হ্যালো 2441139 পর্ব ৩
রাজিয়া রহমান
কৃষ্ণচূড়া গাছটার ডালে অসংখ্য পাখি বসে আছে। চিকন চিকন পাতার ফাঁক দিয়ে এক ফালি রোদ এসে পিয়াসার মুখে পড়লো।এখন টিফিন পিরিয়ড চলছে।
পিয়াসা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আছে।
স্কুলের সব বাচ্চারা খাবার খাচ্ছে। এতো দিন মা তাকে বাড়ি থেকে নাশতা বানিয়ে দিতো ব্রেকের সময় খাওয়ার জন্য। আজকে তো মা নেই।পিয়াসাকে খাবার দেওয়ার ও কেউ নেই।পিয়াসা টের পেলো সে কতটা অসহায় এখন।
মাঠের এক পাশে টিউবওয়েল। পিয়াসা উঠে যায়।আঁজলা ভরে পানি খায়।পেটের মধ্যে মনে হয় একটা রাক্ষস ঢুকেছে। এতো দিন খেতেই ইচ্ছে করতো না।প্রতিদিনই খাবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হতো।অথচ এখন ভীষণ খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু খাবার নেই।
রাব্বি তার দুটো বন্ধুকে সাথে নিয়ে পিয়াসার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ায় ক্রিকেট ব্যাট আর বল নিয়ে। পিয়াসা আনমনা হয়ে মা’কে ভাবছিলো সেই মুহূর্তেই ভীষণ স্পিডে বল এসে পিয়াসার কপালে লাগে।
মুহূর্তের জন্য পিয়াসার দু চোখে যেনো সরষে ফুল ভেসে উঠে।
রাব্বি হেসে বন্ধুদের বলে, “আবারও বল মারবি ওর গায়ে।আমারে ও জুতা দিয়ে পিটাইছে।থুথু মারছে।আমি ও বদলা নিমু।”
হাসিব বলে, “তুই চিন্তা করিস না।তোর এই দোস্ত থাকতে তোর লগে ঝামেলা করে পার পাইবো এরকম কেউ নাই।বল কর আবার। ”
রাব্বি খুশি হয়।হাসিবের হাতের নিশানা অব্যর্থ।
পিয়াসা কপালে হাত দিয়ে দেখে কপাল ফুলে গেছে।ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে কপালে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে পিয়াসা।ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার।সে চায়বনা কাঁদতে। কিছুতেই কাঁদবে না সে।
পপরমুহূর্তে আরেকটা বল আসে পিয়াসার মাথায় লাগতে যায়।মাথা সরিয়ে ফেলে পিয়াসা দ্রুতগতিতে।
এতোক্ষণে বুঝতে পারলো এরা ইচ্ছে করে ওকে লক্ষ্য করেই বল মারছে।
পিয়াসা বল উঠে দাঁড়ায়। পেটে ক্ষিধের আগুন, বুকে যন্ত্রণার আগুন নিয়ে বাঘিনীর মতো এগিয়ে যায় পিয়াসা।
সোজা গিয়ে হাসিবের মুখোমুখি দাঁড়ায়। হাসিব কিছু বলার আগে পিয়াসা স্ট্যাম্প তুলে নিয়ে হাসিবের কপালে মা রে।
হাসিবের মাথা ঘুরে উঠে।
ধপ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় হাসিব।রাব্বি ভয়ে চিৎকার করে উঠে। মুহূর্তেই অনেক শিক্ষার্থী ছুটে আসে রাব্বির চিৎকার শুনে।
ধরাধরি করে হাসিবকে লাইব্রেরি রুমে নিয়ে শোয়ানো হয়।ডাক্তার ডাকা হয়।
পিয়াসা বিরস মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে।তার মুখটা ভীষণ তেঁতো লাগছে।কিছু খেতে ইচ্ছে করছে পিয়াসার।
ক্লাসের ঘন্টা পড়ে যায় টিফিন পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ার পর। পিয়াসা ক্লাসে চলে যায়।
শারমিন ম্যাডাম ক্লাস সেভেনের বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় ক্লাস নেন।টিফিনের পর আজকে শারমিন ম্যাডামের ক্লাস।
শারমিন ম্যাডাম স্কুলের সবচেয়ে দজ্জাল আর কুটনী ম্যাডাম।
ছেলেমেয়েরা আড়ালে তাকা রিনা খান বলে ডাকে।
শারমিন ম্যাডাম ক্লাসে এসে প্রথমেই পিয়াসাকে দাঁড় করালেন।পিয়াসা দাঁড়াতেই জিজ্ঞেস করলেন,”কিরে, স্কুলে আসছ কেনো?মারপিট করতে আসছ?মাইয়া মানুষ হয়ে পোলাটারে অজ্ঞান করে ফেললি?তুই তো কচি খুকি না।১২ বছরের মাইয়ারে আগের যুগে বিয়ে দিতো।তোর ও তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে।এরকম ডাংকু মেয়ের এই স্কুলে জায়গা হবে না।”
ম্যাডামের কথা শুনে ক্লাসের সবাই হেসে উঠে।
পিয়াসা চুপ করে রইলো।
শারমিন ম্যাডাম আবার বললেন,”তোর মা’কে বলবি আসতে আগামীকাল স্কুলে।তোরে টিসি দিয়ে দিবো।”
পিয়াসার চোখ জ্বালা করে মা’য়ের কথা উঠতেই।মা আসবে কোথা থেকে?
রাব্বি উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে বলে, “ম্যাডাম,ওর মা তো নাই।ওদের বাড়ির মাস্টরের লগে পালাই গেছে।
এই কথা বলাতে ও সকালে আমাকে ও পিটাইছে ম্যাডাম। ওর পায়ের জুতা দিয়ে আমারে পিটাইছে,আমার মুখে থুথু ও দিছে।আবার হাসিবকে ও এজন্যই পিটাইছে।”
পিয়াসা রাব্বির দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায়। এই রাব্বিকে সে খু ন করে ফেলবে।হারামির বাচ্চা!
শারমিন ম্যাডাম অবাক হয়ে পিয়াসার দিকে তাকায়। পিয়াসার দুই চোখ জ্বলজ্বল করছে।
“চুপ কর ব্যাটা।দুইটা পোলা মিলে একটা মাইয়ার হাতে মাইর খাইলি শরম করে না?আবার বিচার দেস?পিয়াসা বস তুই। ”
পিয়াসা বসে পড়ে। আজকে আর পড়ায় মন বসে না পিয়াসার। ক্লাসের সবাই গুজগুজ ফুসফুস শুরু করে পিয়াসাকে নিয়ে।
পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে শারমিন ম্যাডাম পিয়াসার দিকে তাকায়। মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে বসে আছে।
স্কুল ছুটির পর পিয়াসা বাড়িতে যায়।জমিরন পিয়াসাকে আসতে দেখে ভীষণ বিরক্ত হয়। এই আপদ তো সহজে ঘাড় থেকে নামবে বলে মনে হয় না। জমিরনের সাথে কথা না বলে পিয়াসা ঘরে যায়।তার খুব খিদে পেয়েছে।
স্কুল ড্রেস চেঞ্জ করে পিয়াসা রান্নাঘরে যায়।পাতিলে ভাত ছাড়া আর কোনো তরকারি নাই।
পিয়াসা এসে দাদীকে জিজ্ঞেস করে, “দাদী,কিছু রান্না করেন নাই?”
“আমি কি তোর লাইগা রানছি?তোর খাওনের চিন্তা আমি করমু öক্যান ক আগে?তোর নানীর লগে গেলি না ক্যান তুই?আমি পারমু না তোরে রাইন্দা খাওয়াইতে।”
“ঠিক আছে।”
পিয়াসা ঘরে ঢুকে যায়। দাদী যখন তরকারি দিবে না তখন আর কি করার।জমিরন এক দৃষ্টিতে তাকায় পিয়াসার দিকে।
এই মেয়ের ত্যাজ তো কম না!
মা’র মতো শইল্যের প্রতি ইঞ্চি ইঞ্চিতে ত্যাজ সব।
এই ত্যাজ ছুটাইতে জমিরনের এই রাতটা লাগবো শুধু। ভুলুর ঘরে নিয়ে ছাইড়া দিবো।
পিয়াসা খানিকক্ষণ শুয়ে থাকে।আজকে আর খেলতে যাবে না।খেলতে গেলেই সবাই পিয়াসাকে মা’য়ের কথা বলবে।গোসল করে পিয়াসা আজকে নিজের কাপড় নিজেই ধোয়।
এই প্রথম নিজেকেই ধুতে হচ্ছে।
কি আশ্চর্য!
মা নেই এক দিন হলো অথচ পিয়াসা মা’কে ছাড়া ও দিব্যি বেঁচে আছে। অথচ এতো দিন তো ভাবতো মা’কে ছাড়া বাঁচতে পারবে না সে।জীবন এরকম কেনো?
সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে ছাড়া ও বাঁচতে শিখিয়ে দেয়।মানুষ আসলে ঠিকই প্রিয় মানুষকে ছাড়া বাঁচে শুধু মরে যায় ভেতরে থাকা সুখী মানুষটা।
পিয়াসা রাতে পড়তে বসে।জমিরন বাহিরে বসে আছে। মালিহাকে ডেকে বললো, “ভুলুরে ঘরে ঢুকা,পিয়াসার রুমে পাঠা।”
“কি কও মা??মইরা যায় যদি?”
“মরবো না।আর মরলেও কি?কে লইবো ওর খোঁজ? মা নাই বাপ নাই আর কে লইবো?
আমি এই মাইয়ারে আমার সামনে দেখতে চাই না।ওরে দেখলেই আমার ওর মা’র কথা মনে পড়ে যায়। ”
মা’য়ের কথামতো মালিহা ভুলুকে ঘরে ঢুকিয়ে বলে পিয়াসাকে গিয়ে কামড়ে আসতে।
পিয়াসা বসে পড়ছিলো।দরজার সামনে ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে পিয়াসা পেছনে তাকায়।ভুলু দাঁড়িয়ে আছে। পিয়াসার গলা শুকিয়ে যায় ভয়।ঘেউ ঘেউ করতে করতে ভুলু পিয়াসার দিকে যায়।পিয়াসা চিৎকার করে লাফিয়ে বিছানায় উঠে। ভুলু ও লাফ দিয়ে বিছানায় উঠতেই পিয়াসা লাফ দিয়ে নেমে ছুটে বের হয়ে যায় রুম থেকে।
জমিরন খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলে, “তোর রুমে আইজ থাইকা ভুলু থাকবো।এই ঘরে তোর জায়গা নাই।আমার বাড়ি থাইকা বাইর হই যা।”
হ্যালো 2441139 পর্ব ২
পিয়াসা থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।সত্যি কি দাদী তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে?
ভুলু ঘরের মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠে আবার।
পিয়াসার বুক ভারী ভারী লাগে।এই পৃথিবীতে তাহলে তার একটা থালার জায়গা ও রইলো না আর?
পিয়াসার অভিমান গাঢ় হয় মায়ের উপর।
তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে বের হয়ে যায় ঘর থেকে।
আর আসবে না সে এই বাড়িতে।কোনো দিন ও না।
কোথায় যাবে পিয়াসা জানে না।শুধু জানে এখানে আর কখনো আসবে না সে।