চন্দ্রাস্ত পর্ব ৪
ফারহানা কবীর মানাল
মহিউদ্দিন সাহেব বারান্দায় বসে আছেন। চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা তুলে রেখেছেন। হাতে চায়ের কাপ। আগুন গরম চা থেকে ধোঁয়া উঠছে। থেমে থেমে শান্ত ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। নাইমা তার কাছে গিয়ে বসল। নিচু গলায় বলল, “আব্বা, আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।”
তিনি চোখ তুলে তাকালেন। বিস্মিত গলায় বললেন, “কি কথা? আর চোখ-মুখের অবস্থা এমন করে রেখেছ কেন?”
“আপনাকে আমার সাথে আসতে হবে। কিছু দেখাতে চাই।”
তঝনও সামান্য চা অবশিষ্ট ছিল, তবু তিনি কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালেন। মেয়েকে অনুসরণ করে পুকুর ঘাটে চলে গেলেন। নাইমা তাকে সিঁড়ির কাছে নিয়ে গেল। সরু গলায় বলল, “এখানটা ভালো করে দেখেন। একটু আগে ভাবী এখানে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিল। মিলি আপু কাপড় ধুয়ে সাবান পানি ফেলে রেখে গেছে।”
“কি বলতে চাইছ? মিলি ইচ্ছে করে এমন করেছে?”
“অসম্ভব কিছু নয় আব্বা। দুলাভাইয়ের মৃ’ত্যুতে খুব কষ্ট পেয়েছে। হতে পারে প্র’তি’শো’ধ নেবার জন্য এমন করেছে।”
মহিউদ্দিন সাহেব একটু গম্ভীর হয়ে পড়লেন। হাত দিয়ে সিঁড়ির ওপর ভালোমতো পরীক্ষা করে বললেন, “শুধু সাবান পানি নয়, তেলও আছে মনে হচ্ছে।”
“এটাই বোঝাতে চাচ্ছিলাম। বারবার করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলার পরও তেলতেলে ভাব রয়ে গেছে। মন বলছে এসব উনি ইচ্ছে করে করেছেন। যেন আমাদের বিপদে ফেলতে পারেন।”
“এমন মনে হবার কারণ?”
“জানি না আব্বা। তবে আপার ঘটনার পর সবকিছুতেই স’ন্দে’হ হয়। কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না।”
সে থেমে গেল। খানিকটা সময় ইতস্তত করে বলল, “মনে পড়ে আব্বা? সোহেল মা’রা যাবার পর আপা আর দুলাভাই দুজনে ভাইয়ার সাথে মিলি আপুর বিয়ে দিতে চেয়েছিল। বলেছিল- যে মেয়ে নিজের ছেলেকে দেখে রাখতে পারে না, তাকে দিয়ে সংসার হয় না। নববীকে ছেড়ে মিলিকে বিয়ে করতে। মিলি আপুর মত না থাকলে কি তারা এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারত? পারত না।”
মহিউদ্দিন সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, “আল্লাহ তোমাকে অনেক বুদ্ধি দিয়েছে। আশা করি এ বুদ্ধি ভালো কাজে ব্যবহার করবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নাইমা মাথা নিচু করে রইল। হঠাৎই তার লজ্জা লাগছে। নববী নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। বিছানায় শুয়ে আছে। তবে শান্ত থাকতে পারছে না, শরীর মন কেমন অস্থির লাগছে। শরিফা বেগম তার ঘরে ঢুকলেন। বিছানায় বসতে বসতে বললেন, “মেয়ে মানুষ এমন অসাবধান হলে চলে না। নিজের কথা না ভাবলেও পেটের সন্তানের কথাটা একটু ভাবো। আজ তোমার ভালো-মন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে হাবিবকে কি জবাব দিতাম? তুমিই বা কিভাবে ওর সামনে দাঁড়াতে?”
নববী কিছু বলল না। চুপচাপ চোখের পানি ফেলতে লাগল। শরিফা বেগম মনে মনে কয়েকটা কঠিন কথা সাজিয়ে নিচ্ছিলেন, তবে তা বলতে পারলেন না। তার আগে নাইমা এসে বলল, “আব্বা তোমাকে ডাকছে।”
তিনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। এলোমেলো পা ফেলতে ফেলতে বললেন, “আবার কি হলো? এই আমি আসছি।”
মহিউদ্দিন সাহেব বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। তার চোখ-মুখ শক্ত। শরিফা বেগম ঘরে ঢুকতে তিনি ইশারায় দরজা লাগিয়ে দিতে বললেন। ভদ্রমহিলা দরজা লাগিয়ে দিয়ে স্বামীর পাশে বসলেন। বললেন, “কি হয়েছে? জরুরি কিছু বলবেন?”
তিনি বরফ শীতল গলায় বললেন, “মিলির এই বাড়িতে থাকার ব্যাপারটা তুমি কেমন ভাবে দেখছ?”
“কেমন ভাবে দেখব? একজনের অপরাধ অন্যজনের কাঁধে চাপানো উচিত না। মেয়েটা এসে ভালোই করেছে। কতদিন বাদে নাতির মুখ দেখলাম।”
“ঠিক। একজনের দোষ অন্যজনের কাঁধে চাপানো উচিত না। তবে তোমার ওই পরিবারের সদস্যদের প্রতি এমন আন্তরিক ব্যবহারের কারণ? আগে না হয় তোমার মেয়ে ছিল, কিন্তু এখন কেন?
শরিফা বেগম কিছু বলতে পারলেন না। শূন্য চোখে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, “আমি এই বাড়ির অভিভাবক, আশা করি তুমি এ কথা অস্বীকার করবে না।”
“অস্বীকার করব কেন? কখনোই অস্বীকার করব না।”
“বাড়ির অভিভাবক হিসাবে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মিলিকে এই বাড়িতে রাখতে চাই না। রোহান বাচ্চা ছেলে, তোমার তাকে দেখতে ইচ্ছে করতেই পারে। তেমন হলে আমাকে বলবে, আমি গিয়ে ওকে এই বাড়িতে নিয়ে আসব। তবে মিলি আর আসবে না।”
কথাগুলো তার পছন্দ হলো না। তবে তিনি কিছু বললেন না। দুপুরে খাবার সময় মহিউদ্দিন সাহেব মিলিকে বললেন, “তোমার বাবা কল দিয়েছিলেন। বললেন– তোমার মায়ের শরীর ভালো না। সংসারের কাজকর্ম করতে পারছেন না।”
মিলি আৎকে উঠে বলল, “সেকি কথা! মায়ের কি হয়েছে?”
“তা জানি না। আজকেই তোমাকে বাড়ি ফিরতে বলেছেন।”
সে রোহানের দিকে তাকাল। নরম গলায় বলল, “রোহান যেতে চাইবে না।”
“রোহান যেতে না চাইলে সমস্যা কি? এখানেই থাকুক। আমরা সবাই ওর খেয়াল রাখব।”
মিলি বলল, “রোহান আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। কি রোহান থাকতে পারবে?”
রোহান মাছের কাটা বাছতে ব্যস্ত হয়ে ছিল। কাজ থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “আমি পারব।”
মিলি সত্যিকার অর্থে নিভে গেল। কোন রকমের খাওয়া শেষ করে বলল, “ঠিক আছে। রোহান থাকুক। ক’দিন পর এসে নিয়ে যাব।”
মহিউদ্দিন সাহেব কঠিন গলায় বলল, “তোমাকে আসতে হবে না। আমি গিয়ে দিয়ে আসব।”
সে আর কিছু বলতে পারল না। হাত ধুয়ে ঘরে চলে গেল। কাপড়-চোপড় গোছাতে গোছাতে ভাবল- যা হয় ভালোর জন্যই হয়। হাবিব ভাই বাড়িতে নেই। শুধু শুধু এখানে থাকার কোন মানে হয় না। সে ফিরলে না হয় আসব। ততদিন রোহান এখানেই থাকুক। মিলির গোছগাছ প্রায় শেষ, নাইমার তার মুখের সামনে ভেজা কাপড় উঁচু করে ধরে বলল, “আপনার জিনিস ভুলে যাচ্ছেন।”
মিলি তার হাত থেকে কাপড়টা নিলো। নাইমা বলল, “সাবধানে যাবেন। আপনার জন্য সহানুভূতি এবং শুভকামনা রইল।”
মিলি ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বলল, “এ কথা কেন বলছ?”
“পরিকল্পনায় অসফল হবার জন্য সহানুভূতি জানালাম।”
“মানে?”
“পৃথিবীর সবাইকে বোঝাতে পারলেও আমাকে এ কথা কখনোই বিশ্বাস করাতে পারবেন না যে সিঁড়িতে সাবান পানি অনিচ্ছাকৃত রেখেছেন। বেশ ভালোই বুঝতে পারছি আপনি ভাবীর ক্ষ’তি করতে চাইছেন। তবে সফল হবেন না।”
“আমি কেন তোমার ভাবীর ক্ষ’তি চাইব? তার সাথে আমার কিসের শ’ত্রু’তা?”
“হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বিতার। মনে পড়ে- গতকাল আপনার জন্য শুকনো খাবার নিয়ে এসেছিলাম? তখন বিছানার ওই কোণে আপনার মোবাইলটা রাখা ছিল। আমার সাথে কথা বলার সময় হঠাৎই ফোনে একটা নোটিফিকেশন আসে। ফোন স্কিন জ্বলে ওঠে।”
“তাতে কি এমন হয়েছে?”
“আপনার মোবাইলের ওয়ালপেপারের আমার ভাইয়ের ছবি দেওয়া। কেন দিয়েছেন?”
মিলি চমকে উঠল। দাঁতে দাঁত চিপে বলল, “তোমার মনে হয় না তুুমি একটু বেশিই বলছ? এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি ছোট, ছোট মানুুষের এসব থেকে দূরে থাকা উচিত।”
“বেশি বলছি এ কথা আমার মনে হচ্ছে না। আপনি যদি একটু কষ্ট করে পৃথিবীর দিকে তাকান। দেখবেন- অনেক মানুষ বয়স অপেক্ষা অনেক বেশি বোঝে। কিছু বাচ্চা বড় থেকেও বিদ্যাবুদ্ধিতে এগিয়ে থাকে।”
“তারা বিশেষ হয়। তুমি কি নিজেকে বিশেষ কেউ মনে করো নাকি?”
“বিবেক-বুদ্ধি আল্লাহর তরফ থেকে এক বিশেষ রহমত। বয়সের তুলনায় তিনি আমাকে একটু বেশি বুদ্ধি দিয়েছেন। অবশ্য কিছু মানুষের বিবেক থাকার পরও তা কোন কাজে আসে না, কারণ তার অন্তরে শ’য়’তা’ন বসবাস করে। সে বিবেকের দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়।”
“তুমি কি আমার সাথে যু’দ্ধ করতে চাইছ?”
“যুগ যুগ ধরে ভালো মানুষের সাথে খারাপ মানুষের যু’দ্ধ চলছে। আপনি চাইলে আমার কোন আপত্তি নেই।”
মিলি হাসল। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “তোমার কথায় একটা খনার বচন মনে পড়ল- অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে।”
“ঠিক। তবে ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হয় না। আমি ব্যতিক্রম একজন। এ উদাহরণ আমার জন্য না।”
মিলির আর কিছু বলবে তার আগে মহিউদ্দিন সাহেব ঘরে ঢুকলেন। সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, “গাড়ি ঠিক করেছি। এসো তোমাকে উঠিয়ে দিয়ে আসি।”
মিলি ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় তীক্ষ্ণ চোখে নাইমার দিকে তাকাল। নাইমা শুধু হাসল। সরল হাসি। সে হাসি দেখতে বেশ ভালো লাগল।
শরিফা বেগম ভেজা চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছেন। দীর্ঘ এত বছরের সংসার জীবনে এই প্রথম মহিউদ্দিন সাহেব তাকে এত কঠিন কথা শুনিয়েছেন। তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছলেন। ভেজা গলায় বললেন, “আমি নিজের ছেলের সংসার ভাঙতে চাই। এমন কথা কিভাবে বলতে পারলেন?”
মহিউদ্দিন সাহেব ভরাট গলায় বললেন, “সত্যিটা বলেছি। নিজের কাজ নিজেই মানতে পারছ না?”
তিনি জবাব দিলেন না। আঁচলে সর্দি মুছলেন। ইসস! ঘেন্নাপিত্তি নেই যেন!
মিলি বাড়ি পৌঁছে দেখল তার মা বিশাল সাইজের কাতলা মাছ কুটছে। সে ব্যাগ রেখে মায়ের পাশে গিয়ে বসল। বলল, “শরীর খারাপ নিয়ে এসব করছ কেন? আব্বা কোথায়?”
ভদ্রমহিলা বিস্মিত গলায় বলল, “কার শরীর খারাপ?”
“কেন তোমার? সেজন্যই তো ফিরে এলাম।”
“কিসব ভুলভাল বকছিস? আমার শরীর খারাপ হবে কেন? সামান্য সর্দি-কাশি পর্যন্ত নেই।”
সে কিছু বুঝল। মনে মনে বলল, “নাইমা মেয়েটাকে ভালো মনে করেছিলাম। এই দেখছি জাত শ’য়’তা’ন। বাপটাকেও সব বলে দিয়েছে।”
মিলি কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, “আব্বা কোথায়?”
“ঘরে বসে আছে। সকালের বাসি খবরে কাগজ পড়ছে। পারলে তাকে এক কাপ চা করে দিয়ে আয়।”
মিলি রান্নাঘরে গেল। কাপে চা ঢেলে বাবার কাছে নিয়ে বলল, “চা, মা দিতে বলল।”
মানিক মিয়া চায়ের কাপ হাতে নিলেন। খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, “রোহান কোথায়? তাকে নিয়ে আসিসনি? ভেবেছিলাম তোকে একটা কল করব। পরে আর মনে ছিল না।”
“আংকেলের সাথে কথা হয়েছে নাকি?”
চন্দ্রাস্ত পর্ব ৩
“কে? রোহানের নানা? না, তার সাথে কোন কথাবার্তা হয়নি।”
মিলির যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। বাপ মেয়ে ফন্দি করে তাকে ওই বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এতে কি হবে? সে যা চায়, তা সে পেয়েই ছাড়বে। প্রয়োজনে কেঁড়ে নেবে। এখন আর কোন কিছুর পরোয়া নেই।