তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ১৬
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
সবাই হাসি হাসি মুখে বাড়িতে ফিরলেও রায়ান ভাইয়ের মুখে হাসি নেই। সে থমথমে মুখ করে নিজের রুমে চলে গেল। সবাই মিলে বড়ো ফুপি, ছোটো ফুপিকে মুভির কাহিনি বলছে। ওদের হাউকাউ ওপরের রুম থেকেও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে রায়ান ভাই। বিরক্তিতে মুখ তেতো হয়ে আসছে তার। সম্পূর্ণ চেষ্টাই বৃথা গেল!
রাতে সবাই একসাথে খেতে বসেছে। অনু তখন খাওয়ার জন্য নিচে নামছিল। ওকে দেখে বড়ো চাচি বললেন,
“অনু, রায়ানকে ডেকে নিয়ে আয় তো।”
অনু ভ্রু কু্ঁচকে ফেলল। কিন্তু কিছু করার নেই। সে রায়ান ভাইয়ের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজায় নক করে বলল,
“খেতে ডাকে।”
কথা শেষ করে চলে যাওয়ার মুহূর্তে হাতে টান পড়ল অনুর। রুমের ভেতর নিয়ে দরজার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল রায়ান ভাই। অনু বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলল,
“কী সমস্যা?”
রায়ান ভাই ধমক দিয়ে বললেন,
“একদম আমাকে মেজাজ দেখাবি না। আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি তোর সমস্যা জানতে চাচ্ছি।”
“আমারও কোনো সমস্যা নেই।”
“তাহলে আমার সাথে এরকম আচরণ করার মানে কী?”
“কী করেছি?”
“ইগনোর করছিস!”
“আশ্চর্য! আপনি আমার চাচাতো ভাই হোন। আপনাকে আমি কেন ইগনোর করব? রিয়াদ ভাইয়া, রবিন, হাসানের মতোই আপনাকে আমি দেখি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রায়ান ভাইয়ের সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল, যেদিন সে অনুকে বলেছিল বাকি কাজিনদের মতোই সে অনুকে দেখে। আজ অনুও একদম তার মতো করেই জবাব দিয়ে দিল।
রায়ান ভাই কিছু বলার পূর্বেই লিলি খালার উচ্চস্বর ভেসে এলো এবার। অনু বলল,
“ডাকছে সবাই। খেতে চলুন।”
রায়ান ভাইকে পাশ কাটিয়েই অনু চলে গেল। রায়ান ভাই এবার খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে যে, অনুর মনে পাহাড়সমান অভিমান জমে আছে তার জন্য। এবং এই অভিমান একদিন কিংবা দুইদিনে তৈরি হয়নি। ধীরে ধীরে হয়েছে। রায়ান ভাই কখনোই অনুর অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করেনি। প্রয়োজনও মনে করেনি। তাহলে এখন কেন করছে? কেন সে অনুকে সূর্যর সাথে সহ্য করতে পারছে না, কেন অনুর অবহেলায় সে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে? এসব কোনো কিছুর প্রশ্নই রায়ান ভাইয়ের কাছে নেই। তবে আর নয়। অনেক হলো। অনু যদি তার সাথে কথা বলতে না চায়, তবে তা-ই হোক। রায়ান ভাইও আর আগ বাড়িয়ে কথা বলবে না। অনু যেভাবে থাকতে চায় সেভাবেই থাকতে দেবে এবং নিজেও নিজের মতো করেই থাকবে।
অনুর অভিমানের ছোঁয়া রায়ান ভাইকেও ছুঁয়ে গেল। দুজনের মাঝে তৈরি হলো আবার অদৃশ্য দেয়াল। দেখা হয়, পাশাপাশি হাঁটা হয়, বসা কিন্তু কথা হয় না। এইযে দুজনের কেউই কারো সাথে কথা বলে না এটা কারো নজরেই পড়েনি। পড়ার কথাও নয় অবশ্য। বাড়ির সবাই এখন ব্যস্ত রিয়াদ ভাইয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত নিয়ে। বিয়ের ডেইটও ফিক্সড করা হয়ে গেছে। এই সপ্তাহেই এঙ্গেজমেন্ট হবে দুজনের। বাবা ও চাচাদের সাথে রায়ান ভাইও পুরোদমে ব্যস্ত। কেনাকাটা করার সময় জুঁই ও অনুর পছন্দকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ওরা এই যুগের মেয়ে, ওদের পছন্দের সাথে স্নিগ্ধার পছন্দও মিলবে আশা করা যায়।
তবুও স্নিগ্ধাকে কল করে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ওর কেমন ডিজাইন বা কীরকম শাড়ি পছন্দ, কীরকম রিং নেবে। স্নিগ্ধা তার স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বলেছে, যেমন ওদের পছন্দ।
শপিং করতে গিয়ে দেখল শপিংমলে এত ভিড় যে জুঁই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজ শুধু স্নিগ্ধার জন্য কেনাকাটা করতে এসেছিল রায়ান ভাই, অনু, জুঁই এবং আয়ান। শাড়ি কেনার জন্য ঘুরতে ঘুরতেই জুঁইয়ের অবস্থা খারাপ। তারওপর এখন আবার বৃষ্টি-বাদলার দিন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গতকাল একটু ভিজেছিল। তাই এখন শরীরে জ্বরজ্বর ভাব। রায়ান ভাই আয়ানকে বলল,
“তুই জুঁইকে নিয়ে বাড়িতে চলে যা। যাওয়ার পথে ওষুধ কিনে নিস।”
জুঁই বলল,
“সমস্যা নেই ভাইয়া। আমি থাকতে পারব।”
রায়ান ভাই ধমক দিয়ে বলল,
“বেশি কথা বলিস না।”
আয়ানকে বলার সাথে সাথেই আয়ান জুঁইকে নিয়ে চলে গেল। রায়ান ভাইয়ের সাথে অনু গেল এবার ডায়মন্ডের রিং কিনতে। দুজনেই চুপচাপ। অনু এটা, ওটা দেখছিল। এতক্ষণ আয়ান ছিল, জুঁই ছিল তাই ওদের সাথে পরামর্শ করতে পারছিল। কিন্তু ওরা নেই তাই পরামর্শও করতে পারছে না। রায়ান ভাই রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাশে। তার পরিবর্তন অনুর চোখে ধরা পড়েছে আরো আগেই। কিন্তু অনু আমলে নেয়নি। প্রয়োজন মনে করেনি।
অনু দুটো রিং হাতে নিয়ে বলল,
“এখান থেকে কোনটা নেওয়া যায়?”
রায়ান ভাই গম্ভীরকণ্ঠে বলল,
“তোর ইচ্ছা।”
অনুর এত রাগ লাগছে! এঙ্গেজমেন্ট কি তার হবে যে তার পছন্দ হলেই হবে? মানুষ তো এটলিস্ট একটু ভালো পরামর্শ দেয়! অনু অনেকক্ষণ দোনোমনা করে এই দুইটা থেকে একটা রিং পছন্দ করল। রায়ান ভাই বিল পেমেন্ট করে গেল বাকি জিনিস কেনাকাটা করতে। সব কেনা শেষ হলে রেস্টুরেন্টে গেল খাওয়ার জন্য। অনু বলল,
“খাব না।”
রায়ান ভাই আর কোনো কথা বলল না। কর্কশকণ্ঠে বলল,
“গাড়িতে গিয়ে বোস। আমি খেয়ে আসছি।”
অনু বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। এগুলো কেমন আচরণ? অনুও কম যায় না। সেও রাগে হনহন করতে করতে গাড়িতে গিয়ে বসল। প্রায় মিনিট দশেক পর এতগুলো খাবারের পার্সেল নিয়ে রায়ান ভাই ফিরে এলো। সেগুলো পেছনের সিটে রেখে সে বসল ড্রাইভিং সিটে। অনু জিজ্ঞেস করল,
“এত জলদি খাওয়া শেষ?”
“খাইনি।” ড্রাইভ করতে করতে বলল রায়ান ভাই।
অনু আর কোনো কথা বলল না।
আগামীকাল রিয়াদ ভাই ও স্নিগ্ধার এঙ্গেজমেন্টের অনুষ্ঠান হবে। আয়োজন করা হয়েছে স্নিগ্ধাদের বাড়িতেই। তাই সবাই সকাল সকাল উঠে তৈরি হয়ে নিয়েছে। এই সময়ে কত ঝামেলা, ঝগড়া যে হয়ে গেছে! একজনের মতের সাথে আরেকজনের মত মিলে না। একজন বলে, কাজ এভাবে কর, আরেকজন বলে ঐভাবে কর। এগুলোতে রায়ান ভাই এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সে কালো একটা স্যুট পরে দাঁড়িয়ে আছে নিচে। মেয়েগুলোর এখনো সাজগোজই শেষ হয়নি। বড়ো চাচ্চু এজন্য বেজায় রেগে আছেন। তিনি ধমক দিয়ে বলছেন,
“এজন্য মেয়েগুলোকে বলছি আগে আগে উঠে, আগে আগে রেডি হতে। একটাও কথা শোনে না। কখন যাব, কখন ফিরে আসব আমরা। ওরা কী ভাববে? কমনসেন্স নাই কোনো!”
আলমগীর চৌধুরী তার বড়ো ভাইকে শান্ত করে বাইরে নিয়ে গেলেন। অনু, জুঁই, মাহফুজা রেডি হয়ে নিচে নেমেছে। কিছুক্ষণ পর এলো সূর্য। নবাবজাদা আজ দেরি করে উঠেছে ঘুম থেকে। এসেই ভাব নিয়ে দাঁড়াল অনুর পাশে। হাসিমুখ করে বলল,
“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে, অনু আপু।”
মাহফুজা বলল,
“শুধু অনু আপুকেই সুন্দর লাগছে? আমাদের সুন্দর লাগছে না?”
“হুম তোমাদেরও সুন্দর লাগছে। কিন্তু অনু আপুকে বেশি সুন্দর লাগছে।”
জুঁই ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“কেন রে?”
“কারণ কালো রঙ আমার পছন্দ।”
“কিন্তু তুই তো পরেছিস সাদা শার্ট।”
“আমি কি জানতাম নাকি অনু আপু কালো পরবে?”
“ইদানীং খুব অনুর দিওয়ানা দেখতেছি তোকে? ব্যাপার কী তোর?”
সূর্য লজ্জা পেয়ে বলল,
“আরে ধুর! কী বলো!”
রায়ান ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছিল। বিরক্ত হয়ে বলল,
“আজাইরা কথা বলা শেষ হয়েছে? হলে গাড়িতে গিয়ে বোস সবাই।”
ধমক খেয়ে সবাই গাড়িতে গিয়ে বসেছে। বিশ মিনিটের মধ্যে সবাই মিলে বের হলো। স্নিগ্ধাদের বাড়িতে গিয়ে সবাই স্নিগ্ধাকে দেখে হা করে তাকিয়ে আছে। এত সুন্দর লাগছে! কিন্তু রিয়াদকে বরাবরের মতোই নিরামিষ নিরামিষ লাগছে। আংটি বদলের পর জম্পেশ খাওয়া-দাওয়া, আড্ডার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্নিগ্ধার বাবা-মা আড্ডার মাঝে বললেন, আজকের রাতটা সবাইকে থেকে যেতে। বড়োরা রাজি না হলেও ছোটোদের জন্য রাজি হতে হলো। রায়ান ভাই একবার ভেবেছিল চলে যাবে, পরে কী ভেবে যেন আর যাওয়া হয়নি।
অর্ধেক রাত সবার গল্প-গুজব করেই কেটেছে। বাচ্চারা একেকজন একেকভাবে ঘুমিয়ে পড়েছে। কখন যে অনু নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না সে। যখন তার ঘুম ভেঙেছে তখন ভোর সাড়ে ছয়টা বাজে। সবাই ঘুমাচ্ছে। সে কী করবে একা? ফোনেও চার্জ নাই। কাল তো চার্জারও আনা হয়নি। সে মেইন গেইটের কাছে যেতেই পাশের রুম থেকে রায়ান ভাই বের হলো। অনু ভয় পেয়ে গেছে হঠাৎ দেখে। রায়ান ভাই জিজ্ঞেস করল,
“ঘুমাসনি?”
“হু। উঠলাম মাত্র।”
রায়ান ভাই বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। অনুকে বলল,
“চল।”
“কোথায়?”
“বাইরে।”
“বৃষ্টি হচ্ছে।”
“আয় চুপচাপ।”
রায়ান ভাই আর অনু ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে। তাও খালি পায়ে। বৃষ্টির জন্য রাস্তার অবস্থা খারাপ। অনু পা টিপেটিপে হাঁটছে। আচমকা রায়ান ভাই অনুর হাত ধরল। হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে খালি গলায় গাইতে লাগল,
“তবু এভাবে সময় আমার
কেটে যাবে তোমাকে ভেবে,
তোমায় নিয়ে স্বপ্নগুলো
ভোর হলে যায় যে ভেঙ্গে।
আকাশ মেঘে বৃষ্টি হয়ে
স্বপ্নগুলো দেয় ভিজিয়ে;
তুমিও কি আমার সাথে
ভিজবে পথে হাত জড়িয়ে।।
একগুচ্ছ কদম হাতে
ভিজতে চাই তোমার সাথে,
একগুচ্ছ কদম হাতে
ভিজতে চাই তোমার সাথে।”
তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ১৫
অনু হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল। রায়ান ভাই হাত ছাড়ল না। আরেকটু শক্ত করে অনুর হাতটা ধরে বুকের মধ্যে নিয়ে আকুতিভরা কণ্ঠে বলল,
“কেন এভাবে আমাকে পো’ড়া’চ্ছিস, অনু?”