হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৯
রাজিয়া রহমান
আষাঢ়ের সাথে তার সম্পর্ক যেমনই হোক,এই সম্পর্ক যে অনেক দামী পিয়াসা প্রথম দিনেই তা ভীষণ ভালো করে বুঝতে পেরেছে।
রান্নার কথা শুনে শিরিন দ্বিমত করতেই সিরাজুল ইসলাম বললো, “পিয়াসা এখন এখানের অতিথি না শিরিন,ও এই বাড়ির বড় বউ,ও আষাঢ়ের বউ।
আষাঢ় আমার বড় ছেলে।এই বাড়ির বড় ছেলে।তেমনই আষাঢ়ের বউ এই বাড়ির বড় বউ,ওর যখন শখ হয়েছে তোর কাছে রান্না শেখার তো শেখাতে হবে তোকেই।”
পিয়াসা এক নজর আষাঢ়ের দিকে তাকায়। যেই মানুষটার খাতিরে সে এতো মর্যাদা পাচ্ছে সে-ই মানুষটার সাথেই তো তার এক জনমের দূরত্ব।
খাওয়ার পর পিয়াসা ড্রয়িং রুমে বসে। রুমে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই তার।একটা পুরনো ম্যাগাজিন কোলে নিয়ে টিভি অন করে সোফায় পা তুলে বসে।
টিভিতে গোপাল ভাঁড় ছেড়ে দিয়ে ম্যাগাজিনে চোখ বুলায়।ঢাবিতে এডমিশন টেস্ট দিয়েছে,রেজাল্ট বের হবে আরো সপ্তাহ খানেক পরে। পিয়াসা সেই কথা মনে পড়তেই বুক কাঁপে।
কে জানে কি হবে রেজাল্ট!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিয়াসার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়।
চান্স না হলে পিয়াসা ভীষণ আঘাত পাবে।
সকাল থেকে একটানা ল্যাপটপের সামনে বসে আছে নির্জন।মাঝেমাঝে তার মনে হয় একটা দমকা হাওয়া তার পুরো জীবন এলোমেলো করে দিয়ে গেলো।
পুরো রুমে মৃত্যুপুরীর মতো অন্ধকার। দরজা, জানালা সব বন্ধ করে নির্জন বসে আছে।ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটা আর্টিকেল ওপেন করা।সবচেয়ে ভয়াবহ আত্মহত্যা সম্পর্কে।
ইদানীং মৃত্যু তাকে ভীষণ টানে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এক জঘন্য মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে নিশ্বাস নিতে ও ভীষণ কষ্ট হয় নির্জনের।
মিনি এসে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে।গতরাতে সে বোনের সাথে ঘুমিয়েছে।
সকাল থেকে যতবার দরজা নক করেছে কোনো সাড়া পায় নি।
মিনির ভালো লাগছে না।
এবার জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগে।নির্জন নাশতা ও করে নি নির্জন।বিয়ের পর থেকে আর ডাইনিং এ খেতে বসে না সে।
নির্জন উঠে দরজা খোলে।
মিনি হুড়োহুড়ি করে রুমে ঢুকে যায়। নির্জনের দিকে তাকিয়ে হাঁফ ছাড়ে।
একই রুমে দুজন বোবা প্রাণী থাকলেও বোধহয় ইশারায় কথা বলার চেষ্টা করে অথচ তাদের কোনো কথা হয় না।
মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা মিনি সহ্য করতে না পেরেই গতরাতে বোনের কাছে ঘুমিয়েছে।
জলজ্যান্ত একজন মানুষ পাশে থেকেও যদি বোবা হয়ে থাকা লাগে তাহলে প্রাণ বাঁচে না।
মিনিকে অবাক করে দিয়ে নির্জন বললো, “সবচেয়ে ভয়াবহ আত্মহত্যা কেমন জানো মিনি?”
মিনির আত্মা কেঁপে উঠে শুনে।কি বলছে এই মানুষটা!
মিনি এগিয়ে এসে নির্জনের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি বলছেন এসব?”
“যতগুলো আর্টিকেল পড়লাম,একটা ও ভয়াবহ মনে হয় নি। এগুলো তো সাধারণ মনে হয়। বিষ খাওয়া,গলায় ফাঁস দেওয়া, সায়ানাইড খাওয়া।আমি খুব ভয়াবহ, যন্ত্রণাদায়ক কিছু খুঁজছি মিনি।”
নির্জন নির্বিকারচিত্তে উত্তর দেয়।
মিনির দম বন্ধ হয়ে আসে শুনে।কান্নায় গলা রুদ্ধ হয়ে আসে।
“কি বলছেন এসব!কেনো বলছেন!আপনি এসব বললে আমার খুব ভয় হয়।”
নির্জনের হাত ধরে কেঁদে উঠে মিনি।
মিনির কান্না নির্জনকে স্পর্শ করে না। তাকে ছুঁয়ে যায় সেই মতো মধ্য রাতে দেখা বাবার অবিশ্বাস্য চোখের চাহনি, ভাইবোনের লজ্জায় অবনত দৃষ্টি, মায়ের নির্বাকতা।
মিনি নির্জনের দুই পা জড়িয়ে ধরে বললো, “আপনি এসব বলবেন না প্লিজ নির্জন ভাই, আমি সহ্য করতে পারি না।”
“কি দোষ ছিলো আমার সেদিন! আমি তো কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তোর রুমে যাই নি।তাহলে কেনো এমন অপবাদ পেতে হলো আমার? আজীবন সবাই জানবে নির্জন দুশ্চরিত্র ছেলে।অথচ এই ভয়ে মা সবসময় আমাকে তার আঁচলের নিচে রেখে বড় করেছে।
আমি মানুষ হতে পারলাম না।”
মিনির ইচ্ছে করলো সত্যিটা বলে দেয় সবাইকে। কিন্তু গলা দিয়ে আসে না।
কেনো সেদিন রাজি হলো!
গলায় কাঁটার মতো সত্যি আটকে থাকে মিনির।
দুপুরের রান্নার সময় পিয়াসা সোজা গিয়ে শিরিনের রুমে হানা দিলো।শিরিন সবেমাত্র শুয়েছে।
পিয়াসা গিয়ে মধুর সুরে ডাক দিয়ে বললো, “ফুফি!আমি এসেছি।”
শিরিন ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বললো, “কেনো এসেছো?কী সমস্যা তোমার?”
“আপনি রান্না করবেন,আমি রান্না শিখবো।চলেন ফুফি।”
শিরিনের মুখ তেতো হয়ে গেলো পিয়াসার কথা শুনে। এই মেয়ে তো আস্তা ত্যাঁদড়!
এতো ত্যাঁদড় দেখে মনে হয় না।
শিরিন কিছু বলার আগেই নিরা জবাব দিলো। পিয়াসাকে তার মায়ের রুমে আসতে দেখে নিরা ও এলো রুমে। এই মেয়েকে নিরার কাছে বিষের মতো লাগছে।
“মা কোনো রান্না করতে পারবে না।তুই গিয়ে তোর শাশুড়ীর কাছে রান্না শেখ,যা।”
পিয়াসা শান্ত সুরে বললো, “তুই না,আপনি বলবা।বয়সে আমি তোমার ছোট হতে পারি কিন্তু সম্পর্কে এখন আমি তোমার ভাবী হই।তাই আপনি করে বলতে শেখো এখন থেকেই।তা না হলে বেয়াদবি করার শিক্ষা আমি ভালোই দিতে পারি।মুদ্রার এক পিঠ দেখেছো এতো দিন কেবল, অপর পিঠ দেখানো শুরু সবেমাত্র।”
নিরা মা’য়ের দিকে তাকায়। এই মেয়ের স্পর্ধা দেখে নিরা হতবাক।
শিরিন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। পিয়াসা শিরিনের হাত ধরে টেনে নামায়।তারপর সোজা রান্নাঘরে নিয়ে যায়।
শিরিনকে রান্নাঘরে আসতে দেখে ঝুনির ভীষণ আনন্দ হলো।এতো দিনে বিষদাঁত ভাঙার মতো কেউ এলো তবে!
শিরিন গোমড়া মুখে চুলা ধরায়।তার সারা শরীর কেমন জ্বালাপোড়া করছে।
সারাক্ষণ এসি রুমে শুয়ে-বসে থাকতে থাকতে সামান্য গরম এখন শরীর সহ্য করতে পারছে না।
শিরিনের মনে হচ্ছে কেউ যেনো তার শরীরে মরিচ লাগিয়ে দিয়েছে।
এতো জ্বালাপোড়া করছে তাই।
এক চুলায় ভাত বসিয়ে অন্য চুলায় মাছ বসালো।বহু বছর পর রান্না করছে শিরিন। হাতে গুনে ও বলতে পারবে না শেষ কবে রান্নাঘরে ঢুকেছে।
না,রান্নাঘরে সে অনেক বারই ঢুকেছে সবার ভুল ত্রুটি ধরতে,ঝামেলা করতে কিন্তু রান্না করতে!
তা মনে নেই।
শিরিনের মনে হচ্ছে সব কিছু সে ভুলে গেছে রান্নাবান্নার।
রান্নাবান্না যেনো একটা মহাযুদ্ধ।
এই যুদ্ধে একমাত্র সৈনিক শিরিন।
সংসারের কাজকর্ম করার ভয়ে শিরিন বাপের বাড়ি খুঁটি গেড়ে বসে ছিলো এতো বছর ধরে। আজ সেই খুঁটি নড়বড়ে করে দিয়েছে এই এক রত্তি মেয়ে!
এটা শিরিনের জন্য কতটা অপমানজনক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সবচেয়ে বড় কথা তার মা ও কোনো প্রতিবাদ করলো না!
মা সম্ভবত প্রতিশোধ নিচ্ছে এখন।যখন বড় ভাবী,মেজো ভাবী কেউ ছিলো না।তখন তাকে রান্না করতে বলায় সে রাজি হয় নি।মা হয়তো তাই এখন সুযোগ পেয়ে তামাশা দেখছে তার।
শিরিনের নাকের জল, চোখের জল মিলেমিশে একাকার হলো।ঘামে,গরমে,কান্নায়,অভিমানে!
নাক মুছে খুন্তি হাতে নিলো তরকারি নাড়ার জন্য।
পিয়াসা পাশ থেকে বললো, “ফুফি,প্লিজ হাইজেন মেইনটেইন করুন।আপনি নাক মুছে সেই হাতে খুন্তি নিলেন হাত না ধুয়েই?
হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৮
ছি!জমিদার বাড়ির মেয়েরা যে এতো অপরিচ্ছন্ন তা তো জানাতাম না।”
শিরিনের ইচ্ছে করলো গরম খুন্তি এই মেয়ের গালে চেপে ধরে। কিন্তু পারলো না।
মনে মনে ভাবলো, “খুব উড়ছো না?এক দিন উড়তে উড়তে দেখবে দুই ডানা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছি।সেদিন এমন ভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে যে তাকাতে ও পারবে না।
খুব শীঘ্রই সেই দিন আসবে।”