হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ৩৩
সানা শেখ
ফজরের নামাজ শেষ করে মায়ার কোলের উপর মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে আলভী।
মায়া আলভী কে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“ওঠো, বিছানায় গিয়ে ঘুমাও।”
“এখানেই ঘুমাব আমি।”
“আমার ঘুম পাচ্ছে এখন, আর তাঁকিয়ে থাকতে পারছি না। সারা রাত একটুও চোখ বন্ধ করতে দাওনি তুমি।”
আলভী শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। মায়া নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে জায়নামাজ দুটো ভাজ করে আলমারিতে তুলে রাখে।
ভেজা চুলের খোঁপা খুলে দিয়ে বেডে উঠে শুয়ে পড়ে। আলভী ফ্যান অন করে লাইট অফ করে দেয়। তারপর নিজেও বেডে উঠে মায়া কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে।
মায়া আলভীর বুকে মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ রেখেই বলে,
“এসি তো অন করাই আছে, তাহলে আবার ফ্যান অন করলে কেন?”
“ফ্যানের বাতাসে চুল শুকিয়ে যাবে, আলাদা করে আর শুকাতে হবে না।”
“ভীষণ শীত করছে এখন।”
“ফ্যান নাহয় এসি দুইটার একটা বন্ধ করো।”
আলভী শোয়া থেকে উঠে বসে পায়ের নিচ থেকে ব্ল্যাঙ্কেট তুলে গায়ে জড়িয়ে নেয় দুজনের। তারপর আবারো মায়া কে শক্ত বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে বলে,
“এখন আর শীত করবে না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মায়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আগের মতো করেই ধরে রয়েছে আলভী। এক হাত বের করে নিজের ফোন টা হাতে নেয়। পাওয়ার বাটন চেপে টাইম দেখে নেয়। আলভীর হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে বসতেই আলভীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। উপুর হয়ে শুয়ে মায়ার কোমর এক হাতে জড়িয়ে ধরে। চোখ বন্ধ রেখেই ঘুম জড়ানো গলায় বলে,
“উঠছো কেন?”
“ওঠো আট টা বারো বেজে গেছে।”
“শুয়ে থাকো, এখন উঠে কি করবে?”
“তুমি শুয়ে থাকো, ছাড়ো আমাকে।”
আলভীর হাত সরিয়ে দিয়ে বেড থেকে নেমে দাড়ায়। রুমের লাইট অন করে। এলোমেলো চুল গুলো হাত খোঁপা করে নেয়। তারপর এলোমেলো শাড়ি কোনো রকমে ঠিক করে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।
ফ্রেস হয়ে এসে দেখে আলভী শোয়া থেকে উঠে বেড গুছিয়ে ঝিম ধরে বসে রয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় মায়া। আলভী বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।
কয়েক মিনিট পরেই ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে আসে। টাওয়েল দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে মায়ার পেছনে এসে দাঁড়ায়। টাওয়েল সোফার উপর ছুঁড়ে দিয়ে মায়া কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
“কি করছো?”
“জড়িয়ে ধরেছি।”
“শাড়ি ঠিক করবো আমি, ছাড়ো এখন।”
ছেড়ে দাঁড়ায় আলভী।
“রুম থেকে বের হও।”
“কেন?”
“শাড়ি ঠিক করবো আমি।”
“করো, আমি কি বাধা দিচ্ছি নাকি? এই এক মিনিট তুমি কি আমার সামনে শাড়ি ঠিক করতে লজ্জা পাচ্ছো? এত কিছুর পরেও তোমার লজ্জার স্টক শেষ হয়নি?”
“উল্টা পাল্টা কথা না বলে বের হও এখান থেকে। গিয়ে ভাবী কে আসতে বলো।”
“ভাবী কে কেনো আসতে বলবো?”
“শাড়ি পড়িয়ে দেওয়ার জন্য।”
“শাড়ি আমি পড়াবো তোমাকে।”
“তুমি শাড়ি পড়াতে জানো?”
“জানিনা এখন শিখে যাব। এখন সোজা হয়ে দাঁড়াও।”
মায়ার কোনো কথা না শুনে নিজেই শাড়ি পড়ানোর জন্য উদ্যত হয়। জোর করে আঁচল নামিয়ে নেয়।
আলভীর জেদের কাছে না পেরে মায়া বলে,
“আমি পড়ছি, তুমি শুধু আমাকে সাহায্য করো।”
“আচ্ছা।”
শাড়ি প্যাচ দিয়ে কুচি করে নেয় মায়া। আলভী নিচে হাঁটু মুড়ে বসে কুচি গুলো ঠিক করে সমান করে দেয়।
খুব একটা সময় লাগে না দ্রুতই শাড়ি পড়ানো হয়ে যায়। আলভী মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“শাড়ি পরানো তো একদম ইজি। পাঁচ মিনিটেই হয়ে যায়। কত সুন্দর করে শাড়ি টা পড়ালাম দেখো।”
মায়া কপাল ভ্রু কুঁচকে বলে,
“শাড়ি তুমি পরিয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“কয়েক টা কুচি ধরলে আর একটা সেফটিপিন লাগিয়ে দিলেই শাড়ি পড়ানো হয়ে যায়? কষ্ট করে শাড়ি পড়লাম আমি আর এসেছে নিজে ক্রেডিট নিতে।”
“এহ্ শাড়ি আমি পড়িয়েছি।”
“হ্যাঁ আমি তো শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
“চুপ চাপ দাড়াও দেখি।”
মায়া কে দার করিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নেয় আলভী কোথাও দিয়ে পেট দেখা যাচ্ছে কিনা। লম্বা করে ঘোমটা টেনে দেয় আলভী নিজেই।
তারপর বলে,
“রুম থেকে বের হবে না একদম, বেডে উঠে শুয়ে থাকো নয়তো বসে থাকো। যার দেখতে ইচ্ছে হবে রুমে এসে দেখে যাবে। আমার কথা যেন মনে থাকে, রুম থেকে বের হবে না। বাইরে গেলে সকলের সামনে ঘোমটা ফেলে উল্টে পাল্টে দেখবে সবাই।”
“ঠিক আছে।”
মায়া বেডে উঠে বসে। রুমেই যখন থাকবে তখন এক হাত ঘোমটা টেনে দিতে হবে কেন?
আলভী ডোর খুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আলভী ড্রইং রুমে আসতেই শীতল নাদিরা সহ বাকি মেয়েরা আলভী কে ঘেরাও করে ধরে।
আলভী কপাল ভ্রু কুঁচকে বলে,
“এখন আবার কোন দাবিতে টাকা চাই?”
ড্রইং রুমে থাকা সকলেই ওদের দিকে তাকায়।
নাদিরা বলে,
“তুমি আমাদের ঠকিয়েছ।”
“কিভাবে ঠকালাম?”
“মাত্র দশ হাজার টাকা দিয়েছো রাতে। গেটে দশ হাজার বাসর ঘরেও দশ হাজার। এত কিপটা কেনো তুমি?”
“দশ টাকা দিয়ে একটা লেবু কিনে এনে এক গ্লাস শরবত দাওনি কেউ, দশ টাকা দিয়ে একটা মোমবাতি কিনে দাওনি সেখানে যে দশ হাজার টাকা দিয়েছি সেটাই তো অনেক। বিয়ে করে লাভ কোথায়? সব দিক থেকে শুধু জামাইয়ের লস, লাভ হয় শুধু শা*লা শা*লী আর বাকিদের। আমার তো কোনো লাভ হলো না।”
“বিয়ে করে এত সুন্দর একটা বউ পেয়েছো আর কি চাও?”
“বউ টা তো আমার নিজেরই ছিল।”
“তো, তুমি কি অন্যের বউ বিয়ে করতে চেয়েছিলে?”
“আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ বলে কি! আমি কেনো অন্যের বউ বিয়ে করতে চাইবো?”
“তোমার কথা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে।”
“কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গলা টা ভিজিয়ে নেই তারপর বাকি কথা বলছি। সাইট প্লীজ।”
সকলের মাঝখান থেকে বেরিয়ে সোফায় এসে বসে নানার পাশে।
মায়ার নানা আলভীর দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলেন,
“জামাই চোখ মুখের এই হাল কেন? সারা রাত ঘুমাননি নাকি?”
আলভী নানার দিকে ঘাড় লম্বা করে এগিয়ে মৃদু স্বরে বলে,
“আপনার নাতনী তো সারা রাত ঘুমোতে দিল না নানা।”
“আমার নাতনী ঘুমোতে দেয়নি নাকি তুমি আমার নাতনী কে ঘুমোতে দাওনি?”
“এত সত্য কথা বলতে নেই নানা।”
আলভীর কথা শুনে তিন নানা নাতিই হেসে ওঠে।
আলভী গলা ছেড়ে বলে,
“আম্মু কফি দাও।”
মায়ার নানি সোফার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,
“মায়া কোথায়?”
আলভী নানি শাশুরির দিকে তাকিয়ে বলে,
“রুমে।”
“রুমে কেন? প্রতিবেশীরা আসছে ওকে দেখার জন্য।”
“রুমে গিয়ে দেখে আসুক যার দেখতে ইচ্ছে করে। আর কোনো পুরুষ যেন ঐ রুমে না যায়।”
নানি আলভীর দিকে তাকিয়ে আবার প্রতিবেশী দের দিকে তাকায়। এরাও এক সময় সুযোগ পেয়ে মায়া কে কটু কথা শুনিয়েছিল।
দুপুরে পার্লার থেকে গত কালকের মেয়ে টা আসে মায়া কে সাজানোর জন্য।
মায়া শাওয়ার নিয়ে খেয়ে চুল শুকিয়ে তার অপেক্ষাই করছিল এতক্ষণ।
মেরুন রঙের লেহেঙ্গা টা ওয়াশরুম থেকে পড়ে আসে মায়া।
মেকআপ শেষ করে গোল্ডেন কালার হিজাব বেঁধে দেয়। হিজাবের উপর ছোট ছোট হোয়াইট স্টোনের পিন লাগিয়ে দেয়। পিন গুলো লাইটের আলোয় ঝিকিমিকি করছে।
সাঁজানো শেষ করে মেয়ে টা নিচে চলে যায়। আলভী নিজের রুমে প্রবেশ করে। রুমে মেয়ে মানুষ দিয়ে গিজগিজ করছে। আলভী কে দেখেই অর্ধেক মেয়ে বেরিয়ে যায়। আলভী মায়ার দিকে তাকায়। ওর কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে মায়া কে।
আলভী নিজের ড্রেস বের করে আলমারির ভেতর থেকে। তারপর ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।
মায়া হেঁটে এসে বেডে বসে। শাড়ির চেয়ে লেহেঙ্গা টা বেশি ভারী।
তিন টা বাজতেই আলতাফ মাহমুদ আলভীর রুমের সামনে এসে গলা খাঁকারি দেন। আলভী বুঝতে পেরে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
আলতাফ মাহমুদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“মায়া কে নিয়ে নিচে আসো এখন, গেস্টরা সবাই চলে এসেছে।”
আলভী মায়ার হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। গত কাল অনেক গেস্ট আসেনি তারা সবাই আজকে এসেছে।
স্টেজের দিকে এগিয়ে যায় দুজন একে অপরের হাত ধরে। সবাই ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ার পরনে মেরুন রঙের লেহেঙ্গা, আলভী ব্ল্যাক কোট প্যান্ট পড়েছে। দুজন কে পাশাপাশি অনেক সুন্দর লাগছে। এরা দুজন যেন একে অপরের জন্যই তৈরি।
হেঁটে এসে স্টেজে উঠে দাঁড়ায়। সকলেই তাঁকিয়ে দেখে দুজন কে। সবাই প্রশংসাও করে।
চেয়ারে বসার সময় আলভী আস্তে আস্তে বলে,
“এদের দেখা দেখি দ্রুত শেষ হলেই বাঁচি। সকালের পর আর বউ কে আদর করার সুযোগই পেলাম না। বউ কে ছয় সাত দিন আদর করে পোষাবে না। নিজের সাথে করে নিয়ে যাব এটাই ফাইনাল।”
রাত আটটা আলভী গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল। মাহিদ পেছন পেছন আসতে আসতে শুনে ফেলে আলভীর গান যদিও আলভী আস্তে আস্তে গানটা গাইছিল। মাহিদ আলভী কে বলে,
“তুমি নাকি ভালো হয়ে গেছো! এখন আবার গান গাইছ দেখছি , তু খিচ মেরি ফটো।”
ওদের দুজনের সামনে দিয়ে একটা পাঁচ-ছয় বছরের পিচ্চি ছেলে যাচ্ছিল। মাহিদ এর কথা গুলো শুনতে পেয়েছে স্পষ্টই।
আলভী কিছু বলবে তার আগেই ছেলেটা বলে,
“তু খিচ মেরি ফটো
তোর বাপে চালায় অটো,
তোর মা’য় চালায় হুন্ডা
তোর চৌদ্দ গুষ্টি গুন্ডা।”
ছেলেটার গান, ছড়া হোক বা কবিতা শুনে দুই ভাই শকড। অবাক হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকায় দুই ভাই তারপর আবার ছেলেটার দিকে তাকায়।
মাহিদ বলে,
হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ৩২
“এই সব কার কাছে শিখেছিস?”
“মাইনষের কাছে।”
“তুই কাকে বললি এগুলো?”
“তোমাকে।”
বলেই ভোঁ দৌড় ছেলে টা।
মাহিদ নিজেও ছেলে টার পেছনে দৌড়ে যায়। আজকে ধরতে পারলেই হলো, হুন্ডা-গুন্ডা সব বের করে দেবে।