তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ১৭
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
অনু জোর করতে লাগল হাত ছাড়ানোর জন্য। রায়ান ভাই তার পূর্বের জেদ বজায় রেখে বলল,
“আমার প্রশ্নের উত্তর দে।”
অনুও জেদ ধরে বলল,
“আপনার প্রশ্নের কোনো জবাব নেই আমার কাছে কারণ আমি কিছুই করিনি। আপনাকে আপনার মতো থাকতে দিয়েছি এবং আমি নিজের মতো থাকছি। তাছাড়া আপনি তো নিজেই এমনটা চেয়েছিলেন।”
রায়ান ভাই চুপ হয়ে গেলেন। সত্যিই তো তাই। সে তো এরকমটাই চেয়েছিল। এবং অনুও তাই করছে। তাহলে সে কেন মেনে নিতে পারছে না? এত চেষ্টা করেও অনুর থেকে দূরে থাকতে পারছে না। এড়িয়ে চলতে পারছে না। তাহলে এখন আর সে কী-ই বা করতে পারে? রায়ান ভাই বললেন,
“বাসায় যা।”
অনুও আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ বাড়ির পথে হাঁটা ধরল। উঠানে গিয়ে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সে দেখল উঠানে বেশ মানুষজন।
সে এগিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই কর্দমাক্ত উঠানে স্লিপ খেল। আশেপাশে ধরার মতো কিছুই ছিল না। ঠিক তখনই পাশ থেকে ওকে ধরে ফেলল কেউ একজন। অনু ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু আশেপাশে বেশ হইচই উঠে গেছে তখন। অনু চোখ মেলে দেখে খুব সুন্দরমতো একটা ছেলে ওকে ধরে রেখেছে। ছেলেটা অনুকে ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি ঠিক আছেন?”
অনু মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল। চোখ গেল পেছনে, রায়ান ভাই অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা হেসে হেসে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ভাইয়া, আসতে না আসতেই আমার ননোদকে নিয়ে পড়লে?”
ছেলেটি সহাস্যে বলল,
“তোর নোনদকে নিয়ে পড়লাম কোথায়? আমি তো বাঁচালাম।”
অনু সকলের কথোপকথনের মাধ্যমে জানতে পারল ছেলেটি স্নিগ্ধার বড়ো ভাই স্নিগ্ধ। ইউরোপ থাকে। কিছুক্ষণ আগেই এসেছে। ওর জন্যই অনুর বাড়ির সবাইকে থাকতে বলা হয়েছিল। সারপ্রাইজ ছিল এটা। স্নিগ্ধ বাকিদের জন্য সারপ্রাইজ হয়ে এলেও প্রথম দিন এবং প্রথম সাক্ষাতেই রায়ান ভাইয়ের শত্রু হয়ে গেল।
স্নিগ্ধ ভীষণ মিশুক ছেলে। অল্প সময়েই অনুর বাড়ির প্রত্যেকের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। শুধুমাত্র কথা বলার সুযোগ হয়নি রায়ান ভাইয়ের সাথে। সে তৎক্ষণাৎ কারো থেকে বিদায় না নিয়েই বাড়িতে চলে গিয়েছে। শুধু খবরটা পথিমধ্যে গিয়ে রিয়াদ ভাইকে কল দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। বাড়ির আর কেউ এই বিষয়টি নিয়ে মাথা না ঘামালেও অনু খুব করে বুঝতে পারছে, রায়ান ভাই অনুর ওপরে রাগ করেই চলে গিয়েছে। করুক রাগ, যাক চলে। কাউকে কষ্ট দিলে তখন কেমন লাগে এই অনুভূতিটুকু তো তারও হওয়া উচিত।
অনুরা স্নিগ্ধাদের বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়িতে এলো দুপুরে। রায়ান ভাই তখন উঠানের জলচৌকিতে ঘুমুচ্ছিল। তার ঠিক মাথার কাছেই লেজ গুটিয়ে ঘুমাচ্ছে রোমিও। এতদিন কী চরম শত্রুটাই না ভাবতো সে রোমিওকে! দাদাভাই রায়ান ভাইকে ডেকে ওঠালেন। রায়ান ভাই ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমরা কখন এলে?”
“মাত্রই। তুই এখানে ঘুমাচ্ছিস কেন?” জানতে চাইলেন দাদা।
রায়ান ভাই জবাবে হাই তুলে বললেন,
“রোমিওর সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে ঘুমিয়ে গিয়েছি।”
“তা বেশ! কিন্তু কাউকে এভাবে কিছু না জানিয়ে চলে এলি কেন ঐ বাড়ি থেকে?”
হঠাৎ করেই রায়ান ভাইয়ের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। কণ্ঠস্বরও গম্ভীর করে বলল,
“এমনি। এত মানুষজন ভালো লাগে না।”
“এরকম একগুঁয়ে হলে কি জীবন চলে? সবার সঙ্গে তো মেশার অভ্যাস করতে হবে।”
রায়ান ভাই অনুর দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
“আমি সবার মতো এতো মিশতে পারি না দাদু। যাই হোক, তোমরা ফ্রেশ হয়ে নাও। আমিও যাই ফ্রেশ হবো।”
এরপর উঠে সে অনুকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অনু তাকিয়ে আছে রায়ান ভাইয়ের যাওয়ার পথে। সে অনুর দিকে তাকিয়ে কেন বলল কথাটি? অনু তো আর কারো সাথে মেশেনি!
এঙ্গেজমেন্টের অনুষ্ঠানের পর এবার বিয়ের বন্দোবস্ত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। কার্ড ছাপানো, আত্মীয়দের দাওয়াত দেওয়া, বিয়ের কেনাকাটা, বাজার সবকিছুর দায়িত্ব সবাই ভাগ করে নিয়েছে। এত ব্যস্ততার মাঝে অনুর সাথে রায়ান ভাইয়ের তেমন দেখা হয় না। দেখা হলেও কথা হয় না। রায়ান ভাইও বলে না, এমনকি অনুও নয়। কিন্তু আজ দুপুরে দেখা হয়ে গেল। সবাই একসঙ্গে খাবে বলে হয়তো। কিন্তু কারণটা জানতে পারা গেল পরে। স্নিগ্ধাদের বাড়ি থেকে মেহমান আসবে আজ। স্নিগ্ধও আসবে। তাই দাদা আজ সবাইকেই কিছু সময়ের জন্য কাজ বাদ দিয়ে বাড়িতে থাকতে বলেছেন। স্নিগ্ধ , ওর বাবা শিকদার রহমান এবং তার দুই ভাই এসেছেন। আজকে দুপুরে সবার দাওয়াত ছিল। বিশেষ করে স্নিগ্ধর জন্য বেশ বড়ো আয়োজন করা হয়েছে। সে বেশ খুশি হলো এত আয়োজন দেখে এবং প্রকাশও করল,
“মনে হচ্ছে নিজের বাড়িতে খেতে বসেছি।”
বড়ো ফুপি বললেন,
“এটা তো তোমার নিজেরই বাড়ি, বাবা। খাও তুমি নিজের মতো করে।”
স্নিগ্ধ একেকটা খাবার খাচ্ছিল এবং মন ভরে প্রশংসা করছিল। ওর স্বচ্ছল ব্যবহারে বাড়ির সবাই ভীষণ মুগ্ধ। খাওয়া শেষে থালাবাসন ধোঁয়ার সময় লিলি খালা স্নিগ্ধর প্রশংসা করে বললেন,
“আহা কী সোনার টুকরা ছেলে! কেমন অমায়িক ব্যবহার গো। মনডা খুবই ভালা।”
ছোটো ফুপি গর্ব করে তখন বললেন,
“আরে সোনার টুকরা তো হবেই। আমি কেমন মেয়ে খুঁজে এনেছি দেখলে না? ঐ মেয়ের ভাই বলে কথা। সোনা তো হবেই।”
“ঠিকই কইছেন। ভাই-বোন দুনোজনেই খাঁটি সোনা এক্কেরে।”
খাওয়া শেষ করে শিকদার সাহেব এবং তার ভাইরা মিলে সবার সাথে কথাবার্তা বলছিলেন। স্নিগ্ধ রোমিওর সাথে খেলছে। এই জিনিসটা রায়ান ভাইয়ের একদমই পছন্দ হলো না। রোমিও কেন একটা অপরিচিত মানুষের সাথে এত সহজেই মিশে যাবে? অবশ্য অনুর পালিত কুকুর বলে কথা! একরাশ বিরক্তি নিয়ে আড়চোখে একবার অনুর দিকে তাকাল রায়ান ভাই। অনু খেয়াল করেনি অবশ্য। সে আলমগীর চৌধুরীর কাছে গিয়ে বলল,
“আব্বু, আমি একটু হোস্টেলে যাব।”
আলমগীর চৌধুরী আঁতকে উঠে বললেন,
“কেন মা? আবার কী হলো? দুদিন পর বাড়িতে বিয়ে। তুমি হোস্টেলে কেন চলে যেতে চাচ্ছো? আমাকে বলো কী হয়েছে?”
অনু বাবাকে শান্ত করে বলল,
“শান্ত হও। আমি একেবারে যাচ্ছি না। আমার রুমমেট শাপলাকে আনতে যাচ্ছি। বিয়ে পর্যন্ত আমার সাথেই থাকবে।”
“তাই বলো! হ্যাঁ, যাও নিয়ে এসো ওকে। মেয়েটা ভীষণ লক্ষ্মী।”
রমিজ চৌধুরী তখন রায়ান ভাইকে ডেকে বললেন,
“তুই তো বাজারে যাবি, অনুর হোস্টেলের সামনে দিয়েই। ওকে সাথে করে নিয়ে যা। আসার সময় আবার নিয়ে আসিস সাথে করে।”
রায়ান ভাই উঠে বললেন,
“আমার একটু অফিসে কাজ আছে। আমি নিয়ে যেতে পারব না।”
সে আর জবাবের অপেক্ষা না করে চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে তখন শুনতে পেল শিকদার সাহেব তার ছেলে স্নিগ্ধকে ডেকে বলছেন,
“বাবা, তুই যা অনুকে সাথে নিয়ে।”
এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল রায়ান ভাই। অনু দ্রুত গতিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“আরে না, না। সমস্যা নেই। আমি যেতে পারব।”
তিনি বললেন,
“সমস্যা নেই, মা। স্নিগ্ধ তোমাকে নিয়ে যাবে।”
অনু দেখল বাড়ির কারো কোনো আপত্তি নেই। তাই অনুও আর আপত্তি জানাল না। তবে সে সাথে করে রোমিওকে নিয়ে নিল। স্নিগ্ধদের গাড়িতে ওঠার পর জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, রায়ান ভাইও গাড়ি বের করেছে। অনুর দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখে সানগ্লাস পরল সে। এরপর চোখের পলকেই গাড়িটা আড়াল হয়ে গেল। এত স্পিডে গাড়ি চালানোর কোনো মানেই হয় না!
স্নিগ্ধ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে জিজ্ঞেস করল,
“যিনি মাত্র গাড়ি নিয়ে বের হলো, উনি আপনার কোন চাচার ছেলে?”
“বড়ো চাচার।”
“ওহ। একটু কেমন যেন। ইন্ট্রোভার্ট নাকি কঠিন স্বভাবের?”
অনু জবাব দিল না। স্নিগ্ধও আর এই বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে বলল,
“আমাকে রাস্তা চিনিয়ে দিয়েন।”
অনু ছোটো করে জবাব দিল,
“হুম।”
রাত আনুমানিক ১১টা পার হয়েছে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ে-দেয়ে। শাপলাও ঘুমে। অনু নিচে নেমেছে পানি আনার জন্য। তখন বাড়ির মেইনগেইট খোলার শব্দ হলো। অনু ভয়ে লুকিয়ে গেল। আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল রায়ান ভাই এসেছে। এত রাত পর্যন্ত তিনি বাইরে ছিলেন? দুপুরের পর আর বাড়িতে আসেনি। স্নিগ্ধ অনুকে এবং শাপলাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তারপর চলে গিয়েছে। বাড়ির সবাই অবশ্য কয়টা দিন বেড়াতে বলেছিল। কিন্তু সে থাকেনি। এমনিও তো পরে তার আসা হবেই। বোন এই বাড়িতে বউ হয়ে আসছে বলে কথা!
রায়ান ভাই এসে উঠানে পেতে রাখা চেয়ারটিতে বসলেন। অনু পানি নিয়ে চলে যাচ্ছিল, তখন পায়ের শব্দ শুনে রায়ান ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
“কে?”
বাড়ির সব লাইট বন্ধ। চাঁদের মৃদু আলোতে শুধুমাত্র অনুর অবয়বটুকু বোঝা যাচ্ছিল। অনু সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে জবাব দিল,
“আমি।”
তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ১৬
কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা। রায়ান ভাই আর কিছু বলছে না দেখে অনু সিঁড়িতে পা রাখল। দুটো সিঁড়ি উঠতেই ঝড়ের বেগে চলে এলেন রায়ান ভাই। অনুর হাত ধরে টেনে দুটো সিঁড়ি নিচে নামিয়ে ফেললেন। অনুর হাত থেকে পানির বোতল ছিটকে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ বোতলটাকে বাম হাতে ধরে নিচে রাখলেন রায়ান ভাই। অনুকে নিয়ে গেলেন সিঁড়ির রেলিঙের কাছে। হাত ধরে খুব কাছে টেনে চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“আর ইউ ট্রাইং টু লাইক স্নিগ্ধ?”