তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২৩
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
অনুর জেদের কাছে বরাবরের মতোই বাড়ির সকলকে আবার হার মানতে হয়েছে। অবশ্য একটা শেষ চেষ্টা সবাই করেছে। স্নিগ্ধাকে পাঠিয়েছিল অনুকে মানানোর জন্য। কিন্তু অনু ওর নিজের সিদ্ধান্তে এতটাই অটল এবং দৃঢ় ছিল যে, স্নিগ্ধার ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইলও কাজে লাগেনি।
রায়ানের মন মেজাজ ভালো নেই। অনুর এরকম হুটহাট সিদ্ধান্ত ওর একদম পছন্দ হয় না। কিন্তু অনু সে তো মহারানি, তাকে কিছু বলা যায় না। সে যা করবে সব ঠিক। আর রায়ান করলেই যত সমস্যা। এই পিচ্চি মেয়েটা কেমন যেন হঠাৎ করেই বড়ো করে হয়ে গেছে। আজকাল রায়ানকেও ওর সাথে কথা বলার জন্য দুবার ভাবতে হয়। চঞ্চল, পাগলাটে মেয়েটা এখন একদম ম্যাচিউর হয়ে গেছে। বড়োদের মতো কথা বলে, বড়োদের মতো আচরণ করে।
হিয়া মন খারাপ করে জিজ্ঞেস করল,
“এখন কী হবে?”
রায়ান কোনো জবাব দিল না। পিংকি বলল,
“আর কী হবে? অনু চলে যাবে হোস্টেলে।”
“প্ল্যান করলাম কী আমরা, আর হচ্ছেটা কী!” বলল মাসুদ।
পিংকি বলল,
“এসব প্ল্যান করাই উচিত হয়নি। এরচেয়ে ভালো ছিল অনুকে বুঝিয়ে বলা। জেলাস ফিল করাতে চেয়ে উলটো এখন ভুল বুঝল।”
হিয়া বলল,
“চলো আমরা সবাই অনুকে সত্যিটা বলে দেই।”
এই পর্যায়ে রায়ান বলল,
“না।”
সবাই অবাক হয়ে সমস্বরে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কেন?”
“ওকে এখন যা-ই বলা হোক না কেন, ও শুনবে না। কারো কথা বিশ্বাসও করবে না।”
অন্তর বলল,
“তাহলে কী করবি?”
“এখন কিছুই করব না। ও রাগের মাথায় আছে। রাগ কমুক। পরে বুঝিয়ে বলব সব।”
মাসুদ বলল,
“নিজেদের মধ্যে ঝামেলা না রাখাই ভালো। আর আমার মনে হয়, এখনই সময় নিজেকে ক্লিয়ার করার। পরে আবার দেরি না হয়ে যায়!”
শাপলা শুয়ে শুয়ে ফোন গেইম খেলছিল এবং আড়দৃষ্টিতে অনুকে দেখছিল। অনু একটা উপন্যাস পড়ছে। শাপলা গলা খাঁকারি দিয়ে ডাকল,
“আপু?”
অনু বই থেকে মুখ না তুলেই বলল,
“বলো।”
“তুমি কি সত্যিই আগামীকাল আমার সাথে হোস্টেলে চলে যাবে?”
“হ্যাঁ।”
“এই সিদ্ধান্ত রাগ করে নিয়েছ তাই না?”
“না।”
“আমার তো মনে হয়…”
শাপলার কথা শেষ হওয়ার আগেই স্নিগ্ধা এলো রুমে। ব্যস্ত হয়ে বলল,
“দুজনে জলদি রেডি হয়ে নাও তো।”
“কেন?” জানতে চাইল অনু।
“এয়ারপোর্টে যাব। ভাইয়া চলে যাচ্ছে আজ। রাতেই ফ্লাইট।”
“আমরা কেন রেডি হবো?”
“কারণ তোমরা আমার সাথে যাবে।”
“আমার ভালো লাগছে না ভাবি। আমি যাব না। ভাইয়াকে নিয়ে যাও।”
“তোমার ভাইয়া বাসায় নেই। জুঁই এক্সামের পড়া পড়ছে। তাই মা বলেছে তোমাকে আর শাপলাকে নিয়ে যেতে।”
শাপলা আনন্দিত হয়ে বলল,
“দারুণ! আমি কখনো এয়ারপোর্টের ভেতর যাইনি জানো? আজ যাওয়া হবে।”
অনু বলল,
“ঠিক আছে। তুমি যাও ভাবির সাথে।”
“তুমি না গেলে আমি যাই কীভাবে?”
“আমার শরীরটা ভালো লাগছে না, শাপলা।”
স্নিগ্ধা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলল,
“এ কী ধরনের কথা অনু? আমি এত করে অনুরোধ করছি তাও রাখবে না? ঠিক আছে, যেতে হবে না কারো। আমি একাই যেতে পারব।”
স্নিগ্ধা রাগ ও মন খারাপ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শাপলা অনুকে বলল,
“ভাবি কষ্ট পেয়েছে। একটু সাথে গেলে কী এমন হবে?”
অনু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, রেডি হও।”
অনু শুধু ড্রেসটা চেঞ্জ করেছে। তার একদমই যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কিন্তু উপায়ও নেই। ভাবির মন রাখার জন্যই যেতে হচ্ছে। অনু যাচ্ছে বলে, স্নিগ্ধা সত্যিই ভীষণ খুশি হয়েছে।
তিনজন যখন বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল, তখন রায়ান ওর কলিগদের নিয়ে বাহির থেকে বাসায় ফিরছিল। গেইটে সবার দেখা হয়ে গেল। রায়ান ভাই স্নিগ্ধাকে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছেন ভাবি?”
“এয়ারপোর্টে যাচ্ছি ভাইয়া। আমার ভাইয়ের ফ্লাইট আজ রাতে।”
স্নিগ্ধার সাথে অনুও যাচ্ছে স্নিগ্ধকে সী অফ করতে, এটা শোনার পর থেকেই রায়ানের মুখ পাংশুটে হয়ে গেছে। সে কড়া দৃষ্টিতে অনুকে দেখলেও, অনু তাকায়নি। রায়ানের অস্তিত্ব তার সামনেই আছে বলে মনে হয় না। রায়ান কোনোভাবে নিজেকে সংযত করে হাসিমুখে বলল,
“ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন ভাবি।”
রায়ান অস্বস্তিতে ম’রে যাচ্ছিল। দুই আঙুলের একটা মেয়ে কীভাবে তাকে জ্বা’লি’য়ে, পুড়িয়ে মারছে।
অনুরা এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখল স্নিগ্ধ, ওর বাবা-মা এবং কিছু বন্ধুরা ওদের আগেই চলে এসেছে। স্নিগ্ধার সাথে অনুকে দেখে স্নিগ্ধ ভীষণ অবাক হয়েছে। অনু এসেই একদম চুপচাপ আছে। সবার সাথে কথাবার্তা বলা শেষ হলে স্নিগ্ধ এসে অনুর পাশে বসল। আজ আর কোনো দুষ্টুমির রেশ নেই তার কণ্ঠে। বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“আমি ভাবতে পারিনি, আপনি আসবেন আজ।”
অনুও স্বাভাবিক থেকে বলল,
“বড়ো চাচি আসতে বলেছে তাই।”
“ভীষণ খুশি হয়েছি।”
“কেন?”
“এইযে অন্তত বিদায় দিতে এসেছেন।”
অনু মৃদু মেকি হাসি দিল। স্নিগ্ধ বলল,
“এই কয়দিন হয়তো অনেক জ্বালিয়েছি। মনে রাগ পুষে রাখবেন না। পারলে ক্ষমা করে দিবেন।”
“না, না কী বলছেন এসব! সাবধানে যাবেন, ভালো থাকবেন। নিজের যত্ন নেবেন।”
স্নিগ্ধ হাসল। ওর চোখে-মুখে কষ্টের চাপা ছাপ ফুটে উঠেছে। অনুর ভীষণ মায়া লাগছে। বাবা-মা, পরিবার সবাইকে ছেড়ে দূরে থাকার কষ্ট কিছুটা হলেও সে নিজেও বোঝে। তাও তো সে বাবা-মাকে চাইলেই কাছ থেকে দেখতে পারে। স্নিগ্ধ তো বিদেশে থাকার জন্য তাও পারে না।
স্নিগ্ধ হেসেই বলল,
“আপনি অনেক ভালো, অনু।”
অনু এই কথায় কী জবাব দেবে বুঝতে পারল না। মৃদু হাসল শুধু। স্নিগ্ধও ঘড়িতে সময় দেখে উঠে দাঁড়াল। তার ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছে। ওর বাবা-মা তখনো কাঁদছিল। যাওয়ার সময় স্নিগ্ধর চোখও টলমল করছিল। ছেলে মানুষরা যে কেন সহজে সবার সামনে কাঁদতে পারে না!
পরেরদিন সকালে একেবারে রেডি হয়েই নিচে খেতে নেমেছে অনু। সবাই মুখ ভার করে রেখেছে। অনুর সিদ্ধান্তে কেউ খুশি নয় বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু অনুর কিছু করার নেই। সবাই তাও শেষ একবার চেষ্টা করেছে অনুকে বোঝানোর কিন্তু লাভ হয়নি।
অনু খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিল। রোমিওকে কোলে নিয়ে আর কান্না আটকে রাখতে পারেনি। ভীষণ খারাপ লাগছে। রোমিওর চোখও টলমল করছে। অবুঝ, অবলা প্রাণীটাও হয়তো বুঝতে পেরেছে, অনু আবারও তাকে ছেড়ে দূরে চলে যাবে। রোমিওকে বাবার কোলে দিয়ে অনু শাপলাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। ড্রাইভিং সিটে রায়ান ভাই বসে আছে। অনুর প্রতিক্রিয়ার কোনো পরিবর্তন হয়নি এতে। পুরো রাস্তাতেও তিনজন একদম চুপচাপ ছিল। রায়ান ভাইকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, ভীষণ রেগে আছে সে।
হোস্টেলের সামনে এসে গাড়ি থামাল রায়ান ভাই। অনু এবং শাপলার সাথে নিজেও গাড়ি থেকে নামল। অনু শাপলাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলে পেছন থেকে রায়ান ভাই ডাক দিল,
“অনু?”
অনু দাঁড়িয়েছে। শাপলা ওদের কথা বলার স্পেস দিয়ে চলে যাচ্ছে ভেতরে। রায়ান ভাই এগিয়ে এলো কাছে। রাশভারী কণ্ঠে বলল,
“সবসময় এত জেদ করা ভালো নয়।”
“আমি তো আপনার সঙ্গে কোনো জেদ করিনি।”
“করেছিস নাকি করিসনি তা আমার থেকেও তুই ভালো করে জানিস। তুইও অবুঝ না, আমিও না।”
“ভালো।”
“এতদিন তোকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখন থেকে আর বোঝাব না।”
অনুর বুকটা কেঁপে উঠল। তবুও স্বাভাবিক থেকে বলল,
“আচ্ছা।”
“খুব শীঘ্রই আবার তোকে বাড়ি ফিরতে হবে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য। রেডি থাকিস।”
“ওহ। হিয়া আপুর সাথে তাহলে বিয়েটা দ্রুতই হচ্ছে?”
রায়ান ভাই অন্য দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। অনুর কপালের ওপর পড়ে থাকা ছোটো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,
“খুব দ্রুতই তুই আমার বউ হচ্ছিস।”
অনু সবিস্ময়ে বলল,
তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২২
“মানে!”
রায়ান ভাই রহস্যজনক হাসি দিয়ে গানের সুরে বলল,
“হুট করে ফিরে এসে, লুট করে নিয়ে যাব
তুই ছাড়া কেউ বউ হবে না,
আমার এই ভালোবাসা কেন তুই বুঝিস না?”