তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২৫
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
থমথমে মুখে দাদুর সামনে বসে আছে অনু। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রায়ান, আয়ান, স্নিগ্ধা এবং জুঁই। দাদুর পেছনে বাড়ির সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সকলেই হতভম্ব হয়ে আছে। দাদু গলা খাঁকারি দিয়ে অনুকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি ঠিক আছো?”
অনু রাগে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। সে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“বাড়ির মেয়েকে এভাবে কেউ তুলে আনে?”
দাদুও অভিনয় করে বললেন,
“ঠিকই তো! রায়ান, এভাবে কেন আমার নাতিকে তুলে এনেছিস?”
রায়ান মাথা নত করে বলল,
“আসতে না চাইলে কী করব?”
“তাই বলে এভাবে জোর করে নিয়ে আসবি?”
আয়ান তখন বলল,
“রায়ান ভাইয়ার দোষ নেই। আমিই বলেছিলাম জোর করে আনতে। অনু যেই ঘাড়ত্যাড়া! আমি তো জানতাম, ও ভালোই ভালো সাথে আসতে চাইবে না।”
অনু কটমট করে তাকিয়ে আছে আয়ানের দিকে। পারছে না এক্ষুনী গি’লে খেতে ওকে। সে রাগে সাপের মতো হিসহিস করে বলল,
“তুমি আমার ভাই না শ’ত্রু!”
“বোনকে বাড়িতে আনার জন্য যদি শ’ত্রু হতে হয় তাহলে আমি শ’ত্রই যা।”
দাদা অনুকে শান্ত করতে বললেন,
“দাদুভাই, মাথা ঠান্ডা করো। তুমি বাড়িতে কেন আসতে চাও না? আমাদের কি তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না? এত পর হয়ে গেলাম আমরা!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অনু চুপ করে আছে। কী করে বলবে সে, তাদেরকে নয়; বরং তার শুধু একজনকে দেখতে ইচ্ছে করে না। এজন্যই সে আসতে চায় না এই বাড়িতে। সবার থেকে দূরে দূরে থাকে।
দাদুকেও নিশ্চুপ থাকতে দেখে অনু বলল,
“সেরকম কিছু নয় দাদু। আসলে এখন অনেক পড়ার চাপ তো তাই।”
“তাই বলে তুই আমাদের দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাবি অনু?” বলল জুঁই।
স্নিগ্ধা জুঁইয়ের হাতে চি’ম’টি কেটে চুপ করতে বলল। দাদুও এই প্রসঙ্গে কোনো কথা বললেন না। তিনি অনুকে বললেন,
“যাও তুমি ফ্রেশ হয়ে আগে একটু রেস্ট করো। খাওয়া-দাওয়া করো।”
অনুর কেমন যেন একটা খটকা লাগছে। দাদুর এত আদুরে, ভালো ব্যবহার, বাড়ির সকলের নিরবতা সবকিছু তাকে ভীষণ ভাবাচ্ছে। কিছু তো একটা গড়মিল আছে। কিন্তু সেটা কী? অনু তাই কোনো রকম ভনিতা না করেই বলল,
“আমি তো খেয়েই ক্লাস করার জন্য বের হয়েছিলাম দাদু। এখন আর খাব না। তোমরা আমাকে বলো কী জন্য এভাবে আমাকে নিয়ে এসেছ? জরুরী তলবটা কী?”
“বলব। সময় তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না।”
“যাচ্ছে। আমার হোস্টেলে ফিরতে হবে।”
“না।”
“না মানে?”
“না মানে না। তোমার আর হোস্টেলে ফেরা হবে না। তুমি বাড়িতেই থাকবে।”
“কী আশ্চর্য! কেন?”
“আমার ইচ্ছে তাই।”
“তোমরা সবাই চাচ্ছোটা কী?”
“তোমার কোনো পছন্দ আছে?”
দাদুর হঠাৎ এমন প্রশ্নে ভড়কে গিয়েছে অনু। আড়দৃষ্টিতে একবার রায়ানের দিকে তাকাল। থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কেন?”
“জানতে চেয়েছি, বলো। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বাড়ির কেউই কিছু বলবে না তোমাকে। মূলত আমরা সবাই এটা জানতে চাই। পছন্দের কেউ থাকলে নিঃসঙ্কোচে এবং নির্ভয়ে বলতে পারো।”
“কিন্তু তোমরা হঠাৎ করে এসব কেন জানতে চাইছ? কী হয়েছে?”
“কিছু হয়নি। পছন্দের কেউ আছে তোমার?”
অনু চোখ-মুখ শক্ত করে, দম নিয়ে বলল,
“না।”
রায়ান তাকাল তখন অনুর দিকে। দাদু ফের প্রশ্ন করলেন,
“কাউকে ভালোবাসো?”
অনুর নিঃশ্বাস যেন আটকে আসতে চাইছে। হাসফাস লাগছে তার। তবুও জোর করে বলল,
“না।”
“বেশ! তাহলে তো ভালোই। তাহলে কি আমরা আমাদের পছন্দমতো তোমার বিয়ের জন্য আগাতে পারি?”
অনু এবার আকাশ থেকে পড়ল। বিয়ে! সে হতভম্ব হয়ে বলল,
“আমার বিয়ে? এত জলদি!”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু কেন? আমার আগে তো জুঁই আপুর বিয়ে দেওয়ার কথা।”
“আমি তো মেয়েদের সিরিয়াল দেখছি না। ছেলেদের সিরিয়াল অনুযায়ী এখন রায়ানের বিয়ের পালা।”
অনু অবাক হতেও ভুলে গেছে এবার,
“মানে? রায়ান ভাই? কী বলছ, বুঝতে পারছি না।”
“আমি, তোমার বাবা-মা এবং রায়ানের বাবা-মা চাই তোমার সাথে রায়ানের বিয়ে হোক। বাড়ির সকলেরই মত আছে এতে।”
অনু ভাষা হারিয়ে ফেলেছে কথা বলার জন্য। সে বাবা-মা’সহ বাড়ির সবার দিকে চোখ বুলাল একবার। দাদু ওর অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন,
“তোমাকে আমরা কেউই জোর করছি না এবং জোর করবও না। তবে আমরা সবাই মন থেকে খুব করে চাই তোমাদের বিয়েটা হোক। আমাদেরকে হতাশ করবে না আশা করছি। রায়ানের মতামত নিয়েছি আমরা। ও এই বিয়েতে রাজি। এখন শুধু তোমার মতটা জানা বাকি। এখনই কোনো উত্তর দিতে হবে না। আগামীকাল সকালে খাওয়ার টেবিলে সবার সামনে তুমি তোমার সিদ্ধান্ত জানাবে।”
অনু নিশ্চুপ। দাদু জুঁইকে বললেন,
“অনুকে রুমে নিয়ে যা।”
জুঁই এবং স্নিগ্ধা মিলে অনুকে রুমে নিয়ে গেল। অনু মনে হচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। সে কারো সাথেই কোনো কথা বলছে না।
আয়ান বাড়ির বাইরে গিয়ে জুঁইকে কল দিল। ফোনের স্ক্রিনে আয়ানের নাম্বার দেখে আগে দরজাটা লক করে দিল জুঁই। তারপর কল রিসিভ করে বলল,
“হ্যালো।”
ফোনের ওপাশ থেকে আয়ান বলল,
“হ্যালো। এতক্ষণ লাগে কল রিসিভ করতে?”
“আরে দরজা বন্ধ করছিলাম। বলো।”
“এখন আর এত ভয় পেতে হবে না।”
জুঁই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কেন?”
“তোমার ভাইয়ের সাথে আমার বোনের বিয়েটা হয়ে গেলে আর কীসের ভয়? আমাদের বিয়েও মেনে নেবে।”
“আহারে! কী স্বপ্নটাই না দেখছ তুমি। তুমি জানো না এই বাসায় রিলেশন কেউ পছন্দ করে না? ভাইয়া আর অনু তো প্রেম করেনি। দাদু নিজেই ওদের বিয়ের কথা বলেছে।”
“এই তুমি আমাকে শুধু শুধু ভয় দেখিও না তো। একবার শুধু ওদের বিয়েটা হোক। তারপর হাতে-পায়ে ধরে হলেও সবাইকে রাজি করাবো।”
“হুম সেটাই। আগে ওদের বিয়েটা হোক। অনুর ভাবমূর্তি দেখে তো মনে হচ্ছে না যে, রাজি হবে।”
আয়ানও এবার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“আমিও এই ভয়টাই পাচ্ছি। ও যদি না করে দেয় তাহলে একদম সব শেষ!”
রাতে অনু এবং স্নিগ্ধা ব্যতীত সবাই নিচে গিয়ে খেতে বসেছে। অনু আসেনি রাগ করে। ওর খাবার লিলি খালা রুমে এসে দিয়ে গেছেন। স্নিগ্ধা আসেনি ওর মাথা-ব্যথা করছে হঠাৎ তাই। জোবেদা বেগম তাই আগেই স্নিগ্ধাকে এসে নিজে খাইয়ে দিয়ে, ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গেছেন।
রিয়াদ খাওয়া-দাওয়া করে রুমে এসে দেখল স্নিগ্ধা চোখের ওপর হাত রেখে শুয়ে আছে। রিয়াদের আসার শব্দ পেয়ে হাত সরিয়ে তাকাল স্নিগ্ধা। বলল,
“ডিম লাইটটাও অফ করে দেবেন প্লিজ?”
রিয়াদ বলল,
“হ্যাঁ, দিচ্ছি। তুমি এখনো ঘুমাওনি কেন?”
“মাথা-ব্যথায় ঘুমও আসছে না।”
“হঠাৎ করে মাথা-ব্যথা বানালে কী করে?”
“বুঝতে পারছি না।”
রিয়াদ ডিম লাইটও অফ করে দিল। মুহূর্তেই ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে। রিয়াদ গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ল। স্নিগ্ধা মাথার যন্ত্রণায় বারবার এপাশ-ওপাশ করছে। রিয়াদ জিজ্ঞেস করল,
“বেশি ব্যথা করছে?”
“হুম।”
রিয়াদ এবার স্নিগ্ধার দিকে ঘুরে শুয়ে, ওর মাথা টিপে দিতে লাগল, চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আনন্দে চোখে পানি এসে জড়ো হলো স্নিগ্ধার। এতক্ষণ যেই যন্ত্রণা সে অনুভব করছিল, এই আনন্দের কাছে তা ফিকে হয়ে গেছে। রিয়াদ বলল,
“এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
স্নিগ্ধা সাহস পেয়ে রিয়াদের খুব কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখল। আকুতিভরা কণ্ঠে বলল,
“প্লিজ সরিয়ে দিয়েন না!”
রিয়াদ অপ্রস্তুতবোধ করলেও স্নিগ্ধাকে কিছু বলল না এবং সরিয়েও দিল না। আগের মতোই মাথা টিপে দিতে লাগল।
রুমের দরজা লাগিয়ে পায়চারি করছে অনু। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। সবাই কখন ঘুমিয়ে পড়বে সেই অপেক্ষা করছে সে। রায়ান ভাইয়ের সঙ্গে বোঝাপড়া আছে তার। সে কী শুরু করেছে এসব? জবাবদিহি করতে হবে তার। ঘড়িতে যখন প্রায় রাত একটা বাজে তখন পা টিপে টিপে রুম থেকে বের হলো অনু। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে। রায়ান ভাইয়ের রুমের সামনে গিয়ে দরজা নক করতে গিয়ে দেখল, দরজা খোলাই আছে। শুধু চাপিয়ে রাখা ভেতর থেকে। তাই আর নক করল না অনু। সরাসরি রুমে ঢুকে গেল। রায়ান ভাই তখন সবেমাত্র গোসল করে বেরিয়েছে ওয়াশরুম থেকে। পরনে শুধু একটা কালো ট্রাউজার। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে হকচকিয়ে তাকাল রায়ান ভাই।
এই অবস্থায় অনু নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে গেল। অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। ভয় হচ্ছে, কখন না জানি আবার লোকটা ওকে অপমান করে দেয়।
রায়ান ভাই অবশ্য অপমানের ধারে-কাছেও গেল না। বরং বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল,
“তুই?”
অনু জেদ দেখিয়ে বলল,
“কেন চিনতে পারছেন না? নাকি সবার মধ্যেই শুধু হিয়া আপুকে দেখতে পান?”
রায়ান ভাই হেসে ফেলল। আলমারি থেকে একটা টি-শার্ট নিয়ে গায়ে জড়িয়ে বলল,
“এখন এদিক ফিরে কথা বলতে পারিস। এমনিও এত লজ্জা পাওয়ার কিছু ছিল বলে মনে হয় না।”
অনু আড়চোখে একবার দেখল। এরপর সরাসরি তাকিয়ে বলল,
“আপনার মতো নির্লজ্জ মানুষের কাছে অনেক কিছুই লজ্জার মনে হবে না স্বাভাবিক।”
রায়ান দুই হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,
“তাই নাকি অনু? রাত একটা বাজে তুই আমার রুমে এসেছিস, অথচ নির্লজ্জ বলছিস আমাকেই?”
অনু তেলে-বেগুনে জ্ব’লে উঠে বলল,
“হ্যাঁ, এসেছি। তো? প্রেম করতে তো আসিনি। বোঝাপড়া করতে এসেছি।”
“কীসের বোঝাপড়া?”
“আপনি যা শুরু করেছেন এসবের মানে কী?”
“কী শুরু করেছি?”
“দয়া করে আমার সাথে কোনো নাটক করবেন না। আপনাকে আমি খুব ভালো করেই চিনি।”
রায়ান ভাই মলিন হাসি দিয়ে বলল,
“তাই? আর আমার ভালোবাসা? ভালোবাসা বুঝিস না?”
অনু একটু ভড়কে গেলেও থেমে গেল না। সে পূর্বের রাগ ধরে রেখেই বলল,
“দাদুকে বিয়ের কথা আপনিই বলেছেন তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“তোকে বিয়ে করতে চাই তাই।”
“আমাকে কেন আপনি বিয়ে করতে চান?”
রায়ান ভাই একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। অনুর চোখে চোখ রেখে বললেন,
“তোকে ভালোবাসি তাই।”
অনু শ্লেষাত্মক হাসি দিয়ে বলল,
“ভালোবাসা? আপনি আসলে আমাকে ভালোবেসে নয়, আমার অনুপস্থিতিতে কষ্ট পেয়ে আমার কাছে এসেছেন। নিজেকে ভালো রাখতে আমাকে চাচ্ছেন।”
রায়ান ভাই নিশ্চুপ হয়ে শুনছে। অনু নিজেই ফের বলল,
“ঠিক এজন্যই এখন আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন। বিয়েটা একবার হয়ে গেল এই মোহ আর থাকবে না। তখন আর এই নাটক করা ভালোবাসাও থাকবে না। তখন হাতের পুতুলের মতো নাচাবেন আমাকে। কিন্তু আমি তো সেটা হতে দেবো না।”
এসব কথা শুনে রায়ান ভাই রাগে-ক্ষোভে অনুর খুব কাছে চলে এলো। অনুকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলল,
“তোর সমস্যা কী অনু? কী ভাবিস তুই নিজেকে? তুই কি ভেবেছিস, তোকে ভালোবাসতে শুরু করেছি বলে তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না? কথা না বললে কষ্ট পাব? পাগল হয়ে যাব? তাহলে তুই শুনে রাখ…”
তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২৪
অনু হঠাৎ এরকম আক্রমণে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে সে। পরক্ষণে চোখ মেলে দেখে রায়ান ভাই ওর পায়ের সামনে দুই হাঁটু মুড়ে ফ্লোরে বসে আছে। সে অনুর দিকে তাকিয়ে কাতর হয়ে বলল,
“তুই ঠিকই ভেবেছিস। তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না অনু! তুই শুধু আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিস না। আমাকে নিয়ে তোর সমস্ত ভুল ধারণা আমি মিথ্যা প্রমাণ করে দেবো, প্রমিস। এরপরও যদি আমাকে যদি ফিরিয়ে দিস, তাহলে তুই বিহীন আমার বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে অনু।”