পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৩০
সাদিয়া আক্তার
আকাশ জুড়ে আজ মেঘের ঘনঘটা। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় বৃষ্টি পড়বে তবে বৃষ্টি আসার না নেই ধূসর রঙা আকাশ দেখে আজ পুনমের ছাদে বসে ছবি আকতে মন চাচ্ছে। তাই ব্রাশ ক্যানভাস ও রং প্যালেট নিয়ে উঠে পড়ে ছাদে আজকে প্রায় একসপ্তাহ ধরে পুনম পেইন্টিং করে না তাই মুক্তি পিছন পিছন এসেছে ভিডিও করবে। পুনমের এই দিকে কোনো ধ্যান নেই সবসময়েই মুক্তি করে।
ছাদে পাটি বিছিয়ে বসে পড়ে দুইবোন। সময়টা বিকালের দিকে হলেও হালকা বাতাস ধূসর রঙা আকাশের কারণে সন্ধ্যে হবো হবো ফিল আসতেছে।
— এই পূর্ণ কফি খাবি,,
— না আপু চা হলে চলবে,, কফি তেতো। নাক মুখ কুচকে বলল পুনম
— এই তোদের এতো অমিল হলে কেমনে হবে রে,,
— মানে কিসের অমিল বলছ,,
মুক্তি কথা ঘুরিয়ে বলল — চন্দ্র ভাইয়ের হাতের কফি অনেক মজা জানিস?? আর চন্দ্র ভাইতো কফি লাভার
— জেনে লাভ নেই চন্দ্র ভাইয়ের মতো তিতা করলা। তিতা খাবারই পছন্দ করবে এতে অবাক হওয়ার কিছু না আর জানারও কিছু নাই
চন্দ্রের প্রতি এমন উদাসীনতা দেখে মুক্তি হতাশ তবুও হাল না ছেড়ে বলল — এই পুনম জানিস আমার ভাইয়ের সৌন্দর্যের কারণে সেই নবম শ্রেণিতে থাকতেই প্রেমের প্রস্তাব আসত,,,
— তো আমি কি করব। তাকে সেভাবে কোনোকালে খেয়াল করা হয়নি চন্দ্র ভাইয়ের প্রতি আমার কোনো ইন্টারেষ্ট নাই,,,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মনের কথা মুখে বেফাঁস বলেই ভয় পেল পুনম ভীতি চোখে মুক্তির দিকে তাকাতেই দেখে মুক্তি কটমট চোখ পুনমের দিকে তাকিয়ে আছে। বোকা হাসল পুনম তবুও মুক্তিকে চেয়ে থাকতে দেখে আবারও নিজের কাজে মনোনীবেশ করল। মুক্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেলো চা আনতে এদিকে ক্যামেরা সেট করা। রেকর্ডিং অপশনে ভিডিও রেকর্ড হচ্ছে।।
রান্নাঘরে এসে দেখে আগোছালো চুলে গ্রে কালারের টিশার্ট পড়া চন্দ্র কফি মেশিন দ্বারা বিট করছে । মুক্তিকে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞাসা করল
— কফি খাবি??
ভাইয়ের হাতের কফি মুক্তি কখনও মিস করে না একগাল হেসে মাথা নাড়াতেই চন্দ্র আবার কফি বানানোতে মনোযোগ দিল। মুক্তি পাতিলে এককাপ পরিমান পানি নিয়ে চুলায় বসিয়ে চন্দ্রের উদ্দেশ্যে বলল — পুনমের সাথে একটু বেশী বেশী চিপকে থাকতে পারো না,,,??
মুক্তির এমন তারা কথায় হতবাক চন্দ্র মুক্তি আর যাইহোক চন্দ্রের সাথে কখনও এমন কথা বলেনি। ভাইকে অসম্ভব ভালোবাসলেও বেশ ডিসটেন্স মেনটেইন করেই চলেছে সে। আর গম্ভীর চন্দ্রও খোলামেলা হতে পারেনি তবে আজ এমন কথা বলল কেনো,??
চন্দ্রের ভাবনা মাঝেই মুক্তি আবার বলল — এতো সুন্দর হয়ে লাভ কি যেই সৌন্দর্যতা দিয়ে পূর্ণকে পটাতে পারো না।
মুখটা সাইটে নিয়ে একগাল হাসল চন্দ্র ফের এদিকে ফিরিয়ে বলল — পুনম পটলে কি হবে??
— প্রেম হবে ভালোবাসা হবে,, আটকে রাখার থেকে নারীদের ভালোবেসে রাখলে জীবন সুন্দর হয় বুঝলে।
— হু
গম্ভীর স্বরে বলে কফি মগ মুক্তির দিকে বাড়িয়ে দেয়। ততক্ষণে পুনমের চাও হয়ে গেছে মুক্তি তার কফি মগ ও চায়ের কাপ সাথে কুকিজ ট্রেতে নিতে পিছন থেকে চন্দ্র গম্ভীর স্বরে বলল — ঐ গাধীর সামনে সারাদিন খালি গায়ে বসে থাকলেও ও আমার দিকে ফিরে তাকাবে না।
— তো তাকানোর ব্যবস্থা করো,,,
মুক্তির কথার উত্তরে চন্দ্র ভ্রু নাচিয়ে চলে গেলো তবে মনে মনে হাসল সেই ব্যবস্থা তো শুরু হয়ে গিয়েছে।
সকালে উঠে পুনম বড় চাচীর সাথে সাহায্য করে। নাশতা বানানো শেষ হলে টেবিল গুছিয়ে রোজিনা বেগমের জন্য নাশতা নিয়ে যায়। আজ রোজিনা বেগমের শরীরটা ভালো না ।। পারভেজ সাহেব রেডী হচ্ছে রোজিনা বিছানায় বসা
— আব্বু আসব,,?
— আসো আম্মাজান জিজ্ঞাসা করা লাগে।
বাবার কথায় বিস্তর হাসে পুনম রোজিনা বেগমের সামনে বসিয়ে তাকে খাওয়াতে নিলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় রোজিনা বেগম।
— কি হলো আম্মু খাও
রুটির টুকরো সামনে ধরে বলল।
— রুটি খাব না ভাত খাব পান্তা ভাত লবণ মরিচ দিয়ে।
মায়ের কথা শুনে পুনম চিন্তায় পরে যায়। বলে কি তার মা এখন পানি ভাত কই পাবে তবুও বলল
— আচ্ছা বসো দেখি চাচীকে জিজ্ঞাসা করে আছে নাকি,,,
পুনম উঠতে নিলে বাধ সাধে রোজিনা বেগম। আবার কি হলো। প্রশ্ন চোখে তার দিকে তাকাতেই তিনি বলল — এগুলোই দে মা এখন খাই পরে পান্তাভাত খাব তোর ভার্সিটি দেরী হয়ে যাচ্ছে।
পুনম কিছু না বলে একগাল হেসে খাওয়াতে শুরু করে। পারভেজ সাহেব বসে বসে মা মেয়ের কান্ড দেখে কিছু বলে না এরমধ্যেই রুপশা ফোন দেয়।
তিনজন মিলে রুপশার সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে থাকে রুপশাকে আসতে বললে সে জানায় লিমনের ইদানীং চাপ বেড়েছে তাই এখন আসতে পারবে না পরে আসবে।
উপর থেকে শার্টের হাতা ভাজ করতে করতে নামছে চন্দ্র পরনে ডার্ক কফি কালারের শার্ট। পুরুষটার বেশীর ভাগ কাপড় ডার্ক কালারের অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ার দারুন তাকে মানায় ভালোই।।
পুনম পারভেজ সাহেবের পাশে বসে ব্রেকফাস্ট করছে চন্দ্র একদম সোজা পুনমের সামনে বসে। পুনম ফিরে তাকায় না এই লোকটাকে সে ভয় পায়। তাই খুব একটা কথা বলে না আবার চন্দ্র গম্ভীর টাইপের হওয়াতে কারো সাথে সখ্যতা নেই। একমাত্র শিহাব রিশান বাদে।।
তবুও পুনমের ফিরে না তাকানো চন্দ্রের বুকে লাগল এই রমনীটি এমন কেনো ভেবে পায়না চন্দ্র।
খাওয়া দাওয়া শেষে পারভেজ সাহেবের সাথে পুনম বেড়িয়ে যায়। চন্দ্র একা একাই যায় ভার্সিটিতে বাইক থামতেই শিহাব রিশান এসে হাজির সাথে কিছু জুনিয়র।
— ভাই ভাবী আসতেছে
জুনিয়র রাব্বীর কথায় পিছন ফিরে তাকায় চন্দ্র পুনম রিক্সা থেকে নামছে। পারভেজ সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় দিয়ে সেই রিক্সা দিয়েই চলে গেলো।
পুনম পাচঁ মিনিট দাড়াতে মিহি আসলে দুজনে একসাথেই ভিতরে ঢুকল।
পুনম আশেপাশে তাকাতে তাকাতে ভিতরে ঢুকছে আজকে চিঠি ওয়ালার কোনো খোঁজ নেই।
— কি হলো পরপর দুইদিন লোকটা চিঠি দিলো আজ কি হলো নাকি কোনো সমস্যা হয়েছে।। ভাবতে ভাবতে মিহির থেকে পিছনে পরে যায় নিজের মতো হাটতে হাটতে মিহি পাশে তাকিয়ে পুনমকে না পেয়ে পিছন ফিরে দেখে পুনম কি যেনো ভাবতে ভাবতে হাটছে।
— অ্যাই পুনু কি ভাবছিস??
— হু কিছু না চল
বলেই তারা ক্লাসে চলে যায়। পরপর তিনটা ক্লাসের পর জানায় আজ আর ক্লাস হবে না পুনম ফোন বের করে টাইম দেখল। এগারোটা বাজে এখন বাসায় যেতে মনে চাচ্ছে না।। মিহিও হলে যাবে না এখন লাইব্রেরিতে যাবে তাই পুনমও মিহির সাথে যাওয়ার পরিকল্পনা করল।
লাইব্রেরিতে নিরবতা বেশীর ভাগই টেবিল খালি সবাই মাঠে আড্ডা দিচ্ছে শুধু পড়ুয়া স্টুডেন্ট”সরাই লাইব্রেরিতে আসে। মিহি সেল্ফে নিজের প্রয়োজনীয় বই খুজে টেবিলে বসে লিখতেছে।
পুনম বই দেখতে দেখতে একটা বই টান দেয় অপর পাশ থেকেও বইটা টান দেয়। পুনম ভ্রু কুচকে ফাকা দিয়ে তাকালে কাউকে দেখতে পায় না আবার বইটা টান দেয় এবার সহজেই পেয়ে যায় প্রথম পাতা উল্টাতেই দেখে ধূসর রঙা এক ভাজ করা পেপার।
পুনম কাগজের ভাজটা খুলে,,,,,
— ডিড ইয়্যু মিস মিই জোহরা,, আমি যদি জানতাম কেউ একজন অধির আগ্রহে আমার অপেক্ষায় আছে তাহলে আমার জোহরা ভার্সিটিতে পা দেয়ার সাথে সাথে বান্দা তার জোহরার চিরকুট রেডী রাখত।
পুনম ” তার জোহরা ” নামের উপর হাত বুলায় এই লেখাটা কেমন জানি কলিজায় লাগে পুনমের। পুনমের ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক মিষ্টি হাসির রেখা। পুনম কি জানে সেই হাসি কারো হৃদয়ে তোলপাড় করার জন্য যথেষ্ট। উহু জানে জানলে এই রমনী এতো মিষ্টি করে হাসত না কেননা এই রমনী তার সামনে আসলেই তো চুপসে থাকে।
অপর সাইটের সেল্ফে হ্যালান দিয়ে হাটু ভাজ করে দাড়িয়ে পুনমকে দেখে চলেছে চন্দ্র।।
— এই পুনু
মিহির ডাকে স্তম্ভিত ফিরে পুনম এতোক্ষণ সে চিঠিতে ডুবে ছিলো।।
— হু শেষ তোর??
— হ্যা চল বাসায় যাই
— হু
বলে বই খানা রাখতে গেলে দেখল আরেকটা চিরকুট খুলে দেখে সেখানে লেখা — রাতে বারান্দায় আসবে অপেক্ষায় থাকব মাই জোহরা,,,
পুনম দুইটা চিরকুটই হাতের ভাজে নিয়ে চটকরে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে।।
মিহি সেটা খেয়াল করে বলল — কি লুকাচ্ছিস
— কিছুনা চল
বলেই আগে আগে হাটতে শুরু করে।।
অপেক্ষার প্রহর বুঝি কাটতে চায়না পুনম একটু পরপর ঘড়ির দিকে তাকায় তো বইয়ে মুখ গুজে। রাত আটটা বাজে অথচ পুনম এখনই অধৈর্য্য হয়ে যাচ্ছে এই বুঝি প্রেমে পড়ার লক্ষণ মিটিমিটি হাসে পুনম তখনই মুক্তি তার ঘরে ঢুকে পুনমকে মিটিমিটি হাসতে দেখে সন্দেহ চোখে তাকায়।।
— কিরে এরকম একা একা হাসছিস কেনো??
— হু কই নাতো
হরবরিয়ে বলেই আবার বইয়ে মুখ গুজে।। রাতের খাবার খেতে বসেছে সবাই খাওয়া শেষে চন্দ্রকে বাইরে যেতে দেখে চাদনী বেগম জিজ্ঞাসা করলেন
— এতো রাতে কোথায় যাচ্ছিস??
— ঐ বাসায় আজ ঘুমাব বাসাটা খালি পড়ে আছে তাই ভাবলাম আমি শিহাব রিশান একটা রাত থাকি,,,
— শিহাব রিশান কই
কামরুল সাহেবের কথায় চন্দ্র তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। তার তাকানোর মানে এই যে তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করছ। কামরুল সাহেবও ভ্রু নাচায় তার মানে এই যে তুমি বিশ্বাস যোগ্য কোনো কাজ করেছ।
চন্দ্র সেই দৃষ্টি পাত্তা না দিয়ে চলে যায়।।
ঠিক রাত এগারোটায় ঠাসস করে কিছু পড়ার শব্দে পুনম বারান্দায় যায়। দেখে একটা হ্যালিকপ্টার ড্রোন চাকার মাঝে একটা চিঠি আটকানো।
পুনম ফ্লোরে বসে রেলিং এ হ্যালান দিয়ে চিরকুট খুলে
— অপেক্ষা করিয়েছি বুঝি মাই জোহরা,, আই অ্যাপোলোজাইস,, তবে তোমার অপেক্ষা আমার মনে শীতলতা সৃষ্টি করেছে,,
পুনম হাসে দৌড়ে ঘর থেকে পেন পেপার আনে লিখতে শুরু করে — আপনি কে?? আপনার নাম কি?? কিছুই তো জানা হলো না,,,
চিঠিটা হেলিকপ্টারে চাকায় গুজে দিতে সেটা সাথে সাথে উড়তে শুরু করে।। মিনিট খানিক পরে উত্তর আসে — আমি মানুষ,,, তিমিরে ঢাকা ধরনীকে প্রজ্বলিত করার একমাত্র অধিশ্বর যে ঐ সুদূর অম্বরে বিরাজমান।
পুনম ভ্রু কুচকে একবার আকাশে তো একবার চিঠির দিকে তাকায়। অপর পাশে ড্রোনের মাধ্যমে পুনমকে দেখতে থাকা চন্দ্র হাসে মনে মনে। তার বোকারানী কিছুই বুঝে নাই।
পুনম এবার লিখে — এটা আবার কেমন নাম কিছুই বুঝিনি,,,,
এবার উত্তর আসে — তো কি নামে ডাকবেন আপনিই ঠিক করেন মাই জোহরা,,,
পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ২৯
চিঠিটা হাতে নিয়ে পুনম কিছুক্ষণ চিন্তা করে পরোক্ষনেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে,, লিখতে শুরু করে — আপনি তো আমায় জোহরা ডাকেন,, তো আমি আপনাকে আলী ডাকি শের”এ আলী,,,,
কাগজটা আটকে দিতেই তা উড়ে চলে গেলো। আবার মিনিট দুইয়ের মধ্যে উত্তর আসল
— অফকোর্স মাই জোহরা,,,,,,,,