চন্দ্রাস্ত পর্ব ৮

চন্দ্রাস্ত পর্ব ৮
ফারহানা কবীর মানাল

মায়ের ডাকে সে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। শরিফা বেগম বাইরে যাবার জন্য তৈরি। দু-হাতে বড় সাইজের দু’টো বাজারের ব্যাগ ধরে আছেন। ব্যাগের ভেতর একটা বড় সাইজের লাউ দেখা যাচ্ছে। তিনি বেশ বিস্মিত গলায় বললেন, “এখনও বোরকা হিজাব পরে আছিস কেন? এতক্ষণ কি করছিলি?”
নাইমা শান্ত গলায় বলল, “ভাবীকে মিলি আপুর ব্যাপারে বলছিলাম। যে অবস্থা হয়েছে তা চোখে দেখা যায় না।”
“কি অবস্থা হয়েছে মিলির? লা’শ ঠিক আছে?”
“অবস্থা ভালো না, আবার খুব বেশি খারাপ না। গায়ে আঁ’চ’ড়ের দাগ ছিল। তবে মুখ ঠিক আছে। চেহারা বোঝা যাচ্ছে।”

“ওহ আচ্ছা। ঘরের দরজা জানালা আটকে বসে থাকবি। আমি না আসা পর্যন্ত দরজা খুলবি না। দেশের যা অবস্থা! কেউ কোথাও নিরাপদ নেই।”
নাইমা চোখ ছোট করে বলল, “আব্বা, ভাইয়া- এরা আসলেও কি দরজা খুলব না?”
“ফাজলামো করিস না নাইমা। আমি খুব সিরিয়াস কথা বললাম৷ একটা বাচ্চা মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে, শহিদ দিবসের জন্য ফুল তুলতে গিয়ে ধ’র্ষ’ণের শিকার হয়েছে। দু-দিন আগে শুনলাম চলন্ত বাসে ডা’কা’তি, নারী যাত্রী ধ’র্ষ’ণ। অবস্থা বুঝতে পারছিস?”
“মেয়েটার কথা বুঝলাম, একা ছিল। কিন্তু বাসে কি আর কোন লোক ছিল না? কেউ এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করতে পারত না?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কেউ কিছুই বলেনি। ডা’কা’তদের কাছে অ’স্ত্র-পাতি থাকে, সেই ভয়েই বলেনি বোধহয়।”
“আমার না বাসের যাত্রীদের দেখতে ইচ্ছে করছে। জীবনের কাছে মনুষ্যত্ব বিক্রি করে দেওয়া জা’নো’য়া’রদের চেহারাও কি মানুষ মতো হয়?”
শরিফা বেগম জবাব দিলেন না৷ দরজা আটকে দিতে বলে বেরিয়ে গেলেন। নাইমা মা’কে সাবধানে যেতে বলে দরজা আটকে দিলো। নববী বলল, “কি হয়েছে? আম্মা কি বলছিলেন?”
নাইমা তাকে সব বলল। বলল, “এই সমাজে ইসলামের আইন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। যখন ধ’র্ষ’ক’দের ধরে প্রকাশ্য দিবালোকে পাথর নি’ক্ষে’প করে মৃ’ত্যু’দ’ন্ড দেওয়া হবে তখন বাকিদের শখ চিরতরে মিটে যাবে।”
“ঠিকই বলেছ। আমি একটা হাদিসে পড়েছিলাম-
‘যে ব্যক্তি জোরপূর্বক ব্য’ভি’চা:র (ধ’র্ষ’ণ) করবে, তাকে হ’ত্যা করো।” (তিরমিজি, আবু দাউদ)’ অবশ্য এটা একটা সাধারণ অনুবাদ।”

“হাদিসের সহীহ রেফারেন্স না থাকলেও আল-কুরআনে বর্ণিত সূরা মায়েদার তেত্রিশ নম্বর আয়াত অনুযায়ী যারা সমাজে অশান্তি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাদের হ’ত্যা করা যায়। ধ’র্ষ’কদের মতো অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা আর কেউ করতে পারে বলে আমার মনে হয় না। জঞ্জাল কোথাকার!”
“একটা মানুষকে এভাবে মে’রে ফেলা যায় নাকি!”
“তুমি কি ধ’র্ষ’নের পক্ষে সুশীলতা করতে চাইছ? চাইছ যে একজন ধ’র্ষ’ক সমাজের ঘুরে বেড়াক?”
নববী কঠিন গলায় না বলল। নাইমা বলল, “কিছুই আর ভালো লাগে না। সে কথা বাদ দাও। তুমি কেন মিলির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে? তোমার ওই বাড়িতে কি কাজ?”

“মনে আছে? তোমার ভাই যেদিন বাড়ি ফিরেছিল, সেদিন মিলিও রোহানকে নিতে এসেছিল।”
“হুম মনে আছে। মা বলছিল- আব্বা বেশি কথা শুনিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। দাঁড়াতে দেয়নি।”
“ওইদিন মিলি আমাকে কিছু ছবি দেখিয়েছিল। তোমার ভাই অফিসের কাজে যে জায়গায় গেছে, সে-ও সেখানে গিয়েছে। একসাথে একই টেবিলে বসে ছবি তুুলেছে।”
“এটা কি কখনো সম্ভব? তোমার মনে হয় ভাইয়া ওকে সাথে নিয়ে যাবে?”

“কখনো মনে হয় না। এসবকিছু তোমার ভাইকে বলেছিলাম। সে আমাকে সবটা বুুঝিয়ে বলেছে। বলেছে- মিলি তাকে ভালোবাসার কথা বলতে গেছিল। তবে সে গ্রহণ করেনি। আমি বিশ্বাস কখনও করবেও না।”
“তা-ই যদি হয়, তাহলে তুমি কেন মিলির বাড়িতে গেলে?”
“এ অনুভূতি তুমি বুঝবে না নাইমা। যখন তোমার বিয়েসাদী হবে, শখের মানুষ হবে। তখন বুঝবে। মেয়েরা তাদের প্রিয় মানুষের দিকে কারোর নজর সহ্য করতে পারে না। আমিও পারিনি।”
“নতুন অশান্তি শুরু হয়েছে! অসভ্য মিলি ফোনের ওয়ালপেপারে ভাইয়ার সাথে নিজের ছবি দিয়ে রেখেছে। পুলিশ এখন ভাইয়াকে স’ন্দে’হ করবে।”
“দুশ্চিন্তা করো না। সত্য প্রকাশিত হবে। ভালো কথা, পুলিশ মিলির ঘর তল্লাশি করেনি?”
“করেছে। তবে বিশেষ কিছু পায়নি। মোবাইলটা নিয়ে গেছে।”

“পুুলিশ খোঁজ করল তখন কানের দুল পেল না। অথচ কানের দুল পেলে তুমি। অদ্ভুত ব্যাপার!”
“বোকার মত কথা বলো না ভাবী। মেয়ে মানুষের ঘরে কানের দুল, গহনাপত্র থাকবে এটাই স্বাভাবিক বিষয়। তাছাড়া কানের দুল জোড়া ড্রেসিং টেবিলের ওপর এমনভাবে রাখা ছিল যেন কেউ ইচ্ছে করে খুলে রেখেছে। এখানে পুলিশেরা কেন সন্দেহ করবে? দুল যদি একটা হতো তাহলে অন্যকথা ছিল। সন্দেহ করার ব্যাপার ছিল।”
“তুমি কেন সন্দেহ করলে?”
“তোমার কানে একই রকমের দুল দেখেছি। সেজন্য সন্দেহ করেছি। আর আমার সন্দেহ মিথ্যে নয়, তুমি ওই বাড়িতে গিয়েছিলে।”

নববী কিছু বলল না। নাইমা তার হাতের ওপর হাত রেখে বলল, “আমি তোমাকে সন্দেহ করছি না। আমি পূর্ণ বিশ্বাস আছে তুমি খু’নের মত জ’ঘ’ন্য কোন কাজ করবে না।”
নববী নিজের চুল খামচে ধরল। হতাশ গলায় বলল, “আমি কেন গেলাম ওখানে! কেন গেলাম! মিলির কথা শোনা একদম উচিত হয়নি। একদম উচিত হয়নি। ও আমাকে ফাঁদে ফেলেছে, ফাঁদে ফেলেছে আমাকে।”
“দুশ্চিন্তা করো না। তুমিই তো বললে সত্য প্রকাশিত হবে।”
নববীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে। হাবিব তাকে বারবার এসব করতে নিষেধ করেছিল। বলেছিল- তাকে বিশ্বাস করতে, মিলির থেকে দূরে থাকতে। মিলি তার ক্ষতি করতে পারে। অথচ সে তার কথা শোনেনি। আগ বাড়িয়ে বাড়ি পর্যন্ত চলে গেছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তাকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া হলে হাবিব কিছুতেই তা মেনে নেবে না। সে এখন কি করবে! কি জবাব দেবে?

দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। মিলিদের বাড়িতে লোকের অভাব নেই। মাঝবয়েসী মহিলারা গোল হয়ে বসে নানান কথা বলছে। বলছে- কপাল দেখেছ! ক’দিন আগেই ছেলেটা ম’র’ল, শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই মেয়ের এই অবস্থা। বাড়িতে যেন শকুনের নজর পড়েছে। আল্লাহ সবাইকে রক্ষা করুন।”
মিলির মা সমানতালে কেঁদে যাচ্ছে। মাঝে দু’বার ফিট হয়েছে। মহিলারা ধরে মাথায় তেল পানি দিয়ে দিয়েছে। এখন আবার ঢলে ঢলে পড়ছে। সত্যিই সন্তান হারানোর শোক সহ্য করা যায় না! শরিফা বেগম রোহানের মুখে ভাত তুলে দিতে প্রচন্ড রকমের ব্যস্ত। এক মহিলা তার কাছ ঘেঁসে বসল। গলার স্বর নামিয়ে বলল, “শুনলাম মিলির সাথে আপনার ছেলের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের কথা বলে বিয়ে করতে চায়নি। সত্যি নাকি?”
শরিফা বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তেঁতো গলায় বলল, “এ কথা কোথায় শুনেছেন? তিল থেকে তাল করবেন না। আর কিছু না হোক আল্লাহকে ভয় করুন।”

মহিলা মুখ বেঁকিয়ে দূরে সরে গেল। শরিফা বেগম ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। তার এসব ভালো লাগছে না। রোহানকে নিয়ে যেতে পারলে তিনি আর কখনো এ বাড়ির সীমানায় পা ফেলবেন না।
মানিক মিয়া বারান্দার কোণে একটা চেয়ারে বসে আছেন। বসে আছেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে, নিস্তেজ শরীর যেন তার সবটুকু ভর চার পায়া আসবাবপত্রের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই বললেই চলে। অবশ্য তারা থেকেই বা কি করবে! মিলির লা’শ পুলিশ নিয়ে গেছে। লা’শ থাকলে হয়তো ক’ব’র দেওয়ার তোড়জোড় থাকত। পুরুষ মানুষের দরকার পড়ত। এখন তার কোন প্রয়োজন নেই। কাটা-ছেঁড়া করার পর যখন লা’শ ফেরত দেবে তখন এসব চিন্তা। তার জীবনে আর কিছু বাকি নেই। জীবন দশায় দুই সন্তানের মৃ’ত্যু দেখে ফেলেছেন। এখন আর কি! তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তার বুকের ভেতরটা কেমন জমাট বেঁধে আছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না। যেন সবটুকুই নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
ঘড়িতে বেলা চারটের মতো বাজে। আকাশের জায়গায় জায়গায় কালো মেঘ জমেছে। হাবিব ফাইল থেকে চোখ সরাল। অফিস সহকারীকে ডেকে বলল, “কড়া লিকারের এক কাপ চা বানিয়ে দেন। মাথা ধরে আছে।”
ভদ্রলোক ভালো-মন্দ কিছু বলল না। মাথা নাড়াতে নাড়াতে চলে গেল। বাদশা বলল, “কি হয়েছে ভাই? কোন সমস্যা?”

হাবিব শান্ত চোখে তাকাল। সরল গলায় বলল, “বিশেষ কিছু নয়। আপনার খবর কি? অফিসে আসার পর থেকেই দেখছি কেমন উসখুস করছেন।”
বাদশা ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বউয়ের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে আছি। নতুন পা’গ’লা’মি শুরু করেছে। আমার কাছে বিবাহবিচ্ছেদ চাইছে।”
“এমন করবে কেন?”
“তার ধারণা আমি অফিসের কাজে বাইরে যাইনি। কাজ আমার উদ্দেশ্য ছিল। মেয়েদের সঙ্গই সব।”
সে অল্প হাসল। আশ্বস্ত গলায় বলল, “তাকে বুঝিয়ে বলুন। আপনাকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে তা-ই হয়তো পরীক্ষা করতে চাইছে।”
“আপনি বুঝবেন না। সন্দেহ বি’ষ কত বি’ষা’ক্ত তা আপনি বুঝবেন না।”
হাবিব জবাব দিলো না। বাদশা তার হাত চেপে ধরে বলল, “একটা গোপন কথা বলি। কথা দেন কাউকে বলবেন না।”

“কি কথা? কি বলব না?”
“কখনও যদি শোনেন আমার মৃ’ত্যু হয়েছে। তবে লা’শ মাটি দিতে দিবেন না। তদন্ত করবেন। আমার ধারণা আমার স্ত্রী আমাকে মে’রে ফেলবে।”
“কিভাবে এসব ভুলভাল ধারনা করছেন?”
“স্বপ্নে দেখেছি। ভরদুপুরে স্বপ্নে দেখেছি।”
“ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় শুনেছি। ভরদুপুরে স্বপ্নের কথা কখনো শুনিনি।”
“আমার এক আত্মীয় ছিল। তার সাথে জ্বিনদের কথা হতো। সে-ই আমাকে বলেছে- ভরদুপুরে স্বপ্ন সত্যি হয়।”
“জ্বিনদের সাথে কথা বলত- এ কথা আপনি বিশ্বাস করেছেন?”
“হ্যাঁ, আমাকেও দু’বার শুনিয়েছে।”
“অবিশ্বাস্য! আমি বিশ্বাস করি না।”

চন্দ্রাস্ত পর্ব ৭

সজীব তাদের দিকে হেঁটে আসল। তাকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। হাবিব বলল, “হাসি খুশি দেখাচ্ছে। খুশির সংবাদ আছে নাকি?”
ভদ্রলোক হাসল। পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বলল, “বিজয়ী হতে কার না ভালো লাগে? তবে খুশির সংবাদও আছে। বস আমার কাছের প্রশংসা করেছেন।”
বাদশা ছোট্ট সুরে ওহ আচ্ছা বলল।

চন্দ্রাস্ত পর্ব ৯