হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৪

হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৪
রাজিয়া রহমান

মানুষ অনেক পরিকল্পনা করে কিন্তু বাস্তবায়িত হয় সেটা যেটা সৃষ্টিকর্তা চান।তেমনই পিয়াসা যতই আষাঢ়কে অপছন্দ করুক সৃষ্টিকর্তা যখন যার সাথে তার ভাগ্য মিলিয়ে রেখেছে সেটা খন্ডাবে কে?
নিজের রুমে বসে পিয়াসা ভাবছিলো সে এমন কেনো!
কেনো সে কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না!
কেনো সব পুরুষকে তার কাছে শাহেদ,সাদেক,কাদেরের মতো মনে হয়!
কেনো মনে হয় সব পুরুষই আসলে ভেতরে ভেতরে নরপশু!
কেনো এই ধারণা থেকে বের হতে পারে না সে!
পিয়াসার অস্থির লাগে।একটু আগে সে আষাঢ়কে যে কথাগুলো বলে এসেছে সেসব কেনো বলেছে!
আষাঢ় তো তাকে রিল্যাক্স করতে চেয়েছিলো,তাকে হেল্প করতে চেয়েছিলো।কিন্তু মন কেনো বারবার বলছে সব পুরুষই জঘন্য। ওদের ভেতরের রূপ জঘন্য!

পিয়াসার অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়।
এই ট্রমা কি কখনো দূর হবে না তার?
রজনীর রুমে শারমিন, আনোয়ার চৌধুরী,সিরাজুল ইসলাম,রজনী চারজন বসে আছে।
ঝুনি খালা চায়ের কাপ নিয়ে আসলো। সবার কঠোর মুখের দিকে তাকিয়ে ঝুনি দ্রুত বের হয়ে গেলো।
বাড়ির অবস্থা সুবিধার না।ঝুনির ভয় লাগে।
একটা নাগিনী তো নিজের জায়গা শক্ত করে ফেলছেই এখন না-কি মেজো নাগিনী ও আসবে এই বাড়ির বউ হয়ে।
এদের মা মেয়েদের যে-ই বিষ,ছোবল দেওয়া লাগবে না এরা যেদিকে তাকাবে সেদিকেই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
রজনী উঠে এসে শারমিনের হাত ধরলো। শারমিনের মনে হচ্ছে এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতি তার জন্য এর আগে আর আসে নি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একটু আগেই রজনী তাকে বলেছে সে আষাঢ়ের জন্য পিয়াসাকে চায়।
এই বাড়ির অভ্যন্তরীণ যে-ই অবস্থা, আষাঢ় যতই ভালো ছেলে হোক শারমিন জেনেশুনে কিছুতেই মেয়েকে এই আগুনে পুড়তে দিতে পারে না। তার উপর শিরিন আছে।যে তার মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া।
কিন্তু আবার রজনীর জন্য ও শারমিনের কষ্ট লাগে।
মহুয়া বেগম বলেছেন রজনী যদি দুই দিনের মধ্যে মেয়ে খুঁজে নেয় তাদের স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে তাহলে রজনীর পছন্দ করা মেয়ের সাথে আষাঢ়ের বিয়ে হবে আর নয়তো মিরার সাথে বিয়ে দিবেন মহুয়া বেগম।
“পিয়াসাকে আমার সেই ছোট বেলা থেকেই পছন্দ শারমিন। মনে মনে সবসময়ই একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো তোর মেয়েকে নিজের মেয়ে করে রাখার। কথাটা তোকে এতো শীঘ্রই জানাতে হবে এটা ভাবনাতেও ছিলো না।ভেবেছিলাম পিয়াসা অনার্স শেষ করলে তারপর বলবো।কিন্তু এখন যেহেতু কথা বলতেই হচ্ছে তখন আর অপেক্ষা করতে পারলাম না।আমি তোর কাছে ভিক্ষা চাইছি তোর মেয়েটাকে।আমার, আমার আষাঢ়ের জীবন তছনছ হয়ে যাবে নয়তো।”

রজনীর কথা শুনে শারমিন বিস্মিত হয়ে বললো, “তা-ই বলে তুই বলছিস আমার মেয়েকে আমি বলির পাঁঠা বানাবো!তোদের পারিবারিক কোন্দলের জন্য আমার মেয়েকে কেনো ভুক্তভোগী হতে হবে! কিছু মনে করিস না,তোরা হয়তো অনেক বড়লোক, খান্দানী বংশ,যে কোনো মেয়ের বাবা মা’য়ের মতে সোনার হরিণ হতে পারে কিন্তু আমার কাছে তা মনে হয় না। তোদের ফ্যামিলিতে মহিলাদেরকে একটা রোবট ছাড়া কিছুই ভাবা হয় না।যে-ই আগুনে তুই পুড়ে ছাই হচ্ছিস তুই চাচ্ছিস নিজ হাতে আমার কলিজার টুকরোকে আমি সেখানে নিক্ষেপ করবো?
এর আগে আমার মরণ হওয়া ভালো রজনী।”
শারমিনের দুই চোখ ভিজে উঠে। তার ছোট মেয়েটা এই পরিবারের সাথে কখনোই তাল মেলাতে পারবে না। সংসার নামক রণক্ষেত্রের রণকৌশল তার ছোট্ট পিয়াসা জানে না।
রজনীর কলিজা ছেঁড়া যন্ত্রণা হতে লাগলো। শারমিন ভুল বলে নি। সিরাজুল ইসলাম শুকনো মুখে বসে বসে নখ খুঁটতে থাকেন।তার কিছুই করার নেই।

আনোয়ার চৌধুরী স্ত্রীর দিকে তাকান।এইখানে স্ত্রীর সাথে তার মতামত ভিন্ন।
আষাঢ়কে তার কখনোই এমন সংকীর্ণ মানসিকতার মানুষ বলে মনে হয় নি। আর না তো আষাঢ় তার বাবা চাচার মতো মানসিকতার মানুষ।
অনেক বছর আগে প্রথম যেদিন এই বাড়িতে এসেছিলেন তিনি।ছাদে সিরাজুল ইসলামের কাছে পিয়াসার ব্যাপারে বলছিলেন।
দুই বন্ধুর কেউ-ই খেয়াল করে নি আষাঢ় পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। যখন খেয়াল হলো পেছনে তাকিয়ে দেখে আষাঢ়ের দুই চোখ টলমল করছে।
আষাঢ় সম্ভবত তখন ইন্টারমিডিয়েট দিবে।
এই বয়সী একটা ছেলে নিজের বাবার সামনে কখনোই কাঁদে না খুব কষ্ট না পেলে।আষাঢ় তো ছিলো ভীষণ ম্যাচিউর।
তবুও সে কাঁদছিলো।
আনোয়ার চৌধুরীর সেদিন মনে হয়েছিলো তার পরে তার মেয়ের কষ্টে কাঁদার জন্য আরেকটা মানুষ তিনি পেয়েছেন।
আনোয়ার চৌধুরী খেয়াল করলেন রজনীর দুই চোখে অসম্ভব যন্ত্রণা আর হতাশা ফুটে উঠেছে।একটা মানুষ সংসার জীবনে এসে কোনো কিছুই পেলো না।তার শেষ ভরসা ছেলের বিয়ে ও তার ইচ্ছের বাহিরে হ্য যদি তাহলে তার জীবনে সুখ কোথায়?

সিরাজুল ইসলাম চুপ করে আছেন আগের মতো। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে যেতে।যার নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই,ন্যায় অন্যায় জেনে ও অগ্রাহ্য করার সাহস নেই সে আসলে সংসার ধর্ম পালন করার যোগ্য না।
কিন্তু মানুষ চাইলেই সবকিছু করতে পারে না।
রজনী দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললো, “তোর কথা সম্পূর্ণ ভুল না।কিন্তু এখানে আমার আর পিয়াসার মধ্যে একটা সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে শারমিন।আষাঢ় ওর বাবার মতো মেরুদণ্ডহীন ছেলে নয় আর আমি মহুয়া বেগমের মতো শাশুড়ী নই শারমিন।”
সিরাজুল ইসলামের চোয়াল ঝুলে গেলো স্ত্রীর কথা শুনে। একজন স্বামীর জন্য এই কথাটা কতটা ব্যর্থতার তা তিনি ভীষণ বাজেভাবে অনুভব করতে পারছেন।কিন্তু এখানে মৌনতা বজায় রাখা ছাড়া কিছুই করার নেই।
রজনী মুচকি হেসে বললো, “আমার মেয়েকে নিয়ে আমি এই চরম বাজি ধরতে চাই না রজনী।”
আনোয়ার চৌধুরী কোমল গলায় বললো, “আমি যদি বলি আমি চাই শারমিন।”
শারমিন ভীষণ বাজেভাবে চমকায়।নিজের স্বামীর থেকে এমন কথা শারমিন প্রত্যাশা করে নি।

আনোয়ার চৌধুরী সিরাজুল ইসলামের দিকে তাকায়। সেবার প্রথম যখন দুই বন্ধুর আবার একের অন্যের সাথে দেখা হয় সেদিনই তো দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো দুজনের বন্ধুত্বকে তারা আত্মীয়তায় রূপ দিবেন।
যাতে পিয়াসার ভবিষ্যত জীবনে আর নতুন করে কোনো কষ্ট না আসে।
সিরাজুল ইসলাম আজকে ভীষণ অসহায়।
শারমিনের চোখ ধীরে ধীরে কঠোর হয়ে আসে।দৃঢ় স্বরে বললো, “আমার মেয়ের জীবন নিয়ে আমি কাউকে দ্বিতীয় বারের মতো ছেলেখেলা করতে দিবো না।সে যদি তুমি হও তাও না।”
আনোয়ার চৌধুরী হেসে বললো, “দেখো শারমিন, তুমি যেমন ওর মা তেমনই আমি ওর বাবা।আর মেয়ের উপর তোমার যতটা অধিকার আমার ও ততটাই।

পিয়াসা ছোট না।ও নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নোট জানে এখন।আমরা না হয় ওর উপর ছেড়ে দিই ওর সিদ্ধান্ত কি।
তবে আমি এটুকু তোমাকে বলতে পারি আষাঢ় যথেষ্ট পরিমাণ ম্যাচিউর এবং উন্নত মানসিকতার মানুষ।ওর মতো সাহসী ছেলে এই সময়ে এসে পাওয়া খুবই দুরূহ।”
শারমিন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আনোয়ার চৌধুরী আর বেশি কিছু বললেন না।কেননা রাশেদের ব্যাপারটা তিনি তার এক ডাক্তার বন্ধুর মাধ্যমে ঘটনাচক্রে জানতে পেরেছেন।রাশেদের পরিবারের সম্পূর্ণ দায়ভার আষাঢ় নিজে নিয়েছে। তখন থেকেই আষাঢ় তার কাছে অনেকটা হিরো হয়ে গেছে।
পিয়াসা যখন নিজের মধ্যকার কমপ্লিকেশন নিয়ে ভাবছে বাবা মা দুজন তখন তার কাছে আসে।মুহূর্তেই পিয়াসা নিজের মধ্যকার দ্বিধাকে সরিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে।এই দুজন মানুষকে সে কখনোই নিজের ভেতরের অনুভূতি জানাতে চায় না।

তা না হলে তাদের মনে হতে পারে পিয়াসা তাদের এখনো আপন করতে পারে নি।
হাসিমুখে পিয়াসা বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “দুই বন্ধু আর দুই বান্ধবী মিলে খুব আড্ডা দিয়েছো মনে হচ্ছে।”
আনোয়ার চৌধুরী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “বাবা,তোর বাবা যদি তোর কাছে কিছু চায় তুই কি তাতে অমত করবি?”
শারমিন কঠোর গলায় বললো, “তুমি এভাবে ওকে ইনফ্লুয়েন্স করতে পারো না।”
আনোয়ার চৌধুরী হাসেন।এই নারী জাতি এমন কেনো তিনি জানেন না।আষাঢ়ের দাদীকে নিয়ে শারমিনের মনে ক্ষোভ আছে তাই বলে আষাঢ়কে কেনো সে ভুল ভাবছে!
শারমিন কেনো এটা ভাবছে না অন্য কোথাও মেয়েকে বিয়ে দিলে কোনো না কোনো দিন সবাই জানবেই পিয়াসার অতীত সম্পর্কে। তখন তারা যদি ব্যাপারটা ভালো ভাবে না নেয়?
মেয়েকে যদি কথার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে!

এরচেয়ে কি ভালো নয় যারা জেনে শুনেই সবটা মেনে নিবে?
শারমিন থমথমে সুরে বললো, “তোর রজনী আন্টি আষাঢ় আর তোর বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।এই বিয়েতে আমার মোটেও মতামত নেই।কিন্তু তোর বাবা চায় এখানে তোর বিয়ে হোক।তোর বাবার কাছে মনে হচ্ছে আষাঢ় ভীষণ ভালো হবে তোর জন্য।”
পিয়াসা চমকায়।বাবা মা তার বিয়ে নিয়ে ভাবছে!
আনোয়ার চৌধুরী কোমল গলায় বললেন, “তুই যা বলবি তাই হবে।তবুও বাবা হিসেবে এটুকু বলতে পারি, একজন বাবার কাছে তার মেয়ে রাজকন্যা হয়।আর সেই বাবা তার মেয়েকে তার হাতেই তুলে দিতে চায় যে তার মেয়েকে ঠিক রানীর মতো করে রাখতে পারবে।”

পিয়াসা বাবার দিকে তাকায়। এই মানুষটা তাকে যেভাবে বাবার আদর দিয়েছে কোনো জন্মদাতা বাবা তেমন আদর,স্নেহ করে কি-না তার সন্দেহ আছে।
লোকে বলে মেয়েরা সবসময় বাবার ন্যাওটা হয়।আজ পিয়াসার মনে হচ্ছে সে নিজেও বুঝি তা।
আজ সে যে সিদ্ধান্ত নিবে তাতে হয় বানা জিতবে না হয় মা জিতবে।কিন্তু পিয়াসার মন কেনো চাইছে বাবা জিতুক?
আষাঢ়কে সে অপছন্দ করে ঠিকই কিন্তু তার চাইতে হাজার গুণ বেশি বাবাকে ভালোবাসে।
যেখানে নিজের বাবা জন্মের পর তাকে দেখেই নি এক নজর আর না কখনো কন্যা বলে স্বীকার করেছেন সেখানে এই মানুষটা তার জীবন আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলেছেন।
পিয়াসা মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার আপত্তির আসল কারণ কী মা?”
শারমিন আহত স্বরে বললো, “মহুয়া বেগম, শিরিন কেমন তুই নিজেই জানিস।আষাঢ় যতোই ভালো হোক,বিয়ের পরে ও যদি ওর বাবার মতো হয়ে যায়!
আমি কেনো তোকে এতো বড় রিস্কে ফেলবো!”

হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৩

পিয়াসা হাসে।হেসে বললো, “কিন্তু মা,বাবাকে যে আমি কষ্ট দিতে পারবো না।”
“মা’কে দিতে পারবি তাহলে?”
“না মা,কিন্তু এটা তুমি ও জানো,বাবা ও জানে,আমি ও জানি আষাঢ় ভাই ওনার ফ্যামিলির মানুষের মতো না।তোমার শঙ্কা অমূলক।”
আনোয়ার চৌধুরী মেয়ের কপালে চুমু খায়। শারমিন ঠিকই বুঝতে পারবে তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নেন নি মেয়ের ব্যাপারে।

হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৫