হামিংবার্ড পর্ব ৭১
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
সকাল থেকেই পুরো বাড়িতে উৎসবের ঝলক। খান ভিলা আজ রঙে, আলোয়, সাজে একেবারে ঝলমলে। লনজুড়ে বিশাল হলুদ-সাদা প্যান্ডেল টানা, তাতে ঝুলছে অর্কিড আর গাঁদার মালা। ইনডোর–আউটডোর একসাথে সাজানো, ভেতরে মেহেদির ঘ্রাণ, বাইরে বাল্ব আর ফেয়ারি লাইটসের ঝিলমিল। আজ তামান্না আর সাবিহার গায়ে হলুদ।
বাড়ির নিচতলায় পার্টি লনে সিল্কের কুশনে মোড়া সোফাসেট, সাজানো ফটো বুথ, ঝুলন্ত ফুলে ঢাকা চকলেট-জুসের স্টেশন, পাশে হালকা বাজছে লাইভ বাউল-ফিউশন ব্যান্ডের মৃদু সুর। ডেকোরের দায়িত্বে দেশের নামী ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি–সবকিছু নিখুঁতভাবে রঙ ও আলোয় মোড়ানো। গেট থেকে ঢোকার মুখেই ফুলে সাজানো একটা আরক দিয়ে ভেতরে ঢোকা।
তামান্না আর সাবিহা সাজছে আলাদা আলাদা ঘরে। মেকআপের জন্য এসেছে টপ ক্লাস বিউটি টিম, তাদের চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে ভিডিওগ্রাফার, ক্যান্ডিড ফটোগ্রাফার। গায়ে হলুদের জন্য এতটা সাজগোছ, জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন কিংবা মেকআপ কোনোটার দরকার ছিল না। কিন্তু আরিশের মতে সবকিছু রাজকীয় স্টাইলে করতে হবে। খান বাড়িতে বহুবছর পর বিয়ে হচ্ছে। আরিশের বিয়েটা তো সেরকমভাবে হয়নি। তাই আরিশের ইচ্ছেতেই সবকিছুতে এতটা জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়েছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরিশ সকাল থেকেই পুরো আয়োজন তদারকি করছে, তবে তার চোখ বারবার খুঁজছে অরাকে।
অরা আজ পরেছে হালকা হলুদ-সোনালি জামদানি, ঝিনুকের মতো ছোট ছোট পার্লস দিয়ে কাজ করা ব্লাউজ, খোঁপায় গাঁদা আর গোলাপ গাঁথা ফুল। তাকে দেখে যেন এক শিল্পকর্ম লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো শিল্পীর নিখুঁত শিল্পকর্ম।
অরা সবকিছু দেখেশুনে নিচ্ছে। তালহার আজ কোনো কাজকর্ম নেই। সাবিহা ও তামান্নার গায়ে হলুদ শেষে তালহার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান।
উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে অরা। ধীরপায়ে আরিশ এগিয়ে আসছে তার কাছে। অরা পেছনে না তাকিয়েও আরিশের নিঃশ্বাস অনুভব করছে। তার ঘাড়ে আরিশের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে শিউরে ওঠে। আরিশ খুব আস্তে বলল,
“তোমাকে আজ দেখে মনে হচ্ছে, এই গায়ে হলুদের আসরে তুমি একমাত্র আলো।”
অরা হেসে বলে,
“আজ তো তামান্না-সাবিহার দিন। আমি তো শুধু….”
আরিশ মাঝখানে বলে ওঠে,
” ইউ আর অনলি মাইন, সো ইউ’ল অলওয়েজ বি মাই প্রাইওরিটি–এভরি সিঙ্গল ডে।
অরা লাজুক চোখে তাকায়। পাশে নয়না, শিমু আর ত্বোহা দৌড়ে আসে। শিমু ও ত্বোহা তালহার মামাতো ভাইবোন।
“ আপু তোমাকে ডাকছে। ”
নয়না বলল। আরিশ ওদেরকে দেখে একটু দূরে সরে দাঁড়াল। অরা গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো।
” কে ডাকছে? ”
আরিশ জিজ্ঞেস করলো। নয়না বলল,
” তামান্না আপু। ”
অরা ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে নয়নাদের সাথে চলে যেতে যেতে বলল,
” আমি আসছি৷ ”
আরিশ কিছু বলল না। তবে চোখের ইশারায় অনেক কিছু বোঝাল। অরা লজ্জায় মাথা ঘুরিয়ে সামনের দিকে এগোল।
গায়ে হলুদের সমস্ত আয়োজন শেষে সন্ধ্যার আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফেয়ারি লাইটগুলোর মৃদু ঝিকিমিকি, বিয়ের ব্যস্ততা—সব মিলিয়ে খান ভিলার আঙিনা যেন এক স্বপ্নপুরী হয়ে আছে। হলুদ রঙে ভেজা বিকেলটা এখন সোনালি রাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সবার চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও আজকের আনন্দ সেই ক্লান্তিকে ছাপিয়ে গেছে। তামান্না আর সাবিহা দুজনেই যেন নতুন জীবনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। ঘরের ভেতর তারা বসে আছে, মেহেদির রঙ শুকিয়ে গাঢ় হচ্ছে হাতভর্তি ডিজাইনে। মুখে হালকা হাসি, চোখে একটু সংশয়, কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন খুশির হাওয়া বইছে।
সাবিহা আয়নার সামনে বসে মেহেদির গাঢ়তা দেখে বলল,
“দেখেছো ভাবি ? তোমার মেহেদি অনেক গাঢ় হয়েছে। তালহা নিশ্চয়ই তোমাকে খুব ভালোবাসে!”
তামান্না কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো। হেসে বলল, ” আপনার হাতের মেহেদীর রঙও খুব সুন্দর হয়েছে। মেহরাব ভাইও আপনাকে খুব খুব ভালোবাসে।”
উল্টো দিকের সোফায় বসে থাকা তাসলিমা খাতুন হেসে ফেললেন,
” এখন কিছু খাওয়াদাওয়া করে নাও তোমরা। তারপর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাও। আগামীকাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। ”
সাবিহা ও তামান্না একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” হ্যাঁ, মা। আমরা যাচ্ছি। ”
তারা দু’জন নিজেদের ঘরের দিকে এগোল। রাতে কিছু খাবে না, কিছুক্ষণ আগেই নাস্তা করেছিল।
রাত এগারোটা ছুঁইছুঁই। ব্যাকইয়ার্ডে বসে আরিশ ও মেহরাবএকসাথে চা খাচ্ছে। মিনিট পাঁচেক আগেই মেহরাব এসেছে। অরা নয়নাকে দিয়ে চা পাঠিয়ে দিয়েছে। তামান্না, সাবিহা হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছে।
মেহরাব বলে উঠল,
“ভাবতে পারছিস? কাল আমার বিয়ে! মা’কে ম্যানেজ করতে বড় কষ্ট হয়েছে। ”
আরিশ চুপচাপ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“তুই ভাগ্যবান। তোদের অন্তত সেভাবে বিয়ে হচ্ছে।”
মেহরাব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তোর আফসোস হয় নাকি?”
আরিশ হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“না রে। অরার সাথে আমার বিয়েটা ছিল অন্যরকম। শুরুর জায়গাটা হয়তো সুন্দর ছিল না, কিন্তু ওকে পাওয়া– এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। এখন ওর হাসি দেখলেই আমার পুরো পৃথিবী ভালো হয়ে যায়।”
মেহরাব মুচকি হাসে।
ওদিকে নয়না, শিমু একপাশে বসে গল্প করছে। সবাই গায়ে হলুদের সাজে, রঙিন চুড়ি, টিপ, গায়ে হলুদের উজ্জ্বল আলোয় নয়নার মুখটা অন্যরকম লাগছে। কিন্তু ওর চোখে কোথায় যেন একধরনের খালি খালি ভাব।
শিমু বলল, “তমি এত চুপ কেন?”
নয়না ছোট্ট করে বলল, ” কিছু না আপু। ”
” অনেক রাত হলো। চলো ঘুমিয়ে যাই। ”
হাই তুলতে তুলতে বলল শিমু। নয়নার থেকে এক বছরের বড়ো সে।
” হুম।”
রাতটা খানিক নীরব, আবার খানিক গুঞ্জনময়। কেউ কেউ আজকের ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, কেউ ব্যস্ত আগামীকালকের বিয়ের জন্য। আর অরা? সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হালকা হাওয়া গায়ে মেখে আকাশের চাঁদ দেখছে। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আরিশ।
“ কী দেখছো, হামিংবার্ড?”
“ চাঁদ। “
আরিশের ভ্রু কুঁচকে ফেলল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ আমাকে দেখো। “
অরা মুচকি হেসে তার দিকে তাকাল। ভদ্রলোক জেলাস ফিল করছে।
“ কী সৌভাগ্য আমার! একসাথে দু’টো চাঁদ দেখছি আমি। “
“ তাই না? “
আরিশ অরার ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে স্লাইড করতে লাগলো। অরা বলল,
“ জি, রাগী ভূত। “
“ আমার অরার জীবনে কেবলমাত্র একটা চাঁদ থাকা চাই, আকাশের চাঁদও তার জন্য নিষিদ্ধ। “
এই বলে আরিশ হঠাৎই অরার কোমর জড়িয়ে ধরল। এক মুহূর্তে দুইজনের মধ্যকার শ্বাস-প্রশ্বাস একত্রিত হয়ে গেল। বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে অরার মুখে পড়ছে সোনালি ছায়া, আরিশের চোখ তাতে আটকে আছে।
“আজ সারাদিন শুধু দেখেছি তোমাকে। স্পর্শ করিনি, কাছে যেতে পারিনি… এখন আর নিজেকে আটকাতে পারছি না।”
আরিশের নেশালো কণ্ঠস্বর যেনো অরাকে মাতাল করে তুলছে। আরিশ হালকা চুমু খেল তার ঘাড়ে। অরা কেঁপে উঠল একটু, কিন্তু সরে গেল না। ঘাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করলো সে। হাত দিয়ে দেখল, রক্ত!
“এটা তোমার জন্য নয়, আমার অস্থিরতার জন্য।”
আরিশ ফিসফিস করল।
অরা আস্তে বলল,
“আপানার ভালোবাসা এমন হিংস্র কেন, রাগী ভূত?”
“কারণ তোমাকে ভালোবাসতে গিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি। আর যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে, তাকে পেলে মানুষ শান্ত নয় বন্য হয়ে ওঠে।”
ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে, চাঁদের আলো আর আরিশের স্পর্শে অরার সমস্ত অবসাদ গলে যেতে লাগল। চারপাশে শুধু নিঃশব্দতা, আর দুটো হৃদয়ের ভেতরে ওঠা তুমুল ঝড়। অরা এখন আরিশের স্পর্শে ভয় পায় না, বিরক্ত হয় না। আরিশের সবকিছুই এখন অরার উপভোগ্য। আরিশ অরাকে কোলে তুলে নিয়ে বেডরুমের দিকে এগোল।
“ তুমি! মেহরাব তুমি এতো রাতে এভাবে দেখা করতে এলে কেন? সবকিছু ঠিক আছে? “
মেহরাব সাবিহাকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে ধরল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো সে। এই নিশীথে মেহরাব ঠিক কী কারণে বাড়ির পেছনের গেটে তাকে দেখা করতে বলেছে সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না সাবিহার।
“ আমি ঠিক নেই। আগামীকাল বিয়ে অথচ একটা রাতও অপেক্ষা যেন সহ্য হচ্ছে না আমার। হুর করে যেনো সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে সাবিহা। “
সাবিহা কী বলবে বুঝতে পারছে না। আজকে মেহরাবকে সত্যি লাগামছাড়া লাগছে।
“ মেহরাব! “
“ বলো সাবিহা। “
“ এখন ফিরে যাও, প্লিজ! আগামীকাল আমাদের দেখা হবে, আমরা এক হয়ে যাবো। আজকের রাতটা শুধু… প্লিজ?”
সাবিহার কথার মধ্যে যেনো কিছু একটা ছিলো। মেহরাব তা অগ্রাহ্য করতে পারলোনা। বাহুডোর থেকে মুক্ত করলো সাবিহাকে।
“ ঠিক আছে। আসছি আমি। কাল রেডি থেকো, তোমায় নিতে আসবো আমি। “
“ থাকবো। এসো…”
মেহরাব কোনো কথা না বলে সাবিহার কপালে চুমু খেলো। তারপর নিঃশ্বব্দে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। সাবিহা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর বাড়ির ভেতর চলে গেলো।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে টুপটাপ। জানালার কাঁচ বেয়ে নামছে জলের রেখা। ঘরটা আধো আলোয় ডুবে আছে। শুধু বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বলছে মৃদু। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ—চোখে একরকম নিঃশব্দ আগুন, ঠোঁটে অদ্ভুত এক রহস্যময় হাসি।
অরা বিছানায় শুয়ে আছে, খোলা চুলে, নরম স্যাটিনের রোব পরা। তার চোখে আজ কিছু একটা আলাদা… সাহসী, চঞ্চল, আর আমন্ত্রণ জানানো।
আরিশ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে অরার কানে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি জানো, আজ আমি তোমাকে আর একচুলও ছাড়া দেব না।”
অরা পিছনে ফিরে তাকাল, ঠোঁটের কোণে খেলা করলো এক লাজুক কিন্তু দুষ্টু হাসি,
“তো আমি কি পালাতে চাইছি?”
আরিশ তখন খুব ধীরে তার দুই হাত তুলে অরার কবজি দুটো ধরে, বিছানার সাথে চে*পে ধরলো।
“তুমি আজ আমার ইচ্ছে মতো থাকবে, পুরোপুরি আমার…”
হামিংবার্ড পর্ব ৭০
তার গলায় কোমলতা ছিল, কিন্তু তার ভেতরে ছিল একরকম জেদ আর তীব্র অধিকারবোধ।
অরা তার চোখে চোখ রাখল। কোনো ভয় নেই, কেবল উত্তেজনা।
“আমি তো সবসময় আপনারই…”
আরিশ আঙুল ছুঁইয়ে দিল অরার কপালে। সেই আঙুল নেমে এলো ভ্রু, গাল, ঠোঁট, গলা ছুঁয়ে ধীরে ধীরে আরও নিচে… যেন এক শিল্পী তার ক্যানভাস আঁকছে। ঘরজুড়ে তখন শুধুই নিঃশ্বাসের শব্দ আর ভালোবাসার গভীরতায় হারিয়ে যাওয়া দুইটি মন।