হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৭

হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৭
রাজিয়া রহমান

হোটেলের বাহিরের দিকটায় ভীষণ সুন্দর একটা ফুল বাগান।রংবেরঙের ফুলে গাছ ভরে আছে।পিয়াসা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবার সাথে কথা বলছে।
হোটেলে চেক ইন করেছে প্রায় ঘন্টাখানেক আগে।পিয়াসার কেমন অদ্ভুত লাগে নিজের জীবনটা।তার জীবনে সবকিছুই কেমন হুট করে ঘটে যায়।কখন কী ঘটে যাবে কোনো নিশ্চয়তা নেই।
তা না হলে দুদিন আগে বিয়ে হতে না হতেই কি-না আষাঢ় তাকে নিয়ে বের হয়ে এলো!
আনোয়ার চৌধুরী শান্ত সুরে বললো, “এখানে তুমি নিজেকে দোষী ভাবছো কেনো?”

“আমার খুব খারাপ লাগছে বাবা।সবাই ভাববে আমার জন্য ওনাদের ফ্যামিলির মেলবন্ধন ভেঙে গেছে।”
“কে কী ভাববে, না ভাববে তার দায়ভার তোমার নয় মা।নিজেকে দোষী ভেবো না।তোমার স্বামীর কাছে তোমার ভালোটাই সবার আগে।আমার তো মনে হয় আষাঢ় ঠিকই করেছে।ও একজন পুরুষ মানুষের মতো কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছে,যা ওর বাবা কখনো করতে পারে নি।”
আষাঢ় মা’য়ের সাথে কথা বলছিলো রুমে বসে।
“বাড়ির অবস্থা কী মা?”
“বাড়ি নিয়ে তোর ভাবাভাবির দরকার নেই বাবা।তুই তোদের নিয়ে ভাব।এই বাড়িতে থাকলে পিয়াসার জীবনটাও আমার জীবনের মতো হয়ে যাবে।কাউকে না কাউকে তো নিয়ম ভাঙতেই হতো।তুই সেই নিয়ম ভেঙেছিস। আ’ম প্রাউড অব ইউ বাবা।”
আষাঢ় মুচকি হেসে বললো, “তুমি যে পৃথিবীর সেরা মা তুমি জানো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“জানি,আমি পৃথিবীর সেরা বলেই তো আমার ছেলেটা সেরা হয়েছে। পিয়াসার বাবা মা’য়ের কাছে আমি ভীষণ বড় গলা করে বলেছি পিয়াসার কখনো অযত্ন হবে না।মৃত্যুর আগ মুহূর্তে এই কথাটা যেনো তোর মনে রাখে।স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক এই দুনিয়ার সব সম্পর্কের উর্ধ্বে। সেই সম্পর্ক বাবা মা ভাই বোনের জন্য যাতে কখনো নষ্ট না হয়।মেয়েরা সবকিছু ছেড়ে স্বামীর কাছে আসে।স্বামীকে কিছুই ছাড়তে হয় না।স্বামী যদি স্ত্রীকে বুঝতে না পারে তাহলে সেই নারীর জীবন বৃথা।আমি চাই না আমার ছেলে কারো চোখের জলের কারণ হোক।কখনো কেউ অভিযোগ করুক তাকে নিয়ে। খোদার দরবারে যাতে দোয়া আসে সবার আগে,অভিযোগ না।”
আষাঢ় কথা বলতে পারে না। মা’য়ের গভীর ক্ষতটা আষাঢ় অনুভব করতে পারে। কিন্তু সে মা’য়ের আঘাত মুছতে পারছে না।আষাঢ় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে মা যেমন কষ্ট পাচ্ছে সে কখনো এমন কষ্ট পিয়াসাকে পেতে দিবে না।ঢাল হয়ে রক্ষা করবে।

পিয়াসা রুমে এসে দেখে আষাঢ় জেগে আছে। পিয়াসা সহজ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো, “কাজটা কি ঠিক হয়েছে বলুন তো!নির্জন ভাইয়ার ডিভোর্স হলো,দাদী বাড়ি ছাড়লো,আপনি আমাকে নিয়ে বের হয়ে এলেন।সবকিছু কেমন হুট করে হয়ে গেলো না!আমাদের না আসাই বোধহয় ভালো ছিলো।”
“আমি তোমার হাজব্যান্ড পিয়াসা।আমার বউয়ের বিন্দুমাত্র অপমান আমি বরদাস্ত করবো না।”
পিয়াসার কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়।
সকালে নাশতার টেবিলে আষাঢ় বললো, “বাসা পাওয়া গেছে পিয়াসা।নাশতা সেরে আমরা বাসা দেখতে যাবো।”
পিয়াসা মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়।
নাশতার পর দুজন বাসা দেখতে যায়।
ধানমন্ডি এরিয়াতেই একটা ফ্ল্যাট দেখা হয়েছে। বাসায় ঢুকে পিয়াসা চমকে যায়।এতো বড় বাসা!
চারটি বেডরুম, একটা ড্রয়িং রুম,একটা ডাইনিং রুম,কিচেন রুম,বারান্দা তিনটি। সবচেয়ে ভালো লাগে সবগুলো রুমের সাথেই এটাচ বাথরুম দেওয়া আছে।একটা কমন বাথরুম ও আছে।কিচেন রুমটাও অনেক বড়।
পিয়াসা ভাবে এতো বড় বাসা কী তাদের আদৌও দরকার?তাছাড়া এতো বড় বাসার ভাড়াও নিশ্চয় অনেক বেশি হবে।

আস্তে করে আষাঢ়কে বললো, “এতো বড় বাসা নিয়ে আমরা কী করবো?আমাদের তো এখন এক রুমের একটা বাসা হলেই চলবে।সেখানে এতো বড় বাসার কি দরকার বলেন?”
লজ্জায় আর বললো না অনেক টাকা নষ্ট হবে এই বাসা নিলে।সেটা বললে আষাঢ় যদি কিছু মনে করে।
আষাঢ় হেসে বললো, “জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার যাতে কখনো মনে না হয় কোনো একটা সময় আমার জন্য তোমার কষ্ট হয়েছে। তুমি এক রুমের বাসায় থেকে অভ্যস্ত নও পিয়াসা আর না আমি। তাছাড়া তুমি ভয় পেও না,এই বাসা ভাড়া দেওয়ার মতো এবিলিটি তোমার হাজব্যান্ডের আছে।আমি যতদিন বেঁচে আছি তোমাকে রানীর মতো রাখতে চাই।যাতে মরে গেলে প্রতিটি মুহুর্তে তুমি আমাকে মিস করো।”

পিয়াসার বুক কেঁপে উঠে মরার কথা বলায়।অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এই মানুষটার সাথে তার জীবন জুড়ে গেছে, সে ভালো করে কথাও বলে না।তবুও কেনো মনের ভেতর তার জন্য হঠাৎ করেই এতো দরদ জন্ম নিলো!
কেনো ইচ্ছে করছে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে যে এরকম কথা যাতে কখনো না বলে।
রাগ করে মহুয়া বেগম মেয়ের সাথে বের হয়ে এসেছেন ঠিকই কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ অসহায় অনুভব করছেন।নিজের মেয়েকে তার চেনা আছে।সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ হলো,প্রায় ১০টা বাজতে চলেছে এখনো কিছু খাওয়া হয় নি।
শিরিনকে ডেকে বলতেই শিরিন থমথমে সুরে বললো, “ঘরে খাবার মতো কিছু নাই মা।নীরা ঘুম থেকে উঠলে হোটেল থেকে নাশতা আনবে।”

“নীরাকে উঠতে বল,১০টা বেজে গেছে প্রায়।”
“না মা,আমি ডাকতে পারবো না।ওর সময় হলে ও নিজেই উঠবে।”
নিরা ঘুম থেকে উঠলো ১১টার পর।উঠে দোকান থেকে চা আর পাউরুটি নিয়ে এলো।মহুয়া বেগম এসব খাবার খান না।শিরিনকে সেই নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন মনে হলো না তার।
এক কাপ চা আর দুইটা পাউরুটি দিয়ে গেলো শিরিন। মহুয়া বেগম কিছু বললেন না।চা এক চুমুক মুখে দিয়ে তিনি ফেলে দিলেন।এতো জঘন্য চা মানুষ খায়!
পাউরুটি দুই পিস পানিতে চুবিয়ে খেয়ে নিলেন।
দুপুরের দিকে শিরিন আর নিরা বাজারে গেলো। মহুয়া বেগম অস্থির হয়ে গেলেন ক্ষিধায়।মিরা আর মিনি দুজনে রুমের দরজা বন্ধ করে আছে।মহুয়া বেগম একা।
এই মুহূর্তে তার ভীষণ মনে পড়লো তার বাড়ির কথা। এতোক্ষণে রজনী তার জন্য খাবার নিয়ে যেতো। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বের হয়ে আসে বুক ছিরে।

হঠাৎ করেই তার মনে হয় মেয়ের বুদ্ধি ধরে তিনি বউদের উপর অনেক অন্যায় করে গেছেন।তিনি ভেবেছেন এতে বউয়েরা তাকে ভয় পাবে,মান্য করবে,সম্মান করবে।
ভয় পায়,মান্য করে ঠিকই কিন্তু সম্মান মন থেকে করতে পারে না।
শিরিন ফিরে রান্না করতে করতে তার সন্ধ্যা হলো।এতো বেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকায় মহুয়া বেগমের মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেলো,শরীর কাঁপতে লাগলো।
শিরিন অবশ্য মা’য়ের এতটা খেয়াল করলো না।তার মন মেজাজের নেই ঠিক এই মুহূর্তে মা হোক আর যে-ই হোক শিরিনের চোখে লাগছে না যেনো।
অনভ্যস্ত হাতের রান্না খুব একটা সুস্বাদু হয় নি।
মহুয়া বেগম খেতে পারলেন না।অতিরিক্ত লবণ হয়েছে রান্নায়।
বিরক্ত হয়ে বললেন,”এসব কী ছাতার মাথা রান্না করেছিস?”

শিরিন কিছু বলার আগে নিরা বললো, “যা রান্না করেছে তাই খাও।না হলে নিজে রান্না করে খাও।গলা উঁচু করে কথা বলবে না নানী।এটা তোমার জমিদার বাড়ি না।এটা আমাদের বাড়ি।”
মহুয়া বেগম হতবিহ্বল হয়ে বললেন, “কি বললি তুই? তোর এতো বড় স্পর্ধা!”
“হ্যাঁ স্পর্ধা আমার। তুমি কোন সাহসে এরকম ধমক দিয়ে কথা বলো আমাকে?তোমার খাই না এখন যে তোমার হুমকি-ধমকি শুনবো আমি।তুমি আমাদের বাড়িতে আছো,আমাদের কথা তোমার শোনা লাগবে।”
মহুয়া বেগম চমকে যান।বিড়বিড় করে বললেন,”তোদের জন্য কি-না আমি রাগ করে বাড়ি থেকে চলে এসেছি!”
শিরিন ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, “কেনো আসলা?কে বলছে আসতে তোমাকে?আমি বলছি আসতে?এসে আমার ঝামেলা বাড়ানোতে বাড়াইছো আবার আমার মেয়ের সাথে ঝামেলা কর!”

মহুয়া বেগম ধাক্কা খান।
এক দিনেই মেয়ে,নাতনির রূপ বদলে গেলো!
কই,বউদের কতোকিছু বলেছেন কতো সময় তারা তো কখনো এভাবে তাচ্ছিল্য করে কথা বলে নি।
তাদের সাথে তো মেয়ে,নাতনিকে নিয়ে সবসময় অশান্তি করেছেন।
খাবার না খেয়ে মহুয়া বেগম উঠে গেলেন।শিরিন ও কিছু বললো না। অযথা তার ঘাড়ে চেপে বসেছে এসে।তার কিসের দায় এতো!
মহুয়া বেগমের নির্ঘুম রাত কাটলো।মহুয়া বেগম আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলেন শিরিন একবার ও তার কাছে আসে নি।রাতে খাবার ও খেলেন না,ঔষধ ও না।

একদিনে মহুয়া বেগম সবকিছু বুঝে গেলেন।লোকে বলে কোদালে টানলে বুকের দিকে টানে।নিজের ছেলের ঘরের নাতি-নাতনীদের যতোই তাচ্ছিল্য করো,তারাই আপন হয়।মেয়ের ঘরের নাতি-নাতনীদের যতোই স্নেহ কর তারা দূরেই চলে যায়।
মহুয়া বেগম কি করবেন ভেবে পেলেন না।এতো অসহায় আগে বোধ করেন নি।
রাতে পিয়াসা রজনীর সাথে কথা বলছিলো।কথার মধ্যে রজনী বললো, “মা না জানি কি খাচ্ছেন, না খাচ্ছেন ওই বাড়িতে।তোমার ফুফুর রান্নাবান্নার নমুনা তো জানোই।”
পিয়াসা মুচকি হেসে বললো, “আপনার খুব খারাপ লাগছে দাদীর জন্য?”
রজনী এক মুহূর্ত ভাবে।মহুয়া বেগমের প্রতি তার অনেক রাগ,অভিমান আছে এটা সত্যি।কিন্তু সেসবের বিচার আল্লাহ করবেন।কিন্তু রজনী তার ক্ষতি চায় না।তিনি ভালো থাকুক।মাথার উপর মুরুব্বীর ছায়া থাকাও কল্যাণের। একদিন নেই কেমন যেনো অসম্পূর্ণ লাগছে সবকিছু।
“খারাপ লাগারই কথা মা।বউ শাশুড়ীর সম্পর্ক কাঁটার মুকুটের মতো। মাথায় থাকলে ক্ষত-বিক্ষত অনুভূতি হয়,না থাকলে বুকের ভেতর মরুভূমির শূন্যতা অনুভব হয়।

মাথার উপর মুরুব্বির ছায়া ছিলেন উনি,এই যে আজকে নেই সাথে মনে হয় প্রচন্ড রোদের তাপ মাথার উপর। কিছু সম্পর্ক এমনই হয় মা।রাগ,অভিমান,ঘৃণা করতে করতে কবে যেনো সেসবের চাইতে ও বেশি ভালোবাসা জন্মে যায়।দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে একসময় রক্তের সাথে মিশে যায়।”
পিয়াসা মন খারাপ করে বলে, “আমি সরি মা।আমার জন্যই তোমাদের বাড়িতে এতো সমস্যা হলো।”
“বোকা মেয়ে।তুই সরি হবি কেনো!এটা তো হওয়ারই ছিলো। আজীবন নিয়ম মেনে কেউ চলতে পারে না।নিয়ম তৈরি হয় মানুষের ভালোর জন্য, সেই ভালোর জন্যই আবার নিয়ম ভাঙতে হয়।মাঝেমাঝে ঝড় ওঠা ভালো, তাতে সবাই বুঝতে পারে সবকিছু সবসময় একই নিয়মে হবে না।প্রতিদিনই যে রোদ ঝলমলে দিন হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।জীবনে নানা রকম দিনই আসবে।সবদিন একই রকম হচ্ছে না বলে যার ক্ষোভ সে বোকার স্বর্গে বাস করে।”

হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৬

আগের দিন পিয়াসারা নতুন বাসায় উঠেছে। আজকে আষাঢ় পিয়াসাকে নিয়ে বের হলো প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করার জন্য। একটা সংসার শুরু করতে গেলে সুই থেকে শুরু করে কতো কিছুই প্রয়োজন হয়।তাছাড়া পিয়াসার রেজাল্ট বের হবে পরশু দিন।এরপর চান্স পেলে ভর্তি হবে ঢাবিতে নয়তো কোনো প্রাইভেটে। ক্লাস শুরু হয়ে গেলে পিয়াসা ব্যস্ত হয়ে যাবে।
কেনাকাটা করতে বের হয়ে পিয়াসা টের পেলো তার কেমন যেনো আনন্দ লাগছে।বিছানার চাদর,জানালার পর্দা কিনতে গিয়ে পিয়াসার মনে হলো সে যেনো সত্যি সত্যি গৃহিণী হয়ে গেছে।

হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৮