তাকালে, আমি বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাই।”
ঘরজুড়ে হেসে উঠল সবাই। অরা তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে, মুখ নামিয়ে রাখলেও মনে মনে ভাবছে– এই মানুষটা আমাকে যতটা ভালোবাসে, আমি কি সত্যিই তাকে বুঝে উঠেছি?
সবাই যখন চকলেট নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত, তখন চুপচাপ সরে গেল তামান্না। কারও চোখে না পড়েই সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেল সে। চারপাশে নরম বাতাস, আকাশে হালকা মেঘ। তবু তামান্নার বুকের ভেতরটা ভারী লাগছে।
ও চায়নি ঈর্ষা করতে। তবু পারল না নিজেকে সামলাতে।
আরিশ যেভাবে অরার দিকে তাকায়… যেভাবে একটা কথার ভেতরে হাজারটা অনুভব ভরে দেয়—তামান্না মনে মনে জানে, তালহার চোখে সে সেই উন্মাদনা কখনও দেখেনি। তালহা ভালো, স্থির, দায়িত্ববান। কিন্তু এমন পাগলামি তার মধ্যে নেই। টাকাপয়সা, দামী উপহার নয় তবে সব মেয়েই চায় আরিশের মতো একটা পাগলাটে পুরুষ জুটুক তার কপালে। যে পুরুষ বরাবর তার জন্য পাগলামি করবে, আর অনেক ভালোবাসবে।
সিঁড়ির নিচ থেকে তালহার গলা ভেসে এল,
“তামান্না?”
সে চুপ। বাতাসে চুল উড়ে পড়ছে মুখে, তাও সরাল না। তালহা ধীরে ধীরে উঠে এসে ছাদের এক কোণে ওকে দাঁড়িয়ে দেখল। গলায় একরাশ মায়া নিয়ে বলল,
“তুমি এমন চুপচাপ চলে এলে কেন, তামু?”
তামান্না চোখ ফেরাল না। কেবল বলল,
“আমি শুধু দেখছিলাম, কেউ কাউকে কতটা ভালোবাসতে পারে।”
তালহা একটু থমকে গেল। বুঝে ফেলল, তামান্না কী বলতে চাইছে।
“তুমি কি ভেবেছো, আমি তোমার জন্য এমন কিছু করব না?”
তার কণ্ঠে কোনো রাগ নেই, আছে কেবল নরম জিজ্ঞাসা।
তামান্না এবার তাকাল। চোখে একটুখানি জল জমে উঠেছে।
“ বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে মাঝে মধ্যে ফুলের মালা, গাজরা নিয়ে আসতে কিন্তু এখন?”
তালহা এবার একধরনের অনুতাপে ভিজে গেল। ধীরে ধীরে ওর কাছে এগিয়ে এল।
“ সরি, তামান্না ভাটিয়া। ইদানীং কাজের চাপে সব ভুলে যাই। শোনো, সবাই তো একরকম হয় না, বলো? আমি এত পরিশ্রম করছি কার জন্য? আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তো, নাকি? ”
তামান্না ঠোঁট কামড়ে নিচে তাকাল। তালহা হাত বাড়িয়ে ওর হাত ধরল। ফের বলল,
” তারপরও আম সরি। তোমার দিকে বেখেয়ালি হয়ে যাওয়ার কারণে। আজকের পর থেকে আর কখনোই এমন ভুল হবে না, প্রমিস!”
তালহা দু’হাতে নিজের কান ধরে বলল, এবার। তামান্না আর অভিমান পুষে রাখতে পারলোনা, হেসে ফেলল।
” থাক! আর কান ধরতে হবে না। এরপর থেকে যেনো কথাগুলো মনে থাকে। ”
তালহা খুশিতে তামান্নাকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে ধরল। লজ্জায় লজ্জাবতী পাতার মতো নুইয়ে গেলো সে।
“ একশোবার মনে থাকবে। এখন চলো, নিচে যাই। শোনো,তোমাকে চকলেট কিনে দেবো না, চকলেট ফ্যাক্টরি কিনে দেবো। খুশি?”
“ আমি ভাবির মতো চকলেট পাগল নই, তালহা ভাইইইইই! আমার ফুল চাই, সাথে কাঁচের রেশমি চুড়ি। “
তামান্নাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, চিবুকে হাত রেখে তাকাল তালহা। ঠোঁটের কোণে তার দুষ্ট হাসির রেখা। তামান্না ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
“ কী হলো?”
“ এখন, হবে… “
তালহা খুব ধীরে তামান্নার ঠোঁটের দিকে এগোতে লাগলো। তালহার মতিগতি বুঝতে অসুবিধা হলো না তামান্নার। লজ্জায়, অস্বস্তিতে একপ্রকার লাফালাফি জুড়ে বসল সে।
“ খবরদার! এটা করবে না, তুমি। “
“ এটাই করবো, মিস তামান্না ভাটিয়া। আরও ডাকো, ভাইয়া!”
“ না, না,না! আর কখনো ভাইয়া বলে ডাকবো না। “
“ শিওর? “
“ হ্যাঁ, হ্যাঁ। “
তালহা হাসতে হাসতে তামান্নাকে ছেড়ে দিলো। তামান্না যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে গিয়েছে। তবে আরিশ আজ অরাকে নিয়ে ছাঁদে যাবে বলে ঠিক করেছে। ভদ্রলোক প্রায়শই খেয়াল করেছে, তালহা তামান্নার সাথে ছাদে সময় কাটায়। হয়তো অরারও ভালো লাগবে বলেই সেই প্রয়াস।
“ আজ হঠাৎ ছাদে যাবেন, বললেন? “
হাতে হাত রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে দু’জন। আরিশের পরনে কালো রঙের টি-শার্ট আর সাথে ট্রাউজার, অরা বেগুনি রঙের শাড়ি পরে আছে, চুলগুলো খোঁপা করা।
“ এমনি!”
“ আচ্ছা, বুঝলাম। “
মুচকি হাসল আরিশ। অরার হাত ধরে ধীরে ধীরে ছাদে উঠলো সে। ছাদে তখন হালকা বাতাস বইছে, চারদিকে নরম আলো ছড়াচ্ছে বৈদ্যুতিক বাতিগুলো। দূরের আকাশটা ছিল নীলচে কালো, জোছনা দেখা যায় না ঠিক, কিন্তু অসংখ্য তারা যেন ঝিকিমিকি করছে নীরব আনন্দে।
ছাদে পা রাখতেই চোখে পড়লো—তালহা গিটার হাতে দাঁড়িয়ে, যেন ঠিক তখনই গান শুরু করবে। তার সামনে তামান্না বসে আছে চুপচাপ, চোখেমুখে প্রশান্তির ছায়া।
আরিশ আর অরাকে দেখে তামান্না আনন্দে চমকে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল, ঠোঁটে হাসি।
“ ভাবি! আপনারা ছাদে এসেছেন! “
“ হ্যাঁ এলাম। তোমাদের ভাইয়া নিয়ে এলো। “
কথাটা বেশ গর্ব করে বলল অরা। আরিশ অরার ভালোলাগার কারণ বুঝতে পারছে। তালহার থেকে গিটারটা নিজের হাতে নিয়ে বলল সে,
“ কতো বছর গিটার ধরিনি! “
তালহার চোখ ছলছল করছে। ছোটো থেকে আরিশকে কখনো এভাবে স্বাভাবিক দেখেনি সে। অরাও অবাক হচ্ছে, আরিশের গিটার বাজানোর চেষ্টা দেখে।
“ তুমি চেষ্টা করলেই বাজাতে পারবে ভাইয়া। “
মুচকি হাসল আরিশ। কয়েকবার চেষ্টা করতেই সুর এলো তাতে। অরার ভীষণ আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হলো, সে।
“ এই গানটা, তোমার জন্য – আমার হামিংবার্ড!”
অরার মুখ থেকে কোনো কথা বের হলোনা আর। তিনজনই আরিশের গান শোনার জন্য চুপ করে রইলো। সবার বুকের ভেতর কেমন ডিপ ডিপ করছে। আরিশ গান শুরু করলো, তার দৃষ্টিতে কেবল অরা।
❝ যখন ও রূপ স্মরণ হয়
থাকে না লোকলজ্জার ভয়
যখন ও রূপ স্মরণ হয়
থাকে না লোকলজ্জার ভয়
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
প্রেম যে করে সে জানে
ঐ প্রেম যে করে সে জানে
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে। ❞
গান শেষে অরা নিঃশব্দে এসে জড়িয়ে ধরল আরিশকে। তালহা, তামান্না হাত তালি দিতে শুরু করেছে। আরিশ অরার আচরণে এতটা খুশি হয়েছে যে তার চোখ ছলছল করছে।
“ খুব সুন্দর হয়েছে, রাগী ভূত। “
“ থ্যাংক ইউ, ডার্লিং। এবার তালহা শুরু কর, আমরা শুনি। “
তালহা বলল,
“ হ্যাঁ অবশ্যই। “
আরিশের থেকে গিটারটা নিলো সে। সবাই এবার তালহার গানের অপেক্ষায়। গান শুরু হলো। এভাবেই সেই রাতে চারজনের মধ্যে একটা সুন্দর সময় কাটতে লাগলো।
নয়নার দিনগুলো এখন আর ক্যালেন্ডারে জমে থাকা সংখ্যার মতো নয়। প্রতিটা দিন যেন একেকটা অনুপস্থিত চিঠি। পলাশের অভাবে নয়নার জীবনটা নিঃশব্দের অভ্যাস হয়ে গেছে।
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙে, কিন্তু ঘুম ভাঙার কোনো কারণ থাকে না। জানালার বাইরে পাখিরা ডাক দেয়, কিন্তু সেই ডাকগুলো তাকে আর জাগায় না। আগের মতো আর চুল বেঁধে আয়নায় দাঁড়িয়ে মুখ দেখে না সে।
পলাশও কি একইভাবে মনে করে তাকে? ও জানে না। তবে এটুকু জানে—প্রতিদিন সে একটা মানুষকে মিস করে, যার সাথে কখনো ভালোবাসার কথা বলা হয়নি। কিশোরী মন সবকিছু নিয়ে খুব ভাবে। জীবনের প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিকে সামলাতে বড্ড হিমসিম খাচ্ছে সে।
আজকাল বিকেল হলেই নয়না ছাদে ওঠে। একা বসে থাকে সেখানে। মোবাইল হাতে নিয়ে হাজারবার সেই পুরনো নামটা সার্চ করে—”পলাশ।” তবে পলাশের আইডি এক্টিভ নেই। দীর্ঘদিন কোনো পোস্ট নেই আইডিতে। পলাশের কী হয়েছে ভেবে কখনো চোখে জল আসে আবার কখনো আসে না, কিন্তু বুকটা জলে ভিজে যায়।
কেউ দেখে না, কেউ বোঝে না—এই মেয়েটা কেমন করে একটানা এক মানুষকে ভালোবেসে গেছে, শুধু অপেক্ষার বিনিময়ে।
বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে—“নয়না, তুই এখনো পলাশ ভাইকে ভুলিসনি?”
সে হেসে বলে,
হামিংবার্ড পর্ব ৬১
“ভুলে যাওয়ার জন্য তো কাউকে আগে সম্পূর্ণভাবে পাওয়া লাগে।”
রাতে নয়না যখন ঘুমাতে যায়, মাথার পাশে পলাশের দেওয়া সেই চিঠি রাখে। ভাঁজে ভাঁজে সে চিঠির কালি ফ্যাকাশে হয়ে যেতে শুরু করেছে। তবু সে পড়ে, প্রতিদিন, পলাশের লেখা সেই কথাগুলো।