হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৩

হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৩
রাজিয়া রহমান

ছাদের একপাশে পুরোটা কবুতরের বাসা।পিয়াসা একদিন গুনে দেখেছে প্রায় ৪৬ জোড়া কবুতর আছে এখানে।
বিভিন্ন প্রজাতির কবুতর। কিছু আছে উড়তে পারে না মোটেও।ভীষণ কিউট,আদুরে লাগে।
থপথপ করে যখন হেঁটে বেড়ায় দেখতে ভীষণ ভালো লাগে।
এই বাড়ির ছাদটা পিয়াসার ভালো লাগলেও পিয়াসা খুব একটা আসে না।
ভর্তিপরীক্ষা নামক যুদ্ধের ভয়ে পিয়াসা বই রেখে অন্য কোথাও নজর দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না।
তবুও আজকে এসেছে ছাদে।আজকে পিয়াসার মন ভীষণ ভালো।একটু আগে পিংকি বলেছে দুই দিন পর না-কি বন্য আর মিরার বিয়ে।
পিয়াসা ভেবে দেখলো দু’জনেই একেবারে মানানসই হবে।দুজনের কেউ-ই পিয়াসার পছন্দের না তাই তাদের জুটি হলে ভালোই হবে।

দুপুরে ছাদে শীতের আদুরে কোমল রোদে বসে পিয়াসার শরীরে কেমন অলসতা এসে ভর করলো।
পিয়াসার গ্রামের কথা মনে পড়ে। এমন দিনে চারদিক ছেয়ে যেতো শিমুল-পলাশ ফুলে।
শিমুল ফুলের কলিকে লিপস্টিক বলতো ছোট বেলায়।
কতো ছোট বেলার কথা!
ভাবতেই পিয়াসার বুক ভেতর কেমন হুহু করে কেঁপে উঠে। যেনো বুক ভেঙে যাচ্ছে কোনো এক অজানা যন্ত্রণায়।
চোখের সামনে একটা মুখ ভীষণ স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠে।
মুখ তাকে ডাকতে চায় না কিন্তু হৃদয় ফেটে পড়ে যেনো একটা বার তাকে ডাকতে।
পিয়াসা নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরে।
কিছুতেই সে তাকে ডাকবে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার মা আছে।
অন্য কেউ তার মা।
কিছুতেই ডাকবে না পিয়াসা।
মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে পিয়াসা ছাদের মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো।
কোনো এক অজানা বাতাস যেনো সঙ্গে করে মায়ের গায়ের গন্ধ বয়ে নিয়ে আসে।
পিয়াসা কান্না করতে চায়,দুই চোখ যেনো পাথুরে মূর্তি।
সেখানে এক ফোঁটা জল আসে না।
পিয়াসার দম বন্ধ হয়ে আসে।ভীষণ যন্ত্রণায় তড়পাতে থাকে।
একটু যদি কান্না আসতো তাহলে বুকের ক্ষত কমে যেতো।
একটু যদি চিৎকার করে কাউকে বলতে পারতো তাহলে এই দমবন্ধ করা যন্ত্রণা থেকে পিয়াসা মুক্তি পেতো।
আষাঢ়ের ঘুম ভাঙে একেবারে দুপুরে।সচরাচর এতো লেইটে আষাঢ় ঘুম থেকে উঠে না। কিন্তু আজকে একটু বেশি দেরি হয়ে গেলো।

ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো কবুতরকে খাবার দেওয়া হয় নি।
ঝুনি খালা কবুতর ছেড়ে দিয়েছে হয়তো কিন্তু খাবার দিতে পারবে না ঠিক মতো। আগে ওদের খাইয়ে তারপর হাসপাতালে যাবে।দাদীর খোঁজ নিয়ে তারপর আবার রাশেদের খবর নিতে হবে।
ছাদে আসতেই এক মুহূর্তের জন্য আষাঢ়ের মনে হলো যেনো ওর হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেছে।
পিয়াসা কেমন করছে!
পিয়াসার উপর জমে থাকা মনের সব অভিমান, অভিযোগ, রাগ ভুলে গিয়ে আষাঢ় তীরের গতিতে ছুটে গেলো পিয়াসার কাছে।

ঝড়ে আহত ডানা ভাঙা পাখির ছানার মতো পিয়াসা কেমন যেনো পাখা ঝাপটাচ্ছে।
এক বুক জড়তা নিয়ে আষাঢ় পিয়াসার হাত ধরে। পিয়াসা এক নজর তাকায় আষাঢ়ের দিকে।
কোমল গলায় ডেকে আষাঢ় জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে পিয়াসা? এমন ছটফট করছো কেনো?”
“আষাঢ় ভাই,আমি কাঁদতে পারছি না।আমি একটু চিৎকার করে কাঁদতে চাই আষাঢ় ভাই।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমি কতো বছর ধরে কাঁদতে পারি না।একটা নিকৃষ্ট মানুষের কথা মনে পড়লেই আমার বুকের ভেতর শক্ত পাথর হয়ে যায় সবটা জুড়ে। আমি একটু কাঁদতে চাই তার জন্য। মেয়েরা নাকি চাইলেই কাঁদতে পারে যেকোনো অজুহাতে। আমি কেনো পারছি না!”

আষাঢ়ের কেমন বুকের পাঁজর ভেঙে যাওয়া যন্ত্রণা হতে লাগলো। মাথার ভেতর এক ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে।
এই ভীষণ অভিমানী মেয়েটা কি নিদারুণ অভিনেত্রী!
বুকের ভেতর কতটা যন্ত্রণার পাহাড় বয়ে বেড়াচ্ছে কঠোর হয়ে।
তাকে দেখে বুঝার সাধ্য নেই কারো তার বুক ভর্তি যন্ত্রণার কথা।
গোপনে পুড়ছে,পুড়ে ছাই হচ্ছে তবুও কাউকে জানায় নি।পিয়াসার সারা শরীর কাঁপছে ভীষণ।
আষাঢ় বুকের সাথে টেনে নিয়ে বললো, “এমন অস্থির হইও না পিয়াসা।একটু নরমাল হও।অতীত কখনো বদলানো যায় না।তবে চাইলে অতীতের মুখোমুখি হওয়া যায়।

যে অতীতকে ভয় পাচ্ছো,সেই অতীতের সামনে দাঁড়াও।দেখবে বুকের জমা আঘাত আস্তে আস্তে কমে যাবে।”
পিয়াসা ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগলো। আষাঢ়ের টিশার্টের গলা খামচে ধরে কাতর স্বরে বললো, “আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে আষাঢ় ভাই। হাত পা ঝিমঝিম করছে।সারা শরীর যেনো নিঃশেষ হয়ে হয়ে আসছে।”
আষাঢ় বুঝতে পারলো প্যানিক অ্যাটাক করছে ওর।পিয়াসার মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য
আষাঢ় বললো, “তোমাকে একটা মজার জিনিস দেখাই পিয়াসা।আমার এতো কবুতরের মধ্যে একটা স্পেশাল কবুতর আছে।আমার কুইন পিজন। দেখো তো ভালো করে, খুঁজে পাও কি-না!”
পিয়াসা এক মুহূর্তের জন্য তাকালো।ছাদভর্তি কবুতর। এতো কবুতরের মধ্যে স্পেশাল কবুতর কোনটা?”
এদিক ওদিক তাকিয়ে পিয়াসা খুঁজে পেলো না।

দ্বিধান্বিত হয়ে বললো, “কোথায়?পেলাম না তো।নেই এখানে।”
আষাঢ় মুচকি হেসে বললো, “আমি তো দেখছি ঠিকই আছে। আমার চোখের সামনেই আছে আমার কইতর।”
পিয়াসা আবারও চারদিকে তাকায়। একটু আগের শরীর খারাপ অনেকটা কেটে গেছে।এখনো আষাঢ়ের বলা কুইন পিজন খুঁজে পাচ্ছে না।
হুট করে পিয়াসার মনে হলো আষাঢ় যেনো ডাবল মিনিংফুল কথা বলছে।
একটু আগের অসহায়ত্ব,দুর্বলতা মুছে গিয়ে চেহারায় ফুটে উঠলো কঠোরতা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কোথায়?দেখান আমাকে।এক্ষুণি দেখাবেন।রাইট নাও।”
আষাঢ় মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ফর্সা মুখখানা রাগে লাল টমেটোর রঙ ধারণ করেছে।বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকা মানবীর দিকে তাকিয়ে আষাঢ়ের মনে হলো এই বুঝি রবী বাবুর বলা সেই চোখ, যেই চোখে মানুষ নিজের সর্বনাশ দেখতে পায়। সে কখনোই এই মায়া কাটাতে পারবে না।
এক জীবন তপস্যা করলেও এই মায়া কাটবে না।

আষাঢ়ের বুক কাঁপে শঙ্কায়। তার জীবনের সর্বনাশ করা এই সর্বনাশিনীকে যদি সে নিজের করে না পায়!
আষাঢ় বাঁচতে পারবে না।কিছুতেই না।
পিয়াসার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। দুই চোখে স্পষ্ট ঘৃণা ফুটে উঠে। এই লোকটা চূড়ান্ত রকমের অভদ্র।
ভীষণ ভীষণ অসভ্য একটা লোক।একটু আগেই পিয়াসার শরীর খারাপের সময় এই লোকটাকে পিয়াসার কাছে এক মুহূর্তের জন্য হলেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিলো।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে ভুল ভেবেছে।এই লোকটা ভীষণ নিচ স্বভাবের একজন মানুষ।
পায়ে পায়ে এগিয়ে আষাঢ়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় পিয়াসা।
চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, “আপনার মতো অভদ্র মানুষ আমি এই দুনিয়ায় দুটো দেখি নি।আমাকে দুর্বল ভেবে আপনি আমার সাথে ফ্ল্যার্ট করছিলেন?আপনি ভীষণ রকম ক্যারেক্টরলেস একজন মানুষ।”
এক মুহূর্ত আর দাঁড়ালো না পিয়াসা।দুপদাপ পা ফেলে নেমে গেলো।
আষাঢ়ের মনে হলো এর চেয়ে যদি পিয়াসা তাকে দুটো থাপ্পড় দিতো তবুও তার এতো কষ্ট হতো না।
পিয়াসার কাছে সে এতটা ঘৃণ্য!

আষাঢ়ের দুই কান দিয়ে গরম ভাঁপ বের হচ্ছে।
এতটা অপমান কি ওর পাওনা ছিলো!
গলার কাছে কাঁটার মতো আটকে রইলো কিছু একটা।
তাই বলে ক্যারেক্টরলেস!
আষাঢ় ভাবতে পারে না। কখনো কোনো মেয়ে ফ্যানের সাথে একা দাঁড়িয়ে ছবি তোলে নি সে,পাব্লিক বাসে কখনো কোনো নারীর পাশে বসে নি।কখনো গার্লস স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নি।অজস্র সুযোগ থাকার পরেও কখনো মিরার দিকে তাকিয়ে দেখে নি।

হ্যালো 2441139 পর্ব ৪২

দৈনিক শত শত মেয়ের মেসেজ পেয়েও কখনো রিপ্লাই করে নি।সেই একদিন একটা হলুদিয়া পাখিকে দেখার পর নিজের মনপ্রাণ সবখানেই শুধু তাকেই রেখেছে সেখানে আজ কমপ্লিমেন্ট পেলো সে চরিত্রহীন!
আস্তে আস্তে আষাঢ়ের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।
পিয়াসা নিচে এসে সোজা নিজের রুমে ঢুকে যায়।তার কেমন লাগছে যেনো!
চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই কালো রাতের ছবি।ছোট ফুফু আর বড় ফুফা!
পিয়াসার সেই থেকেই মনে হয় সব পুরুষই এমন। পিয়াসা কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না।
পিয়াসা জানে সে ভুল, সবাই এক রকম হয় না।কিন্তু সেই রাতের স্মৃতি পিয়াসা নিজের মাথা থেকে বের করতে পারে না।
সেই বিচারে তার কাছে আষাঢ় ও অপরাধী।

হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৪