হ্যালো 2441139 পর্ব ৫০
রাজিয়া রহমান
উত্তপ্ত দুপুরের ভ্যাঁপসা গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন।পিয়াসার ভীষণ হাঁসফাঁস লাগছে।
খাবার টেবিলে মাথার উপর নিঃশব্দে ঘুরছে।
পিয়াসা পাশের চেয়ারে দিকে তাকায়। আষাঢ় কঠোর মুখ করে বসে আছে।
কিছু কি হয়েছে?
নির্জন ছাড়া পরিবারের সবাই উপস্থিত এখানে।আষাঢ়ের ডান পাশের চেয়ারটা নির্জনের ছিলো। আপাতত ওটা খালি পড়ে আছে।
রজনী আর নার্গিস সবাইকে খাবার বেড়ে দিলো।
শিরিনের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আছে।রান্না যে জঘন্য হয়েছে তা জানার জন্য রকেট সায়েন্স লাগে না।শিরিনের মনে হলো সে যেনো কুমির ভর্তি খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুমিরকে এসে বলেছিলো,” আয় খা আমাকে।”
তা না হলে কোন কুক্ষণে সে এই মেয়ের লেজে পা দিয়ে ঝগড়া করতে গিয়েছিলো!
জাউভাত যেমনই হয়েছে,সেটা যার ব্যাপার সে বুঝতো,কেনো মাঝখানে নিজের লম্বা নাকটা ঢুকিয়েছে!
ঝুনির আজকে ভীষণ আনন্দ লাগছে।এতো দিন পান থেকে চুন খসলেই শিরিন ক্যাটক্যাট করতো আজকে যে কি হবে!
খাওয়ার টেবিলে সবাই চুপচাপ। মহুয়া বেগম ডাল দিয়ে ভাত মুখে দিয়ে শিরিনের দিকে বিষদৃষ্টি হানলেন।
শিরিনের মনে হচ্ছে পুরো আসমান তার মাথায় ভেঙে পড়লো বুঝি।
রাগে মহুয়া বেগমের কপালের রগ দপদপ করছে। শিরিন অন্য দিকে তাকায়। সামান্য মুসুরি ডালে কি-না এই বুড়ি দামড়ি মেয়ে এক বয়াম হলুদ ঢেলে দিয়েছে!
তা না হলে মুসুরি ডাল এমন তিতকুটে হয়!হলুদের উৎকট গন্ধের জন্য মুখে নেওয়া যাচ্ছে না।
মিরাজুল ইসলাম মাছ দিয়ে এক লোকমা খেয়ে শিরিনের দিকে তাকান।তার জিহবায় কেউ যেনো আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“পানিইইই” বলে চিৎকার করে উঠলেন।
ঝুনি মিটিমিটি হাসছে।শিরিন রান্না ঘরে যাওয়ার আগে ঝুনি মরিচের গুঁড়ো বদলে দিয়েছে।কাশ্মীরি মরিচের কৌটোয় দেশি ঝাল মরিচের গুঁড়ো রেখে দিয়েছে। ডাল রান্নার সময় শিরিনের বেখেয়ালে কিছুটা হলুদ গুড়ো ঢেলে দিয়েছে।
অনেক দিনের পুরনো ক্ষোভ ঝুনির।সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া করতে পারলো না তাই।
রজনী ছুটে গিয়ে পানি নিয়ে দিলো ফ্রিজ থেকে।
মিরাজুল ইসলামের জিহবা পুড়ে যাচ্ছে। মাথায় কেমন অসহ্য রকম যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি হচ্ছে।
পুরো টেবিলে সবাই চুপচাপ বসে তামাশা দেখছে।
মিরাজুল ইসলাম নিজেকে শান্ত করে বললো, “আমি অনেক বড় গাধা আজকে বুঝলাম।আজীবন তুই আমার কাছে নালিশ করে গেলি আমার বউ রান্না পারে না।আমার উচিত ছিলো তখনই তোকে রান্না করে দিতে বলা।এজন্যই তো কখনো শ্বশুর বাড়ি গেলি না,কখনো রান্নাঘরে ঢুকে নিজ থেকে রান্না করতে গেলি না।আজীবন শুধু অন্যের দোষ ধরে গেলি।”
সিরাজুল ইসলাম আর খাবার মুখে দেওয়ার রিস্ক নিলেন না।রজনীকে বললেন সবার জন্য ডিম ভেজে আনতে।
রজনী কিছু না বলে রান্নাঘর থেকে দুই বাটি গরুর মাংস নিয়ে এলো।প্রায় সময় রজনী মাংস বেশি করে রান্না করে ডিপে রাখে।
যাতে কখনো প্রয়োজন হলে খাওয়া যায়।
শিরিনের রান্না হতেই রজনী ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে ওভেনে গরম করে নিলো।
সবাই গরুর মাংস দিয়ে তৃপ্তি সহকারে ভাত খেলো।
খাওয়ার পর সিরাজুল ইসলাম পিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কিছু বলতে চাও?”
পিয়াসা মুচকি হেসে বললো, “মাঝেমাঝে চুপ থাকাটাই সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ হয়ে যায় আংকেল। আমার কিছু বলার নেই।”
নিরার মনে হলো পিয়াসা যেনো কষে একটা থাপ্পড় বসিয়েছে তার মা’য়ের গালে কোনো কিছু না বলে।
বললে বরং কোনো এক সময় সুযোগ পেতো এটাকে একটা এক্সকিউজ করার,ছোট হয়েও শিরিনকে অপমান করেছে বলে ওর পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে কথা বলার।কিন্তু পিয়াসা না বলে ও যেনো অনেক কিছু বলে দিলো।
সিরাজুল ইসলাম বললেন, “এবার থেকে শিরিনই রান্না করবে।একটা পরিবারে থাকতে গেলে আজীবন একজন পায়ের উপর পা তুলে খাবে, বাকিরা কাজ করবে তা তো হয় না।তাই আপাতত রান্নাঘরের দায়িত্ব শিরিনের।”
মহুয়া বেগম নির্বাক তাকিয়ে দেখলেন তার সাম্রাজ্যের দখলদারিত্ব তার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে। তবে কি এই একরত্তি মেয়ে তার সাম্রাজ্যের দখল নিবে!
মহুয়া বেগমের সারা শরীরে যেনো বিষাক্ত হুল ফুটতে থাকে।
একরাশ আলগা গাম্ভীর্য গলায় এনে বললেন, “আমি এখনো বেঁচে আছি।এই সংসারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এখনো আমি আছি।তাই তোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে না কে রান্না করবে নাকি কে বসে থাকবে।”
সিরাজুল ইসলাম ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন মুহূর্তে।
মহুয়া বেগম পুত্রবধূদের দিকে তাকান।এক্ষুনি পিয়াসার উপর চাপ দেওয়া যাবে না।
রজনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”রান্না বান্না যত্ন নিয়ে করার কাজ,ভালোবাসা দিয়ে করার কাজ।যতো ভালোবাসা মনে নিয়ে খুন্তি নাড়বো,রান্না তত মজা হইবো।”
ঝুনি ফট করে বললো, “তাইলে মনে হয় শিরি আপা মনে সব বিষ নিয়া খুন্তি নাড়ছে এই লাইগা এই বিষাক্ত খাওন কেউ খাইতে পারে নাই।”
মহুয়া বেগম ধমক দেওয়ার আগেই সবাই হোহো করে হেসে উঠলো।
মহুয়া বেগম রজনীকে বললেন,”রাইতের খাওনের বন্দোবস্ত কর।”
শিরিনের ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেলো যেনো শুনে।
পিয়াসা বললো, “কিন্তু দাদী,আমি তো ফুপির কাছে রান্না শিখবো।”
“তোমার শাশুড়ী সবচেয়ে ভালো রান্না জানে,তোমার শাশুড়ী তোমাকে রান্না শেখাবে।”
“আমার শাশুড়ী তো আমার রান্নার দোষত্রুটি ধরে নাই দাদী,ধরেছে ফুপি।তাই ওনাকেই আমাকে রান্না শেখাতে হবে।তাছাড়া জমিদার বাড়ির মেয়ে হচ্ছে ফুপি,আমার শাশুড়ীর চাইতে ফুপির ভালো জানার কথা জমিদার বংশের টেস্ট। তাই অনর্থক আমার শাশুড়ীর উপর গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না।”
নিরা আর সহ্য করতে পারলো না।আক্রোশে চেঁচিয়ে বললো, “আমার মা কি তোর চাকর যে তোর কথা মতো কাজ করনে?”
আষাঢ় ধমকে বললো, “কানে গালে চটকনা খাওয়ার আগে আমার বউকে রেস্পেক্ট দিয়ে ভাবী বলে কথা বলতে শেখ।তা না হলে তোর এই খোমার ডিজাইন চেঞ্জ করে দিবো আমি।”
মিনি অসহায়ের মতো তাকিয়ে নাটক দেখে। এই জাগতিক কিছুই তার ভালো লাগে না।নির্জনের কথাগুলো মাথায় ঘুরছে তার।
হুট করে মিনির মনে হয় সবকথা যদি সে পিয়াসাকে শেয়ার করে তাহলে পিয়াসা হয়তো তাকে একটু হলে সাহায্য করতে পারবে।
এই সংসারে আর কেউ নেই তার মন বুঝার মতো।
কিন্তু পিয়াসাকে তো সে অপছন্দ করে।
মিনি বুঝতে পারে না কি করবে সে।
রজনী পিয়াসার হাত ধরে বললো, “থাক মা,জেদ করো না।তোমার ফুপির রান্না তো দেখলে।এরপর কারোরই আর খাওয়া হবে না ঠিক করে। যার কাজে যারে সাজে।বিনি কাজে লাঠি বাজে।”
ঝুনি বললো, “না ভাবী,লাঠি বাজে না,শিরি আপার থোতা বাজে শুধু। আল্লাহ দিছে তারে চাইনিজ থোতা,আইজকাইল এমন থোতা দেখা যায় না।থোতা না যেনো ইস্পাত।থোতার ধার থাকলেও কাম কাইজের কোনো ধার নাই তার।আকাইম্মা।”
রজনী মৃদুস্বরে ধমক দেয় ঝুনিকে।
নিরা ফুঁসতে থাকে।
হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৯
পিয়াসা আর কথা বাড়ালো না। তার দরকার ছিলো শিরিনকে একটা বড়সড় ধাক্কা দেওয়া যাতে সে বুঝতে পারে পিয়াসা সহজ মেয়ে নয়।আপাতত সেটা হয়ে গেছে। তাই পিয়াসা ও আর কথা বাড়ালো না।
মহুয়া বেগম দেখলেন পিয়াসা মেনে নিয়েছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন মহুয়া বেগম। কিন্তু মহুয়া বেগম জানেন না এরপর পিয়াসার সিদ্ধান্ত শুনলে সে আরেকবার পস্তাবে কেনো পিয়াসাকে বউ করলো তার জন্য।