তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২৭

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২৭
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

আকাশে মেঘ করেছে। রক্তিম মেঘ। বাতাস নেই, বৃষ্টি আসার সম্ভাবনাও কম। বাড়িতে গান-বাজনা হচ্ছে। সবাই ব্যস্ত। কিন্তু আনন্দটা ঠিক হচ্ছে না। না হওয়ার বিশেষ কারণও আছে। রায়ান এবং অনুর গায়ে হলুদ আজ। যতটা আগ্রহ নিয়ে সবাই ওদের বিয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল ততটাই আগ্রহে ভাঁটা পড়েছে সবার। সকাল থেকেই অনুর জ্বর। ভীষণ জ্বর। মাথা সোজা রেখে বসে থাকার উপায় নেই। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে অথচ গতকাল রাতেও মেয়েটা দিব্যি সুস্থ ছিল। এমতাবস্থায় রায়ান সবাইকে জানাল, বিয়ে পেছানোর কথা। আগে অনুর সুস্থতা, পরে বিয়ে। বাড়ির সকলে রাজিও হয়েছিল। কিন্তু বেঁকে বসেছে অনু নিজেই। বিয়ের এতসব আয়োজন, টাকা শুধুমাত্র তার জন্য নষ্ট হোক সে চায় না। ওর জেদের জন্যই আজ গায়ে হলুদ হচ্ছে। রায়ান খুবই অস্থির অনুকে নিয়ে। মনে হচ্ছে সে নিজেই অসুস্থ। ডাক্তার ডাকা হয়েছে, ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে, মাথায় পানি ও জলপট্টি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জ্বর নামার কোনো নামই নেই। একদম পোঁটলাপুটলি নিয়ে এসে তবেই বসেছে যেন।

রায়ান এবং অনু বসে আছে পাশাপাশি। একই বাড়ির ছেলে-মেয়ে, একই জায়গায় বিয়ে। কনে বিদায়ের কান্নাকাটিও হবে বলে মনে হয় না। বিদায় নিয়ে আর অনু যাবে কোথায়? এই বাড়িতেই তো থাকতে হবে। অনুর গায়ে হলুদ শাড়ি, গায়ে কাচা ফুলের গহনা। মুখে বিন্দুমাত্র সাজগোজ নেই। মুখ চেপে বসে আছে চুপচাপ। রায়ান অনুর হাত ধরল। সাথে সাথে মুখটা শুকিয়ে আমশি হয়ে গেল। শরীরে এত জ্বর, তাপে মনে হচ্ছে হাত পু’ড়ে যাবে রায়ানের। না জানি অনুর কত কষ্ট হচ্ছে!
“তুই কেন জেদ করলি, অনু?”
অনু স্মিত হেসে বলল,
“কখন জেদ করলাম?”
“আজ গায়ে হলুদটা না হলে কি হতো না?”
“না, হতো না। আপনার মতলব কী? আপনার হিয়াকে বউ করার ইচ্ছে আছে নাকি?”
রায়ান ধমকের সুরে বলল,
“এক থা’প্প’ড় দেবো, একদম আমার বুকে এসে পড়বি। খালি বাজে কথা!”
অনু হেসে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তা বেশ তো! দিন থা’প্প’ড়, আপনার বুকে গিয়ে না হয় পড়লাম একটু।”
“তুই খুব বাড় বেড়েছিস।”
“হ্যাঁ, একটু একটু বেড়েছি। আপনার বউ হবো বলে কথা।”
রায়ান রাগ দেখাতে গিয়েও পারে না। অনুর শুকনো মুখটা দেখলেই মায়া হচ্ছে। সে কিছুটা শক্ত করে অনুর হাত চেপে ধরে বলল,
“তোর খুব কষ্ট হচ্ছে না রে?”
“উঁহু! খুব না। একটু। আপনি পাশে আছেন বলে সেটুকুও উপলব্ধি হচ্ছে না।”
রায়ান ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমাকে ভালোবাসিস?”
“আপনার কী মনে হয়?”
“তোকে জিজ্ঞেস করেছি।”
“ভালো না বাসলে বিয়ে কেন করছি? আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন, আপনার আগে আমিই আপনাকে ভালোবেসেছিলাম।”

“ভুলিনি।”
“আর তাছাড়া এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে কেন করছি বলুন তো? কেন গায়ে হলুদ পেছাইনি?”
“কেন?”
“বলা তো যায় না, যদি এর মাঝেই ম’রে যাই?”
রায়ান ভাই ধমকে উঠল ফের।
“তোর বাজে কথা বন্ধ করবি না?”
ধমক খেয়েও অনু হেসে বলল,
“আচ্ছা সরি।”

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো একটু সাদামাটাভাবেই। আয়োজনের কোনো কমতি ছিল না কিন্তু উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল। অনু অসুস্থ বিধায় কেউই খুব একটা আনন্দ করতে পারেনি। রাতে সবাই ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছে। স্নিগ্ধা শাশুড়ি এবং চাচি শাশুড়িদের সাথে হাতে হাতে সব কাজ শেষ করে একেবারে রুমে ফিরেছে। রিয়াদ তখনো ঘুমায়নি। একটা বই পড়ছিল। রুমের দরজা আটকিয়ে স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করল,
“আপনি এখনো ঘুমাননি কেন?”
রিয়াদ বই থেকে মুখ তুলে বলল,
“এইতো বই পড়ছিলাম।”
“সারাদিন এত কাজ করেও আপনার বই পড়ার এনার্জি আছে?”
রিয়াদ স্মিত হেসে বলল,
“আছে।”
“ঠিক আছে। আর পড়তে হবে না। ঘুমান এখন।”
“তোমার সব কাজ শেষ?”
“হ্যাঁ। লাইট বন্ধ করব?”
“করো।”

“আপনি আগে শুয়ে পড়ুন।”
রিয়াদ বই বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। স্নিগ্ধা লাইট নিভিয়ে পাশে শুয়ে বলল,
“একটা জিনিস কি খেয়াল করেছেন?”
“কী?”
“রায়ান ভাই কিন্তু অনুকে ভীষণ ভালোবাসে।”
রিয়াদ চুপ করে আছে। স্নিগ্ধা নিজেই বলল,
“রায়ান ভাইয়ের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তিনি অনুকে কতটা ভালোবাসেন। অনুর অসুস্থতায় তিনিই সবচেয়ে বেশি কাতর। মেজো চাচ্চু যতটা অস্থির অনুকে নিয়ে, রায়ান ভাইও ততটাই যেন অস্থির। প্রতিটা মেয়েই আসলে এমন জীবনসঙ্গী চায়, যে তাকে তার বাবার মতোন আগলে রাখবে, ভালোবাসবে। সেদিক থেকে হিসাব করলে কিন্তু আমাদের অনু খুব ভাগ্যবতী বলা যায়।”

রিয়াদ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনল। যদিও স্নিগ্ধা রায়ানের ভালোবাসার বর্ণনা করছিল, কিন্তু কোথাও যেন একটা চাপা আফসোস। না পাওয়ার আক্ষেপ। অনু যদি ভাগ্যবতী হয় তাহলে সেই একই ভাগ্যবতী হওয়ার দাবিদার স্নিগ্ধা নিজেও। কিন্তু রিয়াদের থেকে সে ভালোবাসা তো পায়নি। এই পর্যায়ে এসে রিয়াদের নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে। সে অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকতে গিয়ে বর্তমানকে নষ্ট করছে, তার সারাজীবনের সঙ্গীকে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু তবুও স্নিগ্ধার মধ্যে কোনো অভিযোগ করার প্রয়াস নেই। সে সর্বদা স্বাভাবিক থাকে, হাসি-খুশি থাকে, বাড়ির সবার খুব খেয়াল রাখে। কে জানে তার এই অপরাধবোধ থেকেই হয়তো সে তার এক হাত স্নিগ্ধার গায়ের ওপর রাখল। কাছে আসার চেষ্টা করল। স্নিগ্ধা অবাক হলো প্রথমে, পরক্ষণে মৃদু হেসে রিয়াদের হাতটা সরিয়ে দিল। এরপর রিয়াদের দিকে মুখ করে শুয়ে বলল,

“আমার কথা শুনে আপনি আমাকে দয়া করুন এবং দয়া থেকে আমার কাছে এসে আমাকে আপন করে নিন এমনটা আমি চাই না। আমি চাই আমাকে আপনি ভালোবেসেই কাছে টেনে নিন। অল্প ভালোবাসা হলেও চলবে। তবে সেটা ভালোবাসা হতে হবে, করুণা নয়। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। গুড নাইট।”

অনুর রুমে সবুজ রঙের ডিম লাইট জ্বলছে। বারান্দায়ও লাইট জ্বালানো। বিয়ে বাড়ি বলে এমনিতেই আলোর ঝলকানি বেশি। রুমের দরজা আজকে লক করা হয়নি। মায়ের নিষেধ। যদি কোনো দরকার হয় যেন ছুটে আসতে পারে। যদিও সাথে শাপলা রয়েছে। কিন্তু মেয়েটার ঘুম ভীষণ গভীর। একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর হুঁশ থাকে না। এইযে এখনো অনুকে জড়িয়ে ধরে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। এসব জড়াজড়ি করে ঘুমানো অনুর একদম পছন্দ নয়। সে মা ছাড়া কাউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারে না, কখনো চেষ্টাও করেনি। ওর গায়ে হাত রাখলেও ঘুম হয় না। এইযে এখনো হচ্ছে না। আবার শাপলাকে সরিয়েও দিচ্ছে না। মেয়েটার প্রতি কেমন যেন অদৃশ্য মায়া এবং ভালোবাসা জন্মে গেছে অনুর। পরিবারে অবহেলিত বলে নাকি শাপলা নিজ গুণেই অনুর মনে জায়গা করে নিয়েছে অনু তা জানে না।
অনু শুয়ে শুয়ে দেখতে পাচ্ছে, ভিড়িয়ে রাখা দরজার আড়াল থেকে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। সেই একজনটা কে অনু তা জানে। রায়ান ভাই। না ঘুমিয়ে সে এখানে কেন ঘুরঘুর করছে?

অনু বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করল। লাইটের আলো চোখে বিঁধে। ফোনের আলোতেও মাথাটা ঘুরে উঠল। ব্রাইটনেস একদম কমানো। তবুও চোখে লাগছে। কোনোরকম চোখ কুঁচকে টেক্সট দিল,
“রুমে আসুন।”
এক মিনিটের মাথাতেই রায়ান ভাই রুমে এসে হাজির। যেন সে এতক্ষণ এখানে ছিলই না এমন ভান ধরে বলল,
“কীরে হঠাৎ ডাকলি যে? কোনো সমস্যা? শরীর খারাপ করছে?”
অনুর নির্লিপ্ত জবাব,
“বসুন।”
রায়ান ভাই চেয়ার টেনে এনে বসল। অনু বলল,

“ওখানে না। আরো কাছে। আমার মাথার কাছে বসুন।”
রায়ান ভাই এক পলক তাকিয়ে থেকে অনুর মাথার কাছে বসল। অনু বলল,
“মাথায় হাত বুলিয়ে দিন।”
রায়ান ভাই অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে কপালে স্পর্শ লাগল। আঁতকে উঠে বলল,
“এখনো তো শরীরে অনেক জ্বর! শাপলা তোকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে কীভাবে? ওর গরম লাগছে না?”
অনু হেসে বলল,

“ও ঘুমিয়ে গেলে ওর হুঁশ থাকে না। আর শরীর গরম লাগলেই বা কী? আগামীকাল তো আমাদের বিয়ে। আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবেন না?”
রায়ান ভাই থতমত খেয়ে গেছে। জ্বরের ঘোরে মেয়েটা কীসব আবোল-তাবোল বকছে! অনু ফের বলল,
“চুপ করে আছেন কেন? উত্তর দিন।”
“তোর এখন ঘুমানো উচিত, অনু। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, তুই ঘুমানোর চেষ্টা কর।”
“এড়িয়ে যাচ্ছেন? ঠিক আছে ব্যাপার না। আচ্ছা বলুন, এতক্ষণ রুমের সামনে ঘুরঘুর করছিলেন কেন?”
রায়ান ভাই ধরা খেয়ে বলল,

“কী যা তা বলছিস! আমি কেন দরজার সামনে ঘুরঘুর করতে যাব?”
“কেন ঘুরঘুর করবেন তা তো আর আমি জানি না। আপনি জানেন।”
“জ্বরে তোর মাথা গেছে।”
“মাথা আমার ঠিকই আছে। আর মাথা যদি গিয়ে থাকে তাহলে জ্বরে যায়নি, আপনাকে ভালোবেসে গিয়েছে।”
রায়ান ভাই চুপ করে আছে। অনু বলল,
“আমাকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি ঠিক আছি একদম। বাইরে এভাবে ঘুরঘুর না করলেও চলবে।”
রায়ান ভাই দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল,
“তোকে তো ঠিক থাকতেই হবে অনু। এখনো আমাদের একসাথে অনেকটা পথচলা বাকি।”
অনু ভাবনার মাঝে অনুরোধ করে বসল,

“আমাকে একটা গান শোনাবেন?”
“এখন? এই রাতের বেলা?”
“হ্যাঁ। অনুরোধ করলাম।”
“শাপলা আছে।”
“ও শুনবে না।”
“পাশের রুমে শুনবে।”
“শুনবে না। সফ্ট কোনো গান গাইলেই তো হয়। আর কেউ শুনলে শুনুক। আমি ভয় পাই নাকি? রাত পোহালেই তো আমাদের বিয়ে। আমার বর আমাকে গান গেয়ে শোনাচ্ছে এতে কার কী আসে যায়?”
রায়ান ভাই হেসে ফেলল। আদুরে কণ্ঠে বলল,

“ঠিক আছে। গান শোনাচ্ছি।”
রায়ান ভাই আবেগ মিশিয়ে গাইতে লাগল,
“হৃদয় উজাড় করে একটা জনম
করে যাব তোমারই প্রার্থনা,
যতক্ষণ থাকবে দেহে প্রাণ
তোমায় ছেড়ে কখনো দূরে যাব না।
নিশিদিন এই মনের ভেতর
করি তোমারই আরাধনা,
নিশিদিন এই মনের ভেতর
করি তোমারি আরাধনা।”
গান শেষ হলে অনু খুশি হয়ে বলল,

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২৬

“থ্যাঙ্কিউ।”
“এবার শান্তি হয়েছে? এখন ঘুমো।”
অনু রায়ান ভাইয়ের একটা হাত নিয়ে গালের সাথে ঠেকিয়ে বলল,
“রায়ান ভাই, আমি যদি সত্যিই ম’রে যাই আপনি কী করবেন?”

তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব ২৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here