হামিংবার্ড পর্ব ৬৯

হামিংবার্ড পর্ব ৬৯
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

ক্যাফের এক কোণার টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে মেহরাব ও সাবিহা। কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের দুজনের কথাবার্তার ভেতর জমাট অনুভূতির উত্তাপ গাঢ় হয়ে আছে।
“তুমি কী চাও মেহরাব? আমি তোমার জীবনে থাকি, না তোমার মা খুশি থাকেন?”
সাবিহা চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলো। মেহরাব ধীরে কিছুটা গাম্ভীর্যের সঙ্গে জবাব দিলো,
“তোমাকে ভালোবাসি সাবিহা। সেটা তোমার চোখে চোখ রাখেই বলতে পারি। কিন্তু মা আমার জীবনের শিকড়। আমি মাকে আঘাত দিয়ে কোনো সুখ পেতে চাই না। আবার তোমাকে হারিয়ে নিঃস্বও হতে চাই না।”
সাবিহা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

“তুমি বুঝতে পারো, আমি তোমার জায়গায় কেবল একজন বহিরাগত হয়ে গেছি এখন?”
মেহরাব নরম গলায় বলল,
“তুমি বহিরাগত নও। তুমি সেই মানুষ, যার স্বপ্ন আমি দেখতাম। কিন্তু বাস্তবতা এত সহজ না।
মা একা মানুষ। সারাজীবন আমাকে আগলে রেখেছে। তার অনুভূতিও সত্যি। আর তোমার অভিমান, তাও সত্যি। তোমরা দু’জনেই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাবিহা।”
সাবিহার চোখ ছলছল করছে। মনে হচ্ছে বিয়ের আগেই তার শ্বাশুড়ি মেহরাবকে তার থেকে কেড়ে নিচ্ছে।
“তুমি কি তাহলে সবসময় ব্যালান্স করে যাবে?”
মেহরাব চোখ নামিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি চাই, তুমি বুঝো—এটা ভালোবাসার ভারসাম্য নয়, এটা দায়িত্বের ভারসাম্য।
মা আর তোমার মাঝে কোনো তুলনা করি না আমি। মা আমার অতীত,বর্তমান, শিকড়। তুমি আমার ভবিষ্যৎ, আশ্রয়। আমি চাই, তোমরা দুজনেই থাকো– আমার দুই চোখের মতো।”
সাবিহা শান্ত, নরম গলায় বলল,
“তাহলে আমাকে কখনো একা ফেলে দিও না, চুপ থেকো না। তোমার চুপ থাকাটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়, মেহরাব। ভয় হয়।”
মেহরাব হালকা হাসি দিয়ে সাবিহার হাত ধরল।
“আমি কথা দিচ্ছি, তোমার পাশে থেকেও মা’কে ভালোবাসবো, আর মাকে আগলে রেখেও তোমাকে বুঝবো। তুমি শুধু আমায় একটু সময় দাও।”
সাবিহা হাসল, মেহরাবের হাতে হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

” তুমি সময় নাও। আমিও চেষ্টা করবো মা’কে বোঝানোর। সত্যি বলতে আমার খারাপ লাগছে, মায়ের অসুস্থতার সময় যাইনি বলে। ”
” ভুলটা আমার ছিলো। আমার বলা উচিত ছিলো। তবুও যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আমাদের একসাথে মাকে বোঝাতে হবে। ”
সাবিহা মেহরাবের দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে। মানুষটা তাকে কতটা ভালোবাসে ভাবলেই কতটা শান্তি লাগে সাবিহার। মেহরাব সাবিহার হাতে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। মেয়েটা আশেপাশে তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।

সাজেকের রাত অন্যরকম। দিনের তুলনায় অনেক শান্ত, নিস্তব্ধ। পাহাড়ে রাত নামলে সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা কিছুটা কমে যায়। বাতাস হয়ে ওঠে ঠান্ডা আর স্নিগ্ধ। চারদিকে সবুজ পাহাড় আর মেঘে ঢাকা উপত্যকা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু আশেপাশের কটেজগুলোর আলো জ্বলে থাকে– নরম, হলুদ আলোয় জায়গাটা আরও মনোরম লাগে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়, মানুষের কোলাহল কমে আসে। মাঝেমধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়, আর দূর পাহাড় থেকে আসে শোঁ শোঁ করে বাতাস বইবার শব্দ। আকাশে মেঘ না থাকলে অনেক তারা দেখা যায়, কখনো চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে।
রাতের সাজেকের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য–তার নিঃশব্দতা।
চারপাশে নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে পাহাড়ের বুক চিরে ঠান্ডা বাতাস এসে স্পর্শ করে যাচ্ছে অরার গাল। কটেজের সামনে কাঠের চেয়ারে বসে আছে তারা। আগুনের শিখা ধীরে ধীরে নিভে আসছে। আরিশ পাতলা চাদর মেলে দিলো অরার গায়ে।

“ঠান্ডা লাগছে?”
আস্তে জিজ্ঞেস করল সে।
অরা মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ঠান্ডাটা ভালোই লাগছে। জানেন, কতদিন পর এমন নিঃশব্দ কোনো জায়গায় এসেছি!”
আরিশ মুচকি হাসল। অরার নাকটা চেপে দিলো একটু।
” এরপর থেকে প্রতিমাসে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবো, ডার্লিং। ”
অরা বেশ খুশি হলো। বলল,
” ঘুরতে যেতে ভীষণ ভালো লাগে। তাছাড়া এমন প্রকৃতির মাঝে শুধু আমি… আপনি… আর এই মেঘ! মুহুর্তটা ভীষণ সুন্দর। ”
আরিশ চুপচাপ অরার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তার চোখে ধরা পড়ল একরাশ প্রশান্তি । অরার মিসক্যারেজ হওয়ার পর থেকে আরিশ কখনো তাকে এতটা হাসিখুশি দেখেনি। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে মেয়েটার যেনো হৃদয়ে দোলা লেগেছে।

“তুমি জানো, অরা… এই পাহাড়ে না এলে আমি কখনো বুঝতেই পারতাম না, তুমি এতটা প্রকৃতিপ্রেমী। আগে কখনো কেনো বলোনি, ঘুরতে এতটা পছন্দ করো? ”
অরা চাদরের ভেতর থেকে হাত বের করে ধীরে ওর হাতটা ধরল। ঠান্ডা হাতের উষ্ণ ছোঁয়ায় আরিশ একটু কেঁপে উঠল। পাহাড়ি অঞ্চল, সন্ধ্যার পরে হালকা ঠান্ডা পড়ে।
“এমনি বলা হয়নি কিংবা বলার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। সব সময় তো আপনি এমন ছিলেন না। ”
শব্দগুলো এসে আটকে গেল অরার গলায়।
আরিশ ধীরে অরার চোখে চোখ রেখে বলল,
“আমি তোমার ভালোবাসার অভ্যাসে বাঁধা পড়েছি, হামিংবার্ড। আগের মুহুর্তগুলো যেমন মিথ্যা নয় তেমনই এখনকার সময়গুলোও মিথ্যা নয়। এখন তুমি বলতে পারো, তোমার মনে যা আছে সব….তোমার অভিমানও এখন আমার প্রিয়। তোমার চুপচাপ বসে থাকাটাও আমার কাছে শব্দের মতোই স্পষ্ট।”

” ভালোবাসি রাগী ভূত। ”
আরিশ অরাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
” আই লাভ ইউ টু ডার্লিং। এখন চলো। ”
” কোথায়?”
” রুমে…”
আরিশের ইশারা বুঝতে অসুবিধা হয়নি অরার।
” খারাপ লোক একটা!

“ খারাপ লোক কতটা খারাপ হতে পারে দেখাচ্ছি, চলো।
একটু দূরে কাঠের গায়ে ঝুলে থাকা বাতিটা কাঁপতে কাঁপতে নিভে গেল। রাতের নিস্তব্ধতা গাঢ় হয়ে উঠল। তারা উঠে দাঁড়ালো, বারান্দার কিনারায় এসে দাঁড়ালো পাশাপাশি।
নীচে ছড়িয়ে থাকা মেঘের ঢেউ যেন একটা বিশাল সাদা সমুদ্র। দূরে কোথাও জোনাকি জ্বলছে। আরিশ একহাতে অরাকে জড়িয়ে নিলো, মাথাটা ওর কাঁধে রেখে অরা চোখ বন্ধ করল।
“এই মুহূর্তটা রেখে দিতে ইচ্ছে করে।” ফিসফিস করে বলল অরা।
“রেখে দিয়েছি। তোমার চোখে। তুমি যখনই ক্লান্ত হবে, ফিরে এসো এই স্মৃতিতে। আমি থাকবো, ঠিক এমন করে।”
উত্তর দিল আরিশ। অরা কিছু বলল না, শুধু বুক ভরে শ্বাস নিলো। আরিশ তাকে কোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে এগোল। পাহাড়ি রাতের নিঃশব্দতাও যেন হঠাৎ তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে গেল।

ভোরবেলা। কটেজের জানালার পর্দা সরিয়ে সূর্যের আলো আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকছে। সেই আলোয় অরার মুখটা যেন এক টুকরো শান্তির ছবি হয়ে গেছে। সে এখনো ঘুমিয়ে, হালকা নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কাঁধে ছড়িয়ে আছে। ঠোঁটে শান্ত এক হাসির রেখা। আরিশ ওকে দেখছে–নীরবে, স্থির হয়ে।
রাতের আদরের কোমলতা এখনো ছড়িয়ে আছে ঘরের কোণায় কোণায়। তাদের শরীরের মাঝখানে রাখা কাপড়ের ভাঁজেও যেন লেপ্টে আছে অরার ফিসফাস, আর আরিশের বুকের উত্তাপ। তাদের ভালোবাসা রাতের আঁধারে বলা হয়েছে, কিন্তু তার প্রতিচ্ছবি এই সকালেও রয়ে গেছে।
আরিশ ধীরে অরার গালে হাত রাখে। অরা চোখ মেলে তাকায়। চোখে ঘুমের রেশ, তবু গভীর তৃপ্তি।

“সকাল হয়েছে?”
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে অরা।
” ইয়েস ডার্লিং। ”
অরা কিছু না বলে আরিশের বুকের কাছে মাথা রাখে। কিছু মুহূর্ত এমন থাকে, যেখানে শব্দের দরকার হয় না—শুধু নীরবতা দিয়েই ভালোবাসা বোঝা যায়।
” আপনি কখন উঠলেন? ”
” যখন তুমি আমার ঘাড়ে কিস করলে, তখন। ”
চমকাল অরা। শোয়া থেকে উঠে বসলো। বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল আরিশের দিকে। আরিশ কনুইতে ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় আছে।

” আমি? কখন?”
” এই ঘন্টাখানেক আগে। ”
” আসলেই সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। ”
অরা ফিসফিস করে বলল কথাগুলো। আরিশ মুচকি হেসে খুব ক্ষিপ্র গতিতে অরাকে নিজের পেটের ওপর উঠিয়ে বসাল। অরার বিস্ময় কাটে না। রাতের দৃশ্যগুলো মনে পড়ে যায়, লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল সে।
” লোহা যে কতটা ভাসে তা তো গতকাল রাতেই দেখলাম। আগুন জ্বালিয়ে দিতে যতক্ষণ লেগেছিল, সেই আগুনে জ্বলতে তোমার সময় লাগেনি। উফ… অরা তুমি…. ”
আরিশ আরকিছু বলার আগেই অরা তার মুখ চেপে ধরে।

” চুপ! একদম চুপ। বেশি কথা বলেন কেন? থাকুন, ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
অরা তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে উঠে প্রায় দৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। আরিশের ঠোঁটের কোণে হাসি, শরীরে অরার ভালোবাসার চিহ্ন!

হামিংবার্ড পর্ব ৬৮

সদ্য গোসল সেরে এসেছে অরা। পরনে তার শুভ্র শাড়ি, খোলা চুল থেকে টপটপ পানি পড়ছে। সে ধীরপায়ে বারান্দার দরজা খুলে দিলো। সাজেক এখন মেঘে ঢেকে গেছে। সাদা মেঘ পাহাড় ঢেকে রেখেছে, যেন বিশাল তুলোর চাদর। দূরে সূর্য উঠেছে, সেই আলো মেঘের ওপর পড়ে রূপালি ঝিলিক ছড়াচ্ছে।

হামিংবার্ড পর্ব ৭০