হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৫

হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৫
রাজিয়া রহমান

এক ভয়ানক সত্যির মুখোমুখি হলো সবাই। নির্জন মা’য়ের কোলে মাথা রেখে আকুল হয়ে কাঁদছে।নার্গিস মনে মনে হিসেব করছে কতদিন পর তার ছেলেটা আজ তার সামনে এসেছে।
মায়ের সাথে কথা বলেছে।
পিয়াসা একটা সোফায় দুই পা তুলে আরাম করে বসে আপেল খাচ্ছে।
উল্টো দিকের সোফায় বসে বৈশাখী বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পিয়াসার দিকে।
এই মেয়েটা যত নষ্টের মূল।
যেমন করেই হোক,বিয়ে তো হয়েছে মিনির আর নির্জনের।তাহলে এই শয়তান মেয়েটা সবকিছু ভন্ডুল করে দিলো কীভাবে!

এই মেয়েটা যা চাচ্ছে সবকিছুই পাচ্ছে।এই যে ওর এতো নোংরা একটা অতীত আছে অথচ বাবা মা সব জেনেও কিছুই জানায় নি তাকে।
কেউ একটা টুঁশব্দ ও করছে না এসব নিয়ে।
এই বাড়িটা যেনো একটা বস্তি হয়ে গেছে। কোনো নিয়ম নীতি কিছুই নেই।
অথচ এটা একটা জমিদার বাড়ি।
জমিদার বাড়ি ভাবলেই বৈশাখীর সারা শরীর শিহরিত হয়ে উঠে।
পিয়াসার মাথা ব্যথা নেই এসব নিয়ে। সে ভাবছে তার কাজের কথা।আজকে প্রথম দিন ছিলো তার।কি দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে তার আজকেই।ভীষণ এক্সাইটেড ছিলো পিয়াসা প্রতিটি মুহূর্তে।
এক মগ কপি নিয়ে যাওয়ার সময় পিয়াসার মনে হতে লাগে সে শুধু এক মগ কফি নিয়ে যাচ্ছে না, তার প্রাণ হাতে নিয়ে যাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ড্রয়িং রুমে ভয়ানক নিঃস্তব্ধ।অথচ রুম ভর্তি মানুষ। দেয়ালে দুলতে থাকা বড় ঘড়িটা টিকটিক করছে।পরিবেশ ভীষণ থমথমে হয়ে আছে।মিরাজুল ইসলাম উত্তেজিত ভঙ্গিতে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন।রাগে ব্রহ্মতালু ফেটে যাচ্ছে মনে হচ্ছে তার। মাথার ভেতর আগ্নেয়গিরির গরম লাভা যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হওয়ার অপেক্ষায়।
সিরাজুল ইসলাম কঠোর গলায় মিনিকে জিজ্ঞেস করলো, “পিয়াসা যা বলেছে তা কি সত্যি?”
মিনি নির্বাক তাকিয়ে থাকে।
পিয়াসা সবটা কীভাবে জানলো?
ভাবতে ভাবতে মিনির মনে পড়ে গতকাল সকালেই নিরা আর সে ছাদে দাঁড়িয়ে এই ব্যাপারে কথা বলছিলো।পিয়াসা তখন শুনে ফেলেছে সব!
মিনির বুকের ভেতর হাহাকার করছে।একটু আগে ছোট মামী যখন সবকিছু বললো মিনির মনে হলো প্রতিটি শব্দ তীরের মতো ছুটে এসে মিনিকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে।
নিরা থমথমে সুরে বললো, “মামা,এটা কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে।আপনি পিয়াসা যা বলছে তাই বিশ্বাস করে নিচ্ছেন।ও তো মিথ্যা ও বলতে পারে। নিজের জন্মপরিচয় নিয়ে যে মিথ্যা বলতে পারে তার থেকে আর কতটা সত্যি আশা করেন আপনি?”

“নিরা,অতিরিক্ত কথা বলিস না।পিয়াসা ওর জন্মপরিচয় নিয়ে কোনো মিথ্যা বলে নি।আর আষাঢ় সব জেনে পিয়াসাকে বিয়ে করেছে।আমার ছেলেকে তো তোরা মা মেয়ে সবাই মিলে ঠকিয়েছিস।ওকে ফাঁদে ফেলে বিয়ে করিয়েছিস।”
মিনির দুই চোখ ভিজে উঠে।
মা বোনের অতিরিক্ত চালাকির জন্য আজকে এই হাল হলো তার।
শিরিন চিৎকার করে বললো, “সব মিথ্যা কথা। এই মেয়ে ইচ্ছে করে এসব কথা বানিয়ে বলতেছে।ও চায় না আমি এখানে থাকি,আমার মেয়েরা থাকুক।এই মেয়ে এই জমিদার বাড়ি ভাঙতে চায়।আমি থাকতে তা কখনো হবে না।কেউ ওকে বিশ্বাস করো না।”
ঝুনি হেসে বললো, “চোরের মা’য়ের বড় গলা সারাজীবন শুইনাই আসলাম।আইজ দেখি গলা শুধু বড়ই না,হেই লগে ত্যাজ ও আছে গলায়।’”
শিরিন লাফিয়ে উঠে বললো, “একটা থাপ্পড় খাবি হারামজাদি। বাইর হ এই বাড়ি থেকে।”
মিরাজুল ইসলাম শান্ত সুরে বললেন, “ঝুনি না,তুই বের হবি।এখনই বের হবি তুই তোর মেয়েদের নিয়ে।”
শিরিন কঠোর গলায় বললো, “আমি বা আমার মেয়েরা কেউ কোনো অন্যায় করি নি।এই মেয়েটা আমাদের ফাঁসাতে এসব বলেছে।”

মিরাজুল ইসলাম সহ্য করতে পারলেন না।বোনের সামনে এসে দাঁড়ালেন।দুই চোখ রক্তবর্ণ হয়ে আছে তার।যেনো সদ্য ফোঁটা রক্তজবা।
গলার স্বর ভীষণ ঠান্ডা।
শিরিনের চোখে চোখ রেখে বললেন,”লজ্জা করলো না এরকম একটা জঘন্য কাজ করতে? একজন মা হয়ে নিজের মেয়েকে এরকম নোংরা একটা কাজ করতে সাহায্য করতে?
ভালোবাসা দিয়ে যেই সম্পর্ক হওয়ার কথা তা কি-না তুই ছলনা দিয়ে গড়েছিস?আমার ছেলের জীবন নিয়ে তাস খেলতে নেমেছিস তুই?”
মিরাজুল ইসলামের শান্ত সুরে বলা কথাগুলো শিরিনের কানে উত্তপ্ত সীসার মতো লাগলো।
জ্বলে পুড়ে গেলো সর্বাঙ্গ।এতো বুদ্ধি করে সবকিছু করেও শেষ রক্ষা হলো না?
চুপ থাকলো না শিরিন। উল্টো তেজ দেখিয়ে বললো, “আমি কোনো অন্যায় করি নি।আর ভালোবাসার কথা বলছো তুমি? তাহলে সেদিন তোমার ছেলে চুপ ছিলো কেনো?ও তো চাইলেই সবটা অস্বীকার করতে পারতো। সত্যিটা তোমাদের জানাতে পারতো।
কেনো বাধ্য ছেলের মতো বিয়ে করে নিয়েছে?তোমার ছেলের পেটে পেটে যদি কিছু না-ই থাকতো সে নিজেই তো প্রতিবাদ করতো।”

পিয়াসা শান্ত সুরে বললো, “হ্যাঁ, আমি ও প্রথমে ভেবেছিলাম এই ব্যাপারটা। পরক্ষণে বুঝতে পেরেছি।সম্ভবত ব্যাপারটা এমন হয়েছে যে প্রথম ধাক্কায় উনি বুঝতেই পারেন নি কী থেকে কী হতে যাচ্ছে!
যেখানে কোনো কারণ ছাড়াই তাকে কালপ্রিট ভেবে নিয়েছে সবাই। চাচাজান ও ওনাকে অবিশ্বাস করলেন।সবচেয়ে বড় সমস্যা চাচী বাসায় ছিলেন না।যার সবকিছু চাচী ঠিক করে দেয় এই বয়সে এসেও,সে সবভাবে চাচীর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল মানসিকভাবে।ওনার সম্ভবত কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নি অথবা কখনো তাকে সিদ্ধান্ত নিতে দেয় নি বাবা মা।তাই সবসময় তিনি সবার সিদ্ধান্ত মেনে এসেছেন। তার সাব কানসাস মাইন্ড ধরেই নিয়েছে সএ যা বলবে তা কেউ শুনবে না।
বাস্তবিকই কেউ তার কথাটা শুনতে চান নি।চিলে কান নিয়েছে চিৎকার করে চিলের পিছু দৌড়েছে সবাই।
কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে নির্জন ভাইয়া ও অভিমানে কাউকে কিছু বলতে চায় নি।”
মিনি আকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নির্জনের দিকে।
এই মানুষটাকে মিনি অসম্ভব ভালোবাসে।কেনো সেদিন মা আপার নোংরা চক্রান্তে মিনি রাজি হয়েছিলো মিনি ভেবে পায় না।

এই যে এখন পেয়েও হারিয়ে ফেলছে।
একটু পরে এই মানুষের সাথে মিনির এই জন্মের মতো সম্পর্ক ভেঙে যাবে।
একটা জীবন কেটে যাবে মিনির এই মানুষটার বিরহে।
নির্জন মাথা নিচু করে বসে আছে। মিনি সরাসরি তাকিয়ে আছে নির্জনের দিকে।
নার্গিস বললো, “তুই মাথা নিচু করে আছিস কেনো?তুই তো কোনো অন্যায় করিস নি।যারা অন্যায় করেছে তারা তো ঠিকই মাথা উঁচু করে বসে আছে স্ব গর্বে। তোর কিসের এতো লজ্জা তাহলে?”
নির্জন জবাব দেয় না। মিনির অসহায় দৃষ্টি নির্জনকে দুর্বল করতে পারে না মোটেও।তার মনে পড়ে যায় সেই রাতের কথা। ভাই বোন সবাই কেমন ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো নির্জনের দিকে।নির্জনের মনে হয়েছিলো সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে দুশ্চরিত্র পুরুষ। সেই রাতের লজ্জার কাছে মিনির ভালোবাসা, আবেগ সবকিছু তুচ্ছ মনে হয় নির্জনের।
মহুয়া বেগম মুখ খুললেন খানিকক্ষণ পর। এভাবে সবকিছু চলতে দেওয়া যায় না।এই বংশে কেউ কখনো বউকে ছাড়ে নি।নার্গিস যতই খারাপ হোক,মহুয়া বেগমের মনমতো না হওয়ার পরেও তিনি কখনো ভাবেন নি তাকে ডিভোর্স দিতে বলবেন।

সেখানে আজ এই অনাচার তিনি কিছুতেই হতে দিবেন না।
আজ এদের একটা শিক্ষা দিবেন।কী ভেবেছে সবাই! বাঘ বুড়ো হলেও তার শিকার করা ভুলে যায় না।
গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, “অনেকের অনেক কথা শুনতেছি শুরু থেকে।এবার আমি বলছি।এই বংশে কেউ কখনো দ্বিতীয় বিয়ে করে নি,কেউ বউকে তালাক দেয় নি।আজও এরকম কিছু হবে না।যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।এখন এসব নিয়ে কথা না বাড়ানো ভালো।”

মিরাজুল ইসলাম হেসে বললো, “মা,আমার জীবন নিয়ে কম ছেলেখেলা করো নি।আমাদের সবার জীবন নিয়ে তুমি অনেক খেলা খেলেছো।আমরা সবাই মেনে নিয়েছি।আমার ছেলের সাথে তেমন কিছু হতে দিবো না আমি।ও যদি আমার বোন হয়ে আমার সাথে এই প্রতারণা করতে পারে তবে আমি ও তার জন্য ব্যবস্থা নিতে পারবো।”
মহুয়া বেগম দৃঢ় সুরে বললো, “এরকম কিছু যদি ঘটে তো মনে রাখিস,এই বাড়িতে আজকেই আমার শেষ দিন।”
মহুয়া বেগম তার শেষ কার্ডটা ফেললেন।তিনি জানেন খেলা এখন ঘুরে যাবে।
সিরাজুল ইসলাম মায়ের কাছে এসে বললো, “মা,এরকম ব্ল্যাকমেইল করে একটা জীবন আমাদের জিম্মি করে রেখেছো।আর কতো?

হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৪

তুমি কি করবে সেটা তোমার ব্যাপার। তবে আজকে তাই হবে যা মিরাজ চাইবে,নির্জন যা চাইবে,নার্গিস যা চাইবে।আর ওদের সিদ্ধান্ত যে ভুল না সেটুকু আমি গ্যারান্টি দিতে পারি।”
মহুয়া বেগমের বুকের ভেতর কেঁপে উঠে। তার সব কিছু তাহলে এখানেই শেষ হয়ে গেলো!
এই সংসারে তার আর কোনো গুরুত্ব নেই?
মিরাজুল ইসলাম নির্জনকে বললো, “মুখে মুখে আপাতত তালাক দিয়ে দে।লিগ্যালি বাকিটা আমি দেখছি।”
নির্জন উঠে দাঁড়ায়।
সেদিন সই করার সময় নির্জনের হাত কেঁপেছে কি-না নির্জন জানে না।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার যেনো গলা কাঁপছে।

হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৬