হ্যালো 2441139 পর্ব ৩৫
রাজিয়া রহমান
চুপচাপ নিজের রুমে বসে আছে আষাঢ়। আজকে তার ক্লাস নেই।চোখে মুখে দুনিয়ার ক্ষোভ।যেনো এখনই ঘটিয়ে দিবে কোনো প্রলয়ঙ্কর ঝড়।
দুই চোখে জ্বলজ্বল করছে ক্রোধ।
মিরা থরথর করে কাঁপছে। মিরার হয়েছে উভয় সংকট। নিজের মান সম্মান রক্ষা করতে,নিজের পিঠ বাঁচাতে আষাঢ়ের কাছে এসে ইনফরমেশন দিলো তার মায়ের পিয়াসার মা’কে কল করার ব্যাপারটা।
“আন্টিকে এগজ্যাক্টলী কি বলেছে ফুফু?”
মিরা মিনমিন করে বললো, “মা অনেক আজেবাজে কথা বলেছে।পিয়াসার মা না-কি তোমাদের স্ট্যাটাস দেখে লোভে পড়ে পিয়াসাকে এখানে পড়তে দিয়েছে যাতে তোমাকে পটাতে পারে।তাছাড়া তোমার আর আমার না-কি বিয়ে এক প্রকার ঠিক হয়ে ছিলো এখন পিয়াসা এসে আমাদের মধ্যে ঝামেলা করছে।এরকম অনেক কিছু বলেছে।”
আষাঢ় আর বসে থাকতে পারলো না।
মহুয়া বেগম থম মেরে বসে আছেন।তার মাথায় অসংখ্য হিসাবনিকাশ ঘুরছে।মহুয়া বেগম জমিদার বংশের মেয়ে।মহুয়া বেগমের বাবা ছিলেন শেষ জমিদার। বিয়ে ও হয়েছে আরেক জমিদার বাড়িতে।অর্থ,বিত্ত,বৈভবের মধ্যে বড় হওয়া মহুয়া বেগমের কাছে বংশ,মর্যাদা অনেক দামী।দামী বলেই এই বয়সে হেঁশেলে ঢুকেছেন যাতে কেউ বলতে না পারে জমিদার বাড়ির আগের সেই ঠাঁট নেই এখন।সেখানে শারমিন রীতিমত তার পরিবারকে তাচ্ছিল্য করে গেছে।
মহুয়া বেগমের পায়ের তালু থেকে মাথা পর্যন্ত গরম হয়ে গেছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শারমিন যেই কথাগুলো বলেছে তার শুনে মহুয়া বেগমের মতো বংশ নিয়ে গৌরব করা মানুষের চুপ থাকা কঠিন।
মহুয়া বেগম শিরিনকে বললেন,”শারমিন আজ যে কথাগুলো বলেছে অহংকার করে, সেই অহংকার যদি আমি না চূর্ণবিচূর্ণ করি তবে আমি ও মহুয়া বেগম না মনে রাখিস।”
শিরিন উৎসাহী হয়ে বললো, “কি করবা মা?”
“সময় হলে দেখবি।”
মহুয়া বেগমের কথার মধ্যখানে আষাঢ় এলো।ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকেই আষাঢ় শিরিনের হাত চেপে ধরে। তারপর মহুয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো, “আজকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।হয় ফুফু এই বাড়িতে থাকবে নয়তো আমি থাকবো।আপনি বলেন কোনটা চান?”
মহুয়া বেগম বুঝলেন আবহাওয়া এখন বিরূপ। তাই শান্ত সুরে বললেন, “তোদের বাড়ি এটা,অবশ্যই তুই থাকবি।শিরিনের বাবার বাড়ি এটা হলেও স্বামীর বাড়ি না।ওর আসল ঠিকানা ওর স্বামীর বাড়ি তাই যদি কাউকে চলে যেতে হয় ও যাবে।কিন্তু কি হয়েছে তা আগে বল।”
“ফুফুকে জিজ্ঞেস কর উনি কেনো পিয়াসার মা’কে কল করে আজেবাজে কথা বলেছেন আমার আর পিয়াসার সম্বন্ধে? পিয়াসার সাথে আমার যেখানে কোনো সম্পর্ক নেই সেখানে ওনার স্পর্ধা কি করে হয় পিয়াসাকে খারাপ কথা বলার।পিয়াসাকে উনি কি ভাবেন?ওনার মেয়েদের মতো নোংরা ভাবেন সবাইকে? আমার মাথা গরম করবেন না ফুফু।সবার সব হিস্ট্রি আমার জানা আছে।”
মহুয়া বেগম শিরিনের দিকে তাকায়। তার এই মেয়েটা এতো জঘন্য হয়েছে। অথচ একটু আগে তার কাছে বলেছে যে সে পিয়াসার মাকে কল দিয়ে বলেছিলো পিয়াসার আর আষাঢ়ের বিয়ে হলে ভালো হতো। ওদের দুজনকে খুব ভালো মানায়।আষাঢ় বড় হয়েছে, বিয়ের বয়স হয়েছে।
তাই নাকি পিয়াসার মা এসব কথা বলেছে।
শিরিন অপরাধী চোখে মায়ের দিকে তাকায়। মা’কে সে অন্য রকম বুঝিয়েছিলো।এখন তো ধরা পড়ে গেলো।
মহুয়া বেগম আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,”ওর বিচার আমি করবো।তুই ভাবিস না।”
আষাঢ়কে অবাক করে দিয়ে মহুয়া বেগম উঠে গিয়ে শিরিনকে একটা কষে থাপ্পড় মারেন।শিরিন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে মা’য়ের দিকে তাকায়।
আষাঢ় আর কথা বাড়ায় না।তার রাগের পারদ একটুও নামে নি।আষাঢ় সোজা বের হয়ে যায় বাসা থেকে।
আজকে তাদের দলীয় একটা মিটিং আছে।আষাঢ় সেখানেও গেলো না।রাস্তায় বিক্ষিপ্তভাবে হাটতে লাগলো।
তার জীবন এতো প্যাঁচানো কেনো?সব কিছুতেই প্যাঁচ লেগে যায়।
পিয়াসাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলো সেদিন থেকেই তো আষাঢ় পিয়াসাকে ভালোবাসে।আষাঢ়ের বয়স তখন ১৭ প্রায়।সেই সময়ের ভালোবাসার চারাগাছটি আষাঢ় নিবিড় পরিচর্যা করে অনেক বড় করে তুলেছে।
ছাদে দাঁড়িয়ে পিয়াসার বাবা আর আষাঢ়ের বাবা যখন গল্প করছিলো, তখন গল্পের মধ্যে আনোয়ার আংকেল জানান পিয়াসার ব্যাপারটা।
এতো ছোট একটা মেয়ের জীবনের এরকম করুণ কাহিনী শুনে আষাঢ়ের বুকের কোথাও একটা গোপন ব্যথার সৃষ্টি হয়।সেই ব্যথা আজ ও কমে নি।ব্যথা সৃষ্টিকারী মেয়েটাকে যতদিন এই বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে না পারবে ততদিন এই ব্যথা প্রশমিত হবে না, বরং চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে।
আষাঢ়ের বুক ফেটে যায় যন্ত্রণায়।আজকে ফুফু যে কাজটা করেছে তাতে পিয়াসা তার থেকে আরো হাজারো আলোকবর্ষ দূরে সরে যাবে।পিয়াসাকে ঘিরে জমে থাকা অনুভূতিদের পূর্ণতা হয়ে যাবে অসম্ভব। অথচ সবগুলো অনুভূতি বুকের র ক্তে র মতো তাজা ছিলো। নিজের শখের মানুষটাকে চোখের সামনে দেখেও তার সামনে যেতে পারে না আষাঢ়, তাকে মন ভরে দেখতে পারে না।
জীবনটা যেনো বিষাদে মোড়া ডিসেম্বর মাস।যেই ডিসেম্বরে জীবন থেকে হারিয়ে যায় সবকিছু। যেই ডিসেম্বর মানুষকে রিক্ত,শূন্য করে দেয়।
“আমার কইতর,তুমি কখনো জানবে না বুকের ভেতর জন্ম নেওয়া অনুভূতিকে হ ত্যা করা কতটা কঠিন।”
আষাঢ়ের গভীর ভাবনার মধ্যেই প্রথম আঘাতটা এসে আষাঢ়ের মাথায় লাগে।
এক মুহূর্তের জন্য আষাঢ় দুই চোখে সর্ষে ফুল দেখতে পায়।
অপ্রত্যাশিত আঘাতের জন্য আষাঢ় প্রস্তুত ছিলো না। ছিলো না বলেই পরের আঘাতটা যখন হাটুতে পড়ে আষাঢ় উপুড় হয়ে পড়ে যায় রাস্তায়।
পরপর আরো কিছু আঘাতে আষাঢ় জ্ঞান হারানোর পর্যায়ে চলে যায়। জ্ঞান হারানোর মুহূর্তে আষাঢ় বহু কষ্টে একবার চোখ খুলে তাকায়। হলুদ টি-শার্ট পরা রাশেদ আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা দাঁড়িয়ে হাসছে।
আষাঢ় জ্ঞান হারায়।
রাশেদ কপালের ঘাম মুছে বললো, “শা লা,অনেক নেতাগিরি দেখাইছস বাইন**।তুই যা কইবি তাই হইবো না-কি! তুই কে এলাকায় মাস্তানি বন্ধ করার?ড্রাগ বিজনেস বন্ধ করার দায়িত্ব তোরে তোর কোন বাপে দিছে?তোর বাপ সরকারের সচিব হইতে পারে, আমার হাত ও কিছু কম লম্বা না।”
রাশেদ তার দলবল নিয়ে চলে যায়। রাস্তার উল্টো দিকের দোকানের মন্নান মিয়া আরো কিছু লোকজন নিয়ে আষাঢ়কে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
মিরাজুল ইসলাম বসে আছেন নার্গিসের বড় বোন নাসরিনের ঘরে। নার্গিস এখানে এসেছে খবর পেয়েছেন তিনি।স্ত্রী যতোই খারাপ হোক সে এখন তার সন্তানদের মা।মিরাজুল ইসলাম জানেন,মা যেমনই হোক, কোনো সন্তানই মা’য়ের সাথে বাবার কোনো ঝামেলা হলে মা’কে বাদ দিয়ে বাবাকে সাপোর্ট করতে পারে না।মা’য়ের দোষ হলেও সন্তান মা’য়ের দলে থাকে।
সকাল থেকে ছেলে মেয়েরা সবাই গোমড়া মুখে বসে আছে খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে।
নার্গিস এলো ঘন্টা খানেক পরে।নাক মুখ ফুলে আছে।সম্ভবত কান্নাকাটি করেছিলো। মিরাজুল ইসলাম কথা না বাড়িয়ে বললেন,”বাড়িতে চলো।”
“কার বাড়ি?”
হ্যালো 2441139 পর্ব ৩৪
মিরাজুল ইসলাম শান্ত সুরে বললেন,”আমাদের বাড়ি।”
“আপনাদের বাড়িতে আমার কোনো জায়গা নেই। যেখান থেকে আমাকে অবলীলায় বের করে দেওয়া যায় সেখানে আমি ফিরবো না।আমার নামে আপনি একটা বাড়ি কিনে রেজিস্ট্রি করে দিবেন তারপর আমি নতুন বাড়িতে ফিরবো।”
মিরাজুল ইসলাম হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন।