হ্যালো 2441139 পর্ব ৩৬

হ্যালো 2441139 পর্ব ৩৬
রাজিয়া রহমান

নার্গিসের দুই চোখে ছাই চাপা আগুন।মিরাজুল ইসলাম শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নার্গিসের চোখের দিকে। এই দুই চোখে এতো ক্রোধ কেনো!
“বাড়ি আলাদা না হলে তুমি যাবে না?”
“না।”
“ভেবে দেখো নার্গিস,যা বলছো ঠান্ডা মাথায় ভেবে বলো।বড় ভাবীর ব্যাপার আলাদা। কিন্তু তোমার আমার বিয়ের আগে তুমি, তোমার ফুল ফ্যামিলি জেনেশুনেই এই বিয়েতে রাজি হয়েছো।আমার মা তোমাদের সবাইকে জানিয়েছে আমাদের ফ্যামিলি জয়েন ফ্যামিলি। মৃত্যু ছাড়া আলাদা বাসস্থান হওয়ার সুযোগ নেই।একান্নবর্তী পরিবারে জীবন কাটানোর মতো মেন্টালিটি তোমার আছে কি-না। তুমি, তোমার বাবা মা সবাই বলেছো এটা কোনো সমস্যা না।”
নার্গিস দ্বিধায় পড়ে যায়। এটা সত্যি কথা। তাদের মতো ফ্যামিলিতে এতো বড় ফ্যামিলি থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসা রীতিমতো স্বপ্নের ব্যাপার।

সেখানে নার্গিসের জন্য যখন জমিদার বংশের ছেলের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ এলো,নার্গিসের বাবা মা সিদ্ধান্ত নিলেন কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না।
নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে হওয়ায় নার্গিস সবসময় স্বপ্ন দেখেছে তার জীবনে এমন কেউ আসবে যে তার সব ইচ্ছে পূর্ণ করবে।অনেক অর্থসম্পদ থাকবে যার।সেই স্বপ্ন পূর্ণ হবে ভেবে নার্গিস ও অমত করে নি।
সে তখনই মাথায় সেট করে নিয়েছিলো একান্নবর্তী পরিবার হলেও সে নিজেকে গুটিয়ে রাখবে তাহলেই তো হবে।
কিন্তু তবুও সব কিছু সব সময় মেনে নেওয়া খুব কঠিন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বিয়ের পর প্রথম প্রথম নার্গিস চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তাকে আরো বেশি গুটিয়ে দিয়েছিলো শাশুড়ী আর ননদ।সবসময় বলতো বড় বউ যেমন শিক্ষিত, তেমনই গুণবতী। ছোট বউটা একেবারে ভালো পড়ে নি।এজন্য জাতের মেয়ে আনা লাগে।ছোটলোকের মেয়ের থেকে ভালো ব্যবহার আশা করা যায় না।
“মুখে বলা অনেক সহজ। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় সহজ হয় না মুখে বলা কথার মতো।তখন মনে হয়েছিলো এডজাস্ট করতে পারবো কিন্তু পারি নি।আমি বলবো না এখানে আমার দোষ নেই।আমার যতটা দোষ ততটাই আপনার মা এবং বোনের।আপনার বোন বিয়ের পরেও কেনো মেয়েদের নিয়ে এখানে পড়ে থাকবে?কখনো সেটা ভেবেছেন?

বিয়ের পর কয়দিন বাবার বাড়ি আসতে দিয়েছেন আপনার মা?
হাতে গুনে বলে দিতে পারবো আমি তা।
আমি জানি আমি কখনো বড় ভাবীর মতো ফ্যামিলির জন্য কিছু করি নি। কিন্তু তবুও প্রতিনিয়ত আঘাত পেয়েছি। সবসময় অপমান আর তিরস্কার করে গেছেন আপনার মা বোন।কখনো আপনি একটা কথা ও বলেন নি তাদের।
আমার আর এসব সহ্য হচ্ছে না। আমি আলাদা বাসা না হলে যাবো না।আপনার মা আছে,বোন আছেন।আপনার সন্তানদের দেখার জন্য মানুষের অভাব হবে না।আমি না থাকলেও চলবে আপনার সংসারে।”
মিরাজুল ইসলাম উঠে দাঁড়ালেন।স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন,”ঠিক আছে। আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমি কখনোই আমার ফ্যামিলি থেকে আলাদা হতে পারবো না।তাতে যদি স্ত্রী ছাড়তে হয়, আমার আপত্তি নেই।”
নার্গিসে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

মিরাজুল ইসলাম হেসে বললো, “নার্গিস, তোমার সাথে সম্ভবত আমার এটাই শেষ দেখা। আজকের পর আমি আর কখনোই তোমাকে ফিরিয়ে নিতে আসবো না।আর না আমার সন্তানরা কেউ আসবে তোমার কাছে। আমি যোগ্য স্বামী হতে পারি নি তোমার। আশা করছি সামনে যে তোমার জীবন সঙ্গী হবে সে যোগ্য হবে।
আরেকটা কথা, যেদিন তোমার মনে হবে ফিরে যাওয়া উচিত, ফিরে এসো।”
মিরাজুল ইসলাম চলে গেলেন।নার্গিস অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মিরাজুল ইসলামের দিকে।
নিজের মনকে প্রশ্ন করে নার্গিস,”নারী কি কখনো পুরুষের আপন হতে পারে?
সম্পর্ক কি এতো ঠুনকো যে চাইলেই এভাবে উপেক্ষা করা যায়!”
কলিজা ছেঁড়া যন্ত্রণায় নার্গিসের দুই ঠোঁট নীল হয়ে যায়।

এই প্রথম তার মনে হয় এর চেয়ে যদি কোনো দরিদ্র পরিবারের বউ হতো তাহলে ও ভালো হতো। অন্তত সম্মানটা তো পেতো।দুনিয়াতে ভোগ,বিলাসের চাইতে সম্মানটাই বেশি জরুরি।
বিকেলের দিকে নার্গিসের মা এলেন। মেয়ের এরকম অহেতুক রাগের কথা শুনে বিরক্ত হয়ে বললেন, “মহিলা মাইনসের এরকম রাগ উচিত না।পুরুষ রাগ করলে হয় বাদশাহ, নারী করলে হয় বে শ্যা।
তুই কোন আক্কেলে জামাইরে ফিরাই দিলি ক আমারে?কই যাইবি তুই? এই বয়সে কি সংসার ভাঙ্গবি?পোলা মাইয়া বড় অইছে না?তোর বাপ আছে যে তোরে খাওয়াইবো?”

“মা আমি কেমনে যাইতাম কও?ওইখানে আমার কোনো দাম নাই।আমার নিজের জামাইয়ের কাছে আমার চাইতে তার ভাবী আগে মূল্য পায়।তুমি জানো না,আমার গায়ে হাতব্ব তুলছে সে।ওইখানে আমার দাম কি?”
নার্গিসের মা বুদ্ধিমতী মহিলা। নিজের মেয়েকে তিনি চেনেন।মেয়ের হাত ধরে বললেন,”সংসার একটা যুদ্ধের জায়গা।ওইখানে নিজের পরিশ্রম দিয়ে মাইনসের মন পাইতে হয়।তুই নিজেই তো আমারে কইছস সবসময় যে তুই সবসময় গা বাচাইয়া চলস।সবকিছুর থাইকা দূরে থাকস।সবকিছুর থাইকা দূরে থাকতে থাকতে তুই জামাইরে মনের থাইকা ও দূরে চলে গেছস।স্বার্থপর মানুষ কোনো দিন সুখ পায় না মা।তোর জা কতো কাম করে তা তো আমি নিজে দেখছি।তোরে কি আমি বুঝাই নাই এরকম চলা উচিত না? এইটা কোনো বিবেকবান মাইনসের কাম না।রজনী তো এখনো এই সংসারে আছে তাইলে তোর সমস্যা কি?

সবার কপাল এক রকম হয় না।জীবনে অনেক কিছু মাইনা নেওয়া লাগে।
না মানতে পারলে নিজেরে কখনো সুখী ভাবতে পারবি না।মাইনা নিলেই জীবন সহজ।”
নার্গিস মা’কে বুঝাতে পারে না আর না পারে নিজেকে বুঝাতে।কি করবে সে এখন?
আষাঢ়ের জ্ঞান ফিরলো ঘন্টা খানেক পরে।ধবধবে সাদা বেডে শুয়ে আষাঢ়ের প্রথমে মনে পড়ে সে এখন কোথায়?আশেপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হয় সে বোধহয় হাসপাতালে। হাসপাতালের কথা মনে পড়তেই হাতে, পায়ে অসম্ভব ব্যথা অনুভব হয়।
নিজের ডান হাতের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য অবাক হয় আষাঢ়। ডান হাত ভেঙে গেছে না-কি!
প্লাস্টার করা কেনো?

আশেপাশে কেমন অসুখ অসুখ গন্ধ।হাসপাতালের এই ফিনাইলের গন্ধ নাকে এলেই আষাঢ় অসুস্থ বোধ করে।
ডাক্তার এলো খানিকক্ষণ পর।আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “কি অবস্থা এখন?ভালোই তো আঘাত পেয়েছো তুমি। এখন কেমন অনুভব করছো?”
“ব্যথা ছাড়া তো আর কিছু অনুভব হচ্ছে না স্যার।”
ডাক্তার হেসে বললো, “দুই দিন থাকা লাগবে হাসপাতালে।”
শুনেই আষাঢ়ের পিলে চমকে গেলো।
করুণ সুরে বললো, “না স্যার,আমাকে যেতে দিন।আমি বাসায় গেলে সুস্থ হয়ে যাবো।”
ডাক্তার হেসে বললো, “দুই দিন অবজারভেশনে থাকা লাগবে। দুই দিন পর আপনার কন্ডিশন বুঝে তারপর রিলিজ দেওয়া যায় কি-না ভাবা যাবে।”

আষাঢ় উঠে বসতে যায়।তখনই টের পায় সে নড়াচড়া করতে পারছে না।
“বাড়িতে কাউকে জানিয়েছেন?”
আষাঢ় মুখ শুকিয়ে যায়। বাড়ি!
কাকে জানাবে সে!
বাবা মা’কে এই মুহূর্তে এসব জানালে তারা তাদের ট্যুর রেখে ফিরে আসবে।তার জন্য বাবা মা’য়ের এই সুন্দর সময় নষ্ট হোক আষাঢ় চায় না।বাড়িতে কে আছে তার আপন?
পিয়াসা!
আপন ভাবলেই সবার আগে পিয়াসার কথা মনে পড়ে কেনো!
আষাঢ় ভেবে পায় না।বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানো বোকামি।
আষাঢ় আর সেই বোকামি করবে না।
বুকের ভেতর যুদ্ধের দামামা বাজুক তবুও সে জলের মতো শান্ত থাকবে।

“বাবা মা বাসায় নেই।আমি কাউকে জানিয়ে ঝামেলায় ফেলতে চাচ্ছি না স্যার।আমি নিজেই নিজেকে সামলাতে পারবো। সমস্যা হবে না।”
“এভাবে তো হয় না আষাঢ়। তুমি কিভাবে নিজের টেক কেয়ার করবে?আমি কি একজন নার্সের ব্যবস্থা করে দিবো?২৪ ঘন্টা থাকবে তোমার সেবার জন্য। “
আষাঢ় হেসে উঠে বললো, “না না,স্যার। কোনো দরকার নেই।আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো আপনি একটুও ভাববেন না।”
ডাক্তার আর কিছু বললো না।
আষাঢ়ের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা হারুন গিয়ে তাদের বাড়িতে জানায়।ডাক্তার হারুনকে বলেছে আষাঢ়কে হাসপাতালে থাকতে হবে।কেউ ওর কাছে থাকা দরকার এখন।
মহুয়া বেগমের ঠোঁটে ক্রুর হাসি ফুটে উঠে। শারমিনের সব অহংকার তিনি ভেঙে দিবে।পিয়াসাকে যেভাবেই হোক আষাঢ়ের বউ বানাবেনই।তারপর পিয়াসার ডানা ভেঙে দিবেন।
এটাই হবে শারমিনের উপযুক্ত জবাব।

মহুয়া বেগম পিয়াসাকে ডেকে বললেন, “আষাঢ় হাসপাতালে ভর্তি শুনছো?”
পিয়াসা হতবাক হলো শুনে। ওনার আবার কি হলো!
মহুয়া বেগম সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো, “শুনো পিয়াসা,তোমার আংকেল আন্টি যে বেড়াতে গেছে তুমি তো জানো।ছেলের খবর শুনলে ওরা ছুটে আসবে।আমি চাই না ওরা ওদের আনন্দের সময়টা নষ্ট করুক।এমনিতে ও রজনীর প্রতি আমি অনেক অবিচার করছি।
হাসপাতালে ও তো কারো থাকা দরকার ওর কাছে।”
পিয়াসা বুঝতে পারে বুড়ির উদ্দেশ্য কি।

মহুয়া বেগম কিছু বলার আগে পিয়াসা বললো, “আমার এসব জানার কোনো আগ্রহ নেই দাদী।আমার পড়া আছে।”
মহুয়া বেগম পিয়াসাকে আঘাত দিতে ইচ্ছে করে বললেন, “তুমি তো ভীষণ স্বার্থপর মেয়ে।তোমাকে রজনী আর সিরাজ নিজের মেয়ের মতো আদর করে অথচ তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের ছেলের প্রতি তোমার কোনো দায়িত্ব নেই?হাসপাতালে কে থাকবে এখন?আমার পক্ষে কি সম্ভব? শিরিনের সাথে আষাঢ়ের সম্পর্ক খারাপ, শিরিন, শিরিনের মেয়েরা কেউ যাবে না।নার্গিস ও নাই। তুমি ছাড়া কেউ নাই আমার নাতিরে দেখার।তুমি কি চাও আমার নাতি সেবাযত্নের অভাবে মরে যাক?
এই তোমার পারিবারিক শিক্ষা? তোমার মা বাপরে তো ভালো জানতাম।তুমি তোমার মা’র পেটের মাইয়া তো?”
পিয়াসার আঁতে ঘা লাগে যেনো।

হ্যালো 2441139 পর্ব ৩৫

চমকে তাকায় মহুয়া বেগমের দিকে।
মহুয়া বেগম মুহূর্তেই চেহারায় অনুশোচনা ফুটিয়ে বললেন,”তোমার হাতে ধরি পিয়াসা।আমার আষাঢ় নয়তো সেবার অভাবে মরে যাবে।তুমি ওর কাছে যাও। দুই দিন ই তো।ও একটু সুস্থ হলে ওরে বাড়িতে নিয়ে আসবো। আমি অনেক আশা করে তোমার কাছে এসেছি বোন।”
পিয়াসা মহুয়া বেগমের কান্নাভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। এই মহিলা কাঁদতে ও জানে!

হ্যালো 2441139 পর্ব ৩৭