হ্যালো 2441139 পর্ব ৪২
রাজিয়া রহমান
নিজের বুদ্ধিতে মহুয়া বেগম নিজেই মুগ্ধ হন।এতো চমৎকার বুদ্ধি তার মাথা ছাড়া দ্বিতীয় কারো মাথা থেকে কখনোই বের হতো না।
ধরি মাছ,না ছুঁই পানির মতো একটা জবরদস্ত প্ল্যান করলেন মহুয়া বেগম।
আর এই প্ল্যানের টোপ হচ্ছে রজনী।
মহুয়া বেগম মিটিমিটি হাসেন। তার মাথায় এতো বুদ্ধি কেনো এখনো!
উফফ!
নার্স বললো, “ কি ব্যাপার দাদী,এতো খুশি কেনো আপনি?”
মহুয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “তুমি আমাকে দাদী বললে কেনো?তুমি জানো আমি কে?তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে পারিবারিক?
আমাকে ম্যাডাম বলবে।’”
নার্স থতমত খায় মহুয়া বেগমের কথা শুনে। এই বয়সী একজন মহিলার থেকে এমন ব্যবহার আশা করে নি সে।
এতো রুড ব্যবহার!
মহুয়া বেগম গম্ভীর হয়ে বললেন, “আমার দুই ছেলে আর দুই ছেলের বউকে ডেকে দাও।”
“ম্যাডাম এখন তো ভিজিটিং আওয়ার না।’”
মহুয়া বেগম বিরক্ত হয়।
গতরাতে পিয়াসা এসেছিলো ওর মা বাবার সাথে। কেমন নাক উচু স্বভাবের মনে হচ্ছিলো তাকে তখন।যেনো মহুয়া বেগমকে দেখতে আসা তার জীবনের একটা লস প্রজেক্ট। মহুয়া বেগমকে এই মেয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে।
মহুয়া বেগম কারো অবহেলা মেনে নেওয়ার মানুষ না।
সারাজীবন মানুষ তাকে নমঃ নমঃ করে এসেছে। সবসময় সবার উপর তিনি ছড়ি ঘুরিয়েছেন।সেখানে এই দুই আঙুলে মেয়ে অঙ্গভঙ্গি তাকে বলে দেয় সে মহুয়া বেগমকে গোনায় ও ধরে না।
ভিজিটিং আওয়ারে মহুয়া বেগম দুই ছেলে আর রজনীর সাথে কথা বলতে ডাকলেন।
সিরাজুল ইসলাম আর মিরাজুল ইসলাম দুজনেই সারারাত জেগে ছিলো।
মা’য়ের জন্য দুই ভাই চিন্তিত।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ছেলেরা আসার আগে মহুয়া বেগম জোরে জোরে শ্বাস নেওয়া শুরু করলেন।
তারপর সরাসরি বললেন, “তোমাদের কাছে আমি একটা আবদার করতে চাই।আমি জানি না আমার হায়াত আছে কিনা। বা আর কতো দিন বাঁচবো।কিন্তু মনে কষ্ট নিয়ে মরতে চাই না।”
সিরাজুল ইসলাম মা’য়ের হাত ধরে কেঁদে ফেলেন।এই দুনিয়ায় মা শব্দটায় আল্লাহ এতো মায়া দিয়েছেন কেনো!
সবার কাছে তার মা সেরা।
অন্যের কাছে যতটা খারাপই হোক না কেনো,কোনো সন্তানের চোখে মা খারাপ হয় না।
“মা,তোমার কিছু হবে না।দরকার পড়লে তোমার চিকিৎসা বাহিরের দেশে নিয়ে করবো আমরা।”
“সবসময় মানুষ চিকিৎসার অভাবে মরে না বাবা।মনের কষ্টে ও মরে।”
রজনী অধৈর্য্য হয়ে উঠছে।বাড়িতে শারমিন আর আনোয়ার আছে।রজনী সকালেই যেতে চেয়েছে কিন্তু যেতে পারলো না।নার্স জানালো তার শাশুড়ী বলেছে তিনি যেনো হাসপাতালে থাকেন।
মহুয়া বেগমের কথার পিঠে কথা খেলা রজনীর বিরক্ত লাগছে।
রজনী শান্ত সুরে বললো, “আম্মা,কি বলবেন বলেন।”
“অসুস্থ হতে না হতে তোমার বিরক্ত চলে আসলো আমার উপর? না-কি মনে মনে চাও আমি যাতে তাড়াতাড়ি মরি।তাইলে তো শান্তি তোমার!”
সিরাজুল ইসলাম বিরক্ত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকান।তার অসুস্থ মায়ের সাথে এমন করে কথা বলায় কিছুটা ক্ষিপ্ত হন তিনি।
রজনী স্বামোর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মুহুর্তেই সেই চোখে ক্রোধ জন্ম নিয়েছে।
রজনীর হাসি পায়।এই পুরুষ মানুষগুলো এমন কেনো?
এক মুহূর্তে এরা পালটি খায়!
মহুয়া বেগম কিছুক্ষণ নাঁকিসুরে কাঁদলেন স্বামীর কথা মনে করে। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি অসহায়। তার আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই আর।
সিরাজুল ইসলাম, মিরাজুল ইসলাম দুই ভাই মা’য়ের হাত ধরে কাঁদতে বসে।
মিরাজুল ইসলাম বললো, “মা,তুমি কেনো এসব বলছো?আমাদের দুই ভাইয়ের কাছে যে পুরো দুনিয়া একদিকে আর তুমি অন্যদিকে এটা সবচেয়ে বেশি তো তোমার জানার কথা।”
মহুয়া বেগমের মনে মনে খুশি হন।রজনী চুপ করে হাসপাতালের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়।
এখন কয়টা বাজে কে জানে?
দশটা না-কি এগারোটা!
বাহিরে ভীষণ রোদ।রজনীর মনে পড়ে স্কুল জীবনের কথা। এমন রোদের মধ্যে তো স্কুলে বান্ধবীরা সবাই মিলে কাঁচা আম ফাটিয়ে খেতেন।কেউ আম আনতো,কেউ লবণ মরিচ।
স্কুলের দেয়ালের সাথে আম আছাড় মেরে ফাটিয়ে খাওয়া হতো লবণ মরিচ দিয়ে।
হঠাৎ করে এই কথা মনে পড়লো কেনো রজনীর!
বুঝতে পারে না সে।
মহুয়া বেগম কি বলছেন!
কিছুই বুঝেন নি নিজের ভাবনার মধ্যে থাকায়।তাই আবারও বললেন,”কি বললেন আম্মা?”
মহুয়া বেগম স্পষ্ট করে বললো, “আমি আষাঢ়ের বিয়ে দেখতে চাই।দুই দিনের মধ্যে কাজী ডেকে আমার নাতির বিয়ে দিতে চাই।”
রজনী চমকে উঠে। শেষ পর্যন্ত তার ছেলেকে উনি বলির পাঁঠা বানাতে চাচ্ছেন কেনো!
রজনী সিরাজুল ইসলামের দিকে তাকায় প্রতিবাদের আশায়। কিন্তু সিরাজুল ইসলাম মাতৃভক্তিতে অন্ধ হয়ে গেছেন।অসুস্থ মা’য়ের কথার উপরে কথা বলার মতো সাহস তার নেই।
উল্টো রজনীকে অবাক করে দিয়ে সিরাজুল ইসলাম বললো, “মা,দুইদিনের মধ্যে পাত্রী পাবো কোথায়?”
“পাত্রী আমার পছন্দ করা আছে,বাড়িতেই আছে।” কথাটা বলে মহুয়া বেগম রজনীর দিকে তাকায়।
রজনীর চোখে আগুন জ্বলে উঠে মুহূর্তেই।কি বলছেন উনি?
কার কথা বলছেন!
মিরাজুল ইসলাম বললেন,”কার কথা বলছো মা?”
“মিরা।আমাদের মিরার সাথে আষাঢ়ের বিয়ে দিতে চাই আমি।দুই দিনের ভিতরে মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না এটা সত্যি কথা কিন্তু মিরা ও মেয়ে হিসেবে খারাপ না।বাড়ির মেয়ে বাড়িতে থাকলো।অচেনা জায়গা থেকে বউ করে আনবো,ভালো খারাপের গ্যারান্টি কি?
তার চাইতে ভালো নিজেদের হাতের উপর বড় হওয়া মেয়ের সাথে বিয়ে হোক।”
সিরাজুল ইসলাম ভীত চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।রজনী দুই চোখ ইটের ভাটার ন্যায় জ্বলজ্বল করছে।
সিরাজুল ইসলামের মনে হলো তিনি অনেক বড় মাইনকা চিপায় ফেঁসে গেছেন।
মা’য়ের কথার বাহিরে তিনি যেতে পারবেন না তা তিনি জানেন।বিশেষ করে মা’য়ের শরীরের এই কন্ডিশন যখন। কিন্তু রজনীর চাওয়া ও তো ভুল না।
রজনী কখনোই এটা চাইবে না।
আর তা যে লজিক্যাল তা তিনি জানেন।
রজনী একবার ও স্বামীর দিকে তাকালেন না।গটগট করে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
সিরাজুল ইসলাম চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন।তার মন চলে গেছে কক্সবাজারের দিন গুলোতে।
কি অদ্ভুত!
কিছুদিন আগেই তো তিনি রজনীকে কথা দিয়েছেন রজনীকে আর কোনো কষ্ট পেতে দিবেন না।অথচ সেখান থেকে ফিরেই তিনি কথার খেলাপ করতে চলেছেন!
পুরুষ মানুষের অন্তর্দ্বন্ধ কেউ কখনো বুঝবে না।
মা ও বউয়ের মধ্যকার টানাপোড়েনে পুরুষ জাতির প্রাণ ওষ্ঠাগত।
রজনী যখন বাড়িতে ফিরে তখন পিয়াসা আনোয়ার চৌধুরীর কাঁধে মাথা রেখে গাল ফুলিয়ে বসে আছে।
আনোয়ার চৌধুরী রজনীকে দেখে হেসে বললো, “দেখো অবস্থা! আমার মেয়েটা এখনো অনেক ছোট রয়ে গেছে বুঝলে।আমরা চলে যাচ্ছি বলে কেমন অভিমান করে বসে আছে।”
রজনী মনের ক্ষত লুকিয়ে হাসিমুখে বললো, “আজকে আমি তোমাদের কিছুতেই ছাড়ছি না।প্লিজ আজকে অন্তত না করো না।”
শারমিনের অস্বস্তি হচ্ছে খুব।কিছুতেই মন টানছে না।তবুও গত রাত থেকেছে সে।শারমিন কিছু বলার আগে রজনীর দিকে তাকালো।রজনীকে ভীষণ বিধস্ত লাগছে।
রজনীর কি কিছু হয়েছে!
রজনী কিছু বলার আগেই শিরিন নাচতে নাচতে নিচে নেমে এলো।চিৎকার করে মিরাকে ডেকে বললো, “কই রে মিরা,খুশির খবর শুনে যা।তাড়াতাড়ি আয়।”
নিরা,মিনি ছুটে এলো।শিরিন নিরাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “তোর বড় মামা কল করেছে।মিরার সাথে আষাঢ়ের বিয়ের কথা বলেছে বড় ভাই।”
হ্যালো 2441139 পর্ব ৪১
রজনী আর সহ্য করতে পারলো না।
এগিয়ে গিয়ে শিরিন এর গালে একটা থাপ্পড় বসায়।
চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “আমি বেঁচে থাকতে কখনোই তোমার এই স্বপ্ন পূর্ণ হবে না।”
শিরিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।