দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৮ (২)
আফরোজা আশা
নিশুতি রজনী। সাজানো-গোছানো আলোকিত ফাঁকা ঘর। নিস্তব্ধ সে ঘর জুরে ভেসে বেড়াচ্ছে গুমোট কান্নার আওয়াজ। এক কোণে দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে বৃষ্টি। হাঁটু ভাজ করে গুটিশুটি মেরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চোখমুখে আতংকের ছড়াছড়ি। হাতের চুড়িগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে, মনে প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে চুড়িগুলো ছুড়ে ফেলা হয়েছে।
ঘরের দরজা আলগোছে ভিড়ানো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে ফয়সাল। চোখজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে তার। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ঘরে প্রবেশ করল সে। দরজা আটকে কদম এগলো বৃষ্টির দিকে। সামনা-সামনি এসে হাঁটু গেড়ে বসল। কান্নাভেজা লালাভাব নেত্রপল্লব উঠিয়ে রাগী চোখে ফয়সালের দিকে তাকালো বৃষ্টি। পরক্ষনেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘাড় কাঁত করে ফেলল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফয়সাল বৃষ্টির থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসেছে। আশপাশের ছড়িয়ে রাখা চুড়িগুলো একটা একটা করে হাতে তুলে নিল। সেগুলো বৃষ্টির মুখের সামনে ধরে হালকা ঝাঁকিয়ে শব্দ তুলল। শব্দ শুনে বেঁকিয়ে রাখা ঘাড় সোজা করলো বৃষ্টি। চুড়িগুলো একপলক দেখে হাত উঠালো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ওর সে হাত খপ করে ধরে ফেলল ফয়সাল। বৃষ্টি অন্যহাত দিয়ে ফয়সালকে দূরে সরাতে চাইলে, তড়িৎ বেগে বৃষ্টিকে টেনে পাজাকোলে তুলে নিল সে। ছটফটিয়ে উঠল বৃষ্টি। হাত-পা ছড়িয়ে নামার চেষ্টা চালালো। কিন্তু ফয়সালের পুরুষালি শক্তির সামনে নিতান্তই চুনোপুটি ও। নিজেকে ছাড়াতে ব্যর্থ হলো।
ফয়সাল ওকে এনে সোজা বিছানায় ফেলল। বৃষ্টি উঠে বসার জন্য নড়তে চাইলো কিন্তু সফল হলো না। তার আগেই শরীরের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে ওর ওপর ঝুঁকে পড়ল ফয়সাল। বৃষ্টির দুহাত তার একহাতে মাঝে নিয়ে ধরে মাথার উপর দিকে চেপে ধরল । জান-প্রাণ ছেড়ে মোচড়া-মোচড়ি করলো বৃষ্টি। কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। শেষমেষ দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠল,
‘ আপনার চোখের সামনে একটা পর-পুরুষ আমার হাত ধরার সাহস দেখালো। আপনি তাকে কিছু বললেন না। কিছুক্ষন পর বাসর ঘরে ছুটে এলেন স্বামীর অধিকার ফলাতে। লজ্জা নেই আপনার? ’
ঘৃণা উপচে পড়ছে বৃষ্টির চোখ বেয়ে। ফয়সাল শান্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে। বৃষ্টির কথা শেষ হওয়ার পর বলল,
‘ ফাহিমের থেকে ছয় মাসের বড় আমি। আমার স্ত্রী হিসেবে তুমি সম্পর্কে ওর বড়ভাবি হও। ও সবার আড়ালে তোমাকে বাজেভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছে। তুমি চাইলে সবার সামনে ওকে ওর প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে পারো। ’
বৃষ্টি হিসহিসিয়ে পুনরায় বলল,
‘ সবার আড়ালে হলেও আপনি তো দেখেছিলেন। আপনার নজর পড়েছিল তখন। দেখেও কেন চুপ থাকলেন? বিয়ের আগে তো খুব বড় বড় কথা বলেছিলেন। এখন কি হলো? ভয় পান ওই শয়তানকে? ’
ফয়সাল ঠান্ডা মেজাজে জবাব দিল,
‘ ভয় পাই না। আমার কাজ আমি সময়মতো করব। সুপার পাওয়ার নেই আমার মাঝে। আমিও তোমার মতো সাধারণ মানুষ। সর্বক্ষন চোখে চোখে রাখা সম্ভব না; আমার কর্মব্যস্ততা আছে। ’
বৃষ্টি নড়াচড়া থেমেছে। ফয়সালের কথায় মনযোগী হয়েছে ও। ফয়সাল একটু থেমে আবারো বলতে লাগল,
‘ ফাহিমের মতো নারী লোভী ছেলের অভাব নাই এই দুনিয়ায়। নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য তোমার নিজেকেই লড়তে হবে। আর কতদিন ভয়ে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকবা। বাবার বাড়িতে পার পেয়েছো। কিন্তু এখানে? হুটহাট অনেক পরিস্থিতিতে ও তোমার সামনে চলে আসবে। তুমি ওর সামনে নিজের ভীতি তুলে ধরলে ও আলবাৎ আস্কারা পাবে। যেমনটা আজ পেল। ’
কম্পমান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল বৃষ্টি,
‘ রুমভর্তি মানুষজনের ভিরে বাড়ির নতুন বউ বাড়ির আরেক ছেলেকে অপবাদ দিলে আপনারা ছেড়ে দিতেন আমায়? হয়তো দেখা যেতো এ ঘরে আমার পা পড়ার আগেই তালাক দিয়ে বাবার বাড়িয়ে ছেড়ে আসতেন। ’
কথা শুনে ফয়সাল কিঞ্চিৎ হাসল। চেপে ধরে রাখা বৃষ্টির হাত ছেড়ে দিল। আবার ওর একহাত টেনে নিজের দুহাতের মাঝে ধরল। পাশে রাখা চুড়িগুলো যত্ন সহকারে একে একে পড়িয়ে দিতে লাগল। অতঃপর চুড়িগুলো নিচের দিকে ঠেলে দিয়ে ঠিক সে জায়গায় হাত বসালো, যে জায়গায় ড্রয়িংরুমে বসে থাকা বধূরূপী বৃষ্টির হাত ধরেছিল ফাহিম। সবার চোখের আড়ালে। উপস্থিত মানুষের নজর এড়াতে পারলেও ফয়সালের নজরে ঠিকি ধরা পড়েছিল।
সব দেখেও চুপ ছিল ফয়সাল। বৃষ্টির চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল নিরবে। ও চাইলেই পারত সেখানে ফাহিমকে তার কর্মের শাস্তি দিতে। কিন্তু সেটা একবার-দুবার পারবে। আজ নজরে পড়েছে বলে পারবে। কাল নাও পড়তে পারে। তখন কি! বৃষ্টি নিজেকে গুটিয়ে নিবে। হয়তো কোনো একদিন এসবের প্রভাব পড়বে ওদের সম্পর্কের মাঝে।
ফয়সাল একটা ভারী শ্বাস ফেলে বৃষ্টির দিকে আরেকটু ঝুঁকল। ওর হাতের ওই অংশটুকু বুড়ো আঙুলের সাহায্যে স্লাইড করতে করতে বলল,
‘ এই জায়গায় ধরেছিল না। ’
বলে শব্দ করে চুমু আঁকলো সেখানে।
সে আদুরে স্পর্শে বৃষ্টির ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। স্থির দৃষ্টে কিয়ৎক্ষন চেয়ে রইল ফয়সালের দিকে। ফয়সাল বৃষ্টির চোখে চোখ রেখে ওর হাতের ভাজে হাত গলিয়ে দিল। হালকা চাপ দিয়ে বলল,
‘ আমার বউয়ের হাত খুব নরম। এ হাত আমার জন্যই বরাদ্দ থাকলো। অন্যকাউকে আর ধরতে দিও না। সম্পর্কে থাকাকালীন এ হাত অন্য পুরুষকে ধরতে দিয়ে বিরাট অন্যায় করেছো মেয়ে। এর শাস্তি আমি অবশ্যই তুলব। ’
ফয়সালের কথা শুনে মাথা নত করে ফেলল বৃষ্টি। চোখের কোণ ঘেঁষে গড়ালো নোনাপানি। ফয়সাল আরেকহাতের আঙুলির সাহায্যে সে পানি মুছে দিল। বৃষ্টি কপালে উষ্ণ পরশ বুলিয়ে নরম স্বরে আওড়ালো,
‘ এ ঘর থেকে বের হওয়ার পর কেউ তোমাকে ডিস্টার্ব করলে এই নরম হাত যেন আর নরম না থাকে। যে পরিস্থিতিই থাক প্রতিবাদ করবে তাতক্ষনাৎ। বাকিটা সামলানো আমার দায়িত্ব। ভয় নেই; তোমার স্বামী তোমার সাথে আছে, থাকবে। ’
বৃষ্টি ভেজা গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ একজনের প্রাক্তন জানা স্বত্ত্বেও আপনি আমাকে বিয়ে করলেন কেনো? ’
ফয়সাল দম টেনে বলা শুরু করল,
‘ আমার বাবা তোমাকে আমার জন্য অনেক আগেই তোমার বাবার কাছে প্রপোজাল দিয়েছিল। তোমার বাবা আমার বায়োডাটা ঘেটে বিয়েতে রাজি হয়েছিল। তবে সময় চেয়েছিল দু বছরের। কারণ তোমার নার্সিং ক্যারিয়ারের শুরু হয়েছিল কেবল। আমিও চট্টগ্রামে নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তাই সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখা হয়েছিল। আমি তোমাকে আগে দেখিনি। আব্বা বিয়ে ঠিক করার পর তোমার একটা ছবি পাঠায় আমার কাছে। আমার মতামত না নিয়েই আব্বা বিয়ে ঠিক করেছিল। পরবর্তীতে আমিও সায় দেই তার সাথে। তবে তোমার কোনো খোঁজ-খবর রাখিনি। তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল বহু আগে; তুমি তার প্রাক্তন হয়েছো পরে। ’
বৃষ্টি একরাশ জড়তা নিয়ে অপরাধী গলায় বলল,
‘ আমি আপনার হক মেরেছি। আপনি আমার মতো খারাপ মেয়েকে জেনেবুঝে বিয়ে কেনো করলেন? আমি আপনার যোগ্য নই। ’
ফয়সাল ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে উঠল,
‘ অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে, তোমাকে বিয়ে করে আমার ঘরে তুলতাম না নিশ্চয়ই। ’
ডুকরে কেঁদে উঠল বৃষ্টি। পরক্ষনেই দুহাত দিয়ে ফয়সালের গলা পেঁচিয়ে ধরল। মুখ গুজল ওর প্রশস্থ বুকে। অস্পষ্ট স্বরে নিজের ভুলের জন্য মাফ চাইলো স্বামীর কাছে। স্ত্রীর আহাজারিতে কিছুক্ষন নিরবে কাটালো ফয়সাল। অতঃপর দুহাত দিয়ে স্বীয় বক্ষে আগলে নিল তাকে।
কাঁচুমাঁচু মুখে কাউচে বসে আছে বেলা। কিছুক্ষন আগে বমি করে বিছানা-বালিশ আর মেঝের অনেকাংশ নষ্ট করেছিল। দিগন্ত সেসব পরিষ্কার করেছে। বিছানার চাদর উঠিয়ে ধুয়ে দিয়েছে, আবার নতুন করে চাদর বিছিয়েছে। বেলাকে ঠিকঠাক করে বসিয়ে রেখে বর্তমানে ওয়াশরুমে সে। এদিকে, আগের শাড়ি-কাপড় পাল্টে বেলার গায়ে এখন নতুন সালোয়ার- কামিজ। শরীরে প্রায় হালকা জ্বরও চলে এসেছে। দিগন্ত ওকে যেভাবে রেখে গিয়েছে, ভীতি মুখে সেভাবেই বসে আছে বেলা।
ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে। মিনিট তিনেক পর শাওয়ার নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হলো দিগন্ত। ভেজা তোওয়ালে বেলকনিতে রেখে বেলার কাছে এলো। আধভেজা ঠান্ডা হাত বাড়িয়ে ওর কপাল ছুলো। আস্তে আস্তে তাপমাত্রা বাড়ছে। তারপর কোনো শব্দ বিনিময় হলো না ওদের মাঝে। দিগন্ত বাইরে চলে গেল।
মিনিট বিশেক পর একটা ট্রে হাতে ঘরে ফিরল সে। বেলার সামনে ট্রে টা রেখে রাশভারি গলায় আদেশ ছুড়ল,
‘ তাড়াতাড়ি শেষ কর। ’
নিচে হেলিয়ে রাখা মাথা তুলে ছলছল নেত্রে দিগন্তের দিকে চাইলো বেলা। সে দৃষ্টি অবলোকন করে ভারী শ্বাস ফেলল দিগন্ত। ঘুরে গিয়ে দরজা আটকে, আবার বেলার কাছে এলো। এক পা তুলে ওর সামনা-সামনি বসে ট্রে থেকে নুডলস এর বাটিটা হাতে নিল। চামচে খানিকটা তুলে বেলার মুখের সামনে ধরে চোখ দিয়ে ইশারা করল খাওয়া জন্য৷ কিন্তু বেলা খেলো না। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠল।
বেলার কাজে দুই ভ্রুঁর মাঝে গাঢ় ভাজ পড়লো দিগন্তের। কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে বলল,
‘ বেয়াদবের মতো কাঁদছিস কেনো? আমি তোকে বকেছি না মেরেছি? ’
দিগন্তের কথা শুনেও কোনো উত্তর করল না বেলা। বরং কান্নার বেগ বাড়ালো। চোখমুখ কুঁচকে চুউউ শব্দ তুলল দিগন্ত। ট্রে টা পাশে চাপিয়ে বেলাকে জোর-জুলুম করে ধমকে পুরা খাবারটা শেষ করালো। আদা দিয়ে গরম চা এনেছে সেটাও ধরে-বেঁধে খাওয়ালো। বেলা রাগে কটমট করছে, থেকে থেকে কেঁদে উঠছে আবার দিগন্তের হুমকি-ধমকির ভয়ে টুপ করে খেয়ে নিচ্ছে।
এভাবেই পুরা খাবারটা শেষ করিয়ে ফাঁকা ট্রেটা সাইড টেবিলে চটকা মারলো দিগন্ত। তারপর বেলার আর ওর মাঝের দূরত্ব কমিয়ে বেলাকে কাছাকাছি টেনে আনলো। নিজের সাথে ওকে জাপটে জড়িয়ে ধরে গমগমে স্বরে আওড়ালো,
‘ এখনো গন্ধ পাচ্ছিস? পুরো একটা ডাভ সাবান শেষ করলাম। ’
বেলা দিগন্তের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে কান্নারত স্বরে বলল,
‘ আপনি বাজে গন্ধওয়ালা জিনিস কেনো খাবেন? ওই বিচ্ছিরি গন্ধ আমি সইতে পারি না। আপনি আমার কাছে আসতেই উটকো গন্ধটা পেলাম। কি পঁচা একটা গন্ধ! ছি! দাদী বলেছিল স্বামী কাছে এলে তার কথা শুনে চলতে, মনে কষ্ট না দিতে। কিন্তু আপনার জন্য আমি বমি করে দিলাম। আমার স্বামী কষ্ট পেয়েছে আমার কাজে। ’
বেলার কথা শুনে ওর দিকে হালকা ঘাড় ঝুঁকিয়ে তাকালো দিগন্ত। চোখ রাঙিয়ে ত্যাদড় গলা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ তোর স্বামী কে? ’
বেলাও দিগন্তের চোখে চোখ রাখলো। নাকের পাটা ফুলিয়ে পাল্টা জবাব দিল,
‘ কে হয় হোক, আপনাকে বলতে হবে। ’
‘ বেলায়ায়া! ’
দিগন্তের ডাক শুনে নেত্রপল্লব ছলছল হলো বেলার। অভিমানী সুরে বলল,
‘ আপনি বদলে গেছেন দিগন্ত ভাই। আগে একটু কিছু হলেই আমার উপর চিল্লাতেন আবার আদর করে কথা বলতেন। আমি যে আপনার ঘর নষ্ট করলাম তখন রাগ দেখিয়ে চিল্লালেন না কেনো? এতোক্ষন একটুও কথা বলেননি আমার সাথে। ’
চোখে একরাশ হতাশা মিশিয়ে বেলাকে কিছুক্ষন দেখলো দিগন্ত। অতঃপর দুপাশে না ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে কড়া গলায় বলে উঠল,
‘ নাদানের বাচ্চা! চিল্লালে বাপের গরম দেখিয়ে বাপের বাড়ির রাস্তা ধরতি। ’
দিগন্তের এহেন ডাকে দাঁত কিড়মিড়িয়ে ধরল বেলা। জোরে একটা থাবা মারল দিগন্তের বুকে। হিসহিসিয়ে বলল,
‘ চুপ করেন। আপনি সিগারেট কেনো খাবেন? বিয়ের দিনেও পঁচা জিনিস খেয়েছেন। আপনার জন্যই তো আমার স্বামী রাগ করেছে আমার উপরে। ’
তারপর একটু থেমে বিছানায় হাঁটু গেড়ে দিগন্তের মুখোমুখি হলো বেলা। চোখ বড় বড় করে বলতে লাগল,
‘ আগে তো ভাবিনি! আপনি সিগারেট খেয়ে আসলে আমি আপনার আশেপাশে যাবো কিভাবে? আপনাকে জড়িয়ে ধরতেও পারব না। আজকের মতো বমি করে দিবো। দাদী যে কতগুলো আদর-সোহাগ শিখিয়ে দিল সেগুলো কিভাবে করব? ’
শেষের কথাটা বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল বেলা। অন্যদিকে বেলার কথা শুনে তব্দা খেলো দিগন্ত। আপাতত ভেতরের সব রাগ গিয়ে পড়ল দাদীর উপর। বিড়বিড়িয়ে গালি ছুঁড়ল,
‘ যে বাল জানে না কিছু, সে বালকে পীড়াপীড়ি শেখায়। নাদানের ঘরের নাদান; জ্বালিয়ে মারছে এখন। ’
অতঃপর গলা ঝেড়ে বেলাকে বার কয়েক কান্না থামাতে বলল দিগন্ত। কিন্তু বেলা তো বেলায়! কাঁদতে কাঁদতে গাল-মুখ লাল করে ফেলেছে। হেঁচকি টানাও শুরু হয়েছে ইতঃমধ্যে। দিগন্ত ফোঁস করে দম ছেড়ে খসখসে শক্ত দুহাত বাড়িয়ে ওকে বাহুডোরে আগলে নিল। বেলার চুলের ভাজে উষ্ণ পরশ এঁকে ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ দুদিন ক্লাবে ছিলাম। সিগারেট বেশি খাওয়া হয়েছে। আজ সারাদিনে হাত দিয়েও ছুঁইনি। ’
‘ আ..আপনি ছাইপাশ ছাড়বেন না? ’
‘ ছাড়তে বলছিস? ’
‘ হুম। ’
ঝট করে বেলাকে বাহুবন্ধন থেকে ছাড়লো দিগন্ত। উঠে গিয়ে সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে তিন-চারটা সিগারেটের প্যাকেট হাতে ফিরে এলো। সেগুলো বেলার সামনে রেখে রাশভারি গলায় বলল,
‘ সিগারেট ছাড়তে বললি না? ’
নাক টেনে উপর নিচ মাথা ঝাঁকালো বেলা। দিগন্ত বক্র হাসলো,
‘ তুই আমার কথা মানলে, আমি তোর কথা শুনছি। ’
প্রশ্নাত্মক চাহনী মেলে জিজ্ঞেস করল বেলা,
‘ কি? ’
বেলার দিক অনেকটা ঝুঁকে পড়ল দিগন্ত। ওর দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মিলিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠল,
‘ আমি সিগারেট ছাড়বো, তুই বোরখা ধরবি। ’
ঠোঁট উল্টালো বেলা। কিছুপল গাঁইগুঁই করে কাটালো। এখনি বোরখা ধরতে চায় না ও। বেলাকে কথা বলতে না দেখে দিগন্ত একটা সিগারেট বের করল। আগুন ধরিয়ে মুখের সামনে আনতেই লাফিয়ে উঠল বেলা। সিগারেটটা দিগন্তের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দূরে ফিক মারলো। অতঃপর দিগন্তের গলা জড়িয়ে ধরে হড়বড়িয়ে বলল,
‘ পড়বো তো। আপনি আর খাবেন না কিন্তু। ’
বেলার কথা শুনে অধর কোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটলো দিগন্তের।
থে’তলে যাওয়া রক্তা’ক্ত দেহটা কোলে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে জয়নাল। মিনিট কয়েকের মাঝে ঘটা ঘটনায় পাথর বনে গিয়েছে। তার পরনের সাদা পাঞ্জাবিটা র’ক্তের রঙে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। একসাথে দুটো দেহ নিথর হয়ে রাস্তার মাঝে পড়ে রয়েছে। দুপাশ থেকে আসা গাড়িগুলো জ্যাম হয়ে আটকে আছে। সাধারণ মানুষ হা-হুতাশ করছে। নির্দিষ্ট একটা জায়গা ঘিরে রেখেছে মানুষজন। সবার নজর রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা দেহ দুটোতে। কেউ সাহস করে এগিয়ে আসছে না। পুলিশ কেসের ভয়ে অনেকে পাশে থাকলেও হাত লাগাচ্ছে না।
দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৭
জয়নাল র’ক্তভেজা কাঁপা হাত দিয়ে আবারো পালস চেক করল। হীম-শীতল হাতে কোনো রেসপন্স পেল না। টকটকে চোখজোড়া ফেটে পানি গড়াতে চাইছে তার। পুরুষ মানুষ বিধায় শক্ত হয়ে আছে। গলার আওয়াজ বের হতে চাইছে না। চাপ ধরা গলায় হাহাকার মিশিয়ে বলে উঠল,
‘ মারা গেছে। ’