কাছে আসার মৌসুম পর্ব ১০
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
সময় তখন অনেক। আস্তেধীরে রাতের প্রহর বাড়ছে। কম্যিউনিটি সেন্টারটা মানুষের কোলাহলে মুখরিত তখনো।
অনেকগুলো কণ্ঠের আওয়াজ আসছে কানে। ইয়া বড়ো ঘোমটার ফাঁক গলে পরিবেশ বোঝার চেষ্টা করল তুশি।
নাহ,কিছু দেখা যাচ্ছে না। এত ভারী জামা! কোন বজ্জাত বানিয়েছে এটা? তুশির এসবে অভ্যেস নেই।
মনে হচ্ছে কাপড় নয়,গায়ে দশটা বস্তা চাপিয়ে দিয়েছে। তারওপর এই উঁচু জুতো!
তুশির এখন রাগ হচ্ছে টাকার লোভে ও কেন রাজি হোলো। পরপর, পিঠ সোজা করে ভাবল, থাক একটু এক্টিংই তো করতে হবে। তার বদলে এতগুলো টাকা পেলে,তুশিদের আর কোনো ধার-দেনা থাকবে না। দাদিকেও এক মাস বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে।
তুশি তো দেখতে পায় দাদির শরীরের অবস্থা। কাশির তোপে ঘুম হয় না রাতে। প্রায়ই শরীর গরম থাকে। তাও দাদি কাজ করতে যায়। দুটো অন্নের জন্যে খাটে।
তুশির ইনকামের তো আর ঠিক নেই। আজ বেশি হলে,কাল হয়ই না। মানুষগুলো চালাক হয়ে গেছে,কেউই পকেটে ক্যাশ নিয়ে বের হয় না।
ও লেহেঙ্গার দু মাথা উঁচু করে ধরল। যেই পা বাড়াবে,হিলটা নড়বড়ে হয়ে পড়তে ধরল অমনি। ত্রস্ত পিলারটাকে জাপটে ধরল দুহাতে। কনের বান্ধুবির নাম মুক্তা৷
মেয়েটা ছুটে এলো কাছে । ফিসফিস করে বলল,
“ আস্তে আস্তে হাঁটো। এমন তাড়াহুড়ো করলে তো ধরা পড়ে যাবে।”
“ ওকে ওকে,শিওওর।”
তুশি বোঝাল সে পারবে। কিন্তু সাহস হলো না। দুই তলা হিল কি বাপের জন্মে পরেছে?
মিনমিন করে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ মাই হ্যান্ড ধরে রাখুন তো। হোচট ইটিং করলে সম্মান গোয়িং হয়ে যাবে।”
মুক্তার মুখে বিরক্তি। কিন্তু মাজহার ওকে পই পই করে বলে দিয়েছেন,তুশিকে সব রকম সাহায্য করতে হবে।
এর মাঝে কনেকে খুঁজে আনবেন তারা।
সেই সময়টাতে শুধু বউ সেজে বরের পাশে বসবে তুশি।
যখনই কনেকে নিয়ে আসা হবে,একটা কোনো ছুঁতো দেখিয়ে নেমে আসবে মেয়েটা।
কিন্তু মুক্তা জানে,ওকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার সামনে দিয়েই তো বয়ফ্রেন্ডের বাইকে করে পালাল মেয়েটা। সাহায্যও সেই করেছে। কিন্তু ওসব তো ঘুনাক্ষরেও কাউকে বলা যাবে না। তবে সব প্রশ্নের মুখোমুখি ওকে হতে হবে। সেজন্যে মুক্তা ভান করছে কিছু না জানার।
এরা খুঁজে মরুক,যা ইচ্ছে হোক ও বিপাকে না পড়লেই হলো!
মেয়েটা মুখ ভার করে তুশিকে নিয়ে স্টেজের কাছে এলো।
তুশি কিছু দেখতে পাচ্ছে না।
উঁকিঝুঁকি দেয়াও নিষেধ। মাজহারের কড়া কথা, প্রতি তিড়িংবিড়িং-এ এক হাজার টাকা কাটা।
স্টেজে এখন বর বসে। তখনই তো বর আসার শোরগোল শুনেছিল।
তুশি দাঁড়াতেই,চারদিকটায় হইচই শুরু হলো ফের। ফুলের পাপড়ি ছেটাল কেউ কেউ।
তুশির এসবে খুব বিরক্ত লাগছে!
এই যে বিশাল ঘোমটা এটাই তার কারণ। গা-টা এত কুটকুট করছে না! মনে হচ্ছে টান মেরে সব খুলে ফেলতে।
তখনই কোনও মেয়েলি স্বর কানে এলো। স্ফূর্ত চিত্তে বলছে,
“ ভাইয়া,ভাবিকে হাত ধরে তোলো। একটা ভিডিও হবে, প্লিজ! ”
সাথে সুর মেলাল আরো কজন।
বর উঠে এলো বোধ হয়। নাগড়া জুতোর মসমসে শব্দটা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে তুশি।
চুপচাপ এসে হাতটা পাতল সে।
তুশি হাত দেখেনি। তার ঘোমটা এর চেয়েও বড়ো। মুক্তা কনুই দিয়ে গুতো দিলো বাহুতে। কণ্ঠ চেপে বলল,
“ বর হাত বাড়িয়ে আছে,ধরো।”
তুশি বলল,
“ ডানে না বামে?”
“ নাক বরাবর।”
তুশি আন্দাজ মতো হাতটা তুলল।
টের পেলো একটা খসখসে,অমসৃণ তালুর ছোঁয়া এসে কব্জিতে লেগেছে। কেন যেন বুকখানা ধক করে কেঁপে উঠল ওর।
গলাটা শুকিয়ে বসল অহেতুক।
লোকটা হাতে টান বসাল। আপনা-আপনি তুশির শরীরটা উঠে এলো ওপরে। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বসল সোফায়।
সেই মেয়েটি তার কাঁধে হাত রাখল। কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ ভাবি,হাতে মেহেদি পরোনি কেন?”
তুশির কাছে জবাব নেই। মুক্তাই আগ বাড়িয়ে বলল,
“ আসলে,সময় পায়নি। এত তাড়াহুড়োর আয়োজন না, তাই।”
এক ভদ্রমহিলা শুধালেন,
“ ও এরকম ঘোমটা দিয়েছে কেন? এখন কি ওই যুগ আছে? ”
এই উত্তর মুক্তা জানে। মাজহার আগেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
চটপট বলল,
“ ওর খুব মাথা ব্যথা করছে, আন্টি। এখানে এত আলো! তাকাতে পারছে না,মাইগ্রেনের সমস্যা বোঝেনই তো। এখন এরকম থাকুক। একটু সুস্থ লাগলে ঠিক করে দেবো।”
“ আচ্ছা, সেই ভালো।”
তুশি শক্ত হয়ে সোফায় বসে রইল। ঘামে দরদর করছে শরীরটা। হাত-পা চুলকাচ্ছে। আচ্ছা,জ্বালা তো!
মেয়েদের জামাকাপড় পরতে এত কষ্ট? এসব পরে সবাই বিয়ে করে কীভাবে?
তুশিতো বিয়ে করলেও,ওই প্যান্ট-শার্ট পরেই করবে।
ও টের পাচ্ছে কতগুলো পা স্টেজে উঠছে,নামছে পরপর। সামনে থেকে ক্যাচক্যাচ করে ছবি তুলছে কখনো। কেউ যদি বউয়ের ঘুমটা তুলতেও চায়,আটকে দিচ্ছে মুক্তা। ইনিয়ে-বিনিয়ে বাধ সাধাই
এখন তার একমাত্র দায়িত্ব।
সময় কাটল। খাওয়া দাওয়া শুরু হলো এদিকটায়। মেয়ের বাবা সে নিয়ে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
তুশি ভীষণ অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে। আর কতক্ষণ বসে থাকবে এরকম? এখনো কি ভেগে যাওয়া মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি?
তক্ষুনি, একজন পুরুষ কণ্ঠ বললেন,
“ কাজী সাহেব, আসুন। শুভ কাজে আর দেরি করে লাভ নেই।”
মুক্তা চোখ বড়ো করে ফেলল। এই রে, কাজী এলে তো বিয়ে পড়ানো শুরু হবে। হায় হায়! ও দমকা হাওয়ার মতো এক ছুটে স্টেজ থেকে নামল।
মাজহার সেন্টারের কোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলেন ৷ মেয়েটা এসেই হড়বড়িয়ে শুধাল,
“ মামা,মামা, কোনো খবর পেলেন?”
মাজহারের মুখ কালো। থমথমে গলায় বললেন,
“ না।”
“ এখন তাহলে কী হবে? ওদিকে যে কাজী ডাকা হচ্ছে।
বিয়ে পড়িয়ে দিলে তো সর্বনাশ। মেয়েটাকে নামিয়ে আনব?”
মাজহারের মুখখানা চিন্তায় শুষ্ক। তুশিকে বউ সাজিয়ে স্টেজে বসানোর বুদ্ধিটা শুধুমাত্র ওনার। দুলাভাই,আপা এখনো কিছু জানেন না। কী করবেন এই মুহুর্তে, মাথায় ঢুকছেও না কিছু। তাদের মেয়েকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। শহরে আছে,না শহরের বাইরে যাবে তাও জানা নেই। এত অল্প সময়ে কোত্থেকে ধরে আনবেন? দুলাভাই তো হুকুম বেধে দিয়েই খালাশ।
মুক্তা নিজেই বলল,
“ আঙ্কেল-আন্টিকে বলে দিলে ভালো হতো না?”
“ তুমি এত চিন্তা না করে স্টেজে যাও। যা হবে দেখা যাবে।”
মুক্তা আর কথা বলল না। করুক যা খুশি! ওর কী?
চুপচাপ ঘাড় নেড়ে ফিরে গেল জায়গায়। মাজহারের মাথা ব্যথা উঠেছে। বরপক্ষ চলে এসেছে শুনেই, বুদ্ধি-বিবেচনা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছিল। মনে হচ্ছিল,আপাতত ব্যাপারটা ম্যানেজ করা দরকার। এই মেয়েকে স্টেজে বসিয়ে রেখে,নিজেদের মেয়েকে খুঁজবেন। এরপর পেয়ে গেলে নাহয় আরামসে অদলবদল করা যেতো। কিন্তু এখন তো সে আশাও শেষ।
যত দিকে, যত লোক পাঠালেন সবার একই উত্তর, “ খুঁজে পাচ্ছে না।”
আবার এই মুহুর্তে তুশিকেও স্টেজ থেকে উঠিয়ে আনা যাবে না। পরিস্থিতি এখন যা হাতে আছে , তাহলে তাও বিগড়ে যাবে। মেয়েটা মুখ খুললেও বিপদ! নাহ,কিছু একটা ভাবতে হবে এখন। অনেক বড়ো, শক্ত কিছু। যাতে সাপও মরবে,লাঠিও ভাঙবে না। বিপদ যখন নিজেই বাড়ালেন,ওনাকেই তো কমাতে হবে তা।
কাজী আসার কথায়, মাথায় বোম পড়ল তুশির। এ ব্যাটা এলেই তো কবুল বলতে বলবে। কবুল বললে না বিয়ে হয়ে যায়?
কী আজগুবি কথা!
তুশির বিয়ে হবে কোথাকার কোন ভাল্লুকের সাথে? হায় খোদা,এখন!
ভদ্রলোকের সাথে আরো বেশ কজন এলেন। অল্প ভিড়েই ভরে গেল জায়গাটা। খাতা খুলেছেন তিনি।
হাঁ করবেন কিছু বলতে,আচমকা তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ল তুশি।
সবার নজর একইসাথে বর্তাল এদিকে।
সেন্টারে মোট তিনটে রুম।
একটা খাওয়া-দাওয়ার,যেটা সবচেয়ে বড়ো। অন্যটায় স্টেজ। আরেকটা কোণার দিকে, ছোটো ঘর। যেখানে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র আপাতত রেখেছেন ওনারা।
মেয়ের মা এতক্ষণ স্বামীর সাথে ছিলেন। সবে সবে বুকে ব্যথা সেড়েছে মানুষটার। মেয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালানোর ঝোক্কি তো আর মাথা থেকে যায়নি। কখন কী হয়ে যায়!
ভদ্রমহিলা স্টেজের এদিকটায় এসে দাঁড়ালেন এবার।
বরকে বরণ করার পর আর পা ফেলেননি এখানে।
স্টেজে লেহেঙ্গা পরিহিত,এক ঘোমটাওয়ালি দেখেই আঁতকে উঠলেন রমণী।
তার মেয়েকে তো এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে স্টেজে ওটা কে?
উদ্বীগ্ন পা জোড়া বাড়াতে গেলেই,পেছন থেকে হাতটা চেপে ধরলেন মাজহার।
আস্তে করে বললেন,
“ যেও না আপা।”
“ স্টেজে কে বসে আছে?”
মাজহার এদিক-ওদিক সতর্ক চোখ বোলালেন।
আরো ধীর করলেন গলার স্বর,
“ ওই বস্তির মেয়েটাকে বসিয়েছি।”
ভদ্রমহিলা যেন আকাশ থেকে পড়লেন,
“ কী বলছিস! কেন?”
“ চুপ করে থাকো, আপা। বোকার মতো কাজ করে ফেলেছি। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই।”
তুশি খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না, চড়ছে না দেখে এক ভদ্রমহিলা শুধালেন,
“ কী হয়েছে, মা? কিছু লাগবে?”
মুক্তার চোখমুখ আশঙ্কায় কাঠ।
কথা টেনে নিলো,
“ মনে হয় ওয়াশরুমে যাবে। ওয়াশরুমে যাবি?”
তুশি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল। ওয়াশরুম কেন,আপাতত যেকোনো এক রুমে যেতে পারলেই হবে। ওই মাজহার ব্যাটাকে খুঁজতে হবে তো। ওকে ফাঁসিয়ে দিয়ে কই ঘাপটি মারতে গেল?
মুক্তা ওকে সাথে নিয়ে হাওয়ার গতিতে নেমে এলো নিচে । মাজহার দেখেই বুঝলেন ঘটনা কী!
চ সূচক শব্দ করে হেঁটে এলেন কয়েক পা।
তুশি সোজা সেই কোনার রুমটায় ঢুকেছে। মাথার ঘোমটা এক টানে খুলে চারপাশটায় দেখল । মাজহারও ঢুকলেন তখনি। প্রথমেই মুক্তাকে বললেন,
“ তুমি বাইরে যাও। দেখো ওদিকটা!”
মেয়েটা বাধ্য। বিদেয় নিলো এক কথায়। পরপরই খ্যাক করে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক,
“ কী সমস্যা তোর? ওভাবে নেমে এলি কেন?”
তুশিও কম যায় না। তার কণ্ঠও একইরকম,
“ তো কী করব? দেখছেন না কাজী চলে এসেছে? আরেকটু বসে থাকলেই তো বিয়ে হয়ে যেতো।”
“ গেলে যাবে। সেজন্যে নেমে আসবি?”
তুশির চোখ কপালে উঠে গেল। হতবাক আওড়াল,
“ মানে! গেলে যাবে মানে কী? আপনি তো বলেছিলেন শুধু কিছুক্ষণ বসে থাকার কথা। তারপর আপনাদের মেয়ে পেয়ে গেলে,আমার সাথে পাল্টা-পাল্টি হবে। তাহলে এখন অন্য সুর তুলেছেন কেন?”
মাজহার বললেন,
“ বলেছিলাম,কিন্তু এখন সেরকম হবে না। মেয়েকে পাওয়া যায়নি। হয়ত শহরের বাইরে চলে গেছে।”
“ তাতে আমার কী? আমার সাথে যা কথা হয়েছিল,সেটাতো করেছি তাই না? এখন টাকা দিন।”
তুশি হাত পাতল।
মাজহার রেগে বললেন,
“ টাকা টাকা করবি না,মেয়ে। বলেছি তো দেবো। স্টেজে গিয়ে বোস। যা।”
“ এটা কি ইয়ে হচ্ছে নাকি? মানে ফাজলামো করছেন আমার সাথে? আবার গিয়ে বসব মানে!
দেখছেন না বিয়ে পড়ানোর তোড়জোড় চলছে! আমি ওসব বিয়ে টিয়ের চক্করে নেই। চুপচাপ টাকা দিন নাহলে কিন্তু…”
“
নাহলে কী হ্যাঁ? কী নাহলে! কাজ শেষ না করলে একটা টাকাও পাবি না।”
তুশি ভীষণ চটে বলল,
“ ঠিক আছে,তাহলে আমি এক্ষুনি গিয়ে সবাইকে বলে দেবো যে আপনাদের মেয়ে ভেগে গেছে। আর সেজন্যে আমাকে এখানে বউ সাজিয়ে বসিয়ে রেখেছেন আপনি।”
“ ভয় দেখাচ্ছিস আমাকে?”
“ হ্যাঁ, দেখাচ্ছি। করব,দেখবেন?”
মাজহার হ্যাঁ /না বললেন না।
তুশি বাইরে যেতে হাঁটা ধরল ঘুরে। অমনি পিছু ডাকলেন তিনি,
“ দাঁড়া।”
তুশি ঠোঁট কামড়ে হাসল। এইত বাছা,লাইনে এসো।
ফিরে চাইল গম্ভীর মুখে। মাজহার শুধালেন,
“ তুই জানিস এটা কার বিয়ে?”
তুশির কণ্ঠে অনীহা,
“ কার?”
“ এ এসপি ইয়াসির আবার স্বার্থের। মতিঝিলের নাম করা পুলিশ অফিসার।”
চমকে উঠল তুশি।
গোটা আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ার মতো আর্তনাদ করে বলল,
“ কী?”
তার চোখেমুখে ভয় দেখে বুকে বল পেলেন মাজহার। ভাবলেন,বস্তির ছা-পোষা মেয়ে, পুলিশের নাম শুনেই ঘাবড়ে গেছে। ক্রুর হেসে বললেন,
“ হ্যাঁ। চিনিস তাকে? খুব ডেঞ্জারাস কিন্তু। এতটুকু চাকরির বয়সে এর মতো বারবার ট্রান্সফার কেউ হয়নি।
এইত কদিন আগেও,এমপি রুস্তম আহমেদের ছেলেকে একটা কেসে দশ বছরের সাজা পাইয়ে দিলো। আজকে এখানে তারই বিয়ে।”
তুশির সব প্যাঁচ বেঁধে গেল। গ্রহ-নক্ষত্রের মতো জট পাঁকিয়ে গোল গোল হয়ে ঘুরল মাথাটা।
আজকে ওই পুলিশের বিয়ে হচ্ছে এখানে? ও কি তারই হাত ধরেছিল তখন? এতক্ষণ পাশাপাশিও বসেছিল!
ওই পুলিশ যে কতটা ডেঞ্জারাস সেতো তুশি মারপিট দেখেই বুঝে গেছে।
ওরে তুশি,কোথায় ফেঁসে যাচ্ছিস তুই!
মেয়েটা মনের ভয় চেষ্টা করল লুকাতে। কণ্ঠে চোটপাট বজায় রেখে বলল,
“ ত তো? আমি,আমি কী করব?”
মাজহার হাসলেন। বললেন,
“ বোকা মেয়ে!
পুলিশের বিয়েতে বউ সেজে এতক্ষণ স্টেজে বসেছিলি,এ কথা জানাজানি হলে ক্ষতিটা আসলে কার? তোর নিজেরই।
ইয়াসিরকে তো চিনিস না। যদি জানতে পারে এসব,আমাকে কিছু বলবে না। যা বলার তোকে বলবে। কারণ আমরা বড়ো মাপের বড়ো মানুষ। সিদ কেটে বেরিয়ে আসার অনেক কৌশল জানি। ফাঁসবি তুই। ফ্রড কেসে সোজা জেলে ভরে দেবে। তখন কী করবি? ভালো উকিল দিয়ে জামিন পাবি তাও তো হবে না। বস্তিতে থাকিস,এসবের মুরোদ কই?
তার চেয়ে আমি যা বলছি শোন,
চুপচাপ গিয়ে স্টেজে বোস। বিয়ে তো আর সত্যি সত্যি হবে না।ওরা নাহয় জানে না,মেয়ে বদলে গেছে। তুই আর আমিতো জানব। মিথ্যে মিথ্যে বিয়ে করলে কিছু হবে না। বিয়ে পড়াতে দে। সেন্টার থেকে আস্তেধীরে আত্মীয়-স্বজনের ভিড়টা কমে যাক। যখন শুধু দুই পরিবারের লোক থাকবে? আমি তোকে ঠিক বের করার একটা উপায় বানিয়ে দেবো। তখন তুই তোর মতো নিজের বাড়ি চলে যাস। কিন্তু এখন কোনোরকম কোনো ফাতরামো করা যাবে না। সেন্টার ভরতি লোক,জানলে সমস্যা হবে। যদিও আমার চিন্তা নেই,কারণ ফাঁসবি তো তুই!”
তুশি ভয় পেলো। ভীষণ ভয়! মাজহারের হুমকিতে কী না জানে না,তবে ইয়াসিরের শক্তপোক্ত মুখটা ভাসল চোখে। গলবিল শুকিয়ে এলো খুব। টেবিলের ওপর জলের বোতল ছিল,হাতে তুলেই ঢকঢক করে পানি খেল তুশি। মাজহার মিটিমিটি হাসছেন। টোপ তাহলে ভালোই গিলেছে।
কিন্তু আপাতত এই মেয়ে ছাড়া তার কাছে দ্বিতীয় উপায় নেই। পরিস্থিতি সামলাতে ভুল একটা করলেও,এখন সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরে যা হবে,দেখা যাবে নাহয়।
তুশি অনেকটা পানি খেলো।
হাত দিয়ে মুখ মুছে শ্বাস নিলো বড়ো করে। কণ্ঠে অনিশ্চয়তা ,
“ সত্যি আমাকে বাড়ি যাওয়ার উপায় করে দেবেন তো! কিছু হবে না তো! আমি আমার মতো বের হতে পারব তো!”
“ পারবি। যদি আমার কথা শুনিস তাহলে পারবি। এই যে বেঁকে বসলি একটু আগে,এরকম হলে আমি কোনো কিছুতে নেই। টাকা তো পাবিই না,উলটে…”
“ বুঝেছি বুঝেছি। ফাঁসিয়ে দেবেন এইত?”
ভদ্রলোকের স্বরটা এবার নরম হলো।
বললেন,
“ হ্যাঁ। বললাম না, তোমাকে বাঁচিয়ে নেবো? বিশের জায়গায় দরকার হলে আরো দশ হাজার বেশি পাবে।
শুধু শুধু ইয়াসিরের হাতে ফ্রড কেস খাওয়ার থেকে আমার কথা শোনো। স্টেজে ফিরে যাও।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেই তোমাকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দেবো।”
তুশি তাও চিন্তায় ভুগছে। একরকম উভয় সংকটে থুবড়ে পড়েছে বেচারি। এই লোকের কথা একদিকে ঠিক।
জেলে ঢুকলে বের হয়ে আসার মতো ক্ষমতা,টাকা কিছুই ওদের নেই। যদি সত্যিই উল্টোপাল্টা কেসে ফাঁসিয়ে দেয়? ওই বদ পুলিশকে তো তুশি চেনে। বউ ভেগে গেছে শুনলে রাগ ওর ওপরেই ঝাড়বে।
আবার পালানোর উপায়ও বন্ধ। ওর জামাকাপড় গুলো কোথায় কে জানে! এই বিয়ের পোশাক পরে পালাতে গেলেও,সদর দরজা পেরোতে হবে। দেখে ফেলবে সবাই। তখন ঠিকই পাকড়াও করবে না?
তুশি সব ভেবে একটা কঠিন সিদ্ধান্তে এলো। মাজহার যা বলছে তাই করার সিদ্ধান্ত! লোকটা তো বলল ওকে বাঁচাবে। তাহলে এত চিন্তা কীসের! তুশি তো জানে এটা সত্যি বিয়ে না। ও ওর মতো,ইয়াসির নিজের মতো।
টিনটিন, বাবলু অধৈর্য হয়ে পড়েছে। কত সময় কেটে গেল,তুশি এখনো আসেনি। খিদেয় পেটের হাড় পিঠের সাথে লাগার দশা। না, ওদের সহ্যে আর কূলালো না। ওপাড় থেকে রাস্তা পেরিয়ে চলে এলো এপাশে।
সেন্টারের বাইরে উঁকিঝুঁকি দিলো কতক্ষণ। বাবলু বলল,
“ গেল কই ক তো। এহনো আইল না ক্যান?”
“ জানি না। ওস্তাদ তো এত্ত দেরি করার লোক না। খুদা যে লাগছে ভাই!”
“ আমারো।”
“ ভিত্রে যাবি?”
“ ল যাই।”
টিনটিন বাবলু ভালো করে চারদিকটা দেখল। এসব সেন্টারের বাইরে দারোয়ান-টারোয়ান থাকে না। সুযোগ বুঝে যেই ঢুকতে যাবে,ধমকে উঠলেন এক ভদ্রলোক,
“ এই ছেলেরা কই যাস?”
ভয়ে থেমে গেল দুজন। টিনটিন বলল,
“ ভিত্রে যাই।”
“ কেন? ভিতরে কী?যাওয়া যাবে না ওখানে।”
ভদ্রলোক ওদের ময়লা জামাকাপড় দেখে পথচারী ভেবেছেন। মনে হয়ত দয়া হলো! নিজেই
বললেন,
“ এখানেই দাঁড়া৷ আমি খাবার এনে দেই।”
ওরা মাথা নাড়ল।
লোকটা হাত তুলে কাউকে ডাকতে গেলেন। অন্যমনষ্কতার সুযোগ পেতেই,ছুটে ঢুকে গেল ওরা।
ভদ্রলোক ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন।
“ এই, এই কই যাস!”
বলে পিছু ছুটলেন ত্রস্ত।
তুশির বুকে সাহস নেই। হাত পা টলছে। গলার নীল শিরা স্পষ্ট! ঢিপঢিপ করছে ভেতরটায়।
কোনোরকম হেলতে দুলতে স্টেজের কাছে এসে দাঁড়াল। রেহনূমা এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন কোমল গলায়,
“ তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?” তুশির মাথায় ঘোমটা। উত্তরে ঘাড় নাড়ল দুপাশে।
কাজী বললেন,
“ বোসো মা। বিয়ে পড়ানো শুরু করি।”
তুশি অবশ পা টেনেটুনে বসল কোনোরকম। ওর ঠিক পাশে এই মুহুর্তে যে মানুষটা বসে আছে,সে ইয়াসির। সেই ইয়াসির যে ওরই সামনে রুহান নামক ছেলেটাকে মেরে কাত করে ফেলেছিল।
তুশির হাত-পায়ের তালু ঘেমে একশা। হাঁ করে করে শ্বাস নিচ্ছে। হাঁসফাঁস লাগছে বড্ড। এতক্ষণ নির্ভীক চিত্তে বসে থাকা তরুণী , হঠাৎ কেমন শঙ্কায় নেতিয়ে রইল। এই শঙ্কা তো যে সে শঙ্কা নয়। এর নাম,ইয়াসির আবরার সার্থ!
পাশ থেকে একজন বললেন,
“ মেয়ের বাবা কোথায়? বিয়ে হবে,মেয়ের পাশে এসে বসুন।”
মাজহার কোত্থেকে উড়ে এসে দাঁড়ালেন। হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
“ আসলে দুলাভাইয়ের মন ভালো নেই। বুঝতেই পারছেন, একমাত্র মেয়ে। আমি বরং বসি।”
কেউ আর মানা করলেন না। মামা তো বাবার মতোই।
অদূরে দাঁড়ানো কনের বাবা বিরক্ত শ্বাস ঝাড়লেন। স্ত্রীর কাছে সবটা শুনেছেন তিনি।
“ ওকে এসব কে করতে বলেছিল?”
“ আমি কী বলব বলো,আমিও মাত্র জেনেছি।”
“ শওকত সাহেব এসব জানলে কী হবে ভাবতে পারছো?”
ভদ্রমহিলা বললেন,
“ বলল তো সব সামলে নেবে। ওর ওপর যেন ছেড়ে দিই ব্যাপারটা। এখন চুপচাপ থাকো। কাকতালীয় ভাবে এ মেয়ের নামও তুশি। কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”
ভদ্রলোক কটমট করে বললেন,
“ এইসব তোমার মেয়ের জন্যে হয়েছে। ও মেয়ে যেটা করল আজ,আমি ওকে জীবনে ক্ষমা করব না। এ বাড়ির দরজা তো চিরদিনের মতো বন্ধ!”
রমণীর মুখখানা চুপসে গেল।
তবে উচ্চবাচ্য করলেন না। স্বামী নামক মানুষটার ওপর দিয়ে যা যাচ্ছে,তিনি বোঝেন। কেন যে মেয়েটা করতে গেল অমন!
স্টেজে বিয়ে পড়ানো শুরু হয়েছে। তুশি ঢোক গিলছে শুধু। পুরো শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। এরকম কোনোদিন ওর সাথে হয়নি। না,কক্ষনো না। এতটা ভয়,এতটা চিন্তা তুশির অভিধানে আজকেই প্রথম।
কেন যে মরতে রাজি হয়েছিল!
কাজী সাহেব বরের সমস্ত তথ্যাদি পড়ে পড়ে শোনালেন। শেষে বললেন,
“ বলো মা, কবুল!”
তুশির কণ্ঠরোধ। জিভের মধ্যে আস্ত পাহাড় বসেছে।
ফ্যাসফ্যাসে শ্বাস উঠেছে গলায়৷ প্রথমবার অনুভব করছে শরীরের এই নির্বাধ ভূমিকম্পের। এমন তো হবার কথা নয়৷ এটাত মিথ্যে বিয়ে,তাই না?
মনকে খিঁচে শক্ত করল তুশি। যত তাড়াতাড়ি ও বিয়েটা করবে,তত তাড়াতাড়ি মুক্ত হবে এখান থেকে। দাদি নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে বাড়িতে!
তাই সাথে সাথে বলল,
“ কবুল!”
গুণে গুণে তিনবার হতেই ভ্রু কুঁচকে ফিরল ইয়াসির। এই কণ্ঠস্বর তার ভীষণ চেনা। কোথাও যেন শুনেছে।
কিন্তু, যে মেয়ের সাথে ওর বিয়ে হলো তার গলার স্বর তো এতটা রিনরিনে নয়। গত কাল রাতেও তো বিয়ের ব্যাপারে ফোনে কথা হলো। ইয়াসিরের পরিষ্কার মনে আছে সেসব।
নাকি এত আওয়াজের মধ্যে ভুল শুনেছে ও!
ইয়াসির এবার ভালো করে তুশির দিকে চাইল। মুখ ঢাকা। ব্লাউজের লম্বা হাতার ফাঁক গলে শুধু কব্জি দুটো বেরিয়ে৷ হাতে ছোটো ছোটো সাদা নখ। এক ফোঁটা মেহেদিও নেই। এরকম ব্রাইড হয়?
তারওপর তুশি মেয়েটা তো একটু চাপা রঙের! অথচ হাত দুটো এখন ভীষণ ফরসা লাগছে না?
কাজী সাহেব তখনই বললেন,
“ বলো বাবা,কবুল।”
ইয়াসির নিজেকে সামলাল। রাশ টানল সন্দিহান চাউনির। নাহ, ও হয়ত বেশি বেশি ভাবছে। হতে পারে মেয়েটার মেহেদিতে এলার্জি, তাই পরেনি। বা অন্য কোনো সমস্যা।
ইয়াসির আর মাথা ঘামাল না। চটপট বলে দিলো,
“ কবুল।”
স্টেজের আশপাশ ভরে উঠল, আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! ধ্বনিতে।
শওকতের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। মুগ্ধ হয়ে বরবেশী ইয়াসিরকে দেখছেন। এইত,কদিন আগেই চোখের সামনে একটু একটু করে বড়ো হলো ছেলেটা! আর আজ তার নিজের একটা সংসার হতে যাচ্ছে।
তনিমা যে কেন এলো না! কী সব ছেলের বিয়েতে মায়েদের যেতে নেই বলে,বাড়িতে থেকে গেল। ইয়াসিরের এই বিয়ের মুহূর্তটা দেখলে,সেও আবেগে আপ্লুত হতো নিশ্চয়ই!
ইয়াসির খেয়াল করল, তুশির আঙুল ঠকঠক করে কাঁপছে। কপালে ভাঁজ বসল ওর। স্পষ্ট চোখে দেখল আরো। শুধু আঙুল নয়,তুশির বাহুর কাঁপা-কাঁপিও পরিষ্কার।
ইউশাকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকল ইয়াসির। মেয়েটা ত্রস্ত এসে দাঁড়াল। কান পাততেই আস্তেধীরে বলল,
“ ওনাকে জিজ্ঞেস কর তো,কোনো অসুবিধে হচ্ছে কী না।”
ইউশা চলে এলো এপাশে। একটু-আধটু হাসি ঠোঁটে। ভাইয়া বিয়ে করতে না করতেই বউয়ের সুবিধে নিয়ে মরিয়া!
মেয়েটা তুশির কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
“ ভাবি, কোনো সমস্যা? কিছু হয়েছে?”
তুশি মাথা নাড়লো দুপাশে। বোঝাল,না।
ইউশা ফের জিজ্ঞেস করল,
“ পানি খাবেন?”
তুশি ভেবেছিল কথা বলবে না। বেখেয়ালে মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো,
“ না না,কিছু লাগবে না।”
তড়িৎ ভ্রু কুঁচকে ফেলল ইয়াসির। এইবার কণ্ঠস্বর সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। না,এটাত তুশির আওয়াজ নয়। এই আওয়াজ তার পরিচিত! তবে ওই মেয়ের হবে না।
তার সন্দেহ প্রগাঢ় হলো। ভীষণ খটকায়, সরু করল চোখ।
শক্ত কণ্ঠে শুধাল,
কাছে আসার মৌসুম পর্ব ৯
“ কে আপনি?”
তুশির বুকখানা ছ্যাৎ করে উঠল।
কে আপনি মানে?
বদ পুলিশ কি সব ধরে ফেলল?